HSC 2021 : সমাজকর্ম : অ্যাসাইনমেন্ট

দ্বিতীয় অ্যাসাইনমেন্ট
সমাজকর্ম (২য় পত্র)
৩য় সপ্তাহ

বর্তমান কোভিড পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠীর মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণের পথে অন্তরায়গুলো চিহ্নিত করে সেগুলো দূরীকরণে গৃহীত পদক্ষেপ বর্ণনা।

নমুনা সমাধান

ক. মৌলিক মানবিক চাহিদার ধারণা : সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের যে সকল চাহিদা অপরিহার্য সেগুলাই মৌলিক মানবিক চাহিদা। মানুষের চাহিদার কোন শেষ নেই। কিন্তু কিছু কিছু চাহিদা মানুষের পূরণ না হলে মানুষের জীবন রক্ষা পায় না এবং সামাজিক পরিচয়ও থাকে না। এ সমস্ত অভাব পূরণের চাহিদাই হল মানুষের মৌলিক চাহিদা। এই চাহিদাগুলোর সংখ্যা কিন্তু বেশি একটা নয়; তবে চাহিদার তীব্রতা অনেক।তাই মৌলিক চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে মানুষের যা সম্ভব তাই করোপাশাপাশি মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ না হলে তার ন্যূনতম মর্যাদা হারিয়ে ফেলে।

মানুষের বেঁচে থাকা, দৈহিক এবং মানসিক বিকাশ এবং সামাজিক বা নাগরিক জীবন - যাপনের জন্যে মৌলিক কিছু চাহিদা পূরণ করতেই হয়। এর কোনো বিকল্প নেই। মানুষের জৈবিক এবং সামাজিক চাহিদার সমষ্টি হল মৌলিক মানবিক চাহিদা যা পূরণ করতেই মানুষ সারা জীবন ব্যস্ত থাকে। জন্ম নেওয়ার পর পরই মানুষের মৌলিক চাহিদার সূত্রপাত হয়। শৈশবে প্রথমে দেখা দেয় মূলত জৈবিক চাহিদা পূরণের তাড়া। পরবর্তীতে শিশু যখন পরিবার, দল ও সমাজের সাথে কাজ করা শুরু করে তখন মানবিক বা সামাজিক চাহিদা পূরণের প্রয়োজন পড়ে। এই চাহিদায় মানুষকে তাড়িয়ে নেয় জীবন ভর। মানুষ ছাড়া অন্যান্য জীব কেবল জৈবিক চাহিদা পূরণে ব্যস্ত থাকে।

জেগে থাকা অবস্থাতেই কেবল নয়, ঘুমের মধ্যেও মানুষ চাহিদা পূরণে সচেষ্ট থাকে। কেননা ঘুমও হল একটি মৌলিক চাহিদা। স্থান-কাল ভেদে মানুষের জৈবিক চাহিদার ধরনের কোন পার্থক্য দেখা যায় না। তবে সামাজিক চাহিদা বিভিন্ন সমাজে ও বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের হয়ে থাকে। যেমন ক্ষুধা - তৃষ্ণা, বিশ্রাম, আশ্রয়, চিকিৎসা ইত্যাদি জৈবিক চাহিদা গুলো গ্রাম-শহর, ধনী - দরিদ্র সাদা-কালো, বাঙালি - অবাঙালি, মুসলিম অমুসলিম, শিশু, যুবক, প্রবীণ ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রের মানুষের বেলায় প্রায় সমান। অবশ্য এ সকল চাহিদা পূরণের কৌশল, ধরন ও ধারা এসমস্ত শ্রেণীর মানুষের মধ্যে বেশ তারতম্য পূর্ণ হয়।পাশাপাশি সামাজিক চাহিদা গুলো নানা ধরনের হলেও বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে কিছু কিছু সামাজিক চাহিদা ধরন ও তা পূরণে প্রকৃতি অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে। যেমন শিক্ষা, নিরাপত্তা, চিত্তবিনোদন ইত্যাদি সামাজিক চাহিদা গুলো বর্তমানে সার্বজনীন রূপ পরিগ্রহ রয়েছে।

