সারমর্ম - (৫১ থেকে ১০০)

সারমর্ম (১ থেকে ৫০)
সারমর্ম (৫১ থেকে ১০০)
সারমর্ম (১০১ থেকে ১৫০)
সারমর্ম (১৫১ থেকে ২০০)


৫১
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই ছোট সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি
শ্রাবণ গগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।
সারমর্ম : মহাকালের প্রতীক তরীতে কেবল সোনার ফসলরূপ মহৎ সৃষ্টিকর্মের স্থান হয়। কিন্তু ব্যক্তিসত্তাকে অনিবার্যভাবে হতে হয় মহাকালের নিষ্ঠুর করাল গ্রাসের শিকার। অর্থাৎ এ নশ্বর পৃথিবীতে মহৎ কর্মের স্থান হলেও ব্যক্তি মানুষের স্থান নেই।

৫২
তব কাছে এই মোর শেষ নিবেদন-
সকল ক্ষমতা মম করহ ছেদন
দৃঢ় বলে, অন্তরের অন্তর হইতে
প্রভু মোর! বীর্য দেহ সুখেরে সহিতে
সুখেরে কঠিন করি। বীর্য দেহ দুখে
যাহে দুঃখ আপনারে শান্তস্মিত মুখে
পারি উপেক্ষিতে। ভকতিরে বীর্য দেহ
কর্মে যাহে হয় সে সফল, প্রীতি স্নেহ
পুণ্যে উঠে ফুটে। বীর্য দেহ ক্ষুদ্র জনে
না করিতে হীন জ্ঞান, বলের চরণে
না লুটিতে। বীর্য দেহ চিত্তেরে একাকী
প্রত্যহের তুচ্ছতার উর্ধ্বে দিতে রাখি।
বীর্য দেহ তোমার চরণে পাতি শির
অহর্নিশি আপনারে রাখিবারে স্থির।
সারমর্ম : ত্যাগ ও সহিষ্ণুতার মধ্যেই মানুষের প্রকৃত মনুষ্যত্ব ফুটে ওঠে। বৃক্ষ যেভাবে অপরের সুখের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেয়, মানুষের মনোভাব সেরূপ হতে হবে। এ জন্য কেউ আঘাত করলে আমরা যেন আঘাতকারীর প্রতি ক্রুদ্ধ না হই। এই মানবিক গুণাবলিকেই মানবজীবনের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।

৫৩
তারপর এই শূন্য জীবনে যত কাটিয়াছি পাড়ি
যেখানে যাহারে জড়ায়ে ধরেছি সেই চলে গেছে ছাড়ি।
শত কাফনের, শত কবরের অঙ্ক হৃদয়ে আঁকি,
গণিয়া গণিয়া ভুল করে গণি সারা দিনরাত জাগি।
এই মোর হাতে কোদাল ধরি কঠিন মাটির তলে,
গাড়িয়া দিয়াছি কত সোনামুখ নাওয়ায়ে চোখের জলে।
মাটিরে আমি যে বড় ভালবাসি, মাটিতে মিশায়ে বুক,
আয়-আয় দাদু, গলাগলি ধরি কেঁদে যদি হয় সুখ।
সারমর্ম : প্রিয়জন হারানোর যে ব্যথা তা প্রতিটি মানুষের জন্যই অত্যন্ত দুর্বিষহ। এই ব্যথা তার জন্য আরো বেশি তীব্র আরো বেশি মর্মান্তিক যার একাধিক স্বজন চলে গেছে না ফেরার দেশে এবং তাদের তিনি নিজ হাতে কবরে শুইয়ে দিয়েছেন। তাই মাটিই তার পরম ভালোবাসার স্থান। স্বজন হারানোর ব্যথায় শোকার্ত মানুষ তাই জীবিতদের আঁকড়ে ধরে দুঃখকে প্রশমিত করতে চান।

৫৪
তোমার ন্যায়ের দন্ড- প্রত্যেকের করে
অর্পণ করেছ নিজে, প্রত্যেকের পরে
দিয়েছ শাসনভার হে রাজাধিরাজ।
সে গুরু সম্মান তব, সে দুরূহ কাজ
নমিয়া তোমারে যেন শিরোধার্য করি
সবিনয়ে, তব কাজে যেন নাহি ডরি
কভু কারে।
সারমর্ম : ন্যায় এবং সত্যের ধারক পরম করুণাময় স্রষ্টা প্রতিটি মানুষের মধ্যেই সঞ্চারিত করেছেন ন্যায়-অন্যায় বোধ, বিবেকবোধ আর শাসন করার ক্ষমতা। বিনীত ব্যক্তি স্রষ্টা প্রদত্ত শক্তি এবং ক্ষমতা নির্ভীকচিত্তে, সঠিকভাবে প্রযোগ করতে চান। আর এ জন্য তিনি স্রষ্টার কৃপা প্রার্থনা করেন।

৫৫
তোমার মাপে হয়নি সবাই
তুমিও হওনি সবার মাপে
তুমি সর কারো ঠেলায়
কেউ-বা সরে তোমার চাপে।
তুমি ভেবে দেখতে গেলে
এমনি কিসের টানাটানি,
তেমন করে হাত বাড়ালে
সুখ পাওয়া যায় অনেকখানি।
আকাশ তবু সুনীল থাকে
মধুর ঠেকে ভোরের আলো
মরণ এলে হঠাৎ দেখি
মরার চেয়ে বাঁচাই ভালো।
যাহার লাগি চক্ষু বুঁজে
বহিয়ে দিলাম অশ্রুসাগর
তারে বাদ দিয়েও দেখি
বিশ্বভুবন মস্ত ডাগর।
সারমর্ম : পৃথিবীর কোনো মানুষই অর্থ-সম্পদ, মান মর্যাদায় সমান নয়। এই অমোঘ সত্য সবাইকে মানতে হবে, না হলে মানবজীবন দুঃখে পর্যবসিত হবে। জীবনে চলার পথে বহু বাধা-বিপত্তি মানবজীবনকে স্থবির করে দেয়। ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ, মঙ্গল-অমঙ্গল মানব অস্তিত্বের সঙ্গে বিদ্যমান। তাই যারা দুঃখ, অমঙ্গল, ব্যর্থতাকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে তাদের জীবনেই সার্থকতা নিহিত।

৫৬
তোমাদেরি মাঝে আসে মাঝে মাঝে রাজার দুলাল ছেলে,
পরের দুঃখে কেঁদে কেঁদে যায় শত সুখ পায়ে ঠেলে।
কবি-আরাধ্য প্রকৃতির মাঝে কোথা আছে এর জুড়ি?
অবিচারে মেঘ ঢালে জল, তাও সমুদ্র হতে চুরি।
সৃষ্টির সুখে মহাখুশি যারা তারা নর নহে, জড়;
যারা চিরদিন কেঁদে কাটাইল, তারাই শ্রেষ্ঠতর।
মিথ্যা প্রকৃতি, মিছে আনন্দ, তারাই শ্রেষ্ঠতর।
মিথ্যা প্রকৃতি, মিছে আনন্দ, মিথ্যা রঙ্গিন সুখ;
সত্য সত্য সহস্রগুণ সত্য জীবের সুখ।
সারমর্ম : আবহমানকাল ধরে পৃথিবীতে অনেক মহৎ ব্যক্তির আগমন ঘটেছে যারা মানব সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করেছেন। মানবকল্যাণের জন্য নিজের স্বার্থকে বলি দিয়ে পরার্থে জীবন বিলিয়ে দিয়েই তারা শান্তি পান। এ জন্য বলা হয়, পরের জন্য ত্যাগের মধ্যেই মানুষের প্রকৃত সুখ নিহিত। এ সত্য তারা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেন।

