রচনা : পরিবারের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য

ভূমিকা : মানুষ পশু নয়। জীব হলেও অন্যান্য জীবের চেয়ে ভিন্ন। বিবেকবুদ্ধি ও কর্তব্যজ্ঞান আছে বলেই মানুষ জীবদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করেছে। দেশের প্রতি তার কর্তব্য আছে। কর্তব্য আছে সমস্ত জাতির প্রতি। তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশের মধ্যে যে মানুষ বাস করে সেই প্রতিবেশীর প্রতিও তার কর্তব্য রয়েছে। উপরন্তু যে পরিবারের মধ্যে সে বসবাস করছে, যাদের স্নেহ-মায়া ও ভালোবাসার মধ্যে সে লালিত-পালিত হয়েছে এবং হচ্ছে সেই পরিবারের প্রতিও তার কর্তব্য রয়েছে। যে মানুষের কর্তব্যজ্ঞান নেই, তার জীবন অর্থহীন।

পরিবারের বৈশিষ্ট্য ও করণীয় : সাধারণত মানুষ সংসারজীবনে বাস করতে গেলে সে একা বাস করতে পারে না। সে তার দাদা দাদি, পিতা-মাতা, ভাই-বোন, চাচা-চাচি, প্রমুখের সঙ্গে মিলে যখন বাস করে তখনই সে পরিবারভুক্ত হয়। সেই পরিবারের মধ্যে চাচা-চাচি ছাড়াও আরও অনেকে থাকে। পরিবারের সঙ্গে বসবাস করতে গেলে পরিবারের সকলের প্রতি সকলের কর্তব্য আছে। বিশেষ করে যে কোনো মানুষকে তার বাবা-মা, দাদা-দাদি, ভাই-বোন এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের প্রতি কিছু কিছু কর্তব্য পালন করতে হয়।

পরিবারের সবচেয়ে সম্মানিত এবং শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি পরিবারের বয়োজ্যষ্ঠ ব্যক্তিবর্গ। সেই হিসাবে দাদা-দাদির প্রতি অবশ্যই কর্তব্য রয়েছে। প্রথমত তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি ও সম্মান প্রদর্শন অবশ্যই কর্তব্য। তাঁদের উপদেশ-নির্দেশ সবসময় পালন করা উচিত। মনে রাখতে হবে, তারা তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে যে কথা বলেন সেগুলো তারা জীবনের কল্যাণের জন্যই বলবেন। কারণ তারা তাদের নাতি-নাতনিদের জন্য কখনো খারাপ চাইবেন না। তাদের সঙ্গ দিতে হবে। কিছু সময় তাদের সঙ্গে কাটানো অবশ্য কর্তব্য। বয়সের কারণে কখনো কখনো তারা শিশুদের মতো অবুঝ হয়ে যান। সেজন্য তাদের ওপর রাগ না করে তাদের ভালোবাসা দিয়ে মানিয়ে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, তাদের দোয়া আমাদের একান্ত কাম্য।

একটি পরিবারে দাদা-দাদির পরেই সাংসারিক বা পারিবারিক জীবনে মানুষকে অনেক রকম দায়-দায়িত্ব পালন করতে হয়। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাতা-পিতার প্রতি কর্তব্য। এই কর্তব্যের সঙ্গে অন্য কোনো কর্তব্যের তুলনা হয় না। মাতাপিতার প্রতি অবহেলা করলে মানুষের মনুষ্যত্ববোধ থাকে না। সে তখন মানুষ নামের অযোগ্য হয়ে পড়ে। সমাজের মানুষ তাকে সুনজরে দেখে না। তারা তাকে ঘৃণার চোখে দেখে। সে পশুর চেয়েও অধম বলে বিবেচিত হয়। তাই পরিবারের মধ্যে মাতা-পিতার স্থান। এই মানবজীবনে মাতা-পিতার প্রতি অবশ্যই কর্তব্য রয়েছে। মাতা-পিতার প্রতি কর্তব্য সচেতনভাবের সকল কিছুর উপরে আলাদাভাবে স্থান দিতে হয়। মনে রাখতে হবে মাতা-পিতার প্রতি সন্তানের জীবনের প্রভাব সবচেয়ে ব্যাপক। সব সময়ই মা-বাবার মনে সন্তানের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা থাকে। তারা সব সময়ই সন্তানের কল্যাণ কামনা করেন।