খ . মৌলিক মানবিক চাহিদার বিবরণ: সত্যিকার অর্থে মানুষের চাহিদা অসীম। তাই মৌলিক চাহিদার সংখ্যাও কম নয়। তবে জমি ও সামাজিক অস্তিত্বের প্রশ্নে কিছু কিছু চাহিদাকে সকলেই অত্যাবশ্যক বলে মনে করেন। অর্থাৎ বেঁচে থাকা এবং সমাজে বসবাস করার জন্য অনেক চাহিদার মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু চাহিদা অপরিহার্য বলে গণ্য হয়। এগুলার বিবরণ ধারাবাহিকভাবে নিচে দেওয়া হল।

১ ক্ষুধা : ক্ষুধা যে কোন প্রাণীর প্রধান চাহিদা। ক্ষুধা পেলে আমরা খাদ্য খাই। তাই জীবনের জন্য আমাদের প্রথম প্রয়োজন হলো খাদ্যের।মানুষ কেবল নয়, বরঞ্চ প্রাণী, পাখি, পতঙ্গ উদ্ভিদ সহ সকলেই তাদের জীবনের প্রায় পুরো সময় ব্যয় করে খাদ্য সংগ্রহ ও গ্রহণের পিছে। দেহের বৃদ্ধি সাধন, ক্ষয়পূরণ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, ও তাপ শক্তি উৎপাদন ইত্যাদির জন্য মানুষের দৈনিক প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাদ্য ও পানীয়।আর সুস্থ থাকার জন্য ওই খাদ্য এবং পানীয় হতে হবে নিরাপদ এবং সুষম। দৈহিক বৃদ্ধিই কেবল বৃদ্ধি নয়, মানসিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ও খাদ্য মানুষকে সক্ষম করে তোলে। খাদ্যের চাহিদা মানুষের সবচাইতে তীব্র। এই চাহিদা পূরণের জন্য মানুষ বৈধ অবৈধ সব ধরনের পন্থা অবলম্বন করে।

২. বস্ত্র : খাদ্যের পাশাপাশি বস্ত্র মানুষের অন্যতম চাহিদা। মানুষ ছাড়া অন্য কারো বস্ত্র বা পোশাকের প্রয়োজন হয় না। মানুষের ত্বক পোশাক ছাড়া শীত, তাপ ও আব্রু রক্ষা করতে পারেনা।শুরু থেকেই মানুষ তাই কোনো না কোনো আবরণ বা আচ্ছাদন ব্যবহার করে আসছে। এক্ষেত্রে গাছের ছাল- পাতা, পশুর চামড়া ইত্যাদি প্রথমদিকের মানুষ ব্যবহার করতো।বস্ত্র এর পরবর্তী রূপান্তর। বস্ত্র বা পোশাক মানুষের জৈবিক ও সামাজিক চাহিদা মেটায়। পর্যাপ্ত পোশাক পরিধান করলে ওই মানুষকে সভ্য বলা হয় না। তাই শীত-তাপের বিধান মেনে চলা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং লজ্জা নিবারণের জন্য মানুষের সব সময়ের চাহিদা পোশাক বা বস্ত্ৰ। বর্তমানে সৌন্দর্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে বস্ত্রে বা পোশাকে বিভিন্ন ধরনের সমারোহ লক্ষ্য করা যায়। বস্ত্রের চাহিদা তাই হাজার গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন এলাকায়, পরিবেশে, সংস্কৃতিতে বস্ত্রের ভিন্ন ভিন্ন স্টাইল, ধরণ ও ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।

