মার্চের দিনগুলি

HSC : পৌরনীতি ও সুশাসন : ২য় সপ্তাহ : অ্যাসাইনমেন্ট : ২০২১

লাহোর প্রস্তাবের প্রেক্ষাপট হিসেবে বঙ্গভঙ্গ, মুসলিম লীগ এবং দ্বি-জাতি তত্ত্বের উপর একটি নিবন্ধ লিখ।

নমুনা সমাধান

লাহোর প্রস্তাবের প্রেক্ষাপট হিসেবে বঙ্গভঙ্গ, মুসলিম লীগ, দ্বিজাতিতত্ত্ব সম্পর্কে আমার স্ব লিখিত নিবন্ধ তুলে ধরা হলো:

বঙ্গভঙ্গ: বাংলা ও ব্রিটিশ ভারতে বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫-১৯১১)একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা মধ্যপ্রদেশ, ও আসামের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত ছিল বাংলা প্রদেশ বা প্রেসিডেন্সি, যার রাজধানী কলকাতা। এটি ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সর্ববৃহৎ প্রদেশ। শাসনকার্যের সুবিধার জন্য  ব্রিটিশ সরকার বাংলাবিভক্ত করণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। প্রকৃতপক্ষে ১৯০৩ সালে বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা গৃহীত হয়। এই ক্ষেত্রে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করে স্যার রাম্পফিল্ড ফুলার, স্যার এ্যান্ড্রু ফ্রেজার। ব্রিটিশ ভারতের বড় লার্ট লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালের ১লা সেপ্টেম্বর বাংলাকে ভাগ করেন। এতে ঢাকা, রাজশাহী, আসাম, জলপাইগুড়ি, ত্রিপুরা ও মালদহ নিয়ে গঠিত হয় "পূর্ব বাংলা ও আসাম" নামে নতুন প্রদেশ যার রাজধানী হয় ঢাকা। আর বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা নিয়ে গঠিত হত পশ্চিম বাংলা প্রদেশ, রাজধানী কলকাতা। 

বঙ্গভঙ্গের কারণ : বঙ্গভঙ্গের পেছনের বেশ কিছু বিশেষ কারণ ছিল। যথা-

(১) প্রশাসনিক কারণ : লর্ড কার্জনের শাসনামলে বঙ্গভঙ্গ ছিল একটি প্রশাসনিক সংস্কার।উপমহাদেশের এক-তৃতীয়াংশ লোকের বসবাস ছিল বাংলা প্রেসিডেন্সিতে। কলকাতা থেকে পূর্বাঞ্চলের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও শাসনকার্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা কঠিন ছিল। যার কারণে লর্ড কার্জন এত বড় অঞ্চলকে একটি বৃহৎ  প্রশাসনিক ইউনিটে রাখা যুক্তিসঙ্গত মনে করেননি। তাই ১৯০৩ সালে বাংলা প্রদেশকে ভাগকরার পরিকল্পনা করেন এবং ১৯০৫সালে তা কার্যকর করেন।

(২) রাজনৈতিক কারণ : লর্ড কার্জন শুধু শাসন কার্যের সুবিধার জন্য বা পূর্ব বাংলার মানুষের কল্যাণের কথা বিবেচনা করে বঙ্গভঙ্গ করেননি। তার এই সিদ্ধান্তের সাথে সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক স্বার্থ জড়িত ছিল। তিনিও পূর্ব বাংলার রাজনীতি নিয়ে অবগত ছিলেন। বাঙালী মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবি শ্রেণি ক্রমশ জাতীয়তাবাদ রাজনীতি নিয়ে সচেতন হয়ে উঠছিল। কংগ্রেস নেতারা কলকাতায় বসে সারাদেশে দেশের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতেন। সুতরাং কলকাতাকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থামিয়ে দেওয়াই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। হিন্দু মুসলিম সম্মিলিত শক্তি, ঐক্যবদ্ধ বাংলা ছিল ব্রিটিশ শাসনের জন্য বিপদজনক। এভাবেই লর্ড কার্জন "বিভেদ ও শাসন" নীতি প্রয়োগ করে যতটা না পূর্ব বাংলার কল্যাণে তার চেয়ে বেশি ব্রিটিশ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে বাংলা ভাগ করেন।

