মার্চের দিনগুলি

সারমর্ম - (১ থেকে ৫০)

সারমর্ম (১ থেকে ৫০)
সারমর্ম (৫১ থেকে ১০০)
সারমর্ম (১০১ থেকে ১৫০)
সারমর্ম (১৫১ থেকে ২০০)


অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোন প্রেম নেই প্রীতি নেই করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি,
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাঁদের হৃদয়।
সারমর্ম : সামাজিক মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা, আদর্শ ও জীবনবোধকে ভুলে ক্ষমতার লোভে কিছু মানুষের করায়ত্বের কারণে আধুনিক পৃথিবী আজ চরম সংকটের মুখোমুখি। অথচ যে মহৎ মানুষগুলোর অন্তরে মানুষকে ভালোবাসা তথা দেশপ্রেমের এক সহজাত অনুভব, উজ্জ্বল আলোর মতো জেগে আছে তারা আজ অবহেলিত, উপেক্ষিত।

অধম রতন পেলে কি হবে ফল?
উপদেশে কখনও কি সাধু হয় খল?
ভালো মন্দ দোষগুণ আধারেতে ধরে,
ভুজঙ্গ অমৃত খেয়ে গরল উগরে
লবণ জলধি জল করিয়া ভক্ষণ
জলধর করে দেখ সুধা বরিষণ।
সুজনে সু-যশ গায় কু-যশ ঢাকিয়া
কুজনে কু-রব করে সু-রব নাশিয়া।
সারমর্ম : সুজন-কুজন অর্থাৎ ভালো-মন্দ মানুষ নিয়েই এ জগৎ সংসার। যারা সুজন তারা অন্যের মঙ্গল চিন্তা করে এবং ভালো দিকগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হয়। কিন্তু যারা কুজন তারা সব সময় অন্যের অনিষ্ট করার চিন্তায় মগ্ন থাকে এবং অন্যের দোষত্রুটি খুঁজে বেড়ায়।

অন্ধকার গর্তে থাকে অন্ধ সরীসৃপ;
আপনার ললাটের রতনপ্রদীপ
নাহি জানে, নাহি জানে সূর্যালোকলেশ।
তেমনি আঁধারে আছে এই অন্ধ দেশ।
হে দন্ড-বিধাতা রাজা- যে দীপ্ত রতন
পরায়ে দিয়েছ ভালে তাহার যতন
নাহি জানে, নাহি জানে তোমার আলোক।
নিত্য বহে আপনার অস্তিত্বের শোক,
জনমের গ্লানি। তব আদর্শ মহান
আপনার পরিমাপে করি খান-খান
রেখেছে ধূলিতে। প্রভু, হেরিতে তোমার
তুলিতে হয় মাথা ঊর্ধ্বপানে হায়।
সে এক তরণী লক্ষ লোকের নির্ভর
খন্ড- খন্ড- করি তারে তরিবে সাগর ?
সারমর্ম : শস্য-শ্যামলা, সুজলা-সুফলা, ধনসম্পদে পরিপূর্ণ এই দেশ আজ অজ্ঞতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন। নিজেদের সুবিশাল ঐতিহ্য ভুলে সবাই বিভেদের বেড়াজালে বন্দি। তবুও আশার বাণী, অতীত হারানো ঐতিহ্য চেতনায় বলীয়ান হয়ে এই দেশ ফিরে পাবে তার হারানো গৌরব ও ঐতিহ্য।

অহংকার-মদে কভু নহে অভিমানী।
সর্বদা রসনারাজ্যে বাস করে বাণী।।
ভুবন ভূষিত সদা বক্তৃতার বশে।
পর্বত সলিল হয় রসনার রসে।।
মিথ্যার কাননে কবু ভ্রমে নাহি ভ্রমে।
অঙ্গীকার অস্বীকার নাহি কোন ক্রমে।
অমৃত নিঃসৃত হয় প্রতি বাক্যে যার।
মানুষ তারেই বলি মানুষ কে আর ?
সারমর্ম : প্রাণিকূলের মতো জীবনের অস্তিত্ব থাকলেই তাকে প্রকৃত মানুষ বলা যায় না। প্রকৃত মানুষ হতে হলে তাকে হতে হবে নিরহংকার। যিনি কখনো মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করবেন না, সেই সাথে অঙ্গীকার ভঙ্গ করবেন না। আর তাঁর বাক্য হবে শ্রুতিমধুর ও হৃদয়গ্রাহী।

আমরা নতুন আমরা কুঁড়ি নিখিল বন নন্দনে,
ওষ্ঠে রাঙা হাসির রেখা জীবন জাগে স্পন্দনে।
লক্ষ আশা অন্তরে
ঘুমিয়ে আছে মন্তরে
ঘুমিয়ে আছে বুকের ভাষা পাঁপড়ি পাতার বন্ধনে।
সকল কাঁটা ধন্য করে ফুটবো মোরা ফুটবো গো,
অরুণ রবির সোনার আলো দু’হাত দিয়ে লুটবো গো।
নিত্য নবীন গৌরবে
ছড়িয়ে দেব সৌরভে,
আকাশ পানে তুলব মাথা, সকল বাঁধন টুটবো গো।
সাগর জলে পাল তুলে দে, কেউবা হবে নিরুদ্দেশ,
কলম্বসের মতই বা কেউ পৌঁছে যাবে নতুন দেশ।
জাগবে সারা বিশ্বময়।
এ বাঙালী নিঃস্ব নয়,
জ্ঞান-গরিমা শক্তি-সাহস আজও এদের হয় নি শেষ।
সারমর্ম : আজকের শিশুরাই নতুন পথের নবীন পথিক। এরা আজ নব উদ্যমে, নব নব অভিযানে সারা বিশ্বে সাড়া জাগাবে। সকল বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে সৌরভ ছড়াবে। প্রমাণ করে দিবে বাঙালি অমিত তেজ, জ্ঞান-বুদ্ধিতে নিঃস্ব নয়, বরং বাঙালিরাই শ্রেষ্ঠ।

আমরা সিঁড়ি
তোমরা আমাদের মাড়িয়ে
প্রতিদিন অনেক উঁচুতে উঠে যাও,
তারপর ফিরে তাকাও না পিছনের দিকে।
তোমাদের পদধূলিধন্য আমাদের বুক
পদাঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায় প্রতিদিন।
তোমরাও তা জানো,
তাই কার্পেটে মুড়ে রাখতে চাও আমাদের বুকের ক্ষত
ঢেকে রাখতে চাও তোমাদের অত্যাচারের চিহ্নকে
আর, চেপে রাখতে চাও পৃথিবীর কাছে
তোমাদের গর্বোদ্ধত অত্যাচারী পদধ্বনি।
তবু আমরা জানি,
চিরকাল আর পৃথিবীর কাছে
চাপা থাকবে না
আমাদের দেহে তোমাদের এই পদাঘাত,
আর, সম্রাট হুমায়ুনের মত
একদিন তোমাদেরও হতে পারে পদস্খলন।
সারমর্ম : বর্তমান সভ্যতার বিকাশের মূলে রয়েছে শ্রমজীবীদের অক্লান্ত শ্রম। অথচ এই শ্রমজীবীদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করেছে শোষক শ্রেণি। এমনকি শ্রমজীবীদের অবদানটুকুও তারা স্মরণ করে না। তাই শোষক শ্রেণিদের প্রতি শ্রমজীবীদের সতর্ক বাণী অচিরেই শোষকদের অত্যাচারের স্বরূপ প্রকাশ পাবে, আর তখন তাদের পতন অবশ্যম্ভাবী।

