ভাষণ : বাংলা নববর্ষ বরণ

বাংলা নববর্ষ বরণ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে একজন বক্তা হিসেবে তোমাকে ভাষণ দিতে হবে। ভাষণটি তৈরি কর।

অথবা, বাংলা নববর্ষ’ উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভার প্রধান বক্তার ভাষণ তৈরি কর।

অথবা, বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের জন্য প্রধান বক্তার একটি ভাষণ রচনা কর।

অথবা, বাংলা নববর্ষ বরণ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে একজন বক্তা হিসেবে একটি ভাষণ রচনা কর।


বাংলা নববর্ষ বরণ উপলক্ষে ভাষণ

অনুষ্ঠানের শ্রদ্ধেয় সভাপতি, সম্মানিত প্রধান অতিথি, অতিথিবৃন্দ উপস্থিত সুধীবৃন্দ সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা। পৃথিবীর সর্বত্র ‘নববর্ষ’ একটা Tradition বা ঐতিহ্য। এটা আবার এমন একটা ‘ঐতিহ্য’ যে, যার বয়সের কোনো গাছপাথর নেই। অর্থাৎ অতি পুরাতন। গোড়ার কোনো সুনির্দিষ্ট দিন, তারিখ বা বছরের সাথে এর কোনো যোগাযোগ ছিল বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। অথচ বছরের প্রথম দিনটি ‘নববর্ষ’ নামে পরিচিত হয়ে আসছে। এর মানে এই নয় যে, দিনটিই নতুন বছর; বরং এর মানে হচ্ছে নতুন বছরের আগমন উপলক্ষে অনুষ্ঠিতব্য উৎসবের প্রথম দিন। আসলে নববর্ষ একটা নির্দিষ্ট উৎসবের দিন।

সুধীমণ্ডলী,
পৃথিবীর সব নতুন বছর একই সময়ে আরম্ভ হয় না। এ দেশেই দেখা যায় ইংরেজদের অব্দ অর্থাৎ খ্রিস্টাব্দের নববর্ষ ১ জানুয়ারি, তখন বাংলা কী মাস থাকে? নিশ্চয় ১ বৈশাখ নয়। তেমনি হিজরি সনের ১ মহররম নিশ্চয়ই ১ বৈশাখে অনুষ্ঠিত হয় না। এতদসত্ত্বেও নববর্ষের নামের সাথে কতকগুলো ব্যক্তিগত, আর কতকগুলো সমষ্টিগত অনুষ্ঠান চিরকাল অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে। এগুলোর কোনো কোনোটি ধর্মের রঙে রঙিন। কোনো কোনোটি মর্মের রঙে রঙিন। আবার কোনো কোনোটি ধর্ম ও মর্ম উভয় রঙে রঙিন। নববর্ষের অনুষ্ঠানগুলো কালাতীত। পৃথিবীতে পরিচিত বছরগুলোর আগে থেকেই এ অনুষ্ঠানগুলো প্রতিপালিত হতো এবং বছর জানা শুরু হয়েছে এমন কতকগুলো অজ্ঞাতকুলশীল অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করেই।

প্রতিটি নববর্ষে আমরা অতীত বছরের তিরোধান এবং আগত বছরের আবির্ভাবের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে যাই। যে বছরটি প্রকৃতির রঙ্গমঞ্চ থেকে কালের আবর্তনে বিদায় নিল, একদিকে তার সুখ-দুঃখের বহু স্মৃতিমাখা চিত্র বিলীয়মান এবং অন্যদিকে যে বছরটি প্রকৃতির রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হলো তাকে নিয়ে ভাবী, অথচ অনিশ্চিত সম্ভাবনা সুনিশ্চিতরূপে বিদ্যমান। প্রকৃতির রাজ্যে এক ঋতুর বিদায় ও অন্য ঋতুর আগমনে যে নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে, তা প্রকৃতির অঙ্গে অঙ্গে ফুটে ওঠে। আর তারা নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তা প্রকাশ করে থাকে। এ অনুষ্ঠানগুলোর ঢং আর রং সর্বত্র এক নয়।

প্রিয় এলাকাবাসী,
বাংলা নববর্ষে’র রূপ ও তার আচরিত অনুষ্ঠানগুলোতেই ধরা পড়ে জাতীয় উৎসবের রূপ। ‘পহেলা বৈশাখ’ বাঙালির স্বতঃস্ফূর্ত চিত্তচাঞ্চল্যের বহুমুখী অভিব্যক্তিই বড়-ছোট নানা অনুষ্ঠানে রূপ গ্রহণ করে থাকে। তাই পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষকে বুঝতে হলে এই দিনের অনুষ্ঠানগুলোর একটি মূল্যায়ন থাকা দরকার।

পহেলা বৈশাখে বাংলার জনসমষ্টি অতীতের সুখ-দুঃখ ভুলে গিয়ে নতুনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ওঠে। তারা জানে এ নতুন অনিশ্চিতের সুনিশ্চিত সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ । তাই মন সাড়া দেয়, চঞ্চল হয়, নতুনকে গ্রহণ করার প্রস্তুতি নেয়। তারা সেদিন প্রাত্যহিক কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে ঘরবাড়ি ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে, আটপৌরে জামাকাপড় ছেড়ে ধোপদুরস্ত পোশাক-পরিচ্ছদ পরে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা করে পানাহারে মেতে ওঠে; জড়ো হয়ে গান গায়, হাততালি বাজায়, মুখে বাঁশি ফুঁকে, মাঠে-ঘাটে খেলায় বসে পড়ে, পুকুরে সাঁতার কাটে, ডুব দেয়, নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সবকিছু মিলিয়ে দেশটা যেন হয়ে ওঠে আনন্দমুখর।