৫৭
তোমাতে আমার পিতা-পিতামহগণ
জন্মেছিলে একদিন আমারি মতন।
তোমারি এ বায়ুতাপে তাহাদের দেহ
পুষেছিলে পুষিতেছ আমায় যেমন।
জন্মভূমি জননী আমার যেথা তুমি
তাহাদেরও সেই রূপ তুমি মাতৃভূমি।
তোমারি কোড়েতে মোর পিতামহগণ
নিদ্রিত আছেন সুখে জীবলীলা শেষে।
তাদের শোণিত অস্থি সকলি এখন
তোমার দেহের সঙ্গে গিয়েছে মা মিশে।
তোমার ধূলিতে গড়া এ দেহ আমার
তোমাদের ধূলিতে কালে মিলাবে আবার।
সারমর্ম : আবহমান কাল ধরে পূর্বপুরুষগণ জন্ম ভূমির আলো বাতাসে বড় হয়ে আবার জন্মভূমির মাটিতেই মিশে গেছেন। তেমনি বর্তমান কালের মানুষও একদিন পূর্বপুরুষদের মতো জন্মভূমির মাটিতে বিলীন হয়ে যাবে। এজন্যই প্রতিটি দেশপ্রেমিক মানুষ জন্মভূমির প্রতি কৃতজ্ঞ।

৫৮
তোমার প্রেম যে বইতে পারি
এমন সাধ্য নাই।
এ সংসারে তোমার আমার
মাঝখানেতে তাই-
কৃপা করে রেখেছ, নাথ,
অনেক ব্যবধান-
দুঃখ-সুখের অনেক বেড়া
ধন জন-মান।
আড়াল থেকে ক্ষণে ক্ষণে
আভাসে দাও দেখা-
কালো মেঘের ফাঁকে ফাঁকে
রবির মৃদু রেখা।
শক্তি যারে দাও বহিতে
অসীম প্রেমের ভার
একেবারে সকল পর্দা
ঘুচায়ে দাও তার।
সারমর্ম : এ বিশ্বের সকল কিছু সৃষ্টি করেছেন মহান ¯স্রষ্টা। তিনি সবার মধ্যেই অবস্থান করেন। আকার-ইঙ্গিতে তার পরিচয়ও দেন। কিন্তু ভক্তরা তা উপলব্ধি করতে পারে না। কারণ ধন, জন, মান বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এ জন্য ভক্ত প্রার্থনা করেন, আকার-ইঙ্গিতে নয় বরং সকল বাধাকে অতিক্রম করে তিনি যেন ভক্তের সম্মুখে নিজেকে প্রকাশ করেন।

৫৯
থাকো স্বর্গে, হাস্যমুখে-করো সুধা পান
দেবগণ। স্বর্গে তোমাদের সুখস্থান,
মোরা পরবাসী। মর্ত্যভূমি স্বর্গ নহে,
সে যে মাতৃভূমি-তাই তার চক্ষে বহে
অশ্রুজলধারা, যদি দু’দিনের পরে
কেহ তারে ছেড়ে যায় দু’ দন্ডের তরে।
যত ক্ষুদ্র, যত ক্ষীণ, যত অভাজন,
যত পাপীতাপী, মেলি ব্যগ্র আলিঙ্গন।
সবারে কোমল বক্ষে বাঁধিবারে চায়-
ধূলিমাখা তনুস্পর্শে হৃদয় জুড়ায়
জননীর। স্বর্গে তবে বহুক অমৃত,
মর্ত্যে থাক সুখে-দুঃখে অনন্ত মিশ্রিত
প্রেমধারা অশ্রুজলে চিরশ্যাম করি
ভূতলের স্বর্ণখন্ড-গুলি।
সারমর্ম : দেবতাদের বাসস্থান স্বর্গে রয়েছে অবারিত সুখ। অন্যদিকে পৃথিবীতে সুখ যেমন আছে তেমনি আছে দুঃখও। পৃথিবী তার সকল সন্তানকে প্রেম-ভালোবাসা আর স্নেহের বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। তাই স্বর্গ নয়, সুখ-দুঃখে ঘেরা মাতৃস্নেহ বিজড়িত এই সত্যলোকই মানুষের কাছে প্রিয়।

৬০
কোন ব্যথা নাহি পায়, তার দন্ডে দান
প্রবলের অত্যাচার। যে দ- বেদনা
পুত্ররে না পার দিতে, সে কারেও দিও না।
যে তোমার পুত্র নহে, তারও পিতা আছে,
মহাঅপরাধী হবে তুমি তার কাছে।
সারমর্ম : বিচারকের আসনে যিনি বসেন, সুষ্ঠু ন্যায় বিচার সম্পাদন করাই তার দায়িত্ব। দোষীকে শাস্তি দিয়ে সমাজে শান্তি ফিরিয়ে আনার মহান ব্রত তার। তবে শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে তাকে হতে হয় নিরপেক্ষ এবং সহানুভূতিশীল। যাকে শাস্তি প্রদান করা হলো তার দুঃখে যদি বিচারকের প্রাণ কাঁদে তবেই সে বিচার শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করে।

৬১
লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর,
হে নব সভ্যতা। হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,
দাও সেই তপোবন, পুণ্যছায়া রাশি,
গ্লানিহীন দিনগুলি, সেই সন্ধ্যাস্নান
সেই গোচারণ, সেই শান্ত সামগান,
নীবার-ধান্যের মুষ্ঠি বল্কল-বসন,
মগ্ন হয়ে আত্মমাঝে নিত্য আলোচন,
মহাতত্ত্বগুলি। পাষাণপিঞ্জরে তব,
নাহি চাহি নিরাপদে রাজভোগ নব।
চাই স্বাধীনতা, চাই পক্ষের বিস্তার
বক্ষে ফিরে পেতে চাই শক্তি আপনার;
পরানে স্পর্শিতে চাইছিড়িঁয়া বন্ধন,
অনন্ত এ জগতের হৃদয়স্পন্দন।
সারমর্ম : নাগরিক সভ্যতা কেড়ে নিয়েছে মানুষের অরণ্য লালিত স্নিগ্ধ জীবনকে। ভোগ, বাসনায় পরিপূর্ণ নগরে আধুনিক জীবনের সকল সুযোগ-সুবিধা থাকলেও নেই প্রাণের উচ্ছ্বাস। যান্ত্রিকতায় আবদ্ধ মানুষ হারিয়ে ফেলেছে মানবিকতা, সহমর্মিতা, জীবনের সৌন্দর্য। তাই মানুষ আজ সে আরণ্যক জীবন ফিরে পেতে চায়।

৬২
দুর্গম গিরি, কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুশিয়ার।
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ,
ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?
কে আছে জোয়ান হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যৎ।
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।
সারমর্ম : পৃথিবীতে শান্তি, সাম্য আর স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন এমন একজন তরুণ নেতার যে সঠিক পথে সকল মানুষকে চালিত করতে পারবে। এ পৃথিবীর পথ নানা প্রতিবন্ধকতায় পরিপূর্ণ। এই প্রতিকূল অবস্থায় মানুষ প্রতিনিয়ত পথ হারাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে মানুষকে উত্তরণের জন্য সমগ্র বিশ্বের হাল ধরবে যে সাহসী তরুণ, তাকেই এখানে আহ্বান করা হয়েছে।