আমরা চলিব পশ্চাতে ফেলি পচা অতীত,
গিরি-গুহা ছাড়ি খোলা প্রান্তরে গাহিব গীত,
সৃজিব জগৎ বিচিত্রতর বীর্যবান,
তাজা জীবন্ত সে নব সৃষ্টি শ্রম-মহান।
চলমান বেগে প্রাণ উচ্ছল
রে নবযুগের স্রষ্টাদল
জোর-কদম চলরে চল।
সারমর্ম : তারুণ্যে উদ্দীপ্ত তরুণ সমাজ ঘুণেধরা অতীতকে পেছনে ফেলে নব উদ্যমে সৃষ্টির উম্মাদনায় এগিয়ে যায়। তারা সৃষ্টি করবে নতুন জগৎ। এই প্রেরণায় বিপ্লবী হয়ে সম্মুখে অগ্রসর হয়।

আমার গানের সবটুকু সুর সবটুকু আরাধনা
এই হৃদয়ের সব সৌরভ-বাসনার ব্যঞ্জনা
একাগ্র আর অকুণ্ঠ হয়ে বহু বাতায়ন দ্বারে
আঘাত হেনেছে, পেতেছে দুহাত দুরাশায় বারে বারে।
মেলেনি কিছুই।
বুঝেছি সেদিন মানুষ এমনই দীন,
এ মাটির কাছে আছে আমাদের এমনি অশেষ ঋণ।
অনাদি কালের বন্ধন আর বঞ্চনা একাসনে
চিরজীবনের শৃঙ্খলসম জড়ানো মানব-মনে।
তাই বেদনার বহ্নি ও প্রাণে মাধুর্যে সুনিবিড়,
ঝরা পালকের ভস্মস্তূপে তাই বাঁধিলাম নীড়।
তীক্ষ্ম নখর উদ্যত যার তারে ভালবাসিলাম
দুনয়নে যার হিংস্র আগুন আজো জপি তার নাম।
সারমর্ম : অজ্ঞতা ও হিংস্রতা এ পৃথিবীর মানবকূলকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে। তবুও কিছু সংখ্যক মহৎ প্রাণের অধিকারীগণ মানুষের সেবায় নিয়োজিত; কিন্তু তাঁদের শুনতে হয় বিবেকহীন মানুষের গঞ্জনা, সহ্য করতে হয় লাঞ্ছনা। তারপরও এই মহৎ প্রাণের অধিকারী সুমহান মানুষগুলো বিবেকহীন মানুষের কল্যাণের জন্য জীবনের বিনিময়ে অবিরাম কাজ করে যান।

আমার একার সুখ, সুখ নহে ভাই
সকলের সুখ সখা, সুখ শুধু তাই।
সকলের সাথে বন্ধু, সকলের সাথে,
যাইব কাহারে বলো, ফেলিয়া পশ্চাতে।
একসাথে বাঁচি আর একসাথে মরি,
এসো বন্ধু, এ জীবন সুমধুর করি।
সারমর্ম : আত্মসুখ প্রকৃত সুখ নয়, প্রকৃত সুখ সমষ্টিগত। কেননা মানবকুল একে অন্যের সাথে আত্মার বন্ধনে আবদ্ধ। তাই সমষ্টিগতভাবে পরস্পরের সান্নিধ্যে জীবনকে সুখময় করে তোলার মধ্যেই মানবজীবনের প্রকৃত সুখ নিহিত।

১০
আমারই চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ,
চুনি উঠল রাঙা হয়ে।
আমি চোখ মেললুম আকাশে-
জ্বলে উঠল আলো
পুবে পশ্চিমে।
গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম, ‘সুন্দর’-
সুন্দর হল সে।
তুমি বলবে, এ যে তত্ত্বকথা।
এ কবির বাণী নয়।
আমি বলব এ সত্য,
তাই এ কাব্য।
এ আমার অহংকার,
অহংকার সমস্ত মানুষের হয়ে।
মানুষের অহংকার-পটেই
বিশ্বকর্মার বিশ্বশিল্প।
সারমর্ম : মানুষ সুন্দরের পূজারী। কারণ সৌন্দর্য মানুষের দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের প্রতি মুগ্ধ হয়ে মানুষ পৃথিবীকে নতুন করে ভালোবাসে। তাই পৃথিবীর সৌন্দর্য ও ভালোবাসা সত্য এবং শ্রেষ্ঠ।

১১
আমার একূল ভাঙ্গিয়াছে যেবা আমি তার কূল বাঁধি,
যে গেছে বুকেতে আঘাত হানিয়া তার লাগি আমি কাঁদি।
যে মোরে দিয়েছে বিষে ভরা বাণ,
আমি দেই তারে বুকভরা গান;
কাঁটা পেয়ে তারে ফুল করি দান সারাটি জনমভর
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।
সূত্রঃ কবিতা:-প্রতিদান; কবি:-জসীম উদ্দীন।
সারমর্ম : মহৎ ব্যক্তিগণ কখনো সংকীর্ণ মনের পরিচয় দেন না। তাঁরা সব সময় অন্যের কল্যাণে নিয়োজিত থাকেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন অন্যের কল্যাণের মাঝেই মানবজীবনের সার্থকতা নিহিত। তাই অন্যের দেওয়া আঘাত সহ্য করে যারা পরকে আপন করেন ভালোবাসা দিয়ে শত্রুর মন জয় করেন, তাদের মধ্যেই মনুষ্যত্বের লক্ষণ প্রকাশিত হয়।

১২
আমি চাই মহত্ত্বের মহৎ পরাণ
মুকুতা-মাণিক্য-নিধি
আমারে দিও না বিধি
চাহিনে এ জগতে রাজত্ব সম্মান।
বাঞ্ছিত পরাণ পেলে
মেগে নেব মনুষ্যত্ব শ্রেষ্ঠ উপাদান
প্রাণের সাধক আমি, সাধনীয় প্রাণ।
সারমর্ম : একজন মননশীল হৃদয়বান মানুষের কাছে মহৎ প্রাণই কাম্য। ক্ষমতা, রাজত্ব বা সম্মান মহৎ প্রাণের নিকট কখনোই কাম্য নয়। তাই মহৎ প্রাণের অধিকারীগণ চান প্রকৃত মনুষ্যত্ব, যেখানে মনুষ্যত্বের বাঁধনে মানবজীবন হবে গৌরবম-মন্ডিত।

