রচনা : দেশভ্রমণ

↬ দেশভ্রমণের আনন্দ ও উপকারিতা

↬ ছাত্রজীবনে দেশভ্রমণের গুরুত্ব

↬ দেশভ্রমণের শিক্ষা ও আনন্দ


ভূমিকা :
‘বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি।
দেশে দেশে কত না নগর রাজধানী-
মানুষের কত কীর্তি, কত নদী গিরি সিন্ধু মরু,
কত না অজানা জীব, কত না অপরিচিত তরু
রয়ে গেল অগোচরে।’
                                 -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
দেশভ্রমণ মানুষের জীবনে আনে বৃহতের আহ্বান। আনে অজানা সৌন্দর্যের সংবাদ। অচেনার সান্নিধ্যে তার মনে লাগে বিস্ময়ের শিহরণ। ভুলে যায় প্রতিদিনের তুচ্ছতা। প্রয়োজনের পৃথিবী তাকে ধরে রাখতে পারে না। দেশভ্রমণের নেশা তাকে টেনে নিয়ে যায় প্রকৃতির অবারিত মুক্তাঙ্গনে। অজানাকে জানার জন্যে, অদেখাকে দেখার জন্যে; আমাদের পরিচিত গণ্ডির বাইরে অপরিচিত জগৎকে দেখার জন্যে- অন্তরের আকুল আগ্রহে আনন্দ অনুভব করি। ইবনে বতুতা তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে লিখেছেন- 
‘Travelling makes one know the mystery of Lord’s creation. Travelling gets us self-confident.’

ভ্রমণের আনন্দ : ভ্রমণের আনন্দের আকর্ষণই ভাইকিংদের ভেলায় ভাসিয়ে শ্বেত ভালুকের দেশ নোভাস্কাশিয়ায় নিয়ে গেছে, মার্কো-পোলো ভাসতে ভাসতে এশিয়ার বিস্তীর্ণ স্তূপ পেরিয়ে চীনে, ইবনে বতুতাকে ঘরছাড়া করেছে এশিয়া-আফ্রিকার দেশ থেকে দেশান্তরে। তাঁদের মনের গতির নেশায় বেজে উঠেছিল বিপুল সুদূরের ব্যাকুল বাঁশরীর মধুর ধ্বনি এবং সেই ধ্বনির কুহক হাতছানিতে দিগ্-বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে মায়াময় গৃহকোণ ত্যাগ করে অজানা পথে যাত্রা করেছিলেন। তাঁদের এই দুঃসাহসিক অভিযান মানবকুলকে ভ্রমণের নেশায় অনাদিকাল ধরে উদ্দীপ্ত করে যাবে।

বৈচিত্র্যের নেশা : দিনের পর দিন একই পরিবেশে জীবন-যাপন করে আমাদের মন বিষিয়ে ওঠে। আমরা তখন একটু বৈচিত্র্যের আস্বাদ পেতে চাই। দেশভ্রমণ সেই বৈচিত্র্য এনে দিয়ে আমাদের দেয় অপরিসীম আনন্দ। দেশান্তরিত পথিক যখন নতুন দেশের কোনো নতুন শহরে পদার্পণ করে তখন তাঁর কাচে মনে হয়- ‘আহা! কি সুন্দর।’ সুন্দর মনে যে সর্বদাই সৌন্দর্যমণ্ডিত হবে তা নয়, নতুনত্বও হতে পারে একটা বিশেষ সৌন্দর্য, আনন্দ দেওয়ার একটা বিরাট কারণ। মার্কিন পরিব্রাজক যখন ইতালির কোনো ঘিঞ্জি শহরে পদার্পণ করে তখন তিনি এই নতুনত্বের আনন্দেই হন উদ্বেলিত।