৬৩
দুঃখী বলে, ‘বিধি নাই, নাহিক বিধাতা;
চক্রসম অন্ধ ধরা চলে।’
সুখী বলে,‘কোথা দুঃখ, অদৃষ্ট কোথায়?
ধরণী নরের পদতলে।’
জ্ঞানী বলে,-‘কার্য আছে, কারণ দুর্জ্ঞেয়;
এ জীবন প্রতীক্ষা কাতর।’
ভক্ত বলে,-‘ধরণীর মহারসে সদা
ক্রীড়ামত্ত রসিক শেখর।’
ঋষিবলে,-‘ধ্রুব তুমি, বরেণ্য ভূমান।’
কবি বলে,-‘তুমি শোভাময়।’
গৃহী আছি,-‘জীবনযুদ্ধে ডাকি হে কাতরে,
দয়াময় হও হে সদয়।’
সারমর্ম : বিচার বুদ্ধি, চিন্তা-চেতনা, মন মানসিকতায় পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ একে অপরের থেকে পৃথক। দুঃখী ব্যক্তির কাছে জীবন চির দুঃখময় আর সুখীর কাছে জীবন হলো চির সুখের। তেমনিভাবে জ্ঞানী তার কাজের দ্বারা, ভক্ত তার ভক্তি দ্বারা, ঋষি তার দর্শন দ্বারা জীবন ও জগৎকে বিচার বিশ্লেষণ করে থাকে। গৃহী মানুষ প্রতিনিয়ত জীবনযুুদ্ধে বিপর্যস্ত তাই সে স্রষ্টার কাছে করুণা প্রার্থনার মধ্য দিয়ে জীবনের অর্থ খুঁজে পায়।

৬৪
রুদ্ররূপে তীব্র দুঃখ যদি আসে নেমে,
বুক ফুলিয়ে দাঁড়াস।
আকাশ যদি বজ্র নিয়ে মাথায় পড়ে ভেঙে
র্ঊর্ধ্বে দু’হাত বাড়াস।
সারমর্ম : জীবনের চলার পথে দুঃখ, দারিদ্র্যের মতো নানা প্রতিবন্ধকতা এসে জীবনকে রুদ্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু তাতে ভয় পেয়ে ধৈর্য হারিয়ে ফেলা উচিত নয়। বরং সকল প্রতিকূল অবস্থাকে মোকাবেলা করার সাহস হৃদয়ে ধারণ করতে হবে।

৬৫
দ্যাখ, মানুষের কষ্ট থাকে না, হয় দিনে লোক খাঁটি
সোনার ফসল ফলায় যখন পায়ের তলার মাটি
মাটিরই যদি না এ হেন মূল্য মানুষের দাম নেই?
এই সংসারে এই সোজা কথা সব আগে বোঝা চাই।
বিশ্বপিতার মহাকারবার এই দিন দুনিয়াটা,
মানুষই তাহার মহামূল্যধন, কর্ম তাহার খাটা;
তাঁরি নাম নিয়ে খাটিবে যে জন, অন্ন তো তার মুখে,
বিধাতার এই সাচ্চা বাচ্চা কখনো পড়ে না দুঃখে।
তবে যে একথায় দেখিবারে পাই গরিবের দুর্গতি,
অর্থ তাহার- চেনা না সে তার শক্তির সংহতি।
সারমর্ম : এ পৃথিবীতে প্রকৃত খাঁটি মানুষ মাটিতেও সোনা ফলাতে পারে। সে পরিশ্রম ও মেধা দ্বারা সকল দুঃখ, কষ্টকে লাঘব করতে পারে। কর্মব্যস্ততাই জীবনকে সফল করে আর অলসতা জীবনকে ব্যর্থ করে।

৬৬
ধন্য আশা কুহকিনী। তোমার মায়া
অসার সংসার চক্র ঘোরে নিরবধি।
দাঁড়াইত স্থিরভাবে, চলিত না হায়
মন্ত্রবলে তুমি চক্র না ঘুরাতে যদি।
ভবিষ্যৎ অন্ধ, মূঢ় মানবসকল
ঘুরিতেছে কর্মক্ষেত্রে বর্তুল-আকার,
তব ইন্দ্রজালে মুগ্ধ, পেয়ে তব বল।
বুঝিছে জীবনযুদ্ধে হায় অনির্বার
নাচায় পুতুল যথা দক্ষ বাজিকরে
নাচাও তেমনি তুমি অর্বাচীন নরে।
সারমর্ম : জীবনে চলার পথে প্রতিটি ক্ষেত্রে আশা মানুষকে সঞ্জীবিত করে। আশা আছে বলেই মানুষ তার ভবিষ্যতকে না জেনেও সেই পথেই অগ্রসর হয়, বর্তমানকে সাদরে গ্রহণ করে। অর্থাৎ সংসারচক্রে আশাই মানুষের বেঁচে থাকার একমাত্র প্রেরণা।

৬৭
ধান করো, ধান হবে, ধুলোর সংসারে এই মাটি
তাতে যে যেমন ইচ্ছা খাটি।
বসে যদি থাক তবু আগাছায় ধরে কিছু ফুল
হলদে-নীল তারি মধ্যে, রুক্ষ মাটি তবু নয় ভুল
ভুল থেকে সরে সরে অন্য কোন নিয়মের চলা,
কিছু না কিছুর খেলা, থেমে নেই হওয়ার শৃঙ্খলা,
সৃষ্টি মাটি এত মত।
তাইতো আরও বেশি ভাবি
ফলাবো না কেন তবে আশ্চর্যের জীবনের দাবি।
সারমর্ম : জগৎ ও জীবন চলমান। চলমান এই জীবনে মানুষ নিজ খুশি মতো পরিশ্রম করে এবং তার ফল লাভ করে। পরিশ্রম না করলেও জীবন পৃথিবীর নিয়মে চলতে থাকবে। কিন্তু পরিশ্রম করাটাই বাঞ্ছনীয়। কারণ এর মাধ্যমেই জীবন সার্থক ও সুন্দর হয়ে ওঠে।

৬৮
ধুপ আপনারে মিলাইতে চাহে গন্ধে,
গন্ধ সে চাহে ধুপেরে রহিতে জুড়ে।
সুর আপনারে ধরা দিতে চাহে ছন্দে
ছন্দ ফিরিয়া ছুটে যেতে চায় সুরে।
ভাব পেতে চায় রূপের মাঝার অঙ্গ,
রূপ পেতে চায় ভাবের মাঝারে ছাড়া।
অসীম সে চাহে সীমার নিবিড় সঙ্গ,
সীমা চায় হতে অসীমের মাঝে হারা।
প্রলয়ে সৃজনে না জানি এ কার যুক্তি
ভাব হতে রূপে অবিরাম যাওয়া-আসা।
বন্ধ ফিরিছে খুঁজিয়া আপন মুক্তি,
মুক্তি মাগিছে বাঁধনের মাঝে বাসা।
সারমর্ম : পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত রূপ অরূপের লীলাখেলা চলছে। তাই সীমা অসীমের মাঝে হারিয়ে যেতে চায়, মূর্ত বিমূর্তের মাঝে মিশে যেতে চায়। অরূপ ঈশ্বর এবং রূপময় জগতের এই পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিনিয়ত চলমান।