১৩
আমি যেন কোন এক বসন্তের রাতের জোনাকি,
অথবা দিনের শেষে কোন নীল আকাশের পাখি,
আমি যেন ছোট নদী বুকভরা ছোট ছোট ঢেউ,
সে নদীতে স্নান করে গাঁয়ের মেয়েরা কেউ কেউ।
আমি যেন কোন এক পথশ্রান্ত অচেনা পথিক,
দুদ- তাকিয়ে থাকি যে-আকাশ আলো ঝিকমিক,
আমি যেন কত বন, কত মেঘ, বালুতীর,
অথবা অনেক রাতে একমুঠো চাঁদের আবির।
সারমর্ম : সৌন্দর্যময় এ পৃথিবী সকল নৈসর্গিক উপাদানে সমৃদ্ধ। এই অনুপম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনন্তকাল ধরে কবিচিত্তে হিল্লোল তুলছে। এরই বহিঃপ্রকাশ কবির নানা অনুষঙ্গে।

১৪
আমি মরু-কবি গাহি সেই বেদে-বেদুঈনদের গান,
যুগে যুগে যারা করে অকারণ বিপ্লব-অভিযান
জীবনের আতিশয্যে যাহারা দারুণ উগ্র সুখে
সাধ করে নিল গরল-পিয়ালা, বর্শা হানিল বুকে।
আষাঢ়ের গিরি-নিঃস্রাব-সম কোন বাধা মানিল না,
বর্বর বলি যাহাদের গালি পাড়িল ক্ষুদ্রমনা,
কূপ-মন্ডুক ‘অসংযমী’র আখ্যা দিয়াছে যারে।
তারি তরে ভাই গান রচে যাই, বন্দনা করি তারে।
সারমর্ম : কবি সেই সব মানুষের বন্দনা করেছেন যারা যুগে যুগে নিয়ে আসে বিপ্লব, করেছেন আত্মত্যাগ। কিন্তু সংকীর্ণমনারা এদেরকে উচ্ছৃঙ্খল বলে আখ্যা দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এরাই নন্দিত, বন্দনীয় পূজনীয়।

১৫
আমি আলো এবং অন্ধকারকে চিনি
ফুল এবং পাখিকে চিনি
সামান্য স্তন্যপ্রায়ী থেকে
বহুভোজী বহু প্রাণী চিনি;
শ্রমে প্রেমে ক্রোধে প্রতিশোধে
মানুষের মত কেউ নয়।
গড়ে ওঠে অরণ্যভোগী লোকালয়
-মানুষের শ্রমে,
গড়ে ওঠে মধুকুঞ্জ বংশধারা
মানুষের প্রেমে কামে,
জ্বলে ওঠে দাবানল
-মানুষের ক্রোধে,
লোকালয় অরণ্য হয়
-মানুষের ঘৃণায়, প্রতিশোধে।
সারমর্ম : প্রাণিজগতের মধ্যে মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ। অরণ্যঘেরা পৃথিবীতে তিলে তিলে মানুষ গড়ে তুলেছে সভ্যতা। আবার মানুষের ক্রোধেই দাবানলের মতো জ্বলে পুড়ে সভ্যতার বিনাশ ঘটে।

১৬
আঠারো বছর বয়সে আঘাত আসে
অবিশ্রান্ত; একে একে হয় জড়ো,
এ বয়স কালো লক্ষ দীর্ঘশ্বাসে
এ বয়স কাঁপে বেদনায় থরোথরো।
তবু আঠারোর শুনেছি জয়ধ্বনি,
এ বয়স বাঁচে দুর্যোগে আর ঝড়ে,
বিপদের মুখে এ বয়স অগ্রণী
এ বয়স তবু নতুন কিছু তো করে।
সারমর্ম : আঠারো বছর বয়সের ধর্মই হলো মহান মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে আঘাত-সংঘাতের মধ্যে রক্তশপথ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া। এ বয়সই অদম্য দুঃসাহসে সকল বাধা-বিপদকে পেরিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। সেই সঙ্গে নব সৃষ্টির উল্লাসে মাতোয়ারা থাকে।

১৭
আসিতেছে শুভ দিন
দিনে দিনে বহু বাড়িতেছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ।
হাতুড়ি, শাবল, গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়,
পাহাড়-কাটা সে পথের দুপাশে পড়িয়া যাদের হাড়,
তোমাদের সেবিতে হইল যাহারা মজুর,মুটে ও কুলি,
তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি,
তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদের গান
তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান।
সারমর্ম : দিনে দিনে শ্রমিকদের কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়েই গড়ে উঠেছে মানব সভ্যতা। কিন্তু এই শ্রমজীবী মানুষ শোষিত, বঞ্চিত, ও অবহেলিত। তবে শ্রমজীবী মানুষদের যারা শোষণ করছে তাদের দিন শেষ হয়ে আসছে। কেননা, শ্রমজীবীদের নব উত্থানের সূচনা আসন্ন।

১৮
ইচ্ছা করে মনে মনে
স্বজাতি হইয়া থাকি সর্বলোক সনে
দেশে দেশান্তরে; উষ্ট্রদুগ্ধ করি পান
মরুতে মানুষ হই আরব সন্তান
দুর্দম স্বাধীন, তিব্বতের গিরিতটে
নির্লিপ্ত প্রস্তুরপুরী মাঝে, বৌদ্ধ মঠে
করি বিচরণ। দ্রাক্ষাপায়ী পারসিক
গোলাপ কাননবাসী তাতার নির্ভীক
অশ্বারূঢ়, শিষ্টাচারী সতেজ জাপান
প্রবীণ প্রাচীন চীন নিশি দিনমান
কর্ম-অনুরত,-সকলের ঘরে ঘরে
জন্মলাভ করে লই হেন ইচ্ছা করে।
সারমর্ম : পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে ভালোবাসার মধ্য দিয়েই মানবজীবন সার্থক হয়ে ওঠে। তাই প্রকৃত মানবপ্রেমিকগণ পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চলের মানুষকে অনুভব করেন আত্মীয় হিসেবে। আর এভাবেই প্রতিটি ঘরে ঘরে জন্মলাভ করে নিজেকে বিশ্বসভ্যতার অঙ্গনে ছড়িয়ে দিতে চান।

১৯
ইসলাম বলে, সকলের তবে মোরা সবাই,
সুখ-দুঃখ সমভাগ করে নেব সকলে ভাই,
নাই অধিকার সঞ্চয়ের।
কারো আঁখি জলে কারো ঝাড়ে কিরে জ্বলিবে দীপ?
দু’জনার হবে বুলন্দ নসীব, লাখে লাখে হবে বদ নসীব।
এ নহে বিধান ইসলামের।
ঈদ-উল-ফিতর আনিয়াছে তাই নব বিধান,
ওগো সঞ্চয়ী, উদ্বৃত্ত যা তা কর দান,
ক্ষুধার অন্ন হোক সবার।
ভোগের পেয়ালা উপচায়ে পড়ে তব হাতে
তৃষাতুরের হিসসা আছে ও- পেয়ালাতে
দিয়া ভোগ কর, বীর, দেদার।
সারমর্ম : ইসলাম ধর্মে কোনো বিভেদ নেই, নেই কোনো অর্থনৈতিক বৈষম্য, সঞ্চয়ের প্রবৃত্তি। তাই নিজের অর্জিত সম্পদ ঈদ-উল-ফিতরে দরিদ্রদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া হয়। কেননা ত্যাগের মধ্যেই মহানুভবতার পরিচয় নিহিত, ভোগে নয়। এসবই ইসলাম ধর্মের প্রকৃত তাৎপর্য বলে এ ধর্মকে শান্তি ও সাম্যের ধর্ম বলা হয়।

