রচনা : নিরুদ্দেশ ভ্রমণ

ভ্রমণের নেশা সে তো দুর্দমনীয়। এই নেশা একবার যাকে পেয়ে বসেছে সেই জানে এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া কতটা কঠিন। সুপ্রাচীন কাল থেকেই মানুষ ভ্রমণ করে আসছে। ভ্রমণ সমৃদ্ধ করেছে আমাদের সাহিত্য ভাণ্ডার। সৃষ্টি হয়েছে প্রচুর কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ। 

আমার নিজের সব সময় ইচ্ছে করে বেরিয়ে পড়তে। গৃহবন্দী মন খাঁচায় আটকে থাকা পাখির মতো ছটফট করে। মনের ভেতরে মন অনবরত বলে- বেরিয়ে পড়। একদিন তাই কিছু না ভেবেই ঠিক করে ফেললাম, বেরিয়ে পড়ব। কোথায় যাব? সেই মনটা আবার বলল, বেরিয়ে পড়। ঠিক করলাম, এবার একটি নিরুদ্দেশ ভ্রমণেই বের হব। 

একা একা ভ্রমণে তো কোনো মজাই নেই। তাই বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করলাম। আমার পরিকল্পনার কথা জানাতেই চোখ বন্ধ করে দুপায়ে সবাই খাড়া। সবাই মিলে শুধু নিরুদ্দেশ ভ্রমণের একটা দিক ঠিক করলাম। সিদ্ধান্ত হলো, দক্ষিণ দিকেই বেরিয়ে পড়ব। পরদিন সকালে প্রত্যেকেই প্রয়োজনীয় কাপড়-চোপড় আর টাকাকড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম নিরুদ্দেশ ভ্রমণে। ট্রেনে যাব না বাসে যাব ঠিক করি নি। টিকেটও কাটি নি। নিরুদ্দেশ ভ্রমণে কি আর আগে থেকে টিকেট কাটা যায়? যাত্রার দিন সকালে আমরা কলাবাগান বাস টার্মিনালে হাজির। টিকেট কেটে নিলাম চট্টগ্রামের। শীতের সকাল। আমরা যাচ্ছি দক্ষিণে। যে দক্ষিণা বাতাস বসন্ত নিয়ে আসে ঠিক হলো, চট্টগ্রাম গিয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব। 

সকাল ৭টায় রাজধানী থেকে বাস ছাড়ল। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে বাস ছুটছে। দুপাশে ছায়াছবির মতো সরে সরে যাচ্ছে গ্রাম, সবুজ মাঠ, হাট-বাজার, শস্যখেত। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ফেরি পারাপারের যে ব্যবস্থা ছিল এখন আর তা নেই। দৃষ্টিনন্দন সেতু তৈরি হয়েছে নদীর উপর। শীতলক্ষা সেতু, মেঘনা-গোমতী সেতু, জাপান-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু। এক-একটা সেতু এক-এক রকম সৌন্দর্য ধারণ করে আছে। আমাদের বাস যখন মেঘনা-গোমতী সেতুর মাঝামাঝি পৌঁছল, তখন চারিদিকে অপূর্ব নয়নাভিরাম দৃশ্য; লাল, সাদা, নীল পাল উড়িয়ে অসংখ্য নৌকা ভেসে রয়েছে। 

দেখতে দেখতে কুমিল্লার সুয়াগাজীতে চলে এসেছি। বাস থামল। যাত্রা বিরতি। আমরা নেমে একটি খাবার স্টলে ঢুকে কিছু খেয়ে নিলাম। পনেরো মিনিট পর আবার বাস ছাড়ল। কখনো গান শুনছি, কখনো পাশের জনের সঙ্গে গল্প করছি, কখনো চুপচাপ বাইরের দৃশ্য দেখছি। কুমিল্লা ছাড়িয়ে ফেনীতে প্রবেশ করলাম, এটুকু মনে আছে। এরপর আর কিছু মনে নেই। কারণ, হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। প্রচণ্ড গরম আর চেঁচামেছিতে যখন ঘুম ভাঙল দেখি দু’দিক থেকে সারি সারি গাড়ি স্থির হয়ে আছে। অর্থাৎ জট। যানজটের কবলে পড়লাম। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, জায়গার নাম বড় দারোগার হাট। আমরা চট্টগ্রামের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। আর মাত্র ঘণ্টা খানেক পথ। ঘড়িতে বাজছে এখন সাড়ে এগারোটা। প্রায় দশ মিনিট হলো গাড়ি থেমে আছে। রাস্তার ওপর বাজার বসার কারণে জট লেগেছে। জানা গেল, বড় দারোগার হাট একটি বিখ্যাত তরকারির হাট। এখান থেকে টাটকা তরকারি দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ হয়। হাটের মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া মহাসড়কের ওপরেই ক্রেতা-বিক্রেতারা তাদের কেনাকাটা চালায়। তাই যানজট এখানে নৈমিত্তিক ব্যাপার। গাড়ি এক হাত আগায় তো পাঁচ মিনিট বসে থাকে। প্রায় এক ঘণ্টা পর গাড়ি ছাড়ল। গাড়ি আবার আস্তে আস্তে চলতে শুরু করল। 