৬৯
নর কহে ধূলিকণা, তোর জন্ম মিছে,
চিরকাল পড়ে রলি চরণের নিচে।
ধূলিকণা কহে, ভাই, কেন কর ঘৃণা?
তোমার দেহের আমি পরিণাম কিনা।
মেঘ বলে সিন্ধু তব জনম বিফল
পিপাসায় দিতে নার এক বিন্দু জল।
সিন্ধু বলে পিতৃনিন্দা কর কোন মুখে?
তুমিও অপেয় হবে পড়িলে এ বুকে।
সারমর্ম : মানুষ যখন নিচু অবস্থান থেকে উঁচু অবস্থানে উন্নীত হয় তখন সে স্বভাবতই ভুলে যায় তার অতীতকে। এ ধরনের মানুষ তার অতীতকে স্বীকার তো করেই না বরং নানাভাবে তাকে অবহেলা করে। সে ভুলে যায় তার আপন অস্তিÍত্বকে, আপন উত্থানের শক্তিকে। এ ধরনের মানসিকতা কোনো সমাজেই কাম্য নয়।

৭০
নমি আমি প্রতিজনে, আদ্বিজ চন্ডাল,
প্রভু, ক্রীতদাস।
সিন্ধুমূলে জলবিন্দু-বিশ্বমূলে অণু;
সমগ্রে প্রকাশ।
নমি কৃষি তন্তুজীবী স্থপতি, তক্ষক,
কর্ম, চর্মকার।
অদ্রিতলে শিলাখন্ড- দৃষ্টি অগোচরে
বহু অদ্রি-বার।
কত রাজ্য, কত রাজা গড়িছ নীরবে
হে পূজা, হে প্রিয়।
একত্বে বরেণ্য তুমি, শরণ্য এককে-
আত্মার আত্মীয়।
সারমর্ম : বিন্দু থেকেই সিন্ধুর সৃষ্টি। ঠিক তেমনিভাবে একটি সভ্যতা প্রতিটি শ্রেণি-পেশার মানুষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অবদানের সম্মিলনে গড়ে ওঠে। তাই কোনো মানুষকে ছোট ভাবা বা অস্বীকার করার উপায় নেই। এই মানবসমাজের প্রতিটি মানুষকে তাই সমানভাবে সম্মান, শ্রদ্ধা করতে হবে।

৭১
স্বর্ণ করে নিজ রূপে অপরে শোভিত,
বংশী করে নিজ সুরে অপরে মোহিত।
শস্য জন্মাইয়া নাহি খায় জলধরে
সাধুর ঐশ্বর্য শুধু পরহিত তরে।
সারমর্ম : তারাই মহৎ যারা অপরের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দেন। নদী, গাছপালা, মেঘ-বৃষ্টি, স্বর্ণ-রৌপ্য প্রভৃতি অপরের মঙ্গল সাধনের জন্য আত্মোৎসর্গ করে। যারা প্রকৃত ভালো মানুষ তারা এদের মতোই অপরের কল্যাণ কামনায়, অপরের সুখের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেন।

৭২
নদীতীরে মাটি কাটে সাজাইতে পাঁজা
পশ্চিমী মজুর। তাহাদেরি ছোট মেয়ে
ঘাটে করে আনাগোনা, কত ঘষামাজা।
ঘটি-বাঁটি-থালা লয়ে আসে ধেয়ে ধেয়ে।
দিবসে শতেক বার পিতল-কঙ্কণ
পিতলের থালি পড়ে বাজে ঠন ঠন।
বড় ব্যস্ত সারাদিন। তারি ছোট ভাই,
নেড়ামাথা, কাদামাথা, গায়ে বস্ত্র নাই,
পোষা পাখিটির মতো পিছে পিছে এসে
বসি থাকে উচ্চ পাড়ে দিদির আদেশে,
স্থির ধৈর্যভরে। ভরা ঘট লয়ে সাথে,
বাম কক্ষে থালি, যায় বালা ডানহাতে
ধরি শিশু কর। জননীর প্রতিনিধি,
কর্মভারে অবনত অতি ছোট দিদি।
সারমর্ম : কাজে কর্মে, স্নেহের বাঁধনে, শাসনের আবেষ্টনে প্রতিটি মেয়েই তার মায়ের প্রতিনিধি। সংসারের ছোট-বড় নানা কাজ সে মায়ের মতোই সয়ত্নে করার চেষ্টা করে। নিজের ছোট ভাইটিও তার মাতৃসুলভ স্নেহে সিক্ত। কেবল স্নেহ দিয়েই নয়, মায়ের মতো শাসন করেও সে তার ভাইটিকে তার সংস্পর্শে রাখে।

৭৩
নদী আর কালগতি একই সমান,
অস্থির প্রবাহ করে উভয়ে প্রয়াণ।
ধীরে ধীরে নীরব গমনে গত হয়;
কিবা ধনে, কিবা স্তবনে ক্ষণেক না রয়।
উভয়েই গত হলে আর নাহি ফিরে,
দুস্তর সাগর শেষে গ্রাসে উভয়েরে।
বিফলে বহে না নদী যথা নদী ভরা,
নানা শস্য শিরোরত্নে হাস্যময়ী ধরা।
কিন্তু কাল, সদাত্মা ক্ষেত্রে শোভাকর,
উপেক্ষায় রেখে যায় মরু ঘোরতর।
সারমর্ম : নদী এবং কাল নীরবে ধাবমান। নদী যেমন সাগরে পতিত হয় তেমনি কালও পতিত হয় মহাকালে। সেখান থেকে তাদের ফেরা কখনো সম্ভব নয়। নদী প্রবাহিত হওয়ার সময় শত বাধাকে উপেক্ষা করেও তার চারপাশকে শস্য-শ্যামল করে তোলে। কিন্তু সময়কে উপেক্ষা করলে মানুষ জীবনে কোনো কাজেই সফল হতে পারে না।

৭৪
নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো,
যুগ জনমের বন্ধু আমার আঁধার ঘরের আলো।
সবাই মোরে ছাড়তে পারে বন্ধু যারা আছে,
নিন্দুক সে ছায়ার মতো থাকবে পাছে পাছে।
বিশ্বজনে নিঃস্ব করে পবিত্রতা আনে,
সাধজকজনে নিস্তারিতে তার মতো কে জানে?
বিনামূল্যে ময়লা ধুয়ে করে পরিষ্কার,
বিশ্ব মাঝে এমন দয়াল মিলবে কোথা আর?
নিন্দুক, সে বেঁচে থাকুক বিশ্বহিতের তরে,
আমার আশা পূর্ণ হবে তাহার কৃপা ভরে।
সারমর্ম : নিন্দুক তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্যের কারণে সকলের কাছেই ঘৃণার পাত্র। তার কাজই হলো পরচর্চা করা, যার কারণে কোনো মানুষই তাকে পছন্দ করে না, তার সঙ্গ প্রত্যাশা করে না। কিন্তু এই নিন্দুকই পরচর্চার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত মানুষের দোষ ত্রুটিগুলো চোখের সামনে তুলে ধরে এবং এর ফলে মানুষ নিজেকে শোধরানোর সুযোগ পায়। তাই প্রকৃতপক্ষে নিন্দুককে ঘৃণা করা উচিত নয়।

৭৫
পরের কারণে মরণেও সুখ,
সুখ সুখ করি কেঁদো না আর;
যতই কাঁদিবে ততই ভাবিবে
ততই বাড়িবে হৃদয়-ভার।
আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে
আসে নাই কেহ অবনী পরে,
সারমর্ম : কেবল নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার জন্য এ পৃথিবীতে মানুষের আগমন ঘটেনি। অপরের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করার মধ্যেই জীবনের প্রকৃত সার্থকতা নিহিত। অন্যের কল্যাণসাধনে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েই মানুষ প্রকৃত সুখ খুঁজে পায়। তাই নিজের কল্যাণ নয় পরের কল্যাণসাধনে মনোনিবেশ করতে হবে।