মাতা-পিতা সন্তানের কখনো অমঙ্গল কামনা করেন না। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে মাতা-পিতা নানাভাবে সন্তানকে বড় হতে সাহায্য করেন। পিতার চেয়ে সন্তানের জন্য মা বেশি কষ্ট করেন বলেই ইসলামধর্মে বলা হয়ে থাকে, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেস্ত, আর হিন্দুধর্মে পিতাকে সম্মান দিতে গিয়ে বলা হয়েছে- 'পিতা ধর্ম' পিতা স্বর্গ, পিতা পরম তপস্য। সুতরাং সব ধর্মেই পিতা-মাতাকে বিশেষভাবে সম্মান করা হয়েছে। তাই তাদের প্রতি সন্তানের কর্তব্য অনস্বীকার্য। পিতা-মাতাকে শ্রদ্ধা-ভক্তি ও সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। কোনো প্রকারেই তাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা চলবে না। উচ্চস্বরে তাদের সঙ্গে কথা বলাও বারণ। তাদেরকে সাধ্যমতো সেবা-যত্ন করতে হবে। তাছাড়া তারা যে আদেশ-নির্দেশ করবেন তা বিনা দ্বিধায় পালন করতে হবে। ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে পিতা মাতার খুশিতে আল্লাহ্ তায়ালাও খুশি হন। অথচ আমাদের দেশে এমন অনেক সন্তান আছে যারা মা-বাবাকে ভক্তি-শ্রদ্ধা তো করেই না বরং অবজ্ঞা ও অবহেলা করে। তাদেরকে থাকা-খাওয়া থেকেও বঞ্চিত করে কেউ কেউ। এই দুঃখী মা-বাবাদের জন্য তাই দেশে-বিদেশে গড়ে উঠেছে বৃদ্ধাশ্রম। এর চেয়ে দুঃখের ও কষ্টের বোধ হয় আর কিছু নেই।

পরিবারের অন্যানদের মধ্যে রয়েছে ভাই-বোনেরা। বড় ভাই-বোনদের অবশ্যই সম্মান করতে হবে। তাদের আদেশ-উপদেশ মানতে হবে। তাদের নির্দেশমতো লেখাপড়া করতে হবে। তারাও পরিবারের অন্যানদের মতো সকণের ভালো চায়। যদি ছোট ভাই-বোন থাকে তবে তাদের প্রতি সুনজর দিতে হবে। তাদের স্নেহ বা ভালোবাসা দিতে হবে। তাদের আবদার রক্ষা করতে হবে। তাদের সঙ্গে রাগারাগি বা তাদের অবজ্ঞা করা উচিত নয়। বরং বড় ভাইবোনদের ভালোবাসা ও স্নেহ পেলে তারা জীবনে উন্নতি করতে পারবে। এ ছাড়াও পরিবারে অন্যান্য সদস্য যদি কেউ থাকে, তাহলে তাদেরকেও শ্রদ্ধা, স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়ে কাছে টেনে নিতে হবে। পরিবারের যারা কাজের মানুষ, দারিদ্র্যের কারণে যারা অন্যের বাড়িতে কাজ করতে এসেছে, তাদের সঙ্গে কখনো খারাপ ব্যবহার করা উচিত নয়। বরং তাদের স্নেহ ও আদর দিতে হবে। তারাও পরিবারের একজন। পরিবারে তাদের অবদানও কিন্তু কম নয়। শুধু গরিবার নয়, পরিবারের বাইরে প্রতিবেশীদের প্রতিও আমাদের কর্তব্য রয়েছে। তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে মানুষ কখনো একা নয়, বিপদে-আপদে পরিবারের পাশাপাশি এই প্রতিবেশীরাই এগিয়ে আসে।

উপসংহার : একজন কৃতী সন্তান অবশ্যই তার পরিবারের গৌরবের অধিকারী। তার কৃতিত্বের পিছনে পরিবারেরও অবদান থাকে। তাই পরিবারের সকলের প্রতি যথাযথভাবে কর্তব্য পালন করা প্রত্যেকের দায়িত্ব। পরিবারের সকলে যদি তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে তা হলে একটি পরিবার সুখী হতে পারে, সুন্দর হতে পারে।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post