মার্চের দিনগুলি

সারাংশ - (১ থেকে ৫০)

সারাংশ (১ থেকে ৫০)
সারাংশ (৫১ থেকে ১০০)


অতীতকে ভুলে যাও। অতীতের দুশ্চিন্তার ভার অতীতকেই নিতে হবে। অতীতের কথা ভেবে ভেবে অনেক বোকাই মরেছে। আগামীকালের বোঝার সঙ্গে মিলে আজকের বোঝা সবচেয়ে বড় হয়ে দাঁড়ায়। ভবিষ্যৎকেও অতীতের মতো দৃঢ়ভাবে দূরে সরিয়ে দাও। আজই তো ভবিষ্যৎ-কাল বলে কিছু নেই। মানুষের মুক্তির দিন তো আজই। ভবিষ্যতের কথা যে ভাবতে বসে সে ভোগে শক্তিহীনতায়, মানসিক দুশ্চিন্তায় ও স্নায়ুবিক দুর্বলতায়। অতএব অতীতের এবং ভবিষ্যতের দরজায় আগল লাগাও, আর শুরু করো দৈনিক জীবন নিয়ে বাঁচতে।
সারাংশ : মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় হলো বর্তমান। অতীত এবং ভবিষ্যতের ভাবনা মানুষের জীবনে কোনো সুফল বয়ে আনে না। বরং তা মানুষকে শক্তিহীন, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত এবং স্নায়ুবিকভাবে দুর্বল করে তোলে। তাই জীবনকে সফল করে তুলতে হলে অতীত ও ভবিষ্যতের চিন্তা ঝেড়ে ফেলে বর্তমানকে গুরুত্ব দিতে হবে।

অতীতকে ভুলে যাও। ভবিষ্যত দরজায় খিল তুলে পরম নিশ্চিন্তে বর্তমানে বাসরসজ্জা রচনা করো। নদীর দিকে তাকাও-যে স্রোত চলে যায়, তা আর ফিরে আসে না। দূর নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে তাকাও, তার রহস্য এক অচিন্তনীয় তমসায় আচ্ছন্ন। কী লাভ অন্ধকারে? স্বচ্ছ সুন্দর বর্তমানকে ভালবাস। প্রতি মুহূর্তের কর্মই তোমার বর্তমান।
সারাংশ : অতীত বা অজানা ভবিষ্যতের ভাবনা নয় বর্তমানের ভাবনাই মানুষের জীবনকে সার্থক করে তোলে। তাই অতীতের স্মৃতিচারণা নয়, ভবিষ্যতের রহস্য উদঘাটনের চেষ্টাও নয়, স্বচ্ছ সুন্দর বর্তমানই আমাদের জীবনের প্রকৃত সত্য।