৭৬
পরের মুখে শেখা বুলি পাখির মত কেন বলিস?
পরের ভঙ্গি নকল করে নটের মত কেন চলিস?
তোর নিজস্ব সর্বাঙ্গে তোর দিলেন ধাতা আপন হাতে,
মুছে সেটুকু বাজে হলি, গৌরব কি বাড়ল তাতে?
আপনারে যে ভেঙ্গে চুরে গড়তে চায় পরের ছাঁচে
অলীক, ফাঁকি, মেকি সে জন নামটা তার কদিন বাঁচে?
পরের চুরি ছেড়ে দিয়ে আপন মাঝে ডুবে যা রে,
খাঁটি ধন যা সেথায় পাবি, আর কোথাও পাবি না রে।
সারমর্ম : অন্যের অনুকরণ না করে নিজের মধ্যে যে সুপ্ত প্রতিভা আছে তা বিকশিত করার মাধ্যমেই গৌরব বৃদ্ধি পায়। তাই নিজের মেধা ও বুদ্ধি দিয়ে স্বাভাবিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটানোর মধ্যেই যথাযথ মর্যাদা নিহিত।

৭৭
পাখিটা মরিল। কোন কালে যে, কেউ তা ঠাহর করিতে পারে নাই।
নিন্দুক লক্ষ্মীছাড়া রটাইল, ‘পাখি মরিয়াছে।’
ভাগিনাকে ঢাকিয়া রাজা বলিলেন, ‘ভাগিনা, এ কি কথা শুনি।’
ভাগিনা বলিল, ‘মহারাজ, পাখিটার শিক্ষা পুরো হইয়াছে।’
রাজা শুধাইলেন, ‘ও কি আর লাফায়?’
ভাগিনা বলির, ‘আরে রাম।’
আর কি উড়ে?’‘না’।
‘আর কি গান গায়?’ না?’
‘দানা না পাইলে আর কি চেচাঁয়?’ ‘না’।
রাজা বলিলেন ‘একবার পাখিটাকে আন দেখি।’
পাখি আসিল। সঙ্গে কোতোয়াল আসিল, পাইক আসিল, ঘোড়সওয়ার আসিল। রাজা পাখিটাকে টিপিলেন। সে ‘হাঁ’ করিল না, ‘হুঁ’ করিল না। কেবল তার পেটের মধ্যে পুঁথির শুকনো পাতা খস্ খস্ গজ্ গজ্ করিতে লাগিল।
সারমর্ম : জগতের নিয়ম এই যে, প্রতিটি প্রাণীই নিজস্ব সিদ্ধান্ত ও গন্ডির বাহিরে যেতে চায় না। জোর করে কারো উপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলে তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়, প্রাণচাঞ্চল্যের অবসান ঘটে। প্রকৃতপক্ষে হৃদয়ের আনন্দের সঙ্গে সিদ্ধান্তের যোগসূত্র না ঘটলে জীবনে ব্যর্থতা ও মৃত্যু আসবে।

৭৮
পুণ্যে পাপে দুঃখে সুখে পতনে উত্থানে
মানুষ হইতে দাও তোমার সন্তানে।
হে স্নেহার্ত বঙ্গভূমি-তব গৃহক্রোড়ে
চিরশিশু করে আর রাখিয়ো না ধরে।
দেশ-দেশান্তর মাঝে যার যেথা স্থান
খুঁজিয়া লইতে দাও করিয়া সন্ধান।
পদে পদে ছোট ছোট নিষেধের ডোরে
বেঁধে বেঁধে রাখিয়ো না ভালো ছেলে করে।
প্রাণ দিয়ে দুঃখ সয়ে. আপনার হাতে
সংগ্রাম করিতে দাও ভালো মন্দ সাথে।
সার্থ শান্ত সাধু তব পুত্রদের ধরে
দাও সবে গৃহছাড়া লক্ষ্মীছাড়া করে।
সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী
রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করো নি।
সারমর্ম : জীবনকে জানতে হলে তার ভালো-মন্দ, পাপ-পুণ্য, সুখ-দুঃখ সবটাকেই জানতে হয়। দুঃখ আর সংগ্রামের মধ্য দিয়েই মানুষ প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠে। কিন্তু বাঙালি ধর্ম ও সমাজের নানা বাধার কারণে গৃহকোণে কূপমন্তুকের মতো সুখী জীবনযাপন করছে। তাই বাঙালি প্রাণহীন, নিস্তেজ। এ অবস্থা থেকে বাঙালির উত্তরণের জন্য তাকে ঘরের বাইরে আসতে হবে, সংগ্রাম করতে হবে সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে।

৭৯
পৃথিবীতে কত দ্বন্দ্ব, কত সর্বনাশ,
নতুন নতুন কত গড়ে ইতিহাস-
রক্ত প্রবাহের মাঝে ফেনাইয়া উঠে
সোনার মুকুট কত ফুটে আর টুটে।
সভ্যতার নব নব কত তৃষ্ণা ক্ষুধা-
উঠে কত হলাহল, উঠে কত সুধা
দোঁহা পানে চেয়ে আছে দুইখানি গ্রাম।
এই খেয়া চিরদিন চলে নদীস্রোতে-
কেহ যায় ঘরে, কেহ আসে ঘর হতে।
সারমর্ম : ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়েই প্রতিনিয়ত সভ্যতার বিনির্মাণ চলছে। জন্ম-মৃত্যু, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার পারস্পরিক ক্রিয়ায় এ পৃথিবী চলমান। এই নিয়ম পৃথিবীর সর্বত্রই কার্যকর।

৮০
প্রথম দিনের সূর্য
প্রশ্ন করেছিল
সত্তার নূতন আবির্ভাবে
কে তুমি
মেলেনি উত্তর।
বৎসর বৎসর চলে গেল,
দিবসের শেষ সূর্য
শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিম সাগরতীরে,
নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়,
কে তুমি
পেল না উত্তর।
সারমর্ম : জীবনের সৃষ্টি এবং ধ্বংস নানা রহস্যে আবৃত। কেউ জানে না এই সৃষ্টি এবং ধ্বংসের কারণ। আজ পর্যন্ত কেউ দিতে পারেনি এই জিজ্ঞাসার উত্তর।

৮১
ফুটিয়াছে সরোবরে; কমল নিকর
ধরিয়াছে কি আশ্চর্য শোভা মনোহর।
গুণ গুণ গুণ রবে কত মধুকরে,
কেমন পুলকে তারা মধুপান করে,
কিন্তু এরা হারাইবে এ দিন যখন;
আসিবে কি অলি আর করিতে গুঞ্জন
আশায় বঞ্চিত হলে আসিবে না আর,
আর না করিবে এই মধুর ঝংকার;
সুসময়ে অনেকেই বন্ধু বটে হয়,
অসমেয় হায় হায় কেহ কারো নয়।
কেবল ঈশ্বর এই বিশ্বপতি যিনি,
সকল সময়ের বন্ধু সকলের তিনি।
সারমর্ম : সুখ-দুঃখ মানুষের নিত্যসঙ্গী। সুখের সময় মানুষের শুভাকাক্ষ্ঙীর অভাব না হলেও দুঃখের দিনে এদের কারো ছায়াটাও দেখা যায় না। কিন্তু সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে একজনই সবসময় পাশে থাকেন তিনি হলেন সৃষ্টিকর্তা।

