খুদে গল্প : গ্রামে ফেরা

'গ্রামে ফেরা' শিরোনামে একটি খুদে গল্প লেখ।

গ্রামে ফেরা

নাগরিক জীবনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে মুহিত সাহেব উপলব্ধি করলেন- অনেক হয়েছে, আর না। এবার ফিরতে হবে শেকড়ে। অফিসে বসে বসে এমনটাই ভাবছিলেন তিনি। হঠাৎ করেই তিনি অফিস থেকে বেরিয়ে পড়লেন। সোজা গেলেন বাসায়। গিয়ে দেখলেন তাঁর স্ত্রী শরিফা বেগম নারী উন্নয়ন সমিতির একটি মিটিং করছেন। তিনি স্ত্রীকে নিজের ঘরে ডাকলেন। শরিফা বেগম ভাবতে ভাবতে এগিয়ে গেলেন স্বামীর ঘরে। বললেন, কী হয়েছে তোমার? এভাবে ডাকলে যে! মুহিত সাহেব বললেন, আমার এ শহুরে জীবন আর ভালো লাগছে না। চল গ্রামে ফিরে যাই। সঙ্গে সঙ্গে রেগে গেলেন শরিফা বেগম। মাঝে মাঝে কী হয় তোমার বলো তো? তোমার যেতে ইচ্ছে করছে তুমি যাও, আমি যাব না। এই বলে মিসেস মুহিত আবার সেই মিটিংয়ে যোগ দিলেন। মুহিত সাহেব এবার ছেলের ঘরে গেলেন। ছেলেকে বললেন একই কথা। ছেলে বলল, বাবা সামনে আমার পরীক্ষা, এখন তুমি এসব কী বলছ? মুহিত সাহেবের মেয়ে বলল, বাবা আমি এই শহরে জন্মেছি, এখানে বড় হয়েছি। আমি এ শহর ছেড়ে কোথাও যাব না। হতাশ হয়ে পড়লেন মুহিত সাহেব। অবশেষে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, কেউ না গেলেও তিনি একাই যাবেন। জীবনে বাকিটা সময় তিনি গ্রামেই কাটাবেন। এই চিন্তা থেকেই পরদিন সকালে রওয়ানা দিলেন। সঙ্গে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র। গ্রামের উদ্দেশ্যে বাসে চড়লেন। বাসে উঠে বসে পড়লেন নিজের নির্ধারিত সিটে। এরপর ধীরে ধীরে মনে পড়ল তাঁর সেই গ্রামের কথা। যে গ্রামে তিনি জন্মেছিলেন, বড় হয়েছেন, শৈশব কৈশোর পার করেছেন সেখানে একসময় তাঁর বাবা মা ছিলেন, দাদা দাদি ছিলেন। আজ তারা কেউ নেই। কিন্তু সেই গ্রাম তো আছে, গ্রামের মানুষ তো আছে। আর আছে গ্রামের শান্ত, স্নিগ্ধ, মায়াবী সেই প্রকৃতি। সে প্রকৃতিতে কেটেছে মুহিতের জীবনের সবচেয়ে স্বর্ণালী সময়। মুহিতের তখন মনে পড়ল গ্রামের মানুষের কথা। মুহিত যখন ঢাকায় পড়তে যাবেন, তখন গ্রামের লোকজন সবাই মিলে চাঁদা তুলে তাকে অর্থ দিয়েছিলেন। সেই অর্থে ঢাকায় পড়াশুনা করেছিলেন তিনি। তারপর চাকরির পিছনে হন্যে হয়ে না ঘুরে শুরু করেছেন ব্যবসায়। ঢাকার গুলিস্তানে ছোট একটি কাপড়ের দোকান দিয়েছিলেন। সততা, নিষ্ঠা ও পরিশ্রমের কারণে তিনি আজ ঢাকা শহরের সম্ভ্রান্ত মানুষদের একজন। এখন তার চারটি পোশাক কারখানা, দুটি বাড়ি, চারটি গাড়ি-সব মিলিয়ে মুহিত এখন অনেক ধনী। কিন্তু জীবনের দীর্ঘ সংগ্রাম আর ঢাকা শহরের ব্যস্তময় জীবন-যন্ত্রণা আর ভালো লাগে না তার। তাছাড়া যে গ্রাম তাকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার খোরাক জুগিয়েছে, সে গ্রামের প্রতিও তার কিছু দায়িত্ব আছে। সেই সঙ্গে নগর জীবনের যান্ত্রিকতা, কোলাহল, সময় ধরে চলা, কৃত্রিমতা সবকিছুতে তিনি একেবারে হাঁপিয়ে উঠছিলেন। এ কারণে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতেও তিনি যেতে চান জন্মস্থান রসুলপুর গ্রামে। এমন অনেক কথাই ভাবতে থাকেন তিনি। চোখের কোণে ভিড় করে অজস্র স্মৃতি। বাবা, মা, ভাই, বোন, বন্ধুদের স্মৃতি। স্মৃতিময় পুণ্যভূমিতে যাবেন তিনি। বেড়াতে নয়, জীবনের বাকিটা সময় সেই ভূমির অধিবাসীদের সঙ্গে একাত্মা হয়ে, তাদের সুখ দুঃখের অংশীদার হয়ে থাকতে। এসব ভাবতে ভাবতে এক সময় বাস থেমে যায়। তিনি নেমে পড়েন বাস থেকে। হাঁটতে থাকেন গ্রামের দিকে। গ্রামের ভেতরে ঢোকার সময় প্রথম ধাপ ফেলতেই তা হৃদয়ে দোলা দিয়ে ওঠে। তিনি মাটির দিকে একবার তাকালেন। দেখলেন, নিজের অজান্তে নিজেরই চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়েছে সেই মাটিতে।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post