অর্ধ শতাব্দীর অধিককাল ধরিয়া বাংলা ভাষায় বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ-সকল প্রচারিত হইতেছে; কিন্তু ইহাতে বিশেষ কিছু ফলাফল হইয়াছে কি? বিজ্ঞান-বিষয়ক যে-সকল পুস্তকের কিছু কাটতি আছে, তাহা পাঠ্য-পুস্তক নির্বাচিত কমিটির নির্বাচিত তালিকাভুক্ত। সুতরাং পুস্তক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইবার সোপান স্বরূপ। আসল কথা এই যে, আমাদের দেশ হইতে প্রকৃত জ্ঞানস্পৃহা চলিয়া গিয়াছে। জ্ঞানের প্রতি একটা আন্তরিক টান থাকিলেও কেবল বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের অঙ্গীভূত বিদ্যালয়সমূহে বহুকাল হইতে বিজ্ঞান অধ্যাপনার ব্যবস্থা হইয়াছে। তথাপি এই জ্ঞানস্পৃহার অভাবেই বিজ্ঞানের প্রতি আন্তরিক অনুরাগসম্পন্ন ছাত্র আদৌ দেখিতে পাওয়া যায় না; কেননা ঘোড়াকে জলাশয়ের নিকট আনিলে কি হইবে? উহার তৃষ্ণা নাই। পরীক্ষা পাশ করাই যেখানকার ছাত্রজীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য, সেখানকার যুবকগণের দ্বারা অতীত বৈজ্ঞানিক বিদ্যার শাখা-প্রশাখাদির উন্নতি হইবে, এই হাস্যোদ্দীপক উন্মত্ততা অন্য কুত্রাপিও দেখিতে পাওয়া যায় না। অপরপক্ষে অপরাপর দেশের লোকেরা একথা সম্যক উপলব্ধি করিয়াছেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার হইতে বাহির হওয়াই জ্ঞানসমুদ্রে মন্থনের প্রশস্ত সময়। আমরা দ্বারকেই গৃহ বলিয়া মনে করিয়াছি, সুতরাং জ্ঞানমন্দিরের দ্বারেই অবস্থান করি, অভ্যন্তরস্থ রত্মরাজি দৃষ্টিগোচর না করিয়াই ক্ষুন্ন মনে প্রত্যাবর্তন করি।
সারাংশ : আমাদের দেশে প্রকৃত জ্ঞান চর্চার প্রতি মানুষের আগ্রহ নেই বললেই চলে। জ্ঞানস্পৃহার অভাবে এদেশে বিজ্ঞানচর্চা প্রসার লাভ করেনি। সকলেই পরীক্ষায় পাশ করার জন্য ব্যগ্র বলেই এদেশে প্রাপ্ত গ্রন্থসমূহও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রদত্ত তালিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষার্থীদের আগ্রহকে জাগিয়ে তুলে উন্নত দেশের মতো আমাদের দেশকেও বিজ্ঞানচর্চার কেন্দ্রে পরিণত করতে হবে।

অনেকের ইন্দ্রিয় সংযত, তাঁহাদের চিত্ত শুদ্ধ নয়। ইন্দ্রিয়-সুখ ভোগ করব না, কিন্তু আমি ভালো থাকব এবং আমার ইন্দ্রিয়গুলো ভালো থাকবেÑএই বাসনা তাদের মনে প্রবল। আমার ধন হউক, আমার মান হউক, আমার সম্পদ হউক, আমার সৌভাগ্য হউক, আমি বড় হই, আর সবাই আমার চেয়ে ছোট হউক, তাঁরা এরূপ কামনা করেন। এই সকল অভীষ্ট যাতে সিদ্ধ হয়, তাঁরা চিরকাল সেই চেষ্টায় সেই উদ্যোগে ব্যস্ত থাকেন। সেই জন্য না করেন এমন কাজ নেই, তদ্ভিন্ন মন দেন এমন বিষয় নেই। যারা ইন্দ্রিয়াসক্ত তাদের অপেক্ষাও এরা নিকৃষ্ট। এদের নিকট ধর্ম কিছুই নয়, জ্ঞান কিছুই নয়, ভক্তি কিছুই নয়। তাঁরা আল্লাহকে বাহ্যত মানেন বটে, কিন্তু কার্যত তাঁদের ধর্ম বলে কিছুই নেই। কেবল আপনি আছেন, আপনি ভিন্ন আর কিছুই নেই। ইন্দ্রিয়াসক্তি অপেক্ষাও এই স্বার্থপরতা চিত্ত-শুদ্ধির অন্তরায়। পরার্থ ভিন্ন চিত্ত-শুদ্ধি নেই।
সারাংশ : জীবনকে সার্থক করে তুলতে হলে কেবল ইন্দ্রিয়াসক্তি থেকে মুক্ত হলেই চলবে না মনকেও শুদ্ধ করে তুলতে হবে। যাদের ইন্দ্রিয় সংযত কিন্তু মন শুদ্ধ নয় তারা নিজ স্বার্থের জন্য সব কিছুই করতে পারে। বাইরে নিজেদের ধার্মিক বলে পরিচয় দিলেও ধর্মের মূল যে কথা পরোপকার তা থেকে তারা অনেক দূরে। সেই মানুষই সার্থক যার ইন্দ্রিয় সংযত, মন শুদ্ধ এবং পরার্থ চিন্তাই যার ব্রত।