৮২
বহু মিশ্র প্রাণের সংসারে
সেই বাংলাদেশে শিল্পে, পালা-পার্বণের ঢাকে ঢোলে
আউল বাউল নাচে; পুণ্যাহের সানাই রঞ্জিত
রোদ্দুরে আকাশ-তলে দেখ কারা হাঁটে যায়, মাঝি
পাল তোলে, তাঁতি বোনে, খড়ে-ছাওয়া ঘরের আঙনে
মাঠে-ঘাটে শ্রমসঙ্গী নানা জাতি ধর্মের বসতি
চিরদিন-বাংলাদেশ।
সারমর্ম : নানা ধর্ম-বণ র্ও জাতির মিশ্রণে বাংলার জনপদ বৈচিত্র্যময়। দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যকে লালন করে বাংলাদেশ যেন আজ অসাম্প্রদায়িকতা ও প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ এক অভিন্ন সাংস্কতিক কেন্দ্র। বিভিন্ন পেশার মানুষের শ্রমে-ঘামে গড়ে ওঠা এই ছবি বাংলার চিরকালীন রূপ।

৮৩
বহু দিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা
দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শীষের উপরে
একটি শিশির বিন্দু।
সারমর্ম : মানুষ বহু অর্থ ব্যয় করে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যায় পাহাড়, সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। অথচ তার ঘরের পাশেই রয়েছে ধানের শীষের ওপর শিশির বিন্দুর মতো প্রকৃতির নানা বৈচিত্র্যময় রূপ। এই সৌন্দর্যকে উপভোগ না করে দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়ানো অর্থহীন।

৮৪
বসুমতী কেন তুমি এতই কৃপণা?
কত খোঁড়া খুঁড়ি করে পাই শস্যকণা।
দিতে যদি হয় দে মা প্রসন্ন সহাস,
কেন এ মাথার ঘাম পায়েতে বহাস?
বিনা চাষে শস্য দিলে কি তাহাতে ক্ষতি?
শুনিয়া ঈষৎ হাসি কহে বসুমতি-
আমার গৌরব তাতে সামান্যই বাড়ে,
তোমার গৌরব তাহে একেবারে ছাড়ে।
সারমর্ম : পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জিত ফসল মানুষের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান। পরিশ্রম ছাড়া মাটিতে ফসল জন্মালে মানুষের কৃতিত্ব ক্ষুন্ন হয়, এ গৌরব পৃথিবীর। তেমনিভাবে অন্যের দয়া আর করুণার মধ্য দিয়ে যে প্রাপ্তি, তাতে ব্যক্তির কোনো গৌরব নেই, গৌরব দাতার। আর মানুষের জন্য এই বিনাশ্রমে প্রাপ্তির চেয়ে লজ্জাজনক আর কিছু নেই।

৮৫
বাড়ছে দাম
অবিরাম
চালের ডালের তেলের নূনের
হাঁড়ির বাড়ির গাড়ির ছনের।
আলু মাঙ্গা বালু মাঙ্গা,
কাপড় কিনতে লাগে দাঙ্গা,
উঠছে বাজার হু-হু করে সব কিছুর
আঁখের শাকের কাঠের পাটের আম লিচুর।
খাওয়ার জিনিস শোয়ার জিনিস
পরার জিনিস মরার জিনিস
কিছু ছোঁয়ার সাধ্যি নাই।
ঘাটতি কেবল যেদিক চাই।
অভাব শুধু নাই মানুষের
চাই কত মণ, চাই কত সের,
আন্ডা চাও বাচ্চা চাও
জোয়ানে বুড়ো-আসল ফাও
চাহিদা নাই মানুষগুলোর।
কেবলি তার পড়ছে বাজার।
সারমর্ম : মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। এতে মানবজীবনে দুঃখ ও কষ্ট বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু যাদের সুখ সমৃদ্ধির জন্য এই দ্রব্যাদি, সেই মানুষের মূল্যই কমে যাচ্ছে।

৮৬
বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি
দেশে দেশে কত না নগর রাজধানী-
মানুষের কত কীর্তি, কত নদী গিরি সিন্ধু মরু,
কত না অজানা জীব, কত না অপরিচিত তবু
রয়ে গেল অগোচরে। বিশাল বিশ্বের আয়োজন;
মন মোর জুড়ে থাকে অতিক্ষুদ্র তারি এককোণ।
সে ক্ষোভে পড়ি গ্রন্থ ভ্রমণবৃত্তান্ত আছে যাহে
অক্ষয় উৎসাহে
যেথা পাই চিত্রময়ী বর্ণনার বাণী
কুড়াইয়া আনি।
জ্ঞানের দীনতা এই আপনার মনে
পূরণ করিয়া লই যত পারি ভিক্ষালব্ধ ধনে।
সারমর্ম : এ পৃথিবী যেমন আয়তনে বিশাল তেমনি এর রূপও বৈচিত্র্যময়। কিন্তু তার বেশিরভাগই মানুষের অজানা। অজানাকে জানার আকাঙ্ক্ষা মানুষের চিরকালের। তাই সে তার হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা মেটাতে ভ্রমণকাহিনী পাঠ করে। এর মাধ্যমেই সে তার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে চায়, তার দীনতাকে ঘোচাতে চায়।

৮৭
বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র
নানাভাবে নতুন জিনিস শিখছি দিবারাত্র।
এই পৃথিবীর বিরাট খাতায়
পাঠ্য যে সব পাতায় পাতায়
শিখছি সে সব কৌতূহলে সন্দেহ নাই মাত্র।
সারমর্ম : বিশ্ব প্রকৃতিতে শিক্ষার নানা উপকরণ ছড়িয়ে আছে। মানুষ প্রতিনিয়ত নানাভাবে এই বিশ্বপ্রকৃতির কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করছে। এই পাঠশালা থেকেই মানুষ জ্ঞান আহরণ করে তার জ্ঞানের পরিধিকে বিস্তৃত করছে।

৮৮
বিপদে মোরে রক্ষা কর, এ নহে মোর প্রার্থনা,
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।
দুঃখ-তাপে ব্যথিত চিতে নাই-বা দিলে সান্ত্বনা,
দুঃখ যেন করিতে পারি জয়।
সহায় মোর না যদি জুটে, নিজের বল না যেন টুটে,
সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি, লভিলে শুধু বঞ্ছনা
নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয়।
সারমর্ম : বিপদ থেকে মুক্তি লাভের জন্য প্রয়োজন সাহস, শক্তি আর মনের দৃঢ়তা। অনেক সময় দুঃখ, বঞ্চনায় মানুষ ধৈর্য হারিয়ে ফেলে। সৃষ্টিকর্তার কাছে সে অবস্থা থেকে উদ্ধারের জন্য প্রার্থনা করে। কিন্তু করুণা শিক্ষা নয়, সৃষ্টিকর্তা যেন সকল পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার সাহস আর শক্তি মানুষকে দেন এটাই হওয়া উচিত মানুষের প্রার্থনা।