যেসব ব্যস্ত মানুষ সমুদ্রতীরে কোনো অচেনা রেস্তোরাঁয় ঢুকে পানীয়ের ফরমাশ দেন, তখন তাঁর মনে যে দৃষ্টির উদয় হয় সম্ভবত সেটা সাগরতলার কোনো রূপকথার রেস্তোরাঁ যেখানে পানীয় পরিবেশন করছে মৎস্যকন্যা। মরুভূমির শুষ্ক-শূন্যতা থেকে যখন কোনো আরব স্নিগ্ধ-শ্যামলিমার দেশ বাংলাদেশে পদার্পণ করেন, তখন তিনি অবাক বিস্ময়ে অবলোকন করেন প্রকৃতির এই পূর্ণতা-এই বিস্ময়ই তাঁর আনন্দ। আবার তপ্ত মরুতে চোখ-ধাঁধানো মরীচিকা, বহু যোজন পরে আকস্মাৎ এক ঝরনাবিধৌত মরুদ্যান যে আনন্দ বয়ে আনতে পারে, ভ্রমণ-নেশায় বুঁদ হয়ে যাওয়া পথিকই তাঁর রস আহরণ করতে পারেন। তাই মনকে উৎসাহিত করার জন্যে দেশে দেশে চিত্তাকর্ষক পর্যটনশিল্প গড়ে তোলা হচ্ছে।

শিক্ষার অঙ্গ হিসেবে দেশভ্রমণ বা দেশভ্রমণের উপকারিতা : দেশভ্রমণ শিক্ষার একটি প্রধান অঙ্গ। নানা দেশ ও সেখানকার মানুষের সঙ্গে পরিচয়ের মধ্য দিয়ে আমরা নানাবিধ অভিজ্ঞতা লাভ করি এবং সেই সঙ্গে নতুন নতুন জ্ঞান আহরণ করি। পৃথিবীর কত যে বিচিত্র স্থান আছে, তার বৈচিত্র্যের কথা বই পড়ে সবটুকু জানতে পারি না, চাক্ষুষ অভিজ্ঞতার দ্বারা তা সম্পূর্ণ নতুনভাবে আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। কত বিচিত্র দেশ, বিচিত্র তার অধিবাসী- আরো বিচিত্র তাদের সাংস্কৃতিক জীবনধারা ও সামাজিক রীতিনীতি। দিকে দিকে কত অরণ্য-সমুদ্র-মরু-পর্বত। নিসর্গ প্রকৃতির কত অফুরান বৈভব, কত পশু-পাখি, জীবজন্তু। আমরা দেশভ্রমণের দ্বারা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সেগুলোকে পূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে পারি। ফলে দেশভ্রমণ শিক্ষার এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পুঁথির ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ। অধীত-বিদ্যা তাই আমাদের মনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে না। মহৎ উপলব্ধিতে সেই শিক্ষা পূর্ণ ও সার্থক হয় না। রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন,
‘প্রত্যক্ষ বস্তুর সহিত সংস্রব ব্যতীত জ্ঞানই বলো, চরিত্রই বলো, নির্জীব ও নিষ্ফল হতে থাকে।’

তাই পুঁথির বিদ্যার সঙ্গে চাই বাস্তবের রাখীবন্ধন। আমাদের পঠিত ইতিহাস-ভূগোলই দেশভ্রমণের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার জাদুস্পর্শে হয়ে ওঠে প্রাণময়। মানুষে মানুষে তখন অনুভত হয় প্রাণের মিতালি। ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় ইতিহাসের কত অতীত কীর্তি, কত কাহিনী আমাদের কাছে জীবন্ত হয়ে ওঠে। আমরা যেন সেই ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়েও শুনতে পাই তার শাশ্বত বাণী। তাই দেশভ্রমণ না করলে শিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। শিক্ষার সঙ্গে তার নিক-সম্পর্ক। পাশ্চাত্য দেশে শিক্ষার সঙ্গে দেশভ্রমণের আত্মার সম্পর্ক। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশে দেশভ্রমণকে শিক্ষার একটি অঙ্গরূপে প্রতিভাত করা হয় না। গ্রন্থপাঠের মাধ্যমে যে শিক্ষা গ্রহণ করা হয় তার মধ্যে একটি সীমাবদ্ধতা আছে; কিন্তু গ্রন্থের বাইরে জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার দ্বারা যে শিক্ষালাভ হয়, তা সীমাবদ্ধ নয়। এই শিক্ষার জন্যেই দেশভ্রমণের আবশ্যকতা অপরিহার্য।

