৮ম শ্রেণি : অ্যাসাইনমেন্ট : হিন্দু ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা : ১ম সপ্তাহ : ২০২১

৮ম শ্রেণি এ্যাসাইনমেন্ট : হিন্দু ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা : সপ্তাহ ১

ঈশ্বর শব্দটির অর্থ হচ্ছে প্রভু। তিনি সর্বশক্তিমান। তিনি এক ও অদ্বিতীয়। তিনি নিরাকার, শাশ্বত ও নিত্য এবং অবিনশ্বর। তিনি শৃঙ্খলার সঙ্গে এই জীব জগৎকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। সকল শক্তি ও গুণের তিনিই আধার। তিনি সৃষ্টি, স্থিতি ও পালনের একমাত্র কর্তা। তাঁর আদি নেই, তাই তিনি অনাদি। তাঁর অন্ত নেই, তাই তিন অনন্ত। দেব দেবীরা তাঁরই গুণ বা শক্তির প্রতিভূ। ঈশ্বর যখন নিরাকার, তখন তিনি ব্রহ্ম। আবার তিনিই ভগবান এবং জীবের মধ্যে আত্মারূপে অবস্থান করেন। তিনি সর্বব্যাপী, সকল জীবের আত্ম, সকল কাজের কর্তা এবং সকল জীবের আবাস্থল। জ্ঞানী, যোগী ও ভক্তগণ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে ঈশ্বরের আরাধনা করেন। চিরশান্তি বা মোক্ষ লাভের জন্য ভক্ত ঈশ্বরের কাছে স্তুতি করেন এবং তাঁর কাছে প্রার্থণা জানান। ঋষিরা ঈশ্বরকে ব্রহ্ম বা পরমাত্মা, ভগবান ও আত্মা বা জীবাত্মারূপে উপলব্ধি করেছেন। তবে সকল সাধকের মূল উদ্দেশ্যই পরম পরুষকে পাওয়া।

আমার পরিচিত চেনা-শোনা ৩ জন সাধকের নাম হচ্ছে প্রলয় মুখার্জী, গীতা দেবী, এবং কমলা দেবী।

ঈশ্বরকে যিনি জ্ঞানের মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করেন তিনিই জ্ঞানী। যাঁরা সকল বিষয় বাসনা পরিত্যাগ করে কেবল সর্বব্যাপী ও নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা করেন এবং ব্রহ্মেই সন্তুষ্ট থাকেন, তাদের জ্ঞানী বলা হয়। জ্ঞানীদের কাছে ঈশ্বরই ব্রহ্ম, যিনি এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। জ্ঞানী ব্যক্তিরা মানুষের জন্য, জীবের জন্য এবং ঈশ্বরের ভালবাসা লাভের জন্য কাজ করেন। জ্ঞানযোগে তাঁরা এসব করেন। জ্ঞান অর্থ জানা যোগ অর্থ যুক্ত হওয়া। তাই জ্ঞানী শব্দের অর্থ দাঁড়ায় কোনো বিষয় সম্পর্কে জানার জন্য যুক্ত যিনি।

প্রলয় মুখার্জী প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে গীতা পাঠ করেন এবং এর মাধ্যমে তিনি ঈশ্বরের আরাধনা করেন। বস্তুত গীতা পাঠের মাধ্যমে তিনি নিরাকার ঈশ্বর সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারেন। তিনি জীবের জন্য, মানুষের জন্য এবং ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের জন্য কাজ করেন। তাই প্রলয় মুখার্জীর এসব কর্মকাণ্ড জ্ঞানীর দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। এ কারণে তাঁকে জ্ঞানী বলা যায়।

ধর্মপাল ও ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের জন্য গীতায় বিভিন্ন পথের কথা বলা হয়েছে। ঈশ্বর লাভের এ সকল পথকে যোগসাধনা বলে। যাঁরা আত্মার উপাসনা করেন এবং যোগসাধনার সঙ্গে সম্পৃক্ত হন, তাদের যোগী বলে। আবার, যাঁরা একাগ্রতা সহকারে মনের অন্তঃস্থল থেকে ঈশ্বরের অনুসন্ধান করেন, সকল কামনা-বাসনা দূর করতে-সমর্থ হন, তাঁদের যোগী বলা হয়। এঁদের মূখ্য উদ্দেশ্য ঈশ্বর লাভ। যোগীদের নিকট ঈশ্বর পরমাত্মা। এই পরমাত্মাই জীবাত্মারূপে জীবের মধ্যে অবস্থান করেন। তাই যোগীর কাছে জীবও ঈশ্বর। মহাযোগী ও মহাজ্ঞানী স্বামী বিবেকানন্দ এই মহাবিশ্বের সকল কিছুকেই বহুরূপে ঈশ্বরের প্রকাশ বলে অভিহিত করেছেন।