৮৯
বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি, সে আমার নয়
অসংখ্য বন্ধন মাঝে মহানন্দময়
লভিব মুক্তির স্বাদ। এই বসুধার
মৃত্তিকার পাত্রখানি ভরি বারংবার
তোমা অমৃত ঢালি দিবে অবিরত
নানা বর্ণ গন্ধময়। প্রদীপের মতো।
সমস্ত সংসার মোর লক্ষ বর্তিকায়
জ্বালায়ে তুলিবে আলো তোমারি শিখায়।
সারমর্ম : সংসারী মানুষ সংসারের মায়া-মমতা, বন্ধনের মধ্যে থেকেই ঈশ্বরের আরাধনা করতে চান। সংসারের দায়িত্ব ছেড়ে তিনি বৈরাগ্যের বেশ ধারণ করতে চান না। সংসারই তার কাছে তীর্থস্থান। এ সংসার তীর্থে থেকেই তিনি ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করতে চান।

৯০
ভদ্র মোরা, শান্ত বড়ো, পোষ মানা এ প্রাণ,
বোতাম-আঁটা জামার নিচে শান্তিতে শয়ান।
দেখা হলেই মিষ্ট অতি, মুখের ভাব শিষ্ট অতি,
অলস দেহ ক্লিষ্টগতি, গৃহের প্রতি টান
তৈলঢালা স্নিগ্ধ তনু নিদ্রারসে ভরা,
যেথায় ছোট বহরে বড়ো বাঙালি-সন্তান।
ইহার চেয়ে হতাম যদি আরব বেদুঈন,
চরণতলে বিশাল মরু দিগন্তে বিলীন।
ছুটেছে ঘোড়া উড়েছে বালি, জীবন স্রোতে আকাশ ঢালি,
হৃদয়তলে বহ্নি জ্বালি চলেছি নিশিদিন
বরশা হাতে, ভরসা প্রাণে, সদাই নিরুদ্দেশ
মরুর ঝড় যেমন বহে সকল বাধাহীন।
সারমর্ম : বাঙালি জাতি স্বভাবতই শান্তিপ্রিয়, অলস, কর্মহীন। এরা সর্বদা আরাম-আয়েশে জীবন কাটিয়ে দিতে চায়, কিন্তু এর জন্য পরিশ্রম করে না। এ জীবনের চেয়ে আরব বেদুঈনের মতো সাহসী, কর্মঠ ও সংগ্রামী জীবন ভালো।

৯১
ভালবাসি এই সুন্দর ধরণীরে,
ভালবাসি তার সব ধূলিবালি মাটি,
আমার প্রাণের সকল অশ্রু নীরে
কেমন করিয়া লাগিল সোনার কাঠি।
অশ্রু-কণা মুক্তার মত জ্বলে
ভরিল হৃদয় আনন্দ কোলাহলে
আলোক আসিয়া হৃদয়ে বাজায় বাঁশী,
সুনীল গগন ভরিয়া উঠিল গানে,
সুন্দর লাগে নয়নে রবির হাসি,
গভীর লাগে নয়নে রবির হাসি,
গভীর হরষ উছসি উঠিছে প্রাণে,
যে দিকে তাকাই পুলকে সকল হিয়া
উঠে শাস্তির সংগীতে মুখরিয়া।
সারমর্ম : এই সুন্দর পৃথিবীর ধূলাবালি, মাটি, রূপ-রস সবকিছুকেই কবি ভালোবাসেন। প্রকৃতির অনির্বচনীয় সৌন্দর্যে তাঁর মন পুলকিত হয়। শান্ত স্নিগ্ধ প্রকৃতি তাঁর হৃদয়ে শান্তির ধারা প্রবাহিত করে।

৯২
এই সূর্যকরে, এই পুষ্পিত কাননে,
জীবন্ত হৃদয়-মাঝে যদি স্থান পাই।
ধরায় প্রাণের লেখা চিরতরঙ্গিত
বিরহ মিলন কত হাসি-অশ্রুময়,
মানবের সুখে-দুঃখে গাহিয়া সঙ্গীত
যদি গো রচিতে পারি অমর আলয়।
সারমর্ম : মানুষ জানে সে অমর নয়। এই নির্মম সত্য জেনেও সে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে চায় না। মানুষ হৃদয়ের মাঝে চির অমরত্ব লাভ করতে চায়। পরের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করে, মহৎ কীর্তি স্থাপন করার মাধ্যমেই কেবল মানুষ পারে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিতে।

৯৩
মহাজ্ঞানী মহাজন, যে পথে করে গমন,
হয়েছেন প্রাতঃস্মরণীয়,
সেই পথ লক্ষ্য করে, স্বীয় কীর্তিধ্বজা ধরে,
আমরাও হব বরণীয়।
সময় সাগর তীরে, পদাঙ্ক অঙ্কিত করে,
আমরাও হব যে অমর
সেই চিহ্ন লক্ষ্য করে, অন্য কোন জন পরে,
যশোদ্বারে আসিবে সত্বর।
করো না মানবগণ, বৃথা ক্ষয় এ জীবন,
সংসার সমরাঙ্গন মাঝে,
সংকল্প করেছ যাহা, সাধন করহ তাহা,
ব্রতী হয়ে নিজ নিজ কাজে।
সারমর্ম : এ পৃথিবীতে মহৎ ব্যক্তিগণ তাদের কীর্তির মাধ্যমে অমর হয়ে আছেন। আমাদেরও উচিত তাদের পদাংক অনুসরণ করা। নশ্বর পৃথিবীতে বৃথা সময় নষ্ট না করে সাধনা ও কর্ম করা, তবেই জীবন সার্থক হবে।

৯৪
মরুভূমির গোধূলির অনিশ্চয় অসীমে হারালো?
আকস্মাৎ বিভীষিকা সমুদ্রের তরঙ্গে তরঙ্গে
মূর্ছাহত বালুকণা জাগলো কি মৃত্যুর আহ্বান?
অন্ধকারে প্রেতদল পথপাশে অট্টহাসে কেন?
কঙ্কালের শ্বেত নগ্ন অস্তি-গহ্বরে
প্রাণঘাতী বীভৎস রাগিণী?
মৃত্যু-শঙ্কা মূর্চ্ছনা গ্লানি আচ্ছন্ন গগন,
মানুষের দুরাশার অভিযানে টানি দিল ছেদ?
অদৃশ্য আলোর দীপ্তি অজানিত কোন নভস্থলে
সহসা চমকি ওঠে উদ্ভাসিয়া অন্তরের ছায়া?
মরুভূমি পরপারে কোথা স্বর্ণদ্বীপ
প্রলোভন-সব রক্তে ছন্দে দেয় আনি;
তারি পানে উন্মীলিয়া সকল হৃদয়
গোধূলির অন্ধকারে তিমির রাত্রির বক্ষ ভেদি,
পথহীন প্রান্তরে নামহীন বিপদে উত্তরি,
অজ্ঞাত উষার পানে কারাভাঁর যাত্রা হল শুরু?
সারমর্ম : মানুষের জীবন নানা প্রতিকূলতায় পরিপূর্ণ। মরুভূমির পথে যাত্রার মতো তার জীবনের পথেও আছে নানা বাধা-বিঘ্ন, আছে মৃত্যুর ভয়। এতে মানুষের যাত্রা বার বার ভঙ্গ হয়। তারপরও নতুন ভোরের আশায় মানুষ মৃত্যুকে উপেক্ষা করে সেই অনিশ্চিত পথেই ধাবিত হয়।