উন্নত দেশের ভ্রমণপ্রিয় মানুষ : একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, উন্নত বিশ্বের মানুষেরা অধিক ভ্রমণপ্রিয়। সাধারণত তাঁরা শীতকালে দশ বেঁধে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে রেরিয়ে পড়ে নিরক্ষরেখার অবস্থিত চিরসবুজের দ্বীপ জ্যামাইকা, বারমুদায়, হাওয়াই দ্বীপে কিংবা আল্পসের বরফ-ঢাকা ঢালে অবস্থিত সুইজারল্যান্ডে। এসব দেশের ছাত্ররাও আনন্দ থেকে পিছিয়ে নেই। তাঁরা শিক্ষাজীবনের ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন ছুটিতে বেরিয়ে পড়ে দেশভ্রমণের উদ্দেশ্যে। এ ভ্রমণগুলো তাদের মনকে শিক্ষা, অভিজ্ঞতা এবং সর্বোপরি আনন্দ-রসে সিঞ্চিত করে। ঐ সব দেশের বয়োজ্যেষ্ঠ ও ব্যবসায়ীরাও কিছু সময়ের জন্যে ভ্রমণের আশ্রয় নিয়ে আনন্দে উদ্বেলিত হয়।

দেশভ্রমণ – অতীত ও বর্তমান ‍যুগে : যুগপ্রাচীন কাল থেকেই মানুষের মনে ভ্রমণের নেশা। সুদূর অতীতে দেশভ্রমণ ছিল কষ্টসাধ্য ব্যাপার। সেদিন কোনো সুলভ যানবাহনের ব্যবস্থা ছিল না। যোগাযোগের ব্যবস্থাও ছিল অনুন্নত। অনেক দেশ তখনো ছিল অনাবিষ্কৃত। তবু সেদিনের পথের অনিশ্চয়তা, অশেষ দুর্গতি, জীবন-সংশয়ের আশঙ্কা, কিছুই মানুষকে গৃহবন্দি করে রাখতে পারে নি। সে বেরিয়ে পড়েছে দুর্গম গিরি, কান্তার মরু লঙ্ঘন করার নেশায়। আধুনিক যুগে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিস্ময়কর অগ্রগতি হয়েছে। উন্নতি হয়েছে পথ ও পরিবহন-ব্যবস্থার। রেল, মোটর, জাহাজ, এরোপ্লেন ইত্যাদির প্রচলনে পথের বাধা-বিপত্তি দূর হয়েছে। তৈরি হয়েছে পর্যটন কর্পোরেশন, ট্যুরিস্ট ব্যুরো, ট্রাভেল এজিন্সির মতো বিভিন্ন সংস্থা। এরা ভ্রমণ-বিলাসীদের সামনে তুলে ধরে বিভিন্ন দ্রষ্টব্য স্থানের বিবরণ, পথের বর্ণনা, যাতায়াত, থাকার সুবিধা, মানচিত্র ইত্যাদির বিচিত্র সংবাদ। ফলে দিনে দিনে ভ্রমণপিপাসুদের সংখ্যা বেড়েছে।

দেশভ্রমণ ও বাংলাদেশ : বাংলাদেশ একটি সুপ্রাচীন দেশ। প্রাচীনত্বের গরিমায় বাংলা সারা বিশ্বে পরিচিত। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজরাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এ-দেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি দারুণভাবে উন্নতি লাভ করেছে। দেশের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ও ইতিহাস বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করে দেশের জন্যে আর্থিক সমৃদ্ধি আনয়ন করেছে। বর্তমানে পর্যটনকে শিল্প হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কারণ বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশের পর্যটন স্থান : বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণ-পূর্বে বঙ্গোপসাগরের বেলাভূমি প্রমোদভ্রমণ কেন্দ্র হিসেবে প্রকৃতি নিজের হাতে গড়ে তুলেছে পৃথিবীর এক রহস্যময় সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার- যা পর্যটকদের কাছে খুবই লোভনীয় একটি স্থান হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে। অপরদিকে খুলনা জেলার সুন্দরবনও একইভাবে পর্যটকদের আকর্ষণ করে। এছাড়া বাংলাদেশের প্রান্তবর্তী জনপদ রাঙামাটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। সিলেটের চা বাগান, তামাবিল, জাফলং, পটুয়াখালীর কুয়াকাটা, চট্টগ্রামে ফয়েস লেক, যমুনা সেতু ইত্যাদি পর্যটনের স্থান হিসেবে বেশ সমাদৃত।