৩. বাসস্থান : প্রাণী, পাখি ও পতঙ্গের অন্যতম একটি চাহিদা হলো আশ্রয়। আর এজন্য মানুষ বিভিন্নভাবে তৈরী করেছে বাসস্থান। এটি অনেকটা জৈবিক চাহিদা। মানুষের বেলায় বাসস্থানের প্রয়োজন অন্যান্য পাখি পতঙ্গেরতুলনায় অনে বেশি। শান্তিতে ঘুমানোর জন্যে ঝড়-বৃষ্টি, শীত-তাপ হতে দেহকে রক্ষা করার লক্ষ্যে, জন্তু - জানোয়ার, চোর-ডাকাতের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার লক্ষ্যে, সুষ্ঠু পরিবার গঠন ও পরিচালনার জন্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ উন্নয়নের জন্য এবং ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক নিরাপত্তা বিধান ও নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠায় বাসস্থানের ভুমিকা খরব গুরুত্বপূর্ণ। ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ইত্যাদির পার্থক্য অনুযায়ী বিশ্বের নান অঞ্চলের মানুষের বাসস্থানের ধরন ও আকৃতি ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। সভ্যতার উন্নয়নের সাথে সাথে মানুষ অধিকতর উষ্ণ ও আরামদায়ক বাসস্থান গড়ে তুলেছে। এর ফলে মানুষের। জীবন হয়ে উঠেছে আরও বেশি নিরাপদ, উপযোগী এবং সুখকর।

৪. শিক্ষা : বলা হয় যে পুষ্টি জগতে শারীরিকভাবে মানুষ সম্ভবত সবচেয়ে অসহায় অবস্থায় জন্ম নেয়। বেঁচে থাকা এবং প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য তাকে বিভিন্ন বিষয় শিখে কাজ করতে হয়। শেখার সামর্থ্য আবার মানুষেরই সবচেয়ে বেশি। তবে শিক্ষা হতে পারে প্রধানত দু'ধরনের, সংগঠিত বা আনুষ্ঠানিক এবং অসংগঠিত বা অনানুষ্ঠানিক। বর্তমানে শিক্ষা বলতেন যদিও বা অনানুষ্ঠানিক। বর্তমানে শিক্ষা বলতেন যদিও আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কে ধরা হয় তবে এর বাইরেও বহু কিছু মানুষ নিজে নিজে শিখে নেয়। বিশ্বের অন্যান্য পশুপাখি হতে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব একমাত্র শিক্ষার কারণে। মানুষ যত শিখে ততই শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে। বিশ্বের যে দেশে শিক্ষার হার যত বেশি সেই দেশ তত বেশি উন্নত। বর্তমানে বলা হয় যে, বিশ্বের সকল দেশের শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। শিক্ষা মানুষকে শক্তিশালী করে; এজন্যই শিক্ষা মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদা।

৫. স্বাস্থ্য : জীবনের চলার পথে মানুষ মাত্রই নানা ভাবে অসুস্থ, রোগগ্রস্ত ও আহত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ অবস্থায় প্রয়োজন দেখা দেয় চিকিৎসা, পথ্য, খাদ্য ও পরিচর্যা। এগুলা যথাসময়ে ঠিকভাবে পেলে জীবন হয় সুস্থ, সবল ও স্মৃস্তি দায়ক। তবে কেবল শারীরিক স্বাস্থ্যই নয়, বরঞ্চ সামাজিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক ভাবে মানুষকে সুস্থ থাকতে হয়, সুস্বাস্থ্য এবং সুস্থতার উপরেই নির্ভর করে মানুষের শিক্ষা, কর্ম আয় উন্নতি ইত্যাদি। যৌগিক স্বাস্থ্য ও সুস্থতা মানুষ ছাড়াও অন্যান্য সকল এর মৌলিক চাহিদা। মানুষ যেহেতু শ্রেষ্ঠ জীব তাই সে পারে নিজ ব্যবস্থাপনায় যথাযথভাবে স্বাস্থ্যব্যবস্থা পরিতৃপ্তি করতে। স্বাস্থ্যসেবা আধুনিক মানুষের মৌলিক অধিকার। তাই বিশ্বের প্রতিটি দেশের নাগরিকদের স্বাস্থ্য সেবা প্রদানে থাকে অঙ্গীকারবদ্ধ"। কেননা, "স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল"।