৯৫
মান দিও মা আমায় তুমি
চাইনে আমি মানকে-
বরে নেব আমি তোমার
নিবিড় নীরব দানকে।
গভীর রাতের অন্ধকারে
গ্রহ চন্দ্র তারকারে
যে তান দিয়ে হাসাইয়ে
হাসাতে বিশ্ব-প্রাণকে
প্রাণ আমার জাগাইয়ে
তোল গো সে তানকে-
আড়ম্বরে মত্ত যারা হৃদয়তে অন্ধ
বুঝিবে না তারা আমার নিরিবিলির আনন্দ
শুয়ে ধূলায় পথের পরে
তাকায়ে ওই নীলাম্বরে,
গাহিতে চাই আমি আমার
জগৎ-জোড়া গানকে-
মান দিও না আমায় তুমি
চাইনে আমি মানকে।
সারমর্ম : কবি কোনো মান, ধনসম্পদ আড়ম্বর চান না। বিশ্বপ্রকৃতির ছন্দকে, আনন্দকে তিনি নিজ হৃদয়ে উপলব্ধি করতে চান। তিনি চান গোটা মানব জাতির অন্তরের আনন্দকে, অন্তরের বাণীকে বিশ্বমাঝে ছড়িয়ে দিতে। এ কারণেই তিনি ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করছেন।

৯৬
কাঁদিবার নহে শুধু বিশাল প্রাঙ্গণ।
রাবণের চিতাসম যদিও আমার
জ্বলিছে জ্বলুক প্রাণ, কেন এ ক্রন্দন?
অপরের দুঃখ-জ্বালা হবে মিটাইতে
হাসি-আবরণ টানি দুঃখ ভুলে যাও,
জীবনের সর্বস্ব, অশ্রু মুছাইতে
বাসনার স্তর ভাঙ্গি বিশ্বেরে ঢেলে দাও।
হায়. হায়, জন্মিয়া যদি না ফুটালে
একটি কুসুমকলি নয়ন কিরণে,
একটি জীবনব্যথা যদি না জুড়ালে
বুকভরা প্রেম ঢেলে বিফল জীবনে।
আপনা রাখিলে ব্যর্থ জীবন-সাধনা।
জনম বিশ্বের তরে, পরার্থে কামনা।
সারমর্ম : নিজের দুঃখ, ব্যথা, নিজ স্বার্থে নিমগ্ন হয়ে থাকা মানবজীবনের লক্ষ্য নয়। যে জীবন অন্যের দুঃখ দূর করতে না পারে, অন্যের জন্য নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিতে পারে না, সে জীবন ব্যর্থ। ভোগ-বিলাস, কামনা-বাসনা নয়, আত্মস্বার্থ সিদ্ধি নয়, ত্যাগের মহিমাই জীবনকে সার্থক করে তোলে।

৯৭
মৃত্যুও অজ্ঞাত মোর। আজি তার তরে
ক্ষণে ক্ষণে শিহরিয়া কাঁদিতেছি ডরে।
সংসার বিদায় দিতে, আঁখি ছলছলি
জীবন আঁকড়ি ধরি আপনার বলি
দুই ভুজে।
ওরে মূঢ়, জীবন-সংসার
কে করিয়া রেখেছিল এত আপনার
জনম মুহূর্ত হতে তোমার অজ্ঞাতে
তোমার ইচ্ছার উপর। মৃত্যুর প্রভাতে
সেই অচেনার মুখ হেরিব আবার
মূহূর্তের চেনার মতো। জীবন আমার
এত ভালোবাসি বলে হয়েছে প্রত্যয়,
মৃত্যুরে এমনি ভালোবাসি নিশ্চয়।
সারমর্ম : মৃত্যু অবধারিত জেনেও মানুষ মৃত্যুবরণ করতে চায় না। সে জীবনকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়। মৃত্যু অজ্ঞাত বলেই মৃত্যু নিয়ে মানুষের এত ভয়, তার জীবনের প্রতি ভালোবাসা এত প্রবল। অথচ এই জন্মও তার নিকট এক সময় ছিল অজ্ঞাত। এই জন্ম-মৃত্যুর খেলা মানুষের হৃদয়কে শঙ্কিত করে, বেদনায় সিক্ত করে।

৯৮
যাক বান ডেকে যাক বাইরে এবং ঘরে
আর নাচুক আকাশ শূন্য মাথার পরে,
আসুক জোরে হাওয়া;
এই আকাশ মাটি উঠুক কেঁপে কেঁপে,
শুধু ঝড় বয়ে যাক মরা জীবন ছেপে,
বিজলী দিয়ে হাওয়া।
আয় ভাইবোনেরা ভয় ভাবনাহীন
সেই বিজলী নিয়ে গড়ি নতুন দিন।
আয় অন্ধকারের বদ্ধ দুয়ার খুলে
বুনো হাওয়ার মত আয়রে দুলে দুলে
গেয়ে নতুন গান
যত আবর্জনা উড়িয়ে দেরে দূরে,
আজ মরা গাঙের বুকে নূতন সুরে
ছড়িয়ে দেরে প্রাণ।
সারমর্ম : কল্যাণের পথে যাত্রায় পদে পদে নানা বাধা আসে। এই বাধাকে ভয় পেলে চলবে না। ভয়কে শক্তিকে রূপান্তরিত করে সবাই মিলে পৌঁছতে হবে সেই গন্তব্যে যেখানে আছে কল্যাণ, সমৃদ্ধি, মুক্তি।

৯৯
যারে তুই ভাবিস ফণী
তারো মাথায় আছে মণি
বাজা তোর প্রেমের বাঁশি
ভবের বনে ভয় বা কারে?
সবাই যে তোর মায়ের ছেলে
রাখবি কারে, কারে ফেলে?
একই নায়ে সকল ভায়ে
যেতে হবে রে ওপারে।
সারমর্ম : মানুষ হিসেবে আমাদের মধ্যে আছে প্রেম-ভালোবাসা। ভালোবাসার দৃষ্টিতেই সব মানুষকে দেখতে হবে। কেউ শত্রু, কেউ মিত্র এরকম না ভেবে সবাইকে সমানভাবে ভালোবাসতে হবে। এটাই আমাদের প্রধান দায়িত্ব।

১০০
যেখানে এসেছি আমি, আমি সেথাকার
দরিদ্র সন্তান আমি দীন ধরণীর।
জন্মাবধি যা পেয়েছি সুখ-দুঃখভার।
বহু ভাগ্য বলে তাই করিয়াছি স্থির।
অসীম ঐশ্বর্যরাশি নাই তোর হাতে
হে শ্যামলা সর্বসহা জননী মৃন্ময়ী।
সকলের মুখে অন্ন চাহিস জোগাতে,
পারিস নে কত বার,- কই অন্ন কই
কাঁদে তোর সন্তানেরা ম্লান শুষ্ক মুখ,
জানি মাগো, তোর হাতে সম্পূর্ণ সুখ,
যা-কিছু গড়িয়া দিস ভেঙে ভেঙে যায়,
সব তাতে হাত দেয় মৃত্যু সর্বভূক,
সব আশা মিটাইতে পারিস নে হায়
তা বলে কি ছেড়ে যাব তোর তপ্ত বুক?
সারমর্ম : মানুষ এই পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছে। তাই পৃথিবীর নিকট মানুষের প্রত্যাশাও অনেক বেশী। কিন্তু এই পার্থিব জীবনে দুঃখ, বেদনা, অভাব অনেক সময় মানুষকে আকড়ে ধরে। তবুও মানুষ পৃথিবীর মায়া ছেড়ে কোথায়ও যেতে চায় না।


সারমর্ম (১ থেকে ৫০)
সারমর্ম (৫১ থেকে ১০০)
সারমর্ম (১০১ থেকে ১৫০)
সারমর্ম (১৫১ থেকে ২০০)
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post