(৩) আর্থ-সামাজিক কারণ : তৎকালীন সময়ে কলকাতা হয়ে উঠেছিল আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র। শিল্প, কারখানা, ব্যবসায় বাণিজ্য, অফিস আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবকিছুই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কলকাতাকে ঘিরে। ফলে বাংলার উন্নতি ব্যাহত হয়। কলকাতার অর্থনীতি ছিল হিন্দু সম্প্রদায় নির্ভর। যার কারণে হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দেখা দেয়। তাছাড়া পূর্ব বাংলা থেকে যে কাঁচামাল সরবরাহ করা হতো তার জন্য সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিলনা ফলে সেখানের অর্থনীতি আরো খারাপ হতে থাকে। পর্যাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকায় পূর্ববাংলার জনগণ অশিক্ষিত থেকে যায়। বেকারের সংখ্যা দিনদিন বাড়তে থাকে। তাই মুসলিম সম্প্রদায় বাংলাকে ভাগ করার পক্ষে ছিল।

মূলত বঙ্গভঙ্গের পেছনে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কারণই ছিল মূখ্য।

বঙ্গভঙ্গের ফলাফল : বঙ্গভঙ্গের কারণে বাংলার মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখাদেয়। পূর্ব বাংলার মুসলমানরা নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে বঙ্গভঙ্গকে স্বাগত জানায়। পূর্ব বাংলা প্রদেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ অংশ ছিল মুসলমান। আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে রাজধানী ঢাকায়। নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা বাণিজ্য, শিল্পকারখানা স্থাপন করা হয়। বঙ্গভঙ্গের পর থেকে হিন্দু -মুসলমানের সম্পর্কে ফাটল ধরে। এরপর থেকেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রপাত। এরই প্রেক্ষিতে এলিট মুসলিম সমাজ ১৯০৬সালে মুসলিম লিগ গঠন করে। যার ফলে হিন্দু মুসলমানদের রাজনৈতিক পথ আলাদা হয়ে যায়। মুসলমানদের জন্য ক্রমশ স্বতন্ত্র জাতি-চিন্তা তীব্র হতে থাকে। অন্যদিকে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। তারা এই ভাগ   মেনে নিতে পারেনি। তারা আশাঙ্কা করলেন মুসলিম সাম্রাজ্যের উপর তাদের আধিপত্য হারানোর, ব্যবসায়িক ক্ষতির। ফলে ইংরেজদের উদ্দেশ্য সার্থক হয়। হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়ে যায়। তাঁরা পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়।  

মুসলিমলীগের প্রেক্ষাপট :
নবাব সলিমুল্লাহ সুস্পষ্ট  পরিকল্পনা নিয়ে ঢাকা সম্মেলনের আহবান করেন। ভারতের সকল মুসলিম নেতাদের কাছে সম্মেলনের দাওয়াতপত্রের সাথে তার পরিকল্পনার খসড়া ও পাঠান। সম্মেলনের শেষে নবাবের শাহাবাগের বাগানবাড়িতে অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ সম্মেলন। নবাব সলিমুল্লাহের প্রস্তাবে নবাব ভিখারুল মুলুক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। বক্তৃতার একপর্যায়ে নবাব সলিমুল্লাহ বলেন, "প্রায় ১০ বছর আগে স্যার সৈয়দ আহমদ স্বতন্ত্র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশের মুসলমানদের বর্তমান সংকটজনক পরিস্থিতিতে সেরূপ একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। "এরপর সলিমুল্লাহ নিখীলভারত মুসলিম লীগ গঠনের প্রস্তাব করেন ও দিল্লির হাকিম আজমল খান ও লাহোরের জমিদার পত্রিকার সম্পাদক মাওলানা জাফর আলি খান প্রস্তাবটি সমর্থন করেন। ভোট দিলে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এভাবে ১৯০৬সালে ৩০শে ডিসেম্বর  প্রাজ্ঞ ও দূরদর্শী নবাব সলিমুল্লাহর প্রচেষ্টায় ঢাকায় গঠিত হয় মুসলিম বিশ্বের প্রথম রাজনৈতিক দল নিখীল ভারত মুসলিম লীগ। মুসলিম লীগ প্রতিষ্টা সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রফেসর ডা সিরাজুল ইসলাম তার বাংলার ইতিহাস উপনিবেশিক শাসন কাঠামো গ্রন্থে ২৬৪, ২৬৫ পৃষ্ঠায় বলেছেন সেদিনের মুসলিম নেতৃবৃন্দ নিজেদের সংগঠিত করে তোলার সময়পোযোগী প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন। বঙ্গভঙ্গের কয়েক মাসপরই মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। 