গাড়ির গতি কিন্তু বাড়ছে না। যানজটের ফলে সৃষ্ট দীর্ঘ গাড়ির লাইনের কারণে গাড়ি চালাতে হচ্ছে খুবই ধীর গতিতে। ফলে বড় দারোগার হাট থেকে সীতাকুণ্ডে পৌঁছতে পাঁচ মিনিটের জায়গায় লাগল পনেরো মিনিট। সীতাকুণ্ডে এসে আবার জটে পড়লাম। বড় দারোগার হাটের জটের কারণে সীতাকুণ্ডেও দু’দিকে গাড়ির জট লেগে গেল। তখন দুপুর একটা। আমি সবার উদ্দেশ্যে বললাম, চল এখানেই নেমে পড়ি। ভ্রমণসঙ্গী কয়েকজন আপত্তি জানাল। আমি তাদের মনে করিয়ে দিলাম, এটা নিরুদ্দেশ ভ্রমণ। অগত্যা সবাই নামতে বাধ্য হলো। 

পেটে প্রচণ্ড খিদে। একটি হোটেলে ঢুকে সবাই দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম। কাছাকাছি গাছের ছায়ায় বসে নিলাম পরবর্তী সিদ্ধান্ত। সীতাকুণ্ডে যখন নেমেছি তখন বিখ্যাত চন্দ্রনাথ পাহাড় না দেখার প্রশ্নেই ওঠে না। কাছেই সবচেয়ে উঁচু যে পাহাড়টা সেটাই নিশ্চয় চন্দ্রনাথ পাহাড়। তবু একজন বয়স্ক লোককে জিজ্ঞাসা করতে তিনি চাঁটগেয়ে ভাষায় কী যেন বললেন, ঠিক বোঝা গেল না। আবার জিজ্ঞাসা করাতে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন পাহাড়টা। হ্যাঁ, আমাদের অনুমানই ঠিক। আমরা হাঁটতে থাকলাম পাহাড়ের দিকে। কিছুক্ষণ হাঁটার পর চোখে পড়ল সীতাকুণ্ড কলেজ। তারপর যতই সামনে এগোচ্ছি ততই ডানে বামে দেখছি ধর্মীয় গুরুদের স্মৃতি বিজড়িত নানা গাছ, সৌধ, ঘর প্রভৃতি। যেমন, স্বামী বিবেকানন্দ যে গাছটির নিচে বসে সভা করেছিলেন, সেই গাছটি অত্যন্ত যত্নের সাথে রক্ষিত। গাছের গোড়ায় খুব সুন্দর করে বেধি তৈরি করা হয়েছে। 

হাঁটতে হাঁটতে আমরা পাহাড়ের গোড়ায় এসে গেছি। প্রশস্ত একটি সিঁড়ি উঠে গেছে পাহাড়ের ওপর। সেই সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকলাম। একসময় দেখলাম সিঁড়ির ডানপাশে বেশ নিচে একটি ঘর। ঘরটির গায়ে লেখা আছে ‘সীতার বিশ্রামাগার, দর্শন করুন।’ পাশেই একটি মৃত পাহাড়ি ঝরণা। ঝরণার পাশে একটি কুপ। দেখেই অনুমান করা যায় ঝরণা থেকে কূপে পানি প্রবেশের ব্যবস্থা ছিল। কূপের গায়ে লেখা, ‘সীতার স্নানের কুণ্ড।’ জনশ্রুতি আছে, সীতার এই স্নানের কুণ্ড থেকেই ‘সীতাকুণ্ড’ নামের উৎপত্তি। 