২০
উড়িয়া মেঘের দেশে চিল কহে ডাকি;
কি কর চাতক ভায়া ধূলি মাঝে থাকি।
কোথায় উঠেছি চেয়ে দেখ একবার
এখানে আসিতে পার সাধ্য কি তোমার।
চাতক কহিছে, তবু নিচে দৃষ্টি তব,
গদা ভাব কার কিবা ছোঁ মারিয়া লব।
মেঘ বারি ভিন্ন অম্ল জল নাহি খাই,
তাই আমি নিচে থেকে ঊর্ধ্বমুখে চাই।
সারমর্ম : পৃথিবীতে উঁচু-নিচু নানা শ্রেণির মানুষ বাস করে। অর্থের দিক থেকে ধনী হলেও ক্ষুদ্রমনা মানুষ অপরের ক্ষতি করার চেষ্টা করে। অন্যদিকে বড় মনের মানুষ আর্থিকভাবে গরীব হলেও সমাজের সকলের মঙ্গলের জন্য কাজ করেন।

২১
এ জীবনে যে যাহারে প্রাণ ভরি ভালবাসিয়াছে
উচ্চ হোক তুচ্ছ হোক দূরে কিংবা থাক তাহা কাছে,
পাত্র বা অপাত্র হোক, প্রেমেই প্রেমের সার্থকতা;
বিশ্বজয়ী প্রেম কভু বিশ্ব মাঝে জানে না ব্যর্থতা।
প্রেমিকের অশ্রুজলে মন্দাকিনী চির-প্রবাহিত,
প্রণয়ীর দীর্ঘশ্বাসে স্বর্গে গিয়া হয় সে বঞ্চিত,
সত্যের নিষ্ফল-প্রেম স্বর্গে গিয়া হয় সে সফল,
নন্দন-মান্দারে রয় প্রণয়ের পরিমল।”
সারমর্ম : প্রেম সার্থকতা খুজে পায় প্রেমের মাঝেই। প্রেমে ব্যর্থতা বলতে কিছু নেই। প্রেমিকের অশ্রু আর প্রেমিকার দীর্ঘশ্বাস স্বর্গের উদ্যানে ফুল হয়ে ফোটে। মর্ত্যলোকে যে প্রেমকে নিস্ফল মনে হয়, তা সুশোভিত হয় স্বর্গের নন্দন কাননে।

২২
এ দুর্ভাগা দেশ হতে হে মঙ্গলময়,
দূর করে দাও তুমি সব তুচ্ছ ভয়
লোকভয়, রাজভয়, মৃত্যুভয় আর
দীনপ্রাণ দুর্বলের এ পাষাণভার,
এই চিরপেষণযন্ত্রণা, ধূলিতলে
এই নিত্য অবনতি, দন্ডে গলে পরে
এই আত্ম-অবমান, অন্তরে বাহিরে
এই দাসত্বের রজ্জু, ত্রস্ত নত শিরে
সহস্রের পদপ্রান্ততলে বারংবার
মনুষ্য-মর্যাদা-গর্ব চির পরিহার
এ বৃহৎ লজ্জারাশি চরণ আঘাতে
চূর্ণ করি দূর করো। মঙ্গলপ্রভাতে
মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে
উদার আলোক-মাঝে, উন্মুক্ত বাতাসে।
সারমর্ম : লোকনিন্দা, ক্ষমতা ও মৃত্যুর ভয় মানুষের স্বাভাবিক বিকাশকে বাধাগ্রস্থ করে। পরাধীনতার শৃঙ্খল ব্যক্তিত্বকে আঘাত করে আত্মাকে দুর্বল করে ফেলে। সুতরাং স্বাধীনভাবে মাথা তুলে দাঁড়াতে হলে মনের ভেতরের সকল প্রতিকূলতাকে দূর করতে হবে।

২৩
এই-সব মূঢ় ম্লান মূক মুখে
দিতে হবে ভাষা, এই-সব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে
ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা; ডাকিয়া বলিতে হবে-
‘মুহূর্ত তুলিয়া শির একত্র দাঁড়াও দেখি সবে;
যার ভয়ে তুমি ভীত সে অন্যায় ভীরু তোমা-চেয়ে,
যখনি জাগিবে তুমি সম্মুখে তাহার তখনি সে
পথকুক্কুরের মত সংকোচে সত্রাসে যাবে মিশে।
দেবতা বিমুখ তারে, কেহ নাহি সহায় তাহার;
মুখে করে আস্ফালন, জানে সে হীনতা আপনার
মনে মনে।
সারমর্ম : শোষিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের দুঃখের অবসান ঘটাতে হবে। শোষকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে মনোবল জাগাতে হবে। ঐক্যবদ্ধ জনতার সামনে শোষক বা অত্যাচারী যত বড়ই ক্ষমতাবান হোক না কেন তার হীন কর্মের জন্য অপমানিত হবে এবং পরাজয় অনিবার্য।

২৪
একদা ছিল না জুতা চরণ যুগলে,
দহিল হৃদয় মন সেই ক্ষোভানলে।
ধীরে ধীরে চুপি চুপি দুঃখাকুল মনে,
গেলাম ভজনালয়ে ভজন কারণে।
সেথা দেখি একজন পদ নাহি তার,
অমনি জুতার খেদ ঘুচিল আমার।
পরের দুঃখের কথা করিলে চিন্তন,
আপনার মনে দুঃখ থাকে কতক্ষণ?
সারমর্ম : নিজের জুতো নেই বলে ক্ষোভের কিছু নেই। কারণ যার পা নেই সেই দুঃখীজনের কথা ভাবলেই এ দুঃখবোধ স্থান পাবে না। নিজের যা কিছু আছে তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। আর অন্যের দুঃখ-কষ্ট, বেদনা-ক্ষোভ উপলব্ধি করার মধ্যেই মানবজীবনের প্রকৃত সার্থকতা নিহিত।

২৫
একদা পরমমূল্য জন্মক্ষণ দিয়েছে তোমায়
আগন্তুক! রূপের দুর্লভ সত্তা লভিয়া বসেছ
সূর্য-নক্ষত্রের সাথে। দূর আকাশর ছায়াপথে
যে আলোক আসে নামি ধরণীর শ্যামল ললাটে
সে তোমার চক্ষু চুম্বি তোমারে বেঁধেছে অনুক্ষণ
সখ্যডোরে দ্যুলোকের সাথে; যুগ-যুগান্তর হতে
মহাকালযাত্রী মহাবাণী পুণ্য মুহূর্তের তব
শুভক্ষণে দিয়াছে সম্মান; তোমার সম্মুখ দিকে
আত্মার যাত্রার পন্থ গেছে চলি অনন্তের পানে-
সেথা তুমি এক যাত্রী অফুরন্ত এ মহাবিস্ময়।
সারমর্ম : দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত মানবসভ্যতার সঙ্গে মানুষ অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক অনুভব করে। প্রকৃতির সঙ্গেও রয়েছে মানুষের সুসম্পর্ক। প্রকৃতির সান্নিধ্যেই মানুষের জীবন বিকশিত হয়। কিন্তু এই অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ সঙ্গীহীন।

