খুদে গল্প : ক্ষুধা

'ক্ষুধা' শিরোনামে একটি খুদে গল্প লেখ।

ক্ষুধা

লোকটির চলার ক্ষমতা নেই। আজ তিন দিন শুধু পানি খেয়েই বেঁচে আছেন তিনি। লোকটির বয়স আর কতই হবে, ৬০ কিংবা ৬৫। এই বয়সে খেতে না পেয়ে তিনি একেবারেই কাহিল হয়ে পড়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে সেই ব্যক্তিটি শুধু হাঁপাচ্ছিলেন। লোকটি এসে বসেছেন একটি আমগাছের নিচে। এতক্ষন প্রচন্ড রোদের মধ্যে তিনি হেঁটেছেন। ফলে ক্ষুধার্ত অবস্থায় এভাবে হাঁটার কারণে তিনি আরও বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। সেই ব্যাক্তিটি আমগাছটির গোড়ার সঙ্গে নিজের পিঠ হেলান দিয়ে বসে আছেন। এমন সময় ২৫-২৬ বছরের এক যুবক সেখানে এলো। যুবকটি বেশ কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করল, চাচা আপনার কী হয়েছে? আপনি এভাবে হাঁপাচ্ছেন কেন? উত্তরে বৃদ্ধলোকটি কোনো কথাই বলতে পারলেন না। শুধু ইঙ্গিতে বোঝালেন যে, তিনি পানি খেতে চান। যুবকটি আশেপাশে কোনো টিউবওয়েল বা পানি না পেয়ে দোকান থেকে এক বোতল পানি এনে দিল। বৃদ্ধ লোকটি পানি পেয়ে বহুদিনের তৃষ্ণার্ত পথিকের মতো ঢক ঢক করে বোতলের সবটুকু পানি খেয়ে নিলেন। যুবকটি তাঁর পাশে এসে বসল। যুবকটি বৃদ্ধের কাছে জানতে চাইল তার এমন অবস্থা কীভাবে হলো। বৃদ্ধ তার করুণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ যুবকের দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর কিছুটা স্পষ্ট আবার কিছুটা অস্পষ্ট ভাষায় যা বললেন, তাতে বোঝা গেল- বৃদ্ধের নাম আসগর আলী। বাড়ি কুসুমপুর। বাড়িতে তার এক বিঘে জমি ছিল। তাছাড়া অন্যের জমিতে কাজও করত। ফলে স্ত্রী ও দুই পুত্রকে নিয়ে তার সংসার ভালোই চলত। কিন্তু একদিন স্ত্রীর অসাবধানতায় আগুন লাগে তার বাড়িতে। আগুন লেগেছিল মাঝ রাতে। তখন সবাই গভীর ঘুমে অবচেতন। আসগর আলী বাড়ি ছিলেন না। তিনি গিয়েছিলেন গঞ্জে। বাড়ি ফিরে দেখেন সেই আগুনে তার স্ত্রী, দুই পুত্র দগ্ধ হয়ে গেছে। দুই পুত্র সেই রাতেই মারা যায়। অর্থাভাবে চিকিৎসা করাতে না পেরে স্ত্রীও মারা যান সাত দিন পর। স্ত্রী পুত্রকে হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েম আসগর আলী। বছর দশেক পরে আসগর আলীর জীবনে আসে আরেক দুর্বিষহ সময়। গ্রামের মাতব্বর আক্কাস আলীর চোখ পড়ে তার সেই জমির ওপর। এরপর নানা ছল চাতুরী করে সেই জমিটিও নিয়ে যায় আক্কাস আলী। তারপর থেকেই ঘর ছাড়া আসগর আলী। তখন থেকেই তিনি শ্রমিকের কাজ করেন। যা পান তাই দিয়ে কোনোভাবে খেয়ে জীবনধারণ করেন। কিন্তু এখন তার বয়স হয়েছে অনেক। ফলে কেউ আর কাজে নিয়ে চায় না। তাছাড়া এই বয়সে অত ভারী কাজ আসগর আলী করতেও পারেন না। এই কারণে তার সঙ্গীরাও তাকে ফেলে চলে গেছে। আজ সাত দিন হলো তিনি কোনো কাজ পাননি। হাতে যা ছিল তা দিয়ে দিন চারেক কিছু খেয়েছেন। তারপর থেকে শুধু পানি খেয়েই বেঁচে আছেন। বৃদ্ধের জীবনের এ করুন ঘটনা শুনে যুবকের চোখে পানি এসে গেল। কোনোভাবে চোখ মুছে জিজ্ঞাসা করল কাউকে কিছু বলেননি কেন? উত্তরে বৃদ্ধ বললেন, ভিক্ষা করবার মন চায় না। কথাটি শুনে বৃদ্ধের প্রতি যুবকের শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। যুবক বৃদ্ধকে বসিয়ে রেখে গেল খাবার আনতে। দোকান থেকে একটি প্লেটে করে ভাত, মাছ, ডাল ও সবজি এনে দিল। তিন দিন খেতে না পেয়ে বৃদ্ধের পেট যেমন পিঠের সঙ্গে লেগে গিয়েছিল তেমনি চোখও বসে গিয়েছিল কপালের সঙ্গে। চোখের সামনে এতগুলো খাবার দেখে বৃদ্ধ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন খাওয়ার জন্য। খুব দ্রুত ভাতের সঙ্গে কিছু সবজি মেখে মুখে দিতে গিয়েই বৃদ্ধ হঠাৎ করে থেমে গেলেন। এরপর উচ্চ স্বরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন।