বাংলাদেশের পুরাকীর্তি : বৌদ্ধযুগে রাজশাহী জেলার পাহাড়পুরে বৌদ্ধ সংস্কৃতির ধ্বংসাবশেষ সত্যিই দেখার মতো এবং এর থেকে অনেক কিছু জানার আছে। পাহাড়পুরের বৌদ্ধ-আশ্রম, আশ্রমের কিছু দূরে সত্যপীরের-ভিটা, প্লেটের উপর তাম্রলিপি ও ব্রোঞ্জ-নির্মিত মূর্তি- এসব পুরাকীর্তির নিদর্শন এখানে রয়েছে। এরকম আরো কয়েকটি স্থানের নাম হল- বগুড়া জেলার ইতিহাস-প্রসিদ্ধ করতোয়া নদীর তীরে এবং ঢাকা-দিনাজপুর বিশ্বরোডের পাশে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী মহাস্থানগড়। প্রাচীন বৌদ্ধযুগের বহু ধ্বংসাবশেষ এখানে বিদ্যমান। এছাড়া নওগাঁ, জয়পুরহাট, কুমিল্লা-ময়নামতিতেও রয়েছে প্রভু-বুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভের ধ্বংসাবশেষ। এসব দর্শনীয় স্থান পর্যটকদের আকর্ষণ করে। ঢাকার আহসান মঞ্জিল, ঢাকেশ্বরী মন্দির, কার্জন হল, লালবাগের কেল্লা, হোসনী-দালাল, সোনার গাঁ লোকশিল্প-যাদুঘর; দিনাজপুরের কান্তজীর-মন্দির, নাটোরের দিঘাপাতিয়া-রাজবাড়ি, বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ, নোয়াখালীর বজরা মসজিদ- এ সবই সভ্যতার নিদর্শন এবং ইতিহাস-প্রসিদ্ধস্থান হিসেবে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সভ্যতায় অনেককিছু ধারণ করে আছে।

উপসংহার : দেশভ্রমণ পৃথিবীর সকল দেশের সকল শ্রেণীর লোকের মধ্যেই দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। জীবনের জটিলতা যত বাড়বে, বিচিত্র কর্তব্য ও দায়িত্বের বোঝা আমাদের ব্যস্ত ও উদ্বিগ্ন করে তুলবে, একটানা ও একঘেয়ে জীবনের গ্লানির আবর্তের মধ্যে পড়ে আমাদের নিঃশ্বাস যত বদ্ধ হয়ে আসবে, ততই ভ্রমণ সম্পর্কে আমরা উৎসাহী হব; দেশভ্রমণের উপযোগিতা ততই বেড়ে চলবে।


[ একই রচনা আরেকটি বই থেকে সংগ্রহ করে দেয়া হলো ]


ভূমিকা : মানুষ চিরকাল একভাবে জীবন-যাপনে সন্তুষ্ট থাকতে পারে না। তার নিত্যনতুন কৌতূহলবৃত্তি চরিতার্থ করবার আকাঙ্ক্ষা থাকা স্বাভাবিক। কারণ, বৈচিত্র্যের মধ্যেই জীবনের আনন্দ। এই বৈচিত্র্যময় বিশ্বের মধ্যে যে কত বিচিত্র জায়গা, বিভিন্ন মানুষ ও নানা রকম দৃশ্যাবলি আছে তার অন্ত নেই। আমরা সাধারণ মানুষ জগৎ সম্বন্ধে কতটুকুই-বা জানি। বিরাট অজানা রাজ্যের কিছুটা না জানলে জীবনের সার্থকতা থাকে না। আমাদের পরিচিত আবেষ্টনীর বাইরে গেলে এই একই পৃথিবীর মধ্যে এবং একই মানবসমাজের মধ্যে কতই-না পার্থক্য। প্যারিস অথবা নিউইয়র্কে গেলে দেখা যায় বর্তমান সভ্যতার কী বিপুল সমারোহ, বিলাসব্যসন, ব্যস্ততা ও কোলাহলের কী অন্তহীন আয়োজন।

ভ্রমণে অর্জিত হয় বাস্তব অভিজ্ঞতা : দেশ-বিদেশ ভ্রমণে যে-শিক্ষা হয় সে-শিক্ষা বই পড়ে আয়ত্ত করা যায় না। অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি অপেক্ষা একজন ভ্রমণকারী জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে অনেক বেশি জানেন। করণ পুঁথি-পুস্তকে যা আমরা পড়ি তা প্রাণহীন অবস্থায় থেকে যায়। কিন্তু যখন আমরা ভ্রমণে নানা দেশ ও জাতির সাক্ষাৎ পরিচয় পাই, তখন বইয়ের জগৎ আমাদের সামনে প্রাণরসের সজীবিত হয়ে ওঠে। যেসব দেশ ও মানুষ সম্বন্ধে বইতে পড়ে মনে রাখতে প্রাণান্ত হতে হয়, তাদের সাথে একবার চাক্ষুষ পরিচয় হলে মনের মধ্যে চিরকাল তা জাগরুক হয়ে থাকবে। ইতিহাসে যাদের কীর্তি মনকে নাড়া দিতে পারেনি, তাঁদের লীলাস্থানগুলো একবার স্বচক্ষে দেখলে তা আমাদের উদ্দীপিত ও অনুপ্রাণিত করে তোলে। যেসব প্রাচীন জায়গায় বহু স্মৃতির অন্ধকার হতে চোখের সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে।

