রচনা : বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপন / পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপন / বৈশাখী উৎসব

ভূমিকা : পহেলা বৈশাখ বাংলা বর্ষের প্রথম মাসের প্রথম দিন। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বাহক ‘পহেলা বৈশাখ’ এক অসাম্প্রদায়িক উৎসবের দিন। অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় আনন্দঘন পরিবেশে উদ্‌যাপিত হয় নববর্ষের প্রথম দিন।

বাংলা সনের সূচনা : কৃষিকাজের সুবিধার্থেই মোগল সম্রাজ আকবর ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০/১১ মার্চ বাংলা সন প্রবর্তন করেন এবং তা কার্যকর হয় তার সিংহাসনে আরোহনের সময় থেকে (১৫৫৬, হিজরি ৯৬৩)। হিজরি চন্দ্রসন ও বাংলা সৌরসনকে ভিত্তি করে বাংলা সন প্রবর্তিত হয়। নতুন সনটি প্রথমে ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত ছিল, পরে তা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত হয়।

পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপন : নতুন বছরের উৎসবের সাথে বাঙালি জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। হাজার বছরের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় এসময় বাঙালি হারিয়ে যায় বাঁধভাঙা উল্লাসে। সর্বজনীন এবং স্থানীয় এ দু’ধরনের অনুষ্ঠান সমারোহে ফুঁটে উঠে বাঙালির লোক-সংস্কৃতির চিরাচরিত ধারা। এর মধ্যে কয়েকটি -বৈশাখী মেলা, হালখাতা, গম্ভীরা, বলীখেলা, লাঠিখেলা বা কাঠি নাচ, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, গরুর দৌড়, হা-ডু-ডু খেলা। ঢাকা শহরে পহেলা বৈশাখের মূল অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের গানের মাধ্যমে নতুন বছরের সূর্যকে আহ্বান। পহেলা বৈশাখে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে ছায়ানটের শিল্পীরা রমনা বটমূলে সম্মিলিত কণ্ঠে গান গেয়ে নতুন বছরকে স্বাগতম জানান। ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানটের এ বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা।

মঙ্গল শোভাযাত্রা : ঢাকার বৈশাখী উৎসবের আরেকটি আবশ্যিক অঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা। বাংলাদেশের জনগণের লোকজ ঐতিহ্যের প্রতীক মঙ্গল শোভাযাত্রা। ১৯৮৫ সালে যশোরে ‘চারুপীঠ’ নামের একটি সংগঠন প্রথমবারের মতো বর্ষবরণ করতে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করে। সেই শোভাযাত্রার পর ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে আয়োজন করা হয় প্রথম আনন্দ শোভাযাত্রার। ১৯৯৫ সালের পর থেকে এ আনন্দ শোভাযাত্রাই ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। ৩০ নভেম্বর ২০১৬ জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (UNESCO)-এর নির্বস্তুক বা অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পায় এ বর্ণিল উৎসব।

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বৈশাখী উৎসব : বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের (রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি) তিনটি প্রধান ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর (ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমা) সবচেয়ে বড় উৎসব ‘বৈসাবি’। এ উৎসবটি ত্রিপুরাদের কাছে বৈসুক, বৈসু বা বাইসু, মারমাদের কাছে সাংগ্রাই ও চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের কাছে বিজু নামে পরিচিত। প্রতিবছর বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দুই দিন এবং বৈশাখের প্রথম দিন এ উৎসব পালন করা হয়।

দেশে দেশে পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপন : শুদু বাংলাদেশ আর ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নয়, ত্রিপুরাতেও সাড়ম্বরে উদ্‌যাপিত হয় পহেলা বৈশাখ। ‘চিত্রাই’ নামে প্রায় একই উৎসব পালন করে তামিলরা। যা পুরোটাই মন্দিরভিত্তিক উৎসব। পাঞ্জাবি শিখরা অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে বৈশাখী উৎসব পালন করে। মধ্য এপ্রিলে বার্মাতে পালিত হয় ‘থিংগ্যান’ নামে বৈশাখী উৎসব। পর্যটন দেশ থাইল্যান্ডেও পালিত হয় পহেলা বৈশাখ। ১৪ ও ১৫ এপ্রিল নিজস্ব রীতিতে ‘সংক্রান’ নামে তারা এ উৎসব পালন করে।

করোনায় বৈশাখী উৎসব : বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরোসের প্রাদুর্ভাব ২০২০ সাল থেকেই বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল দেশের মানুষের জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করেছে বা করছে। ২০২০ সালের পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপনও তাই স্বল্প পরিসরে করতে হয়েছিল। ১৯৭১ সালের পর থেকে কখনও বন্ধ না হওয়া ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান বা টানা ৩০ বছর ধরে হওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রারও ছেদ পড়ে এ করোনার কারণে। চৈত্রের রুদ্র দিনের পরিসমাপ্তি শেষে বাংলার ঘরে ঘরে নতুন বছরকে স্বাগতম জানাবে সব বয়সের মানুষ। নব আলোর কিরণশিখায় দূর হবে করোনা, নবরূপে সাজিয়ে যাবে প্রত্যেক বাঙালির হৃদকোণ। নব আলোর শিখায় প্রজ্বলিত হয়ে শুরু হবে আগামী দিনের পথচলা- এটাই সবার প্রত্যাশা।

উপসংহার : লোকজের সাথে নাগরিক জীবনের সেতুবন্ধন পহেলা বৈশাখ। পহেলা বৈশাখের ঐতিহ্য বহু প্রাচীন। ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে বক্ষে ধারণ করে নতুন বর্ষকে বরণ করতে উদগ্রীব সারা বিশ্বের বাঙালি প্রাণ।


আরো দেখুন :
দুই বন্ধুর মধ্যে পহেলা বৈশাখ নিয়ে একটি সংলাপ
অনুচ্ছেদ : বাংলা নববর্ষ
অনুচ্ছেদ : বৈশাখী মেলা
ঢাকার পহেলা বৈশাখের অভিজ্ঞতা
নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে বন্ধুকে পত্র লেখো
প্রতিবেদন : বিদ্যালয়ে বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপন উপলক্ষ্যে
ভাষণ : বাংলা নববর্ষ বরণ
নববর্ষ উদ্‌যাপনের আয়োজন সম্পর্কে জানিয়ে ভাইকে পত্র লেখো
সাধারণ জ্ঞান : মুহম্মদ এনামুল হক [ বাংলা নববর্ষ ]
অনুচ্ছেদ : মঙ্গল শোভাযাত্রা
বিদ্যালয়ে নববর্ষ উদ্‌যাপন উপলক্ষে একটি আমন্ত্রণপত্র রচনা
‘বৈশাখী মেলা’ শিরোনামে দিনলিপি
বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপন উপলক্ষে দুই বন্ধুর মধ্যে সংলাপ
Application for celebrating Pohela Boishakh
Paragraph : Pahela Baishakh
Report on Boishakhi Mela
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post