এই গল্পটি অন্য বই থেকেও সংগ্রহ করে দেয়া হলো


লোকটির আর চলার ক্ষমতা নেই। আজ তিনদিন শুধু পানি পান করে দিনাতিপাত করছে সে। জনবহুল স্টেশনে নিশ্চল পড়ে আছে তার ক্ষুধায় ক্লান্ত দেহটি। গত কয়েকদিন যাবৎ সামান্য একটা চাকরির সন্ধানে সে ঘুরে বেরিয়েছে ঢাকার একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত। ফরিদপুরের পদ্মা তীরবর্তী এক সমৃদ্ধ গ্রামে ছিল তার সুখের সংসার। কিন্তু প্রমত্তা পদ্মার সর্বগ্রাসী ছোবলে বিলীন হয়ে গেছে তার ঘরবাড়ি, ফসলি জমিসহ সবকিছু। জীবিকার তাগিদে পরিবার ফেলে লোকটি ঢাকায় আসে। শুনেছিল ঢাকায় এলে নাকি চাকরি পাওয়া যায়। কিন্তু আসার পর দেখল সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। পূর্বপরিচিত একজনকে বহুকষ্টে খুঁজে বের করেছিল সে। কিন্তু লোকটি বলে দিয়েছে, ‘আমার নিজের অবস্থাই এখন ভালো না, তোমাকে কাজ দেওয়া এখন সম্ভব নয়, মাসখানেক পর এসো, দেখি কিছু ব্যবস্থা করা যায় কিনা।’ তার বুঝতে বাকি থাকে না যে এখানে এসে কোনো লাভ হবে না।

এদিকে গ্রাম থেকে আসার সময় সামান্য যে টাকা নিয়ে এসেছিল, তাও শেষ হয়ে গেছে দুদিনেই। এক সময় গ্রামের স্বনির্ভর কৃষক ছিল সে। তাই আত্মসম্মানবোধ এতটাই প্রখর যে কারো কাছে ভিক্ষা চাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। ক্ষুধার যন্ত্রণায় এক সময় সবকিছু ভুলে কেবল খাদ্যের সন্ধান করতে থাকে সে। কিন্তু টাকা ছাড়া এখানে খাবার জোটে না এটা সে বুঝে গেছে। ক্ষুধায় ক্লান্ত নিথর দেহ নিয়ে স্টেশনের প্লাটফর্মেই পড়ে থাকে লোকটি। তার পাশেই ভিক্ষা করে এসে বিশ্রাম নিচ্ছিল এক ভিক্ষুক। ভিক্ষুকটি তার দিকে তাকিয়ে বলে ‘মিয়াভাই, পেটে কি কিছু নাই?’ লোকটি কিছু বলে না, ভিক্ষুকটি আবার বলে, ‘বুঝতে পারছি মিয়াভাই। কিন্তু কাজ এত সহজে পাইবা না। আমার লগে ভিক্ষা করো। পরে কাজ পাইলে কইরো।’ লোকটি উদাস মনে ভাবতে থাকে তার পরিবারের কথা। চাকরি বা টাকা জোগাড় করতে না পারলে কীভাবে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে? ভাবে, সে কি তাহলে ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আপোশ করে অন্যের কাছে হাত পাতবে?
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post