রচনা : আজি এ বসন্তে

শত ফুল ফুটিয়ে, কোকিলের কুহুতানকে সঙ্গী করে প্রকৃতির রঙ্গমঞ্চে বসন্তের আগমন ঘটে। ছয় ঋতুর পালাবদলের এ বাংলাদেশে বসন্তে প্রকৃতি হয়ে ওঠে সুন্দরের এক অপরূপ ভাণ্ডার। শীতের শুষ্কতা ও রুক্ষতাকে বিদায় করে প্রাণিকুল বসন্ত বাতাসে প্রাণের বার্তা নিয়ে আছে গাছে কচিপাতার উঁকি দেওয়া, ফুলের বনে আগুনলাগা সৌন্দর্যের আহ্বান বসন্তের আবেদন বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। উদাসী মানবমনে এ ঋতুর প্রভাব অবশ্যম্ভাবী। প্রকৃতির সাম্রাজ্যে বসন্তের অবস্থান তাই রাজার আসনে। ‘ঋতুরাজ’ হিসেবে সকলের কুর্নিশ বসন্তের চরণেই সমর্পিত হয়।

ষড়কভুর বাংলাদেশে রূপবৈচিত্র্যে বসন্তের তুলনা নেই। কুয়াশার চাদরে ঢাকা শীতের প্রকৃতি প্রাণচাঞ্চল্য হারিয়ে নির্জীব নিথর হয়ে পড়ে। সমস্ত আগ্রহ নিয়ে সে অধীর অপেক্ষা করে বাসন্তী আবহাওয়ার। তখন জাগে কিশলয়, সবুজের স্বপ্নে বিভোর বৃক্ষরাজি পাতা ঝরিয়ে নতুনকে বরণ করে নিতে প্রস্তুত হয়। দ্রুত প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলির রূপবদল ঘটতে থাকে। দিনের পর দিন সবুজের সমারোহ বাড়ে, রঙের মেলায় ভিড় বাড়ে, বাতাসের গতি আর ছন্দে পরিবর্তন আসে। গুটিয়ে যাওয়া প্রকৃতি নিজেকে মেলে ধরতে শুরু করে। ফাল্গুনে শুরু করে চৈত্রের শেষাবধি প্রকৃতির গায়ে একে একে বহু বর্ণিল বসন্তের সমারোহ চোখে পড়ে। অকারণ খুশিতে নাচে অশোকের বন, হৃদয় নিংড়ে গেয়ে ওঠে বনের পাখিরা। বাতাসের মৃদু মর্মর ধ্বনির সঙ্গে দূর বনান্ত থেকে ভেসে আসা কোকিলের কুহুতান মিলে এ ধরাতেই যেন স্বর্গীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়। শিমুল-পলাশ-কৃষ্ণচড়ার বিপুল প্রাণখোলা উল্লাস, গন্ধমদির মাধবী-মঞ্জরির তুমুল সৌন্দর্যের আহ্বান উপেক্ষা করা সাধ্যেরও অতীত।

মানব মনে বসন্তের প্রভাব বিশেষ উল্লেখের দাবিদার। বসন্ত মানুষের মনের উঠোনকে যতটুকু রঙিয়ে দিতে পারে, অন্য কোনো ঋতুর সে ক্ষমতা নেই। পুষ্পিত সৌন্দর্যের আহ্বান, পাখির কলকাকলি আর বর্ণিল রঙের সমারোহ মানুষের হৃদয়কে চঞ্চল করে তোলে। প্রকৃতির এমন উষ্ণ-সজীব আহ্বান মানুষকে চিরসবুজ মানসিকতা দান করে। বসন্তের দূরন্ত উদ্দামতা মানবমনকে অজানার স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে চলে। সকল সংকীর্ণতা, পঙ্কিলতার কালিমাকে পাশ কাটিয়ে উদার মানসিকতার ছোঁয়ায় জেগে ওঠে সবাই। কবির কবিতায়, ভাবুকের ভাবনায় কিংবা শিল্পীর সংগীতে বসন্ত একটি অনিবার্য অনুষঙ্গ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিরহীর মনের দশা উপস্থাপন করতে গিয়েও বিস্মৃত হন নি বসন্তের সৌন্দর্যের-
আহা আজি এ বসন্তে
এত ফুল ফোটে 
এত বাঁশি বাজে
এত পাখি গায়—

