মার্চের দিনগুলি

রচনা : বাংলাদেশের সংবিধান

ভূমিকা : সংবিধান হচ্ছে একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দলিল। এতে সরকার গঠন, সরকারের বিভিন্ন অঙ্গসহ মৌলিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে সম্পর্ক, নাগরিকের মৌলিক অধিকার, এককথায় রাষ্ট্র পরিচালনাসংক্রান্ত নীতিমালা অন্তর্ভুক্ত থাকে। ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। নয় মাসে রচিত হয় বাংলাদেশের সংবিধান।

বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়া : স্বাধীন বাংলাদেশে প্রণীত ১৯৭২ সালের সংবিধান সমগ্র জাতির জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাস থেকেই সংবিধান রচনার কাজ শুরু হয়। ১১ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান অস্থায়ী শাসনতান্ত্রিক আদেশ জারি করেন। সে আদেশ অনুযায়ী ১৯৭০-এর নির্বাচনে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্যগণ গণপরিষদের সদস্য হন। ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ গণপরিষস আদেশ জারি করেন। তারপর ১৯ এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন আহ্বান করা হয় এবং তৎকালীন আইনমন্ত্রী কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ৩৪ সদস্যবিশিষ্ট সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। ৭১টি অধিবেশনের মাধ্যমে কমিটি শাসনতন্ত্রের খসড়াটি তৈরি করেন। ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনে খসড়া শাসনতন্ত্রটি উপস্থাপন ও ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর সংবিধান কার্যকর করা হয়।

সংবিধানের সংজ্ঞা : সাধারণত সংবিধান বলতে আমরা এমন কিছু নিয়ম নীতি, বিধি-বিধান বা অনুশাসনকে বুঝি, যা রাষ্ট্র পরিচালনার মূলসূত্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ রাজনৈতিক ব্যবস্থা এসব নিয়ম-কানুনকে অনুসরণ করেই তার কার্যপরিচালনা করে থাকে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল সংবিধানের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে, A Constitution is the way of life the state has chosen for itself.

বাংলাদেশের সংবিধানের বৈশিষ্ট্যসমূহ : সংবিধান নির্দিষ্ট কতগুলো বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। বাংলাদেশের সংবিধানের কিছু বৈশিষ্ট্য আছে তা নিচে লেখা হলো-

প্রস্তাবনা : বাংলাদেশের সংবিধান শুরু হয়েছে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’-এই শব্দগুলো দিয়ে। বাংলাদেশ সংবিধানে একটি প্রস্তাবনা রয়েছে। প্রস্তাবনায় জনগণকে সংবিধানের উৎস হিসেবে স্বীকার করা হয়েছে।

অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা দখলকারীদের শাস্তি : সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭(ক) অনুযায়ী অসাংবিধানিক পন্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলকারীদের অপরাধ রাষ্ট্রদোহিতা হিসেবে বিবেচিত হবে এবং সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত হবে।

সংবিধানের মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত বিধানাবলি : সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭(ক) অনুযায়ী সংবিধানের মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত বিধানাবলি সংশোধন অযোগ্য।

সর্বোচ্চ আইন : সংবিধানই হচ্ছে সর্বোচ্চ আইন।

গণতন্ত্র : বাংলাদেশ সংবিধানে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে।

লিখিত সংবিধান : বাংলাদেশ সংবিধান একটি লিখিত দলিল। এই সংবিধানে সরকারের প্রকৃতি ও গঠনকাঠামো, সরকারের কার্যাবলি, রাষ্ট্রীয় মূলনীতি, জনগণের মৌলিক অধিকার প্রভৃতি বিস্তারিতভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে।

দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান : বাংলাদেশের সংবিধান দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান।

রাষ্ট্রীয় মূলনীতি : ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ সংবিধানের ৮নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি চারটি। যেমন : জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা

জাতীয়তা ও নাগরিকত্ব : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ৬নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিক ‘বাংলাদেশি’ বলে পরিচিত হবেন এবং তাদের এ নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত হবে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী বাংলাদেশের জনগণ বাঙালি হিসেবে পরিচিত হবে।

এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা : বাংলাদেশের আইনসভা এক কক্ষবিশিষ্ট। এর নাম জাতীয় সংসদ।

মালিকানা নীতি : বাংলাদেশের সংবিধানের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো এখানে তিন শ্রেণির মালিকানার নীতিকে স্বীকার করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে-
(১) রাষ্ট্রীয় মালিকানা
(২) সমবায় মালিকানা
(৩) ব্যক্তিগত মালিকানা।

বিচার বিভাগের স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা : বাংলাদেশের সংবিধানের বিধান মোতাবেক বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট নামে অভিহিত হবে। আপিল বিভাগ এবং হাইকোর্ট বিভাগ নিয়ে গঠিত এই সুপ্রিম কোর্ট শাসন বিভাগ থেকে পৃথক থাকবে।

বাংলা পাঠের প্রাধান্য : বাংলাদেশ সংবিধানের ১৫৩(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাংলা ও ইংরেজি পাঠের মধ্যে বিরোধের বাংলা পাঠ প্রাধান্য পাবে। 

ন্যায়পাল : বাংলাদেশ সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদে ন্যায়পালের বিধান রয়েছে। ন্যায়পাল যে কোনো মন্ত্রণালয় ও সরকারি ক্ষেত্রে কর্মচারীর যেকোনো কার্য সম্পর্কে তদন্ত করতে পারবেন।