ভ্রমণ থেকে শিক্ষা : আবার প্রশান্ত মহাসাগরের কোনো অজ্ঞাত দ্বীপে অথবা কোনো দুর্গত উপত্যকায় গেলে দেখা যায় ঐসব জাযগায় মানুষ আধুনিক সভ্যতার সর্বপ্রকার স্পর্শ থেকে আত্মরক্ষা করে নিশ্চিন্ত আরামে দিন কাটাচ্ছে।

ভ্রমণের উপকারিতা : ভ্রমণ মানুষের মনকে সতেজ ও প্রফুল্ল করে বলে আমাদের ছন্দহীন বাঁধাধরা জীবন ভ্রমণের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। বিচিত্র নরনারী, বিভিন্ন দেশ এবং জনপদ দেখে মানুষের হৃদয়ের উদারতা ও প্রশান্তি বেড়ে যায়। যারা চিরকাল একই জায়গায় কাটিয়েছে তাদের দৃষ্টি সংকুচিত ও মন সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। অভিজ্ঞতার অভাবে মানুষ জীবনের অনেক জটিল সমস্যার সমাধান করতে অপারগ হয়। কিন্তু যারা দেশ-বিদেশ ঘুরে ব্যাপক অভিজ্ঞতা লাভ করে তারা উদার ও উন্মুক্ত মন নিয়ে জীবন ফুলে-ফলে গৌরবময় করতে সক্ষম হয়। ভ্রমণের ফলে মানুষের ভ্রান্ত মত ও বিকৃত ধারণা দূর হয়, দৃষ্টি খুলে যায়।

ভ্রমণকাহিনী পাঠ : ভ্রমণের যে আনন্দ ও উপকার তা আংশিক পাওয়া যায় ভ্রমণকাহিনীতে। ভ্রমণকাহিনীর মধ্য দিয়ে এ পৃথিবীর কত বিচিত্র রহস্য ও আনন্দ সৌন্দর্যই না আমরা জানতে পারি। মার্কোপোলের ভ্রমণবৃত্তান্ত পড়ে প্রাচীন পৃথিবীর অজ্ঞাত পরিচয় জীবন আমাদের মানসগোচর হয়। রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠি, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের দ্বীপময় ভারত, মনোজ বসুর চীন দেখে এলাম, সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে বিদেশেজলে ডাঙায়, মুহম্মদ আবদুল হাই-এর বিলেতে সাড়ে সাতশ দিন প্রভৃতি বই পড়ে আমরা দেশভ্রমণের আনন্দ অনুভব করি। অন্নদাশংকর রায়ের পথে প্রবাসে বা জাপানে পড়ে আমরা বিলেত ও ফ্রান্স তথা সমগ্র ইউরোপ ও জাপানের সংস্কৃতি ও সভ্যতার মূল মর্মবাণী সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করি। তবে দেশ-বিদেশের ভ্রমণকাহিনী পড়ে যতই জ্ঞান লাভ করা যাক না কেন প্রত্যক্ষভাবে ও বাস্তবে দেশভ্রমণ না করলে কোনো জ্ঞানই সম্পূর্ণ হয় না। তাই দেশভ্রমণের জন্য গুরুত্ব আরোপ করে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে- ‘তোমরা পৃথিবী ভ্রমণ কর’

উপসংহার : মহানবি হযরত মুহম্মদ (স.) আল্লাহর সৃষ্টির মাহাত্ম্য ও বৈচিত্র্যকে অনুধাবন করবার জন্য দেশভ্রমণ করার উপদেশ দিয়েছেন। তাঁর এ উপদেশ যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা সহজেই উপলব্ধি করা যায় যখন একজন মানুষ দেশভ্রমণে বের হয়।

12 Comments

Post a Comment
Previous Post Next Post