২৬
এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান,
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাবো- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি,
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
সারমর্ম : নতুন প্রজন্মের জন্য পুরাতন প্রজন্মকে স্থান ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু বর্তমান পৃথিবী নানা সংকটে জর্জরিত। তাই সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য সকল জীর্ণতা, ব্যর্থতা, গ্লানি দূর করে দিয়ে নতুন প্রজন্মের জন্য সুন্দর আবাসস্থল গড়ে তুলতে হবে।

২৭
ওই যে লাউয়ের জাংলা পাতা ঘর দেখা যায় একটু দূরে
কৃষক বালা আসছে ফিরে পুকুর হতে কলসী পুরে।
ওই কুঁড়েঘর উহার মাঝেই যে চিরসুখ বিরাজ করে,
নাইরে সে সুখ অট্টালিকায়, নাইরে সে সুখ রাজার ঘরে।
কত গভীর তৃপ্তি যে লুকিয়ে আছে পল্লীপ্রাণে,
জানুক কেহ নাই- বা জানুক সে কথা মোর মনই জানে
মায়ের গোপন বিত্ত যা তার খোঁজ পেয়েছে ওরাই কিছু
মোদের মত তাই ওরা আর ছুটে নাকো মোহের পিছু।
সারমর্ম : সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা আমাদের পল্লীগ্রাম। গ্রামের বধূদের পুকুর থেকে জল নিয়ে আসা এবং জীর্ণ কুটিরে বসবাসের মধ্যেও শান্তির ফল্গুধারা বয়ে যায়। কিন্তু ধনিক শ্রেণির প্রচুর্যের মধ্যেও এ সুখ নেই। তাই শান্ত সিগ্ধ পল্লির মমতাময় জীবন ছেড়ে প্রাচুর্যের মোহের দিকে কেউ ধাবিত হয় না।

২৮
কতবার এল কত না দস্যু, কত না বার
ঠগে ঠগে হল আমাদের কত গ্রাম উজাড়
কত বুলবুলি খেল কত ধান-
কত মা গাইল বর্গীর গান-
তবু বেঁচে থাকে অমর প্রাণ-
এ জনতার-
কৃষাণ, কুমোর, জেলে, মাঝি, তাঁতি আর কামার,
অমর দেশের মাটিতে মানুষ তাদের প্রাণ-
মূঢ় মৃত্যুর মুখে জাগে তাই কঠিন গান।
সারমর্ম : বাঙালির ইতহাস রক্তে রঞ্জিত ইতিহাস। সুদীর্ঘকাল থেকে বাংলার বুকে নেমে এসেছে অত্যাচারের খড়গ। তবু বাংলার সংগ্রামী শ্রমজীবী মানুষ বহিরাগত আক্রমণের মুখেও অব্যাহত রেখেছে জীবনধারা।

২৯
কবি, তবে ওঠে এসো- যদি থাকে প্রাণ
তবে তাই লয়ে সাথে, তবে তাই করো আজি দান।
বড়ো দুঃখ বড়ো ব্যথা - সম্মুখে কষ্টের সংসার
বড়ই দরিদ্র, শূন্য বড় ক্ষুদ্র, বদ্ধ, অন্ধকার।
অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু,
চাই বল, চাই স্বাস্থ্য আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ু,
সাহস বিস্তৃত বক্ষপট। এ দৈন্য-মাঝারে, কবি,
একবার নিয়ে এসো স্বর্গ হতে বিশ্বাসের ছবি।
সারমর্ম : জাতীয় জীবনে সুখ-দুঃখ, হতাশা-ব্যথর্তার গ্লানি মোচন করে জাতির পুনরুজ্জীবনে কবিকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হয়। কবি তাঁর সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে জাতির সংকট উত্তরণে সাহস ও উৎসাহ যোগাবেন। একই সঙ্গে হতাশাগ্রস্ত জাতিকে দেখাবেন নবজীবনের সম্ভাবনা।

৩০
কহিল গভীর রাত্রে সংসার বিরাগী
‘গৃহ তেয়াগিব আমি ইষ্ট-দেব লাগি।
কে আমারে ভুলাইয়া রেখেছে এখানে!” 
দেবতা কহিলা, “আমি।” শুনিল না কানে।
সুপ্তিমগ্ন শয্যার প্রান্তে ঘুমাইছে সুখে।
কহিল, “কে তোরা, ওরে মায়ার ছলনা।”
দেবতা কহিলা, “আমি”। কেহ শুনিল না।
ডাকিল শয়ন ছাড়ি, “তুমি কোথা প্রভু!”
দেবতা কহিলা, “হেথা”। শুনিল না তবু।
স্বপনে কাঁদিল শিশু জননীরে টানি,
দেবতা কহিলা, “ফির”। শুনিল না বাণী।
দেবতা নিঃশ্বাস ছাড়ি কহিলেন, “হায়,
আমারে ছাড়িয়া ভক্ত চলিল কোথায়!”
সারমর্ম : স্রষ্টার কাছে প্রিয় তাঁর সৃষ্টি। তাই তাঁর সৃষ্টিকে ভালোবাসলে তাঁকে পাওয়া যায়। তাই সংসার ধর্ম ত্যাগ করে কখনো স্রষ্টাকে পাওয়া যাবে না। বরং গৃহে থেকেই স্রষ্টার সাধনা করা যায়।

৩১
কহিল মনের খেদে মাঠ সমতল
মাঠ ভারে দেই আমি কত শস্য ফল;
পর্বত দাঁড়ায়ে রহে কি জানি কি কাজ
পাষাণের সিংহাসনে তিনি মহারাজ।
বিধাতার অবিচারে কেন উঁচু নিচু,
সে কথা বুঝিতে আমি নাহি পারি কিছু।
গিরি কহে, “সব হলে সমভূমি পারা
নামিত কি ঝরনার সুমঙ্গল ধারা?”
সারমর্ম : এ বিশ্বসংসারে সবাই একই রকম কর্তব্য পালন করে না। তাই বলে কাউকে ছোট বা অপ্রয়োজনীয় মনে করা যাবে না। বরং যে কেউ, যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন সবাইকে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয়। কারণ সবকিছুরই একে অপরের প্রতি একটা যোগসূত্র আছে।

৩২
কিসের তরে অশ্রু ঝরে, কিসের লাগি দীর্ঘশ্বাস।
হাস্যমুখে অদৃষ্টের করব মোরা পরিহাস।
রিক্ত যারা সর্বহারা, সর্বজয়ী বিশ্বে তারা,
গর্বময়ী ভাগ্যদেবীর নয়কো তারা ক্রীতদাস।
হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে করব মোরা পরিহাস।
আমরা সুখের স্ফীত বুকের ছায়ার তলে নাহি চরি।
আমরা দুঃখের বক্রমুখের চক্র দেখে ভয় না করি।
ভগ্ন ঢাকে যথাসাধ্য বাজিয়ে যাব জয়বাদ্য,
ছিন্ন আশার ধ্বজা তুলে ভিন্ন করব নীলাকাশ।
হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে করব মোরা পরিহাস।।
সারমর্ম : মানবজীবন যেমন ক্ষণস্থায়ী তেমনি সংগ্রামমুখর। এই সংগ্রামে সুখের সঙ্গে দুঃখ কষ্ট বিদ্যমান। তাই দুঃখের সময় হতাশায় নিমজ্জিত হওয়া যাবে না। বরং সকল দুঃখ-কষ্ট, প্রতিকূলতা জয় করে সম্মুখে এগিয়ে যাওয়াই বাঞ্ছনীয়।