৬. চিত্তবিনোদন : বিনোদনের অংশ নেওয়া মানুষের একটি সহজাত চাহিদা। আদিকাল হতেই মানুষ সকল বয়সে এবং সকল সময়ে বিনোদনের সাথে জড়িত। শরীরে শক্তির জন্য যেমন প্রয়োজন খাদ্য তেমনি প্রশান্তির জন্য দরকার বিনোদনের। বিনোদন মানুষের চিত্তকে সুস্থ ও সবল রাখে। পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়ন, অবসর যাপন, নেতৃত্ব দান ইত্যাদি চিত্র বিনোদন প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে। তাই বিশ্বের সব দেশেই সব সময় নাচ অভিনয় আবৃত্তি বিতর্ক ভ্রমণ পরিদর্শন ইত্যাদিতে মানুষ জড়িত থেকেছে। বর্তমানে রেডিও, টিভি, নাটক, বই,সিনেমা, পার্ক চিড়িয়াখানা কম্পিউটার, ক্রীড়া, পর্যটন ইত্যাদি মানুষের চিত্তবিনোদনের আকর্ষণীয় উপকরণ হিসেবে চালু রয়েছে। বিনোদনের মাধ্যমে ও উপকরণ অঞ্চল, সংস্কৃতি শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইত্যাদির কারণে ভিন্ন হয়ে
থাকে।

গ. মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণে বিদ্যমান ৫ টি সমস্যা : মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণে বিদ্যমান পাঁচটি সমস্যা নিচে উল্লেখ করা হলো :

১. অপুষ্টি : বাংলাদেশের অন্যতম সামাজিক সমস্যা হল অপুষ্টি। এটি মূলত মৌলিক মানবিক চাহিদা অপূরণজনিত কারণে হয়। এর প্রধান শিকার হলো শিশু ও নারী। বাংলাদেশ প্রায় তিন - চতুর্থাংশ শিশু ও দুই তৃতীয়াংশ নারী অপুষ্টিতে ভোগে। অপুষ্টির কারণে শিশুদের মধ্যে অন্ধ, প্রতিবন্ধী, কম বৃদ্ধি, খাটো হওয়া ইত্যাদি তে দেখা দেয়। তাছাড়া অপুষ্ট মায়ের সন্তান কম ওজন নিয়ে জন্ম নেয় এবং শিশুর মৃত্যু হার বৃদ্ধি পায়। অপুষ্টির শিকার হয়ে অন্যান্য মানুষ অসুস্থ, রোগগ্রস্ত, দ্রুত বার্ধক্য এবং অকাল মৃত্যুর সম্মুখীন হয়। প্রয়োজনীয় আয়, শিক্ষা খাদ্য, চিকিৎসা, বস্ত্র, আশ্রয় ইত্যাদির অভাবে অপুষ্টিজনিত সমস্যা দেখা দেয়।

২. স্বাস্থ্য হীনতা : সুস্বাস্থ্য এবং সুস্থ থাকার জন্য দরকার হয় খাদ্য পুষ্টি শিক্ষা, চিকিৎসা, চিত্তবিনোদন ইত্যাদি। কিন্তু বাংলাদেশে এ সকল মৌলিক চাহিদা সঠিকভাবে পূরণ হয় না বলে যে সমস্ত সমস্যার উদ্ভব হয় স্বাস্থ্যহীনতা তার মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের গ্রামীণ ও শহরের দরিদ্র মানুষদের মধ্যে নানা ধরনের রোগ ও অসুস্থতা লক্ষ্য করা যায়। দরকারি চিকিৎসাসেবা থাকায় এবং চরম দারিদ্র্যের কারণে অধিকাংশ মানুষের স্বাস্থ্য হুমকীর মুখে। তাছাড়া কুসংস্কার, ভেজাল, নকল খাদ্য ও ওষুধ স্বাস্থ্য সমস্যাকে আরও বেশী জটিল করে তোলে। অপুষ্টি ও রোগ - শোকের কারণে এ দেশের মানুষের গড় আয়ু কম। তাছাড়া শিশুমৃত্যু, প্রসূতি মৃত্যু, প্রতিবন্ধকতা এখানে অনেক বেশি।