বসন্তের বিবাগী বাতাস মনের অলিগলিতে প্রবেশ করে অজানা শিহরণের ছোঁয়া দেয়। প্রেমিকমনে প্রিয়জনের জন্যে হাহাকারের ব্যথা বাজে, কাঙ্ক্ষিত আপনজনের জন্যে মন কেমন করে। অতীতের স্মৃতি রোমন্থনে, স্মৃতি জাগানিয়া ক্ষণগুলো বারবার মনে দোলা দিয়ে যায়। প্রকৃতির নান্দনিক ছোঁয়া চোখে স্বপ্ন জাগায়, মনকে বিভোর করে। বসন্তের রূপে মুগ্ধ কবির উচ্চারণ-
বসন্তকাল এসেছে মোর দ্বারে
জানালা দিয়ে চেয়ে আকাশ পানে 
আনন্দ আজ ক্ষণে ক্ষণে জেগে উঠছে প্ৰাণে।

বসন্তের এ আনন্দের রেশ একা একা উপভোগ্য নয়। প্রিয়সঙ্গ লাভের জন্যে সবার প্রাণেই আকুলতার সুর বাজে। সামনে ঝরা কৃষ্ণচূড়ার লাল গালিচা, ডালে কৃষ্ণবর্ণ কোকিলের মধু আহ্বান, দখিনা মৃদুমন্দ সমীরণ, পাশে বাহুডোরে বাঁধা প্রিয়জন আর তার উষ্ণ সান্নিধ্যে এমন আকাঙ্ক্ষার টান এ সময় সবাই অনুভব করে। বিরহী মনের ব্যাকুলতা শীতের রিক্ততাকে যেন বসন্তেও টেনে নিয়ে আসে। ‘সুখে আছে যারা সুখে থাক তারা, সুখেরও বসন্ত সুখে হোক সারা’- এমন আক্ষেপপূর্ণ মনোভাবেই কাটে তাদের সুখের মতো ব্যথা জাগানিয়া বসন্তদিনগুলো।আবহমান বাঙালির জীবনধরা ও সংস্কৃতিতে ঋতুরাজ বসন্ত রাজার আসনেই সমাসীন। পয়লা ফাল্গুন তারিখে অনুষ্ঠিত বসন্ত-বরণ উৎসব নাগরিক জীবনে একটি বিশেষ আনন্দের দিন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের অংশগ্রহণে বসন্তকে বরণের আকুলতায় মেতে ওঠে। বাঙালি প্রাণ। মেয়েরা পরে বাসন্তী রঙের শাড়ি, খোঁপায় গুঁজে নেয় লাল ফুল; আর ছেলেরা বাসন্তী রঙের পাঞ্জাবি বা ফতুয়ার সাজে দলে দলে বসন্তের শোভা বাড়ায়। নির্দিষ্ট ধর্ম বা সম্প্রদায়ের না হয়ে বসন্ত বরণ অনুষ্ঠান বাঙালি সংস্কৃতির অসাম্প্রদায়িক দিকটি বিশ্বের সামনে তুলে ধরে। নেচে গেয়ে সবাই ঋতুরাজকে বরণ করে নেয়। বসন্তের শেষে কোথাও বা আয়োজন করা হয় গ্রামীণ মেলার, আর এ উপলক্ষে নিস্তরঙ্গ গ্রামীণ জীবনে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায়।

শীতের রিক্ত প্রকৃতি বসন্তে নতুন প্রাণ পায়, পূর্ণতা পায়। বসন্ত মানেই প্রকৃতির উদ্দাম আবেগ, অফুরান প্রাণচাঞ্চল্য। বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বসন্তের কল্যাণে সকলের দৃষ্টিতে মোহনীয় রূপে ধরা দেয়। ফুল-পাখি-দখিনা সমীরণের সম্মিলিত সৃজনশীলতায় এ ঋতুতে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি আনন্দের স্বপ্নরাজ্যে পরিণত হয়। তাই বসন্তের প্রতি ভাবুক বাঙালির ভালোবাসা এত বেশি প্রকাশ পায়। আর এভাবেই রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ আর ভাব-আনন্দে মাটির পৃথিবীকে মাতিয়ে দিয়ে ধরায় আসে বসন্তের দিন, সবার প্রিয় বসন্তকাল।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post