মৌলিক অধিকার : সংবিধানের তৃতীয় ধারায় নাগরিকদের ব্যক্তিত্ব বিকাশের কতগুলো মৌলিক অধিকার সংবিধানে লিপিবন্ধ করা হয়। যেমন- সাম্যের অধিকার, চলাফেরা, সভা-সমিতি, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা প্রভৃতি।

সংবিধানে সন্নিবেশিত মৌলিক অধিকার : বাংলাদেশ সংবিধানের তৃতীয় ভাগে ২৬ অনুচ্ছেদ থেকে ৪৪ অনুচ্ছেদ পর্যন্ত মৌলিক অধিকার সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা রয়েছে। সংবিধানে শুধু বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্যই মৌলিক অধিকার প্রণয়ন করা হয়নি, বরং বাংলাদেশে বিদেশি নাগরিকদের ব্যাপারেও গুরুত্বপূর্ণ ধারা সংযোজন করা হয়েছে। মৌলিক অধিকার মোট ১৮টি।

(ক) শুধু বাংলাদেশের নাগরিকরা ভোগ করতে পারে, এমন মৌলিক অধিকার ১২টি। যথা-

১. আইনের দৃষ্টিতে সমতা
২. ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষ বৈষম্য করা যাবে না
৩. সরকারি চাকরির সমান সুযোগ
৪. বিদেশি রাষ্ট্রের উপাধি গ্রহণ
৫. আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার
৬. সমাবেশের স্বাধীনতা
৭. চলাফেরার স্বাধীনতা
৮. সংগঠনের স্বাধীনতা
৯. বাক্-স্বাধীনতা
১০. পেশা ও বৃত্তির অধিকার
১১. সম্পত্তির অধিকার
১২. গৃহ ও যোগাযোগ রক্ষা

(খ) বাংলাদেশে বসবাসকারী নাগরিক ও বিদেশিরা ভোগ করতে পারবে, এমন মৌলিক অধিকার ৬টি যথা-

১. জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার
২. গ্রেফতার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ
৩. জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধকরণ
৪. বিচার ও দণ্ড সম্পর্কে বিধান
৫. ধর্মীয় স্বাধীনতা
৬. সাংবিধানিক প্রতিকার পাওয়ার অধিকার

বাংলাদেশের সংবিধানের সংশোধনের প্রেক্ষাপট : ১৯৭২ সালে স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান প্রণীত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত তা ১৭ বার সংশোধিত হয়েছে। এ সংশোধনীগুলোর কোনোটিতে জনগণের ইচ্ছা ও রাষ্ট্রের প্রয়োজন আবার কোনোটিকে সরকারের সুবিধা রাষ্ট্রের ইচ্ছায় বেশি প্রতিফলিত হয়েছে। সংশোধনীগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সংশোধনী নিচে তুলে ধরা হলো-

প্রথম সংশোধনী : ১৯৭৩ সালের ১৫ জুলাই প্রথম সংশোধনী আনা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন গণহত্যা এবং যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত পাকিস্তানি সৈন্যসহ অন্যান্যের বিচারের জন্য এই সংশোধনী আইন প্রণীত হয়।

অষ্টম সংশোধনী : ৯ জুন ১৯৮৮ সালে পাসকৃত অষ্টম সংশোধনী দ্বারা রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম প্রবর্তন করা হয়, আঞ্চলিক পর্যায়ে হাইকোর্টের ৬টি বেঞ্চ গঠন করা হয়। এছাড়া বানান পরিবর্তন করে 'Bengal'-এর পরিবর্তে Bangla এবং 'Dacca'-এর পরিবর্তে Dhaka করা হয়।

ত্রয়োদশ সংশোধনী : ২৮ মার্চ ১৯৯৬ সালে অনুমোদিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী দ্বারা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় অবাধ, সুষ্ঠু, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য।

পঞ্চদশ সংশোধনী : ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর বিল পাস হয়। এ বিলের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনগুলো হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল, সংরক্ষিত নারী আসন ৫০-এ উন্নীতকরণ, জাতির পিতার প্রতিকৃতি সংরক্ষণ মূলনীতি সংশোধন, সংবিধানের মৌলিক বিধান সংশোধন অযোগ্য ঘোষণা, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রাখা ইত্যাদি।

ষোড়শ সংশোধনী : ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর (ষোড়শ সংশোধন) বিল-২০১৪ পাস হয়। এর ফলে বর্তমান সংবিধানে বাহাত্তরের ৯৬ অনুচ্ছেদে পুনঃস্থাপিত হয়। এতে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা ফিরে পায় সংসদ।

সপ্তদশ সংশোধনী : ২০১৮ সালের ৮ জুলাই সপ্তদশ সংশোধনী বিল পাস হয়, ফলে সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসন আরও ২৫ বছরের জন্য সংরক্ষিত হয়।

উপসংহার : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান হলো বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার মূল লিখিত দলিল। এতে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, শাসক-শাসিতের সম্পর্ক, অধিকার প্রশ্ন ইত্যাদি বিষয়ে সাংবিধানিক ব্যাখ্যা রয়েছে। তাই বাংলাদেশের সংবিধান বাংলাদেশের নাগরিকদের কাছে পবিত্র ও অমূল্য সম্পদ।


আরো দেখুন :
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post