৩. নিরক্ষরতা ও অজ্ঞতা : মানুষের জীবনের সবচেয়ে দরকারী উপাদান হলো শিক্ষা ও জ্ঞান। নিরক্ষর ও অজ্ঞ মানুষ নানা কুসংস্কারে আবদ্ধ থাকে এবং সঠিকভাবে উন্নয়ন ঘটাতে পারে না। বাংলাদেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ নিরক্ষর। বলা হয় যে, "শিক্ষাই আলো "। অথচ শিক্ষার চাহিদা পূরণ হওয়াতে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম অনুন্নত দেশ হওয়ার পিছনে এই নিরক্ষরতা বেশিরভাগ দায়ী। একথা বলতেই হয় যে, দেশের বহু ক্ষেত্রে উন্নতি হলেও শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নতি খুব কম এবং বিস্তৃতির গতি সবচেয়ে মন্থর। শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষক, বই-পুস্তক, স্কুল- কলেজ ইত্যাদি প্রচণ্ড অভাব এদেশের অধিকাংশ মানুষকে শিক্ষা হতে বঞ্চিত করে রেখেছে। ফলের জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে। সৃষ্ট হচ্ছে অপুষ্টি, স্বাস্থ্য হীনতা সহ নানান ধরনের সামাজিক সমস্যা। 

৪. গৃহ ও বস্তি সমস্যা : গৃহ হচ্ছে মানুষের আশ্রয়স্থল। বাংলাদেশের বিরাট সংখ্যক মানুষ গৃহহীন। ভূমির স্বল্পতা এর অন্যতম কারণ। দেশের সকল মানুষের জন্য পরিকল্পিত আবাসনের কোন পরিকল্পনা আজও গ্রহণ করা হয়নি। ফলে ঢাকা সহ সকল শহরের অন্যতম সমস্যা হল বস্তি। দেশের শহর অঞ্চলের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ বসবাস করছে এখন বস্তিতে। বাসা বাড়ির স্বল্পতা এবং বস্তির বিস্তারের ফলে স্বাস্থ্যহীনতা, অপুষ্টি, নিরক্ষরতা, অপরাধ মাদকাসক্তি, সন্ত্রাস পতিতাবৃত্তি সহ নানা জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রে শিশু ও নারীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুস্থ নাগরিক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে উপযুক্ত আবাসন অপরিহার্য। অথচ বাংলাদেশের প্রচণ্ড অভাব রয়েছে।

৫. অপরাধ ও কিশোর অপরাধ : আইন পরিপন্থী কাজ করা হলো অপরাধ। আর এই কাজটি কিশোর অবস্থায় করলে তাকে বলা হয় কিশোর অপরাধ। মৌলিক মানবিক চাহিদা যথাযথভাবে পূরণ না হলে সমাজে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায়। অর্থের অভাবে মানুষ যখন খাদ্য, বস্ত্র বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা অভাব পূরণ করতে পারেনা ঠিক তখনই চুরি ছিনতাই, ডাকাতি ইত্যাদি অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি অসচ্ছলতার অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি অসচ্ছলতার কারণে ঘুষ, দুর্নীতি মজুতদারী, চোরাচালান হতে শুরু করে ভিক্ষাবৃত্তি, পতিতাবৃত্তি, আত্মহত্যা, নেশা, সন্ত্রাস ইত্যাদি বাংলাদেশ বেড়েই চলছে। পর্যাপ্ত চিত্তবিনোদনের অভাবে এদেশের মানুষ নানাভাবে দিন দিন বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।

ঘ . সমস্যা সমাধানে গৃহীত ৫ টি পদক্ষেপ : মানুষের মৌলিক মানবিক চাহিদা সমস্যার সমাধানে গৃহীত পাঁচটি পদক্ষেপ নিচে বর্ণনা করা হলো :

১. খাদ্য : বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে সার্বিক কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়েছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১৬-২০) জাতীয় কৃষি নীতি ও সহস্রাব্দ উন্নয়নের লক্ষ্য রেখে কৃষি খাতের সরকারের উন্নয়নের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে কৃষি উপকরণের ভর্তুকি বৃদ্ধি, কৃষি উপকরণ সহজলভ্য করা, কৃষিঋণের আওতা বৃদ্ধি এবং প্রাপ্তি সহজীকরণ করা হয়েছে। মাটির গুনাগুন বজায় রাখা এবং অধিক ফসল ফলন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সুষম সার ও জৈব সারের ব্যবহার কৃষকদের মাঝে জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন বাংলাদেশ সরকারের লক্ষ্য। এই লক্ষ্যে দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা মেটাতে ভেষজ খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ কৃষিখাতের সার্বিক উন্নয়নকে সরকার সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে।