৩৩
কী গভীর দুঃখে মগ্ন সমস্ত আকাশ,
সমস্ত পৃথিবী চলিতেছে যতদূর
শুনিতেছি একমাত্র মর্মান্তিক সুর,
‘যেতে আমি দেব না তোমায়।’ ধরণীর
প্রান্ত হতে নীলাভ্রের সর্বপ্রান্ততীর
ধ্বনিতেছে চিরকাল অনাদ্যন্ত রবে,
‘যেতে নাহি দিব; যেতে নাহি দিব।’ সবে
কহে, ‘যেতে নাহি দিব।’ তৃণ ক্ষুদ্র অতি,
তাঁরেও বাঁধিয়া বক্ষে মাতা বসুমতী
কহিছেন প্রাণপণে, ‘যেতে নাহি দিব।’
আয়ুক্ষীণ দীপমুখে শিখা নিব-নিব,-
আঁধারে গ্রাস হতে কে টানিছে তারে,
কহিতেছে শতবার, ‘যেতে দিব নারে।’
এ অনন্ত চরাচরে স্বর্গমর্ত্য ছেয়ে
সবচেয়ে পুরাতন কথা, সবচেয়ে
গভীর ক্রন্দন, ‘যেতে নাহি দিব।’ হায়,
তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়।
সারমর্ম : এ পৃথিবীতে কোনো প্রাণীই চিরস্থায়ী নয়। তবু এ পৃথিবী থেকে কেউ যেমন চলে যেতে চায় না তেমনি সবাই সবাইকে ধরে রাখতে চায়, কিন্তু সবাই ব্যর্থ। ইহকাল ছেড়ে একদিন সবাইকে চলে যেতে হবে। এটাই জগতের বিধান।

৩৪
কুকুর আসিয়া এমন কামড় দিল পথিকের পায়,
কামড়ের চোটে বিষদাঁত ফুটে বিষ লেগে গেল তায়।
ঘরে ফিরে এসে রাত্রে বেচারা বিষম ব্যথায় জাগে,
মেয়েটি তাহার, তারি সাথে হায়., জাগে শিয়রের আগে।
বাপেরে সে বলে ভর্ৎসনা ছলে কপালে রাখিয়া হাত,
তুমি কেন বাবা ছেড়ে দিলে তারে, তোমার কি নেই দাঁত?
কষ্টে হাসিয়া আর্ত কহিল, “তুইরে হাসালি মোরে,
দাঁত আছে বলে কুকুরে গায়ে দংশি কেমন করে?
কুকুরের কাজ কুকুর করেছে, কামড় দিয়েছে পায়,
তা’বলে কুকুরে কামড়ানো কিরে মানুষের শোভা পায়?
সারমর্ম : দুর্জন ব্যক্তিরা হীন কর্ম করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যারা মহান, প্রকৃত মনুষ্যত্বের অধিকারী, তারা কখনো আঘাত পেলেও পাল্টা আঘাত করবে না। বরং শত দুঃখ-কষ্ট, লাঞ্ছনার মধ্যেও সহিষ্ণুতার পরিচয় দেন।

৩৫
কে বলে তোমারে বন্ধু, অস্পৃশ্য অশুচি
শুচিতা ফিরিছে সাদা তোমারি পিছনে।
তুমি আছ, গৃহবাসে তাই আছে রুচি,
নইলে মানুষ বুঝি ফিরে যেত বনে।
শিশুজ্ঞানে সেবা তুমি করিতেছ সবে,
ঘুচাইছ রাত্রিদিন সর্ব ক্লেদ গ্লানি।
ঘৃণার নাহিক কিছু স্নেহের মানবে,
হে বন্ধু, তুমিই একা জেনেছ সে বাণী।
নির্বিচারে আবর্জনা বহু অহর্নিশ
নির্বিকার সদা শুচি তুমি গঙ্গাজল।
নীলকণ্ঠ করেছেন পৃত্বীবে নির্বিষ।
আর তুমি? তুমি তারে করেছ নির্মল।
এস বন্ধু, এস বীর, শক্তি দাও চিতে
কল্যাণের কর্ম করি লাঞ্ছনা সহিতে।
সারমর্ম : অস্পৃশ্য, অশুচি বলে সমাজের নিচু শ্রেণির মানুষদের অপবাদ দেয়া অন্যায়। তারা কাজ ও পরিশ্রমের মাধ্যমে সমস্ত জঞ্জাল পরিষ্কার করে পৃথিবীকে বসবাসের উপযোগী করে। তাদের নিকট থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে এবং আমাদের উচিত এই মেহনতি মানুষদের সম্মান করা।

৩৬
কে তুমি খুঁজিছ জগদীশে ভাই, আকাশপাতাল জুড়ে
কে তুমি ফিরিছ বন জঙ্গলে, কে তুমি পাহাড়-চূড়ে?
হায় ঋষি দরবেশ,
বুকের মানিককে বুকে ধরে তুমি খোঁজ তারে দেশ দেশ।
সৃষ্টি রয়েছে তোমা পানে চেয়ে তুমি আছ চোখ বুঁজে,
স্রষ্টারে খোঁজো আপনারে তুমি আপনি ফিরিছ খুঁজে।
ইচ্ছা-অন্ধ। আঁখি খোলো, দেখ দর্পণে নিজ কায়া,
দেখিবে তোমারি সব অবয়বে পড়েছে তাঁহার ছায়া।
সকলের মাঝে প্রকাশ তাঁহার, সকলের মাঝে তিনি,
আমারে দেখিয়া আমার অদেখা জন্মদাতারে চিনি।
সারমর্ম : বিধাতাকে পাওয়ার জন্য মানুষ সংসার ত্যাগ করে বৈরাগী হতে চায়। কিন্তু স্রষ্টা তার সৃষ্টির মধ্যেই বিরাজমান। তাই অন্তর্দৃষ্টি খুলে নিজেকে জানার মাধ্যমেই বিধাতাকে খুজে পাওয়া যায়।

৩৭
রিপুর তাড়নে যখনই মোদের বিবেক পায় গো লয়,
আত্মগ্লানির নরক অনলে তখনই পুড়িতে হয়।
প্রীতি ও প্রেমের পুণ্য বাঁধনে যবে মিলি পরস্পরে,
স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদেরই কুঁড়েঘরে।
সারমর্ম : স্বর্গ ও নরক দূরে কোথাও নয়, মানুষের মাঝেই বিদ্যমান। নিজের কর্মফলের মধ্য দিয়ে মানুষ স্বর্গ ও নরকের ফল ভোগ করে। যারা বিবেকবর্জিত অন্যায় করে বেড়ায় তারা পৃথিবীতেই নরক যন্ত্রণার ফল ভোগ করে। পক্ষান্তরে যারা হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা ত্যাগ করে সবার সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখে তারা পৃথিবীতেই স্বর্গ সুখ লাভ করে।