বাংলা নববর্ষের সর্বজনীন অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে বার্ষিক মেলার আয়োজনও একটি। বাংলাদেশের নানা স্থানে পুরো বৈশাখ মাস জুড়ে বিশেষ করে পহেলা বৈশাখে ছোট-বড় নানা মেলা বসে। স্থানীয় লোকেরাই এ সমস্ত মেলার আয়োজন করে। মেলাগুলোর স্থায়িত্বকাল সাধারণত এক থেকে সাত দিন হয়ে থাকে। উত্তরবঙ্গের দিনাজপুরের নেকমর্দানে এখনও পহেলা বৈশাখে যে মেলা বসে, তা হচ্ছে উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় মেলা, এ মেলার স্থায়িত্বকাল সাত দিন। এ মেলায় হেন বস্তু নেই যা পাওয়া যায় না। জনসাধারণের আনন্দদানের উপযোগী আয়োজন এ মেলায় কম থাকে না। যেমন নাচ, গান, নাগরদোলা প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

বাংলা নববর্ষের ‘পুণ্যাহ’ আরও একটি সর্বজনীন অনুষ্ঠান । ‘পুণ্যাহ’ শব্দের মৌলিক অর্থ—“পুণ্যকাজ অনুষ্ঠানের পক্ষে জ্যোতিষ শাস্ত্রানুমোদিত প্রশস্ত দিন।” কিন্তু বাংলায় এর অর্থ দাঁড়িয়ে গেছে জমিদার কর্তৃক প্রজাদের কাছ থেকে নতুন বছরে খাজনা আদায় করার প্রারম্ভিক অনুষ্ঠানসূচক দিন। প্রজারা নতুন বছরের অথবা অতীত বছরের খাজনা আংশিক বা পুরোপুরি পরিশোধ করতেন। ঐ দিন জমিদার প্রজার সম্বন্ধের দূরত্ব কমে আসত। তারা পরস্পর মিলিত হতেন, পরস্পর সুখ-দুঃখের খবর নিতেন, এমনকি পরস্পর পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করতেন। দেশের বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে এখনও এগুলো প্রচলিত আছে।

সুধীমণ্ডলী,
হালখাতা’র অনুষ্ঠান পহেলা বৈশাখের আর একটা সর্বজনীন আচরণীয় রীতি। ‘হালখাতা’কে পুণ্যাহ অনুষ্ঠানেরই ওপিঠ বলা চলে। উভয় অনুষ্ঠানের সামাজিকতা, লৌকিকতা, সম্প্রীতি ও সৌজন্যের দিকও লক্ষণীয়। পৃথিবীব্যাপী নর-নারী নববর্ষে অনুভব করে যে, জীবনধারণের একটা কালচক্র সম্পূর্ণ আবর্তিত। তাদের উৎসবের অনুষ্ঠানগুলোতে আশা, নিরাশা, আনন্দ, উল্লাস অথবা ধর্ম প্রাধান্য লাভ করে।

আজও পৃথিবীতে ঋতুর পরিবর্তন ঘটে, আজও মানুষের দেহ ও মনে প্রকৃতির এ পালাবদলের ছোঁয়া লাগে। আজও তাই মানুষ ভিন্ন ভিন্ন সময় বিশ্বময় ‘নববর্ষ’ উদ্যাপন করে। যেমনটি আমরা করছি এবং আগামী বছরকে সম্ভাবনাময় বলে সাদরে বরণ করছি। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।

খোদা হাফেজ।


আরো দেখুন :
দুই বন্ধুর মধ্যে পহেলা বৈশাখ নিয়ে একটি সংলাপ
রচনা : নববর্ষ / পহেলা বৈশাখ
অনুচ্ছেদ : বাংলা নববর্ষ
রচনা : বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপন / পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপন / বৈশাখী উৎসব
অনুচ্ছেদ : বৈশাখী মেলা
Composition : Pohela Boishakh
ঢাকার পহেলা বৈশাখের অভিজ্ঞতা
নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে বন্ধুকে পত্র লেখো
প্রতিবেদন : বিদ্যালয়ে বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপন উপলক্ষ্যে
নববর্ষ উদ্‌যাপনের আয়োজন সম্পর্কে জানিয়ে ভাইকে পত্র লেখো
সাধারণ জ্ঞান : মুহম্মদ এনামুল হক [ বাংলা নববর্ষ ]
অনুচ্ছেদ : মঙ্গল শোভাযাত্রা
বিদ্যালয়ে নববর্ষ উদ্‌যাপন উপলক্ষে একটি আমন্ত্রণপত্র রচনা
‘বৈশাখী মেলা’ শিরোনামে দিনলিপি
বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপন উপলক্ষে দুই বন্ধুর মধ্যে সংলাপ
Application for celebrating Pohela Boishakh
Paragraph : Pahela Baishakh
Report on Boishakhi Mela
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post