রচনা : বাংলাদেশের শেয়ার বাজার

সূচনা : একটি বাজারভিত্তিক অর্থনীতিতে শুধুমাত্রই ব্যাংক ঋণ শিল্পায়নের জন্য প্রধান নয়। প্রথাগত আচারে ব্যাংক ঋণ দেয় স্বল্পমেয়াদে। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যিকভিত্তিক কোম্পানিগুলোর দীর্ঘমেয়াদী ঋণের প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রেই শেয়ার বাজারের গুরুত্ব। দীর্ঘমেয়াদী অর্থ সংগ্রহের জন্যই শেয়ার বাজার বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত। মুক্তবাজার অর্থনীতির যে-কোন দেশে শেয়ার বাজার গত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশে এ ঐতিহ্য মাত্র কয়েক দিনের। তবে অগ্রগতি যে হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই, কেননা প্রায় ৪০ বছর পর ইতোমধ্যে চট্টগ্রামে আরেকটি স্টক এক্সচেঞ্জ কাজ শুরু করেছে। নিঃসন্দেহে এটি আমাদের অর্থনীতির জন্য মাইলফলক।

শেয়ার বাজারে কী হয় : একটি কোম্পানির উদ্যোক্তারা শেয়ার বাজারে শেয়ার ছেড়ে অর্থ সংগ্রহ করে। তাই এক্ষেত্রে কিছু শর্ত থাকে।
১. কোম্পানিকে একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত করতে হবে;
২. আয়-ব্যয়ের হিসাব কোন চাটার্ড একানউন্টিং ফার্ম কর্তৃক নিরীক্ষিত হতে হবে;
৩. স্থিতিপত্র, আয়-ব্যয় হিসাব পুঁঞ্জি নিয়ন্ত্রক অফিসে পেশ করতে হবে;
৪. কোম্পানির প্রসপেক্টাস সিকিউরিটিজ এই এক্সচেঞ্জ কমিশনে পাস করিয়ে নিতে হবে;
৫. কোম্পানিতে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান ঋণ দিয়েছে সেগুলো থেকে ছাড়পত্র নিতে হবে এবং দেশের প্রধান শেয়ার বাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের তালিকাভুক্ত হতে হবে।

সুতরাং সহজেই বলা চলে, শিল্পোয়নের অপরিহার্য শর্ত পুঁজি আর সেজন্য বহু ও সিকিউরিটির মাধ্যমে যে কাজ চলে সাধারণত সেটাই শেয়ার বাজার। শেয়ার সাধারণত দুই প্রকার– “সাধারণ শেয়ার এবং ‘প্রেফারেন্স শেয়ার’। প্রেফারেন্স শেয়ারের ধারকরা নির্দিষ্ট হারে ডিভিডেন্ট পায়, ফলে ঝুঁকি কম। আর সাধারণ শেয়ারের ধারকরাও ডিভিডেন্ট পায়, তবে প্রেফারেন্স শেয়ার ধারকদের দেবার পর। সুতরাং সভাবতই তা ঝুঁকিপূর্ণ।

প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয় এখানে শেয়ার বাজার দু’রকমের– প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি। যে শেয়ার প্রথম বাজারে ছাড়ে তাই প্রাথমিক ইস্যু; এটি সাধারণত ব্যাংকের মত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোই সম্পন্ন করে। প্রাথমিক ইস্যুর পর বিনিয়োগকারী যখন তা বিক্রয় করে নগদ অর্থ গ্রহণ করে তখন সেকেন্ডারি বাজার। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ মূলত সেকেণ্ডারি বাজারে শেয়ার হস্তান্তর করে। শেয়ার বাজারে প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে এর দরদাম স্থির হয়। বিড ও অফারের ভিত্তিতে বাজারে এর মূল্য নির্ধারিত হয়। এটি সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে ব্রোকারদের উপর। ব্রোকাররা ব্রোকারেজ ফার্মের শেয়ার প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়। এরাই ‘বুলস’ বিয়ারস স্ট্যাগস-এর ট্রেডগুলো নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সাম্প্রতিককালে শেয়ার বাজারে ধস নামার প্রধান কারণ এই ব্রোকাবরা। এর পাশাপাশি সরকারের কতিপয় আকস্মিক পদক্ষেপ গ্রহণ, কোটিপতিদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব কিংবা শেয়ার মঞ্জুদকরণ, টাউট-বাটপাড়দের সাথে ব্রোকারদের সম্পৃক্ততা,রাজনৈতিক দলের বিরূপ মন্তব্য ইত্যাদি। এক্ষেত্রে সুস্থ ও স্বাভাবিক কর্ম পরিকল্পনার নিরিখে ব্রোকারদের উপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা প্রয়োজন। আবাশীল ও ঝামেলামুক্ত ব্রোকাররাই শেয়ার বাজার চাঙ্গা রাখতে পারে।