মুসলিম লীগের গুরুত্বঃ ব্রিটিশ সরকারের প্রতি মুসলমানদের আনুগত্য সুনিশ্চিত করা ও সরকারি ব্যবস্থা সম্পর্কে মুসলমানদের মনে কোনোরকম সন্দেহ সৃষ্টি করতে দেওয়া। মুসলমানদের রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করা। জাতীয় কংগ্রেসের প্রভাব প্রতিপত্তি খর্ব করা। মুসলিম লীগ ঘোষণা করে যে ভারতে হিন্দু মুসলিমদের মিত্রতা সম্ভব কিন্তু রাজনৈতিক মিত্রতা সম্ভব না।

দ্বি-জাতি তত্ত্ব : পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪০সালের জানুয়ারি মাসের একটি ইংরেজি পত্রিকায় দ্বি-জাতীয় তত্ত্ব নামে তার বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, "ভারতে দুটি জাতি রয়েছে এবং মাতৃভূমির শাসন ব্যবস্থায় উভয় জাতিকে অংশ গ্রহণ করতে হবে। তার দ্বি -জাতি তত্ত্ব আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। এক জাতি এক রাষ্ট্র নীতি উপর ভিত্তি করে তিনি দ্বি- জাতি তত্ত্বের বিশ্লেষণ করেন। ভারতের হিন্দু ও মুসলমান দুটি পৃথক জাতি ১৯৪০সালে লাহোরে যে পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হয় তা দ্বি জাতিতত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল।

লাহোর প্রস্তাবের বৈশিষ্ট্য :
১) ভারতের উত্তর পশ্চিম ও পূর্ব ভূ-ভাগের মুসলমান সংখ্যা গরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোকে স্বাধীন রাষ্ট্র সমূহ গঠন করতে হবে।

২)এসব স্বাধীন রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট অঙ্গ রাষ্ট্রগুলো স্বায়িত্ত শাসিত ও সার্বভৌম হবে।

৩)সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাথে পরামর্শ করে তাদের সব অধিকার ও স্বার্থরক্ষার জন্য সংবিধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রাখতে হবে।

৪)প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, যোগাযোগ ইত্যাদি বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অঙ্গরাজ্যগুলোর হাতে ন্যস্ত হতে থাকতে হবে।

লাহোর প্রস্তাবের গুরুত্ব : লাহোর প্রস্তাবের প্রতি কংগ্রেসে নেতাদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু এই প্রস্তাবে তীব্র নিন্দা করেন। তবে ঐতিহাসিক সত্য এইযে  লাহোর প্রস্তবের পর থেকে মুসলমান সম্প্রদায় নিজস্ব আলাদা রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতে থাকে। এই প্রস্তাবেত প্রেক্ষিতে ভারতের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক আন্দোলনে এক নতুন ধারার জন্ম হয়। সে অনুযায়ী মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা শুধু সময়ের হয়ে দাঁড়ায়। এরপর থেকে মুসলিম লীগ ও জিন্নাহর রাজনীতি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার দিকে ধাবিত হতে থাকে, যার শেষ পরিণতি ছিল ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসের দেশ ভাগ। দ্বি- জাতি তত্ত্বের বাস্তব পরিণতিতে ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ই আগস্ট ভারত নামে দুইটি রাষ্টের জন্ম দেয়।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post