জ্ঞানের দ্বারা ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হয়। সর্বভূতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব উপলব্ধ হয় এবং মুক্তির পথ প্রশস্থ হয়। ঈশ্বর সম্পর্কে তার অমর বাণী
অর্থাৎ জীবের সেবা করলেই ঈশ্বরের সেবা করা হয়। গীতা দেবী সকল বিষয় ত্যাগ করে সর্বব্যাপী নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা করেন। তিনি ঈশ্বরকে পরমাত্মা হিসেবে দেখেন এবং মনের অন্তঃস্থল থেকে ঈশ্বরের অনুসন্ধান করেন। তাঁর কাছে ঈশ্বর সকল জীবের মধ্যেই অবস্থান করেন। তাই বলা যায় গীতা দেবীর এসব ভাবনা যোগীর দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। এ কারণে তাঁকে যোগী বলা যায়।

যাঁরা ভক্তির মাধ্যমে ঈশ্বরের স্বরূপ উপলব্ধি করেন তাঁরা হলেন ভক্ত। যাঁরা সংসারের বিষয় ও বৈষয়িক কর্মের মধ্যে থেকে সর্বশক্তিমান ভগবানের উপাসনা করেন, তাঁদের ভক্ত বলা হয়। ভক্তেরা সর্বজীবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব উপলব্ধি করেন এবং সেইভাবেই জীবসেবার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের সেবা করেন। ভক্তের নিকট ঈশ্বর ভগবান। তিনি রসময়, আনন্দ ও গুণময়। ভক্ত ভগবানের নিকট নিজেকে সমর্পণ করেন। নিজের সকল কাজকে ভগবানে কাজ হিসেবে সম্পাদন করেন।

কমলা দেবী প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে স্নান শেষে মন্দিরে মূর্তি পূজার মাধ্যমে ঈশ্বরের আরাধনা করেন। তিনি মূর্তি পূজার মাধ্যমে দূর্গা দেবীর পূজা করেন। তাঁর ধারণা দেব দেবীরা ঈশ্বরেরই অংশ। তাই তিনি মনে করেন, মূর্তি পূজার মাধ্যমে ঈশ্বরেরই পূজা করা হয়। এভাবে তিনি মূর্তি পূজার মধ্য দিয়ে ভক্তি সহকারে ঈশ্বরের আরাধনা করেন। তাই বলা যায় কমলা দেবীর এসব ধ্যান ধারণা ভক্তের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। এ কারণেই তিনি ভক্ত।

ঈশ্বর বা ব্রহ্মের অপর নাম পরমাত্মা। এ পরমাত্মা জীবের মধ্যে অবস্থান করেন বলেই জীবের চেতনাশক্তি আছে। এই চেতনাই জীবাত্মা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবের মধ্যে আত্মারূপে নিরাকার ব্রহ্ম বা পরমাত্মার ক্রিয়াশীল থাকার বিষয়টি চমৎকারভাবে কবিতার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন।
“সীমার মাঝে, অসীম, তুমি বাজাও আপন সুর।
আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর।”
(গীতাঞ্জলী)
জীবের দেহের সীমার মধ্যে পরমাত্মা বা ঈশ্বর বিরাজ করেন। তাঁর ক্রিয়াশীলতার কারণেই আমাদের জীবন এত সুন্দর, এত মধুর। ঈশ্বরই অবতার। তিনি যখন দুষ্টের দমন করেন এবং ন্যায় নীতি প্রতিষ্ঠার জন্য পৃথিবীতে অবর্তীণ হন তখন তাকে অবতার বলে। যেমন মৎস, বরাহ, রাম ইত্যাদি। আবার ঈশ্বরের কোনো গণ বা শক্তি যখন আকার ধারণ করে, তখন তাঁকে দেবতা বা দেব দেবী বলে। যেমন শক্তির দেবী দুর্গা, বিদ্যার দেবী সরস্বতী ইত্যাদি।

উপরের আলোচনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ব্রহ্মই ঈশ্বর, ভগবান এবং জীবাত্মা। বিভিন্ন দেব দেবীরা ঈশ্বরেরই সাকার রূপ মাত্র। ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়। তাই প্রলয় মুখার্জী, গীতা দেবী এবং কমলা দেবীর সাধনার পথ পৃথক হলেও তাঁরা এক পরম পুরুষের বা ঈশ্বরেরই সাধনা করছেন। তাঁদের বিভিন্ন মত ও পথ থেকে আমরা এই শিক্ষাই পাই যে, ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান। তিনি সবকিছুই জানেন। তাই তিনি পরমাত্মাকে সুখী করেন, অপরাধীকে শাস্তি দেন এবং অদৃশ্যভাবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। আমরা যেখানেই থাকি, সেখানেই ঈশ্বর আছেন কল্পনা করে তাঁর সাধনা করা উচিত। তাহলেই কেবল আমাদের মুক্তির পথ প্রশস্থ হবে।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post