শেয়ার বাজারে অর্থ বিনিয়োগ : শেয়ার বাজারে অর্থ বিনিয়োগের পূর্বে কিছু তথ্য জানা প্রয়োজন। কারণ সঠিক বিনিয়োগের সিদ্ধান্তের উপরই লাভ-ক্ষতির প্রশ্ন। ব্রোকার বিনিয়োগকারীকে নানাভাবে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু সচরাচর তা ঘটে না। অনেক ক্ষেত্রে ব্রোকারদের কপটতায় বিনিয়োগকারীরা সর্বস্ব হারিয়ে মাথা চাপড়ান। এক্ষেত্রে অত্যন্ত সচেতনভাবে সঠিক বিনিয়োগ করতে হয়। এজনা প্রসপেক্টাস পড়ার পাশাপাশি কোম্পানি সম্পর্কে সচেতন নজর রাখা আবশ্যক। প্রসপেক্টাসে উল্লেখিত বিষয় যেমন ইস্যুকৃত শেয়ার বা ডিবেঞ্চারের সংখ্যা ও বরাদ্দের কোটা, কোম্পানি কি কাজে এ অর্থ খাটাবে, অর্থ ব্যবহারের আর্থিক ও ভৌত পরিকল্পনা, প্রিমিয়াম শেয়ারের যৌক্তিকতা, শিল্প ইউনিটের ক্ষমতা এবং এর উৎপাদিত পণ্য, কাঁচামাল ও উৎপাদিত পণ্যের অনুপাত, এসবসহ প্রকল্পের বর্ণনা, প্রকৃত আর্থিক অবস্থা, ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি ভালোভাবে দেখা দরকার। আর পুরনো কোম্পানির ক্ষেত্রে লভ্যাংশ মুনাফা, পণ্যের বাজার চাহিদা, পণ্যের ধরণ ইত্যাদি সনাক্ত করা প্রয়োজন। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আরেকটি শরীক বিদেশিরা। বাংলাদেশের গত দদি দেশগুলোর জন্য বিদেশী বিনিয়োগ একটি বড় ভরসা। শেয়ার বাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উপর একটা কোটা নির্ধারণ থাকে। তবে এটি নির্ভর করে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সরকারের গৃহীত নীতি পদ্ধতির উপর।

শেয়ার মূল্য উঠানামার কারণ : এর মূল্যসূচক উঠানামা করবেই। এটি একটি স্বাভাবিক ঘটনা। এক্ষেত্রে কতকগুলো ফ্যাক্টর কাজ করে, যেমন— কোম্পানির শেয়ার আয়তন, কোম্পানির শেয়ারের চাহিদা, কোম্পানির অতীত রেকর্ড ও ভবিষ্যতের লভ্যাংশ বোনাস ব্য শেয়ার ইস্যুর সম্ভাবনা, কোম্পানির মুনাফা অর্জনের ক্ষমতা ইত্যাদি। উন্নত বিশ্বের শেয়ার বাজার রাজনীতি ও অর্থনীতির সাথে জড়িত। আমাদের দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাই মূল্যসূচক নেমে যাবার প্রধান কারণ। এ ছাড়া অর্থনৈতিক স্থবিরতা, হঠাৎ করে ‘লক ইন’ প্রথার প্রবর্তন প্রভৃতির কারণে বাজার মন্দা অনুভূত হয়। এছাড়া ব্রোকারদের সৃষ্টি কৃত্রিম চাহিদাও শেয়ারের মূল্য বৃদ্ধিতে কাজ করে।

উপসংহার : আমাদের অর্থনৈতিক অবকাঠামো ফলপ্রসূ নহে। তাছাড়া অর্থলগ্নিকরণেও যথাযথ নিরাপত্তা নেই, নেই কোন গৃহীত পদক্ষেপ। অর্থনীতিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির ফলেই দেশের অর্থনীতি ত্বরান্বিত হয়। দেশে নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠার ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে, কর্মসংস্থানের যোগান বাড়ছে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে সন্দেহ নেই। কিন্তু এক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতাদের অধিকতর সচেতন থাকা প্রয়োজন। কারণ শেয়ার বাজার শক্তিশালী হলে এবং ৫.শের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ব্যহত করণে বিদেশী বিনিয়োগের একটা বড় অংশকে নিজেদের দিকে টানা সম্ভব।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post