৩৮
ক্রন্দিছে নিখিল বন্দী, হে নবীন, মুক্ত কর তারে,
নিয়ে চল আলো অভিসারে।
পৃথিবীর অধিকার-বঞ্চিত যে ভিক্ষুকের দল-,
জীবনের বন্যাবেগে তাদের কর বিচঞ্চল। অসত্য অন্যায়
যত ডুবে থাক, সত্যের প্রসাদ
পিয়ে লভ অমৃতের স্বাদ।
অজস্র মৃত্যুরে লঙ্ঘি হে নবীন, চল অনায়াসে
মৃত্যুঞ্জয়ী জীবন-উল্লাসে।
সারমর্ম : এ পৃথিবীতে নবীনরাই মৃত্যুভয়কে জয় করে অন্ধকারাচ্ছন্ন বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিতে পারে। তাইতো শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনে প্রতিবাদী হয়ে সংগ্রামের পথে যেতে হবে। মানবতার এ পথই চিরায়ত কল্যাণের পথ।

৩৯
ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দুর্বলতা,
হে রুদ্র, নিষ্ঠুর যেন হতে পারি তথা।
তোমার আদেশ, যেন রসনায় মম
সত্য বাক্য জ্বলি উঠে খর খড়গ সম।
তোমার বিচারাসনে লয়ে নিজ স্থান।
অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।
সারমর্ম : ক্ষমা মহৎ গুণ হলেও তা যেন সত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাধাপ্রাপ্ত না হয়। যদি হয় তাহলে সেখানে দুর্বলতা প্রকাশ পায়। এজন্য অন্যায়কারীকে প্রশ্রয় না দেওয়াই উত্তম। কেননা, অন্যায়কারী এবং অন্যায় সহ্যকারী দুজনেই সমঅপরাধী।

৪০
ক্ষুদ্র এই তৃণদল ব্রহ্মান্ডের মাঝে
সরল মাহাত্ম্য লয়ে সহজে বিরাজে;
পূরবের নব সূর্য, নিশীথের শশী
তৃণটি তাদেরি সাথে একাসনে বসি।
আমার এ গান এও জগতের গানে
মিশে যায় নিখিলের মর্ম মাঝখানে;
শ্রাবণের ধারাপাত, বনের মর্মর
সকলের মাঝে তার আপনার ঘর।
কিন্তু হে বিলাসী, তব ঐশ্বর্যের ভার।
ক্ষুদ্র রুদ্ধ দ্বারে শুধু একাকী তোমার।
সারমর্ম : তৃণলতা যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে তারও যোগসূত্র রয়েছে। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের দিক দিয়ে সে সূর্য ও চাঁদের সঙ্গে সমগোত্রীয়। কবির সংগীতের সুরও মিশে যায় বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে। কিন্তু ভোগবিলাসীরা সম্পদকে একান্তভাবে নিজের মনে করে। যে কারণে তারা বিশ্বপ্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন।

৪১
খেয়া নৌকা পারাপার করে নদীস্রোতে,
কেহ যায় ঘরে, কেহ আসে ঘর হতে।
দুই তীরে দুই গ্রাম আছে জানাশোনা,
সকাল হইতে সন্ধ্যা করে আনাগোনা।
পৃথিবীতে কত দ্বন্দ্ব, কত সর্বনাশ,
নূতন নূতন কত গড়ে ইতিহাস-
রক্তপ্রবাহের মাঝে ফেনাইয়া উঠে
সোনার মুকুট কত ফুটে আর টুটে!
সভ্যতার নব নব কত তৃষ্ণা ক্ষুধা
উঠে কত হলাহল, উঠে কত সুধা!
শুধু হেথা দুই তীরে, কেবা জানে নাম,
দোঁহাপানে চেয়ে আছে দুইখানি গ্রাম।
এই খেয়া চিরদিন চলে নদীস্রোতে-
কেহ যায় ঘরে, কেহ আসে ঘর হতে।
সারমর্ম : সভ্যতার উষালগ্ন থেকে পৃথিবীতে দ্বন্দ্ব-সংঘাত বিরাজমান। ফলে রক্ত সংঘাতের মধ্য দিয়ে নতুন নতুন ইতহাস, সাম্রাজ্য রচিত হচ্ছে। অথচ বাংলার গ্রাম এ থেকে ব্যতিক্রম। নেই কোনো দ্বন্দ্ব-সংঘাত বরং তাদের মধ্যে রয়েছে প্রীতির বন্ধন। এখানে কেউ খেয়া পার হয়ে যায় অথবা কেউ আসে। অর্থাৎ তাদের মধ্যে সহজ সরল জীবনধারা বিরাজমান।

৪২
খোদা বলিবেন, হে আদম সন্তান,
আমি চেয়েছিনু ক্ষুধার অন্ন, তুমি কর নাই দান।
মানুষ বলিবে, তুমি জগতের প্রভু,
আমরা তোমারে কেমনে খাওয়াব, সে কাজ কী হয় কভু?
বলিবেন খোদা-ক্ষুধিত বান্দা গিয়াছিল তব দ্বারে
মোর কাছে তুমি ফিরে পেতে তাহা যদি খাওয়াইতে তারে।
সারমর্ম : স্রষ্টার কাছে প্রিয় তার সৃষ্টি, আর সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হলো মানুষ। মানুষ ইচ্ছে করলেও স্রষ্টা সরাসরি সেবা করতে পারে না। তাই মানুষের মধ্যে যারা ক্ষুধার্ত তাদেরকে সেবা করলেই ¯স্রষ্টাকে সেবা করা হয়। বিনিময়ে ¯স্রষ্টা ক্ষুধার্তের সেবাকারীকে সমতুল্য সুখ দান করেন।

৪৩
গাহি তাহাদের গান-
ধরণীর হাতে দিল যারা জানি ফসলের ফরমান।
শ্রম-কিণাঙ্ক কঠিন যাদের নির্দয় মুঠি-তলে
ত্রস্তা ধরণী নজরানা দেয় ডালি ভরে ফুলে-ফলে।
বন্য-শ্বাপদ-সঙ্কুল জরা-মৃত্যু-ভীষণ ধরা
যাদের শাসনে হল সুন্দর কুসুমিতা মনোহারা।
সারমর্ম : যাদের কঠিন শ্রমে পৃথিবীর বুকে ফসল উৎপন্ন হয়েছে কবি তাদের জয়গান গেয়েছেন। শ্রমজীবীদের রক্ত ও ঘামেই সভ্যতার বিকাশ ঘটে। তাদের শ্রমেই পৃথিবী অনুপম সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর হয়ে ওঠে। তাই যে শ্রমজীবীরা জরা, মৃত্যুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে তাদেরই জয়গান গাওয়া উচিত।

৪৪
চাব না পশ্চাতে মোরা, মানিব না বন্ধন ক্রন্দন
হেরিব না দিক-
গণিব না দিনক্ষণ, করিব না বিতর্ক বিচার-
উদ্দাম পথিক।
মুহূর্তে করিব পান মৃত্যুর ফেনিল উন্মত্ততা
উপকণ্ঠ ভরি –
খিন্ন শীর্ণ জীবনের শত লক্ষ ধিক্কার লাঞ্ছনা
উৎসর্জন করি।
সারমর্ম : যারা নব উদ্যমের পথিক তারা কখনো অতীতের মোহে আচ্ছন্ন হয় না, মানে না কোনো বাধা বন্ধন। বরং আত্মত্যাগের মহান মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে লাঞ্ছিত জীবনের পরিবর্তে সম্ভাবনাময় জীবনের লক্ষ্যে সামনে এগিয়ে যায়।