সিঁড়িপথ ধরে আর কিছু দূর উঠতেই একটি বাড়ি চোখে পড়ল। সেখানে লোকও আছে দেখছি। জানা গেল, এটি উপাসনালয়। এখানে পানি ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে দেখলাম। চন্দ্রনাথ পাহাড়ের কেয়ারটেনারও এখানেই থাকেন। উপাসনালয়টির ভিতর দিয়ে সিঁড়িপথ উপরের দিকে চলে গেছে। এবার যে সিঁড়িগুলো পেলাম সেগুলো অত্যন্ত খাড়া। এতটাই খাড়া যে দেখে মনে হবে শুন্যে ভুলছে। নিচের দিকে তাকালে মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। আরো উপরে উঠে একটি ঝরণা দেখলাম। ঝরণার স্বচ্ছ জল দেখে হঠাৎ করে শরীরে ক্লান্তি এসে গেল। ইচ্ছে হলো এই জলে অবগান করে ঝরণার পাশেই ঘুমিয়ে পড়ি। খুব আয়েশ করে ঝরণার পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে আজলা ভরে সেই মিষ্টি পানি পান করলাম। 

পাহাড়ের চূড়ায চন্দ্রনাথ মন্দির, হিন্দুদের তীর্থস্থান। সেখানে একটানা ওঠা সম্ভব নয়। বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে উঠতে হচ্ছে। যতই উপরে উঠছি ততই নিচের বাড়ি-ঘর, গ্রাম, খেত-খামার আকারে ছোট হয়ে আসছে। এক সময় চূড়ায় উঠে গেলাম। সমতল ভূমি থেকে চূড়াটি কত উপরে তা না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। সেখানে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল এক অপার সৌন্দর্য। চূড়ায় দাঁড়িয়ে আশে-পাশের পাহাড়গুলোর দিকে তাকালে সেগুলোকে সমতল ভূমি বলে মনে হয়। আর সমতল ভূমির দিকে তাকালে মনে হয় ছোপ ছোপ সবুজের দাগ। যেন পটে আঁকা কোনো ছবি। পাহাড় থেকে যে সমুদ্রের দূরত্ব প্রায় দশ কিলোমিটার, মনে হচ্ছে এক লাফেই সেই সমুদ্রে চলে যাওয়া যাবে। দূরে সমুদ্রের মধ্যে দেখা গেল একটি কালো রেখা। পরে জেনেছি সেটাই না কি সন্দ্বীপ। দূরে দূরে সমতল ভূমি আর পাহাড়। পাহাড়ের কাফেলা চলে গেছে অনেক দূর পর্যন্ত। পশ্চিম দিকে ছাড়া আর সবটাই সবুজে মোড়া। পশ্চিমে সাগরের অপূর্ব সৌন্দর্য। এসবের সাথে পড়ন্ত বিকেলের ডুবন্ত লাল টকটকে সূর্য। সব মিলিয়ে এক অপার্থিব সৌন্দর্যে আমরা সবাই নির্বাক বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়লাম। 

সীতাকুণ্ড পাহাড় থেকে যখন নেমে এলাম তখন সন্ধ্যা গাঢ় হয়ে এসেছে। আবার একটা বাস ধরে সোজা চাটগাঁ শহর। সাধারণ গোছের একটা আবাসিক হোটেলে খেয়ে-দেয়ে কাটিয়ে দিলাম রাত। পরদিন সকালে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত ঘুরে, ঝটপট সেরে নিলাম ফয়েস লেক দেখা। সেদিনই ঢাকায় ফিরতে হবে। সামনে পরীক্ষা। বাড়ি থেকে কেবল একদিনের ছুটি নিয়ে এসেছি আমরা। 

নিরুদ্দেশ ভ্রমণ হলেও মনে মনে একটু ইচ্ছে ছিল কক্সবাজার যাবার। অথচ দেখা হয়ে গেল সীতাকুণ্ড, চন্দ্রনাথ পাহাড়। নিরুদ্দেশ ভ্রমণ সার্থক হলো, যথার্থ হলো।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post