অনেকে বলেন, স্ত্রীলোকদের উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন নাই। মেয়েরা চর্বচোষ্য রাঁধিতে পারে, বিবিধ প্রকার সেলাই করিতে পারে, দুই-চারিখানা উপন্যাস পাঠ করিতে পারে, ইহাই যথেষ্ট, আর বেশি আবশ্যক নাই। কিন্তু ডাক্তার বলেন যে, আবশ্যক আছে, যেহেতু মাতার দোষ-গুণ লইয়া পুত্রগণ ধরাধামে অবতীর্ণ হয়। এইজন্য দেখা যায় যে, আমাদের দেশে অনেক বালক শিক্ষকদের বেত্রতাড়নায় কণ্ঠস্থ বিদ্যার জোরে এফএ, বিএ পাস হয় বটে; কিন্তু বালকের মনটা তাহার মাতার সহিত রান্নাঘরেই ঘুরিতে থাকে।
সারাংশ : যারা নারীদের চার দেয়ালে বন্দি রাখার পক্ষে তারা মনে করে যে নারীদের উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন নেই। কিন্তু সন্তান যেহেতু মায়ের দ্বারা প্রভাবিত হয় সেহেতু নারীদের উচ্চশিক্ষা একান্ত প্রয়োজন। তা না হলে মায়ের ক্ষুদ্র গন্ডিতে সন্তানের মনও আবদ্ধ থাকবে। হয়ত সে উচ্চশিক্ষা লাভ করবে ঠিকই কিন্তু তার মন প্রসার লাভ করবে না।

অনেকের ধারণা এই যে, মহৎ ব্যক্তি শুধু উচ্চবংশেই জন্মগ্রহণ করে থাকেন; নীচকুলে মহত্ত্বের জন্ম হয় না। কিন্তু প্রকৃতির দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় যে, মানুষের এ ধারণা ভ্রমাত্মক। পদ্ম ফুলের রাজা; রুপে ও গন্ধে সে অতুলনীয়। কিন্তু এর জন্ম হয় পানের অযোগ্য পানিভরা এঁদো পুকুরে। পক্ষান্তরে বটবৃক্ষ বৃক্ষকুলের মধ্যে বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন বটে। অথচ বহু বৃক্ষের ফল আমরা আস্বাদন করি। কিন্তু এত খ্যাতনামা যে বটবৃক্ষ তাহার ফল আমাদের অখাদ্য।
সারাংশ : বংশমর্যাদা মানুষের মহত্ত্বের পরিচায়ক নয়। মানুষ তার হৃদয়ের বিশালতা, প্রতিভা, গুণাবলি প্রভৃতির মাধ্যমেই মহৎ হয়ে ওঠে। কেবল মানবসমাজই নয় প্রকৃতির মধ্যেও এ বিষয়টি লক্ষণীয়।

অপরের জন্য তুমি তোমার প্রাণ দাও, আমি বলতে চাই নে। অপরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুঃখ তুমি দূর করো। অপরকে একটুখানি সুখ দাও। অপরের সঙ্গে একটুখানি মিষ্টি কথা বলো। পথের অসহায় মানুষটির দিকে একটা করুণ কটাক্ষ নিক্ষেপ করো। তাহলেই অনেক হবে। চরিত্রবান, মনুষ্যত্বসম্পন্ন মানুষ নিজের চেয়ে পরের অভাবে বেশি অধীর হন, পরের দুঃখকে ঢেকে রাখতে গৌরববোধ করেন।
সারাংশ : অন্যের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করতে হবে এমন কোনো কথা নেই ।জীবন উৎসর্গ না করে ছোট ছোট দুঃখ দূর করার মধ্য দিয়েও অন্যকে সুখী করা যায়। নিজের কথা না ভেবে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল হলে অসহায় মানুষ উপকৃত হয়। মহৎ ব্যক্তিরা এভাবে সর্বদাই নিজের সুখ-দুঃখকে উপেক্ষা করে পরের কল্যাণ কামনায় ব্রতী হন।