৪৫
মুহূর্তে নিমেষ কাল, তুচ্ছ পরিমাণ,
গড়ে যুগ যুগান্তর-অনন্ত মহান।
প্রত্যেক সামান্য ত্রুটি, ক্ষুদ্র অপরাধ,
ক্রমে টানে পাপপথে, ঘটায় প্রমাদ।
প্রিত করুণার দান, স্নেহপূর্ণ বাণী,
এ ধারায় স্বর্গসুখ নিত্য দেয় আনি।
সারমর্ম : ক্ষুদ্র থেকেই বৃহতের সৃষ্টি। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা নিয়ে গড়ে ওঠে মহাদেশ, বিন্দু বিন্দু জল নিয়ে মহাসাগর, তুচ্ছ মুহূর্ত নিয়ে যুগ যুগান্তর। আবার ছোট অপরাধ থেকেই সংঘটিত হয় বড় পাপ।

৪৬
কোন্ রণে কত খুন দিল নর, লেখা আছে ইতিহাসে,
কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে।
কত মাতা দিল হৃদয় উপড়ি কত বোন দিল সেবা,
বীরের স্মৃতি স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা?
কোন কালে একা হয়নিক জয়ী পুরুষের তরবারী,
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয়-লক্ষ্মী নারী।
সারমর্ম : মানব সভ্যতায় পুরুষের পাশাপাশি নারীর ভূমিকা ও অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় নারীর কোন স্থান হয়নি। অথচ পুরুষের সকল কাজের শক্তি, সাহস ও প্রেরণার যোগানদাতা হচ্ছে নারী।

৪৭
জলে না নামিলে কেহ শিখে না সাঁতার
হাঁটিতে শিখে না কেহ না খেয়ে আছাড়,
সাঁতার শিখতে হলে
আগে তবে নাম জলে,
আছাড়ে করিয়া হেলা হাঁট বার বার
পারিব বলিয়া সুখে হও আগুসর।
সারমর্ম : যে কোনো বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষণ সেই সাথে অনুশীলন। কেননা, জলে না নেমে যেমন সাঁতার শেখা যায় না, তেমনি আছাড় না খেলে হাঁটা যায় না। তাই হতাশ না হয়ে সকল দুঃখ কষ্ট সহ্য করে জয়ী হব এই মনোভাব নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়াই উচিত।

৪৮
জাতিতে জাতিতে ধর্মে নিশিদিন হিংসা ও বিদ্বেষ
মানুষে করিছে ক্ষুদ্র, বিষাইছে বিশ্বের আকাশ,
মানবতা মহাধর্ম রোধ করি করিছে উল্লাস
বর্বরের হিংস্র নীতি, ঘৃণা দেয় বিকৃত নির্দেশ।
জাতি-ধর্ম-দেশ উর্ধ্বে ঘৃণা উর্ধ্বে পাচ্ছ যেই দেশ,
সেথায় সকলে এক, সেথায় মুক্ত সত্যের প্রকাশ,
মানবসভ্যতা সেই মুক্ত সত্য লভুক বিকাশ,
মহৎ সে মুক্তি-সংজ্ঞা মঙ্গল সে নির্বার অশেষ।
জাতি-ধর্ম-রাষ্ট্র ন্যায় সকলি যে মানুষের তরে
মানুষ সবার উর্ধ্বে নহে কিছু তাহার অধিক।
সারমর্ম : মানুষের মধ্যে যে হিংসা বিদ্বেষ বিরাজমান তার মূল কারণ ধর্মীয় ও জাতিগত পার্থক্য। অথচ যেখানে মানবধর্মই বড় ধর্ম, সেখানে জাতিগত বিভেদের কারণে মানবতা ধুলায় লুণ্ঠিত। তাই মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে ধর্মীয় সংঘাত পরিহার করে পৃথিবীর মঙ্গল নিশ্চিত করতে মানবতাকেই দেশকালের ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে।

৪৯
জীবনে যত পূজা হলো না সারা
জানি হে, জানি তাও হয়নি হারা।
যে ফুল না ফুটিতে ঝরেছে ধরণীতে
যে নদী মরুপথে হারালো ধারা
জানি হে, জানি তাও হয়নি হারা।
জীবনে আজো যারা রয়েছে পিছে
জানি হে, জানি তাও হয়নি মিছে
আমার অনাগত আমার অনাহত
তোমার বীণাতারে বাজিছে তারা
জানি হে, জানি তাও হয়নি হারা।
সারমর্ম : এ বিশ্ব জগতে কোনো কর্মই তুচ্ছ বা মূল্যহীন নয়। আমরা দৈনন্দিন জীবনে অনেক কর্ম শুরু করে এর গুরুত্ব বিবেচনা না করে অসমাপ্ত রেখে দেই। কিন্তু এই অসমাপ্ত কাজের ভেতরেই হয়তো সুপ্ত আছে ভাবীকালের সম্ভাবনা। তাই ভবিষ্যতের সম্ভাবনাময় জীবনের জন্য অসমাপ্ত কাজের প্রতি হতাশ হওয়ার কোনো অবকাশ নেই।

৫০
জীবন্ত ফুলের ঘ্রাণে,
দুপুরের মিহি ঘুম ছিঁড়ে কুঁড়ে গেল :
জেগে দেখি আমি
আমার ঘরেতে ওড়ে ছোট এক বুনো মৌমাছি,
ডানায় ডানায় যার সোঁদাগন্ধ অজানা বনের।
কেমন সুন্দর ওই উড়ন্ত মৌমাছি।
অশ্রান্ত করুণ ওর গুণগুণানিতে
কেঁপে ওঠে মাটির মসৃণতম গান,
আর দূর পাহাড়ের বন্ধুর বিষন্ন প্রতিধ্বনি।
যেন আজ বাহিরের সমস্ত পৃথিবীর আর সমস্ত আকাশ
আমার ঘরের মাঝে তুলে নিয়ে এল
কোথাকার ছোট এক বুনো মৌমাছি।
সারমর্ম : ঘরের চারদেয়ালের কৃত্রিম পরিবেশের মধ্যে আবদ্ধ থাকলে প্রকৃতির সান্নিধ্য যেমন পাওয়া যায় না তেমনি প্রকৃতিকে অনুভবও করা যায় না। এই কৃত্রিম পরিবেশের মধ্যে যদি কখনো লীলাময়ী প্রকৃতি মুক্তহস্তে সৌন্দর্য বিতরণ করে তাহলে আবার মানুষের হৃদয়ে অনির্বচনীয় ভাবের হিল্লোল তুলে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক তা কখনো অস্বীকার করা যায় না।


সারমর্ম (১ থেকে ৫০)
সারমর্ম (৫১ থেকে ১০০)
সারমর্ম (১০১ থেকে ১৫০)
সারমর্ম (১৫১ থেকে ২০০)

1 Comments

Post a Comment
Previous Post Next Post