২. বস্ত্র : বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৩ সালের মধ্যে বস্ত্রের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এবং বস্ত্র রপ্তানিতে মাত্রা নির্ধারণ করে দেশের প্রথম বস্ত্র নীতি ঘোষণা করে। পঞ্চম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (১৯৯৭-২০০২) বস্ত্রের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে 2005 সালের মধ্যে বার্ষিক মাথাপিছু 17 মিটার বস্ত্র প্রাপ্তির নিশ্চয়তা বিধানের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।বাংলাদেশের রপ্তানিমুখা পোশাক শিল্পের শতকরা ৪০ থেকে 85 ভাগ বস্ত্রের চাহিদা দেশীয় শিল্প থেকে আসে। বস্ত্র ও তৈরি পোশাক শিল্পে বর্তমানে 50 লক্ষ লোক নিয়োজিত রয়েছে। বর্তমানে বন্ধ মিলগুলো পর্যায়ক্রমে চালু করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বস্ত্র খাতের উন্নয়নে বস্ত্র প্রযুক্তিবিদ ও বস্ত্র বিষয়ক দক্ষ জনশক্তির চাহিদা পূরণে পাঁচটি স্টাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, 6 টি টেক্সটাইল ইন্সটিটিউট এবং 40 টি ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট তৈরি করা হয়েছে।

৩. বাসস্থান : দরিদ্র জনগোষ্ঠীর গৃহায়নের লক্ষ্যে সরকার কর্তৃক ১৯৯৭-৯৮ গৃহায়ন তহবিল গঠন করা হয়। এ তহবিল দ্বারা এখন পর্যন্ত 3.55 লক্ষ লোক উপকৃত হয়েছে। গৃহনির্মাণ কর্মসূচির আওতায় ফেব্রুয়ারি 2015 সাল পর্যন্ত ৬১,০৯২ গৃহ নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। সারাদেশে মোট ৫১৩ টি এনজিও এবং 64 জেলার 450 টি উপজেলায় গৃহায়ন ঋণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন। করা হয়েছে। শহর অঞ্চলের ভাসমান জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসনের লক্ষ্যে কয়েকটি পুনর্বাসন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। ভূমিহীন গৃহহীন ও ছিন্নমূল পরিবারের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে গ্রহণ করা হয় আশ্রয় প্রকল্প। ১৯৯৭-২০০২ সাল পর্যন্ত সময়ে 300 কোটি টাকা ব্যয়ে 50 হাজার পরিবারকে এ প্রকল্পের আওতায় পুনর্বাসন করা হয়।

৪. শিক্ষা : সাংবিধানিক দায় বদ্ধতা ও আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার প্রতিপালনে " সবার জন্য শিক্ষা " নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার একটি নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত সকল বালক - বালিকা কে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা দান এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই নিরক্ষতা দূর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। সরকার যুগোপযোগী ও কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ - প্রণয়ন করেছে। শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, নতুন কারিকুলাম প্রণয়ন, পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন সহ নানাবিধ উন্নয়ন ও সংস্কারধর্মী কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে।

৫. স্বাস্থ্য : সরকারের সাংগঠনিক দায় বদ্ধতা হল নাগরিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা। স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের প্রধান পদক্ষেপ হিসেবে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা এর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা শিশুদের মারাত্মক ছয়টি রোগ (ডিপথেরিয়া, টিটেনাস, পোলিও, হুপিং কফ যক্ষা ও হাম) প্রতিরোধের জন্য ১৯৭৯ সাল থেকে টিকাদান কর্মসূচি চালু রয়েছে। দেশকে পোলিও মুক্ত করার লক্ষ্যে দেশব্যাপী জাতীয় টিকাদান দিবস পালিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি-২০১১ প্রণয়ন করা হয়েছে। মাঠকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবী মাধ্যমে ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া যক্ষ্মা ও কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ এবং ভিটামিন (এ) এর অভাবজনিত অন্ধত্বের দূরীকরণ কৃমিনাশক ঔষধ বিতরণ ও টিকাদান কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post