অভাব আছে বলিয়া জগৎ বৈচিত্র্যময় হইয়াছে। অভাব না থাকিলে জীব-সৃষ্টি বৃথা হইত। অভাব আছে বলিয়া অভাব-পূরণে এত উদ্যোগ। সংসার অভাবক্ষেত্র বলিয়া কর্মক্ষেত্র। অভাব না থাকিলে সকলেই স্থানু-স্থবির হইত, মনুষ্যজীবন বিড়ম্বনাময় হইত। মহাজ্ঞানীগণ অপরের অভাব দূর করিতে সর্বদা ব্যস্ত। জগতে অভাব আছে বলিয়াই মানুষ সেবা করিবার সুযোগ পাইয়াছে। সেবা মানবজীবনের পরম ধর্ম। সুতরাং অভাব হইতেই সেবাধর্মের সৃষ্টি হইয়াছে। আর এই সেবাধর্মের দ্বারাই মানুষের মনুষ্যত্বসুলভ গুণ সার্থকতা লাভ করিয়াছে।
সারাংশ : অভাব মানুষকে কর্মের পথে চালিত করে জগতকে বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে। অভাব আছে বলেই মানবজীবন চলমান। এ অভাব থেকেই সেবাধর্ম উৎপত্তি লাভ করেছে। অপরের অভাব পূরণের ইচ্ছা এবং তা বাস্তবে রূপ দেওয়ার মধ্য দিয়েই মানুষ মহান হয়ে ওঠে।

অভ্যাস ভয়ানক জিনিস। একে হঠাৎ স্বভাব থেকে তুলে ফেলা কঠিন। মানুষ হবার সাধনাতেও তোমাকে সহিষ্ণু হতে হবে। সত্যবাদী হতে চাও? তাহলে ঠিক করো, সপ্তাহে অন্তত এক দিন মিথ্যা বলবে না। ছ’মাস ধরে এমনই করে নিজে সত্য কথা বলতে অভ্যাস করো। তারপর এক শুভ দিনে আর একবার প্রতিজ্ঞা করো, সপ্তাহে তুমি দুদিন মিথ্যা বলবে না। এক বছর পরে দেখবে সত্য কথা বলা তোমার কাছে অনেকটা সহজ হয়ে পড়বে। সাধনা করতে করতে এমন একদিন আসবে যখন ইচ্ছে করলেও মিথ্যা বলতে পারবে না। নিজেকে মানুষ করার চেষ্টায় পাপ ও প্রবৃত্তির সঙ্গে সংগ্রামে তুমি হঠাৎ জয়ী হতে কখনও ইচ্ছা করো না, তাহলে সব প- হবে।
সারাংশ : মানুষ এমনভাবে অভ্যাস দ্বারা বশীভূত সে সহজে তার অভ্যাসগুলো ত্যাগ করতে পারে না। তবে প্রকৃত মানুষ হওয়ার জন্য খারাপ অভ্যাসগুলো অবশ্যই বর্জন করতে হবে। হঠাৎ করেই মানুষ তার খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করতে গেলে সব পন্ড হয়ে যায়। ধীরে ধীরে অনুশীলনের মাধ্যমেই বদ অভ্যাস পরিবর্তন করে একজন ভালো মানুষ হয়ে ওঠা সম্ভব।

১০
অমঙ্গলকে জগৎ হইতে হাসিয়া উড়াইয়া দিবার চেষ্টা করিও না। তাহা হইলে মঙ্গলসমেত উড়িয়া যাইবে। মঙ্গলকে যেভাবে গ্রহণ করিয়াছ, অমঙ্গলকেও সেইভাবে গ্রহণ করো। অমঙ্গলের উপস্থিতি দেখিয়া ভীত হইতে পার, কিন্তু বিস্মিত হইবার হেতু নাই। অমঙ্গলের উৎপত্তি অনুসন্ধান করিতে যাইয়া অকূলে হাবুডুবু খাইবার দরকার নাই। যেদিন জগতে মঙ্গলের আবির্ভাব হইয়াছে, সেই দিনই অমঙ্গলের যুগপৎ উদ্ভব হইয়াছে। একইদিনে, একই ক্ষণে, একই উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্ত উভয়ের উৎপত্তি। এক কে ছাড়িয়া অন্যের অস্তিত্ব নাই, এক-কে ছাড়িয়া অন্যের অর্থ নাই। যেখান হইতে মঙ্গল ঠিক সেখান হইতেই অমঙ্গল। সুখ ছাড়িয়া দুঃখ নাই, দুঃখ ছাড়িয়া সুখ নাই। একই প্রয়োজনে, একই নির্ঝর ধারাতে উভয় স্রোতস্বিনী জন্মলাভ করিয়াছে, একই সাগরে উভয়ে গিয়া মিশিয়াছে।
সারাংশ : মঙ্গল-অমঙ্গল, সুখ-দুঃখ পরস্পর বিপরীতমুখী হলেও একে অপরের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। মঙ্গলের পথে যাত্রায় যেমন অমঙ্গলকে এড়ানো যায় না তেমনি দুঃখ না পেলেও সুখের মর্ম অনুধাবন করা যায় না। এদের একটির উপস্থিতিতে আরেকটির মূল্য আমরা উপলব্ধি করি। তাই মঙ্গল ও সুখের পাশাপাশি অমঙ্গল ও দুঃখকেও জীবনে বরণ করে নিতে হবে।

১১
অমঙ্গলের অপলাপ করিও না; অমঙ্গল তোমার সহচর, তুমি ছাড়িতে চাহিলেও সে তোমাকে ছাড়িবে না। মঙ্গল ও অমঙ্গল সমানভাবে তোমাকে জড়াইয়া থাকিবে। যতদিন তোমার জাগ্রতাবস্থা স্ফুর্তি পাইবে, ততদিন মঙ্গলের সঙ্গে অমঙ্গলও নিত্য ফুটিয়া উঠিবে। যখন অমঙ্গলের তিরোধান হইবে তখন মঙ্গলেরও তিরোধান হইবে; তোমার জাগরণ তখন সুষুপ্তিতে বিলীন হইবে। যতদিন জাগিয়া আছ ততদিন তোমার ব্যাপ্তি; ততদিন মঙ্গল তোমার ডান হাত ধরিয়া থাকিবে, অমঙ্গল তোমার বাম হাত ধরিয়া থাকিবে। উভয়ই তোমাকে জীবনের পথে লইয়া যাইবে। একের বুঝি আকর্ষণ অপরের বুঝি বিকর্ষণ। উভয়ের মধ্যে তোমার গমনীয় পথ।
সারাংশ : মানুষের জীবনে মঙ্গল ও অমঙ্গল সর্বদাই পাশাপাশি অবস্থান করে। মানুষ চাইলেই অমঙ্গলকে উপেক্ষা করতে পারে না। তাই আমঙ্গলকে ভয় পাওয়া বা এর জন্য দুঃখ পাওয়ার কোনো কারণ নেই। কেবল মৃত্যুতেই এর শেষ, তাই একে বরণ করেই লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

১২
আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে আমাদের উপমহাদেশ ছিল সভ্যতার সূতিকাগার। মানুষের জ্ঞান কতদিকে কতভাবে কতকিছুর অনুসন্ধান যে করেছে, সেকালের উত্তর-পশ্চিম ভারতের অধিবাসীদের কীর্তি খ্যাতি থেকে তা আজ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সেকালের ভারতের ইয়াঙ্ক, পাণিনি এবং পতঞ্জলি প্রভৃতি গুণিজনেরাই প্রথমে ধ্বনি বিজ্ঞানের চর্চা করেন। ইউরোপ আমেরিকা আজ যা করছে আড়াই হাজার বছর আগে ওঁরা তাই করে গেছেন। তফাতের মধ্যে এই যে তাঁদের ধ্বনি বিজ্ঞান সাধনার ভিত্তি ছিল অনুভূতি আর একালে এঁদের হাতে আছে বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার
সারাংশ : আড়াই হাজার বছর আগের মানব সভ্যতার সূতিকাগার হিসেবে ভারতীয় উপমহাদেশের অধিবাসীদের কীর্তি এবং উদ্ভাবন মূলত আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণার অন্যতম বিষয়। ইয়াঙক, পানিনি, পতজ্ঞলি প্রমুখ ছিলেন সেকালের ভারতের ধ্বনি বিজ্ঞান চর্চার পথিকৃৎ। ইউরোপ-আমেরিকার মতো গবেষণাগার না থাকলেও তাদের চর্চার মাধ্যমেই ধ্বনি বিজ্ঞান আজ এ পর্যায়ে পৌছেছে।

১৩
আজকের দুনিয়াটা আশ্চর্যভাবে অর্থের বা বিত্তের ওপর নির্ভরশীল। লাভ ও লোভের দুর্নিবার গতি কেবল আগে যাবার নেশায় লক্ষ্যহীন প্রচ-বেগে শুধু আত্মবিনাশের পথে এগিয়ে চলেছে। মানুষ যদি এই মূঢ়তাকে জয় না করতে পারে, তবে মনুষ্যত্ব কথাটাই হয়তো লোপ পেয়ে যাবে। মানুষের জীবন আজ এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে সেখান থেকে আর হয়তো নামবার উপায় নেই, এবার উঠবার সিঁড়ি না খুঁজলেই নয়। উঠবার সিঁড়িটা না খুঁজে পেলে আমাদের আত্মবিনাশ যে অনিবার্য তাতে আর কোনো সন্দেহ থাকে না।
সারাংশ : অর্থ-বিত্তের লোভে মানুষ এতটা উন্মত্ত হয়েছে যে, সে তার বাস্তব জ্ঞানও হারিয়ে ফেলছে। মানুষ তার মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে ক্রমশ আত্মবিনাশের পথে এগিয়ে চলেছে। এ অবস্থা থেকে পিছিয়ে আসার উপায় হয়তো নেই। কিন্তু গোটা মানব জাতির মঙ্গলের জন্য এ নেশা পরিত্যাগের পথ খোঁজাটা আজ অপরিহার্য।

১৪
আমরা যখন তর্ক করি তখন অপরকে আত্মমতাবলম্বী করিয়া জয়লাভের জন্য ব্যগ্র হই, যখন আত্মমত প্রকাশ করি তখন অপরের মতকে বশে আনিয়া প্রবল হইবার চেষ্টা করি এবং যখন অপ্রয়োজনীয় গল্প বলি তখনও অপরের হৃদয়কে আশ্রয়প্রার্থী করিয়া আশ্রয়দাতা প্রভু হইতে চাই। সংসারের কাজে আমরা অপরের অভাব ও আকাক্সক্ষার উদ্রেক বৃদ্ধি করিয়া সফল হইবার নিমিত্তে প্রভু সাজিয়া আপনাদিগকে দুর্লভ করি। আমাদের নিজেদের অভাব থাকিলেও পাছে বিপক্ষ আমাদের অভাব বুঝিতে পারিয়া প্রবল হয় এই ভয়ে আমরা সেই ভাবটিকে হৃদয়ের এক প্রান্তে লুকায়িত রাখিয়া বাহিরে কপট বিমুখতার ভাবটিকে প্রকাশ করি। সংসারে প্রত্যেকেই জয়লাভের উদ্যোগে ব্রতী, কিন্তু তাই বলিয়া সকলেই জয়লাভ করিতে পারে না। একের জয়ে অন্যের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। সম্পূর্ণ জয়লাভ কদাচিৎ ঘটে। আংশিক জয়লাভই নিত্য ঘটনা। সংসার-সংগ্রামী আড়ম্বরের যদিও অভাব নাই কিন্তু শেষ ফল সন্ধি। এই সন্ধিতে যাহার লাভের ভাগ অধিক তিনিই জয়ী এবং যাহার লাভের ভাগ অল্প তিনি পরাজিত।
সারাংশ : নিজের চিন্তার বীজ অন্যের মনে বপণ করাই আমাদের বিতর্কের উদ্দেশ্য। আপন অভাবকে সংগোপন রেখে বাইরের জগতে রাজা হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা আমাদের। জয়ী হওয়ার আকুলতাই অন্যকে পরাজিত করে, আর শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে পরাজয়ের ইতিহাসই বেশি। পরস্পর সন্ধির ফলে নির্ণিত হয় শেষ ফল, সেখানে অধিক ভাগের অধিকারী সর্বদা জয়ী।

১৫
আমরা যে কত শিক্ষালোভী তার প্রমাণ আমাদের পাঁচ বৎসর বয়সে হাতেখড়ি হয়। আর কমসে কম একুশ বৎসর বয়সে হাতে কালি মুখে কালি মেখে আমরা সেনেট হাউস থেকে লিখে আসি। কিন্তু এতেও আমাদের শিক্ষার সাধ মেটে না। এরপরে আমরা সারাজীবন যখন যা কিছু পড়ি তা কবিতাই হউক, আর গল্প হউক-আমাদের মনে স্বতঃই এ প্রশ্নের উদয় হয় যে, আমরা এ পড়ে কী শিক্ষা লাভ করলুম, এ প্রশ্নের উত্তর মুখে মুখে দেওয়া অসম্ভব; কেননা, সাহিত্যের যা শিক্ষা তা হাতে হাতে পাওয়া যায় না। সাহিত্য যা দেয় তা আনন্দ; কিন্তু ও বস্তু আমরা জানি নে বলে মানি নে। আমাদের শিক্ষার ভিতর আনন্দ নেই বলে আনন্দের ভিতর যে শিক্ষা থাকতে পারে তা আমাদের বুদ্ধির অগম্য। আমাদের আকাঙক্ষাকে শিশুকাল থেকেই কোমর বেঁধে আমরা খর্ব করি। অর্থাৎ সেটাকে কাজে খাটাবার আগেই তাকে খাটো করে দিই। অনেক সময়ে বড়ো বয়সে সংসারের ঝড়-ঝাপটার মধ্যে পড়ে আমাদের আকাঙক্ষার পাখা জীর্ণ হয়ে যায়, তখন আমাদের বিষয় বুদ্ধি অর্থাৎ ছোট বুদ্ধিটাই বড় হয়ে ওঠে; কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে, শিশুকাল থেকেই আমরা বড়।
সারাংশ : আমাদের শিক্ষার সম্পর্ক প্রয়োজনের কারণেই আনন্দের সাথে নয়। আর এ কারণেই সাহিত্য পাঠ করে সবাই শিক্ষাকে খোঁজে আনন্দকে নয়। শিক্ষার সাথে আনন্দের যোগের অভাবে তাই জীবনটাও নিরানন্দময় হয়ে পড়েছে। আমাদের শিক্ষা প্রয়োজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে বলে এর মূল তাৎপর্যকে আমরা কখনোই উপলব্ধি করতে পারি না।

১৬
আমার বলিতে দ্বিধা নাই যে, আমি আজ তাহাদেরই দলে, যাহারা কর্মী নন ধ্যানী। যাহারা মানবজাতির কল্যাণসাধন করেন সেবা দিয়া, কর্ম দিয়া, তাহারা মহৎ যদি নাই হন, অন্তত ক্ষুদ্র নন। ইহারা থাকেন শক্তির পেছনে রুধির ধারার মতো গোপন, ফুলের মাঝে মাটির মমতা রসের মতো অলক্ষ্যে।
সারাংশ : মানবজাতির কল্যাণসাধনে কর্মীরা সেবা, কর্ম দিয়ে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু ধ্যনীরা থাকেন পরোক্ষে। তারা কর্মীদের প্রেরণাশক্তি হিসেবে কাজ করে যান।

১৭
আমরা ছেলেকে স্কুল কলেজে পাঠিয়ে ভাবি যে, শিক্ষা দেওয়ার সমস্ত কর্তব্য পালন করলাম। বৎসরের পর বৎসর পাস করে গেলেই অভিভাবকরা যথেষ্ট তারিফ করেন। কিন্তু তলিয়ে দেখেন না যে, কেবল পাস করলেই বিদ্যার্জন হয় না। বাস্তবিক পক্ষে ছাত্রের বা সন্তানের মনে জ্ঞানানুরাগ বা জ্ঞানের প্রতি আনন্দজনক শ্রদ্ধার উদ্রেক হচ্ছে কিনা, তাই দেখবার জিনিস। জ্ঞানচর্চার মধ্যে যে এক পরম রস ও আত্মপ্রসাদ আছে, তার স্বাদ কোনো কোনো শিক্ষার্থী একবিন্দুও পায় না।
সারাংশ : শিক্ষা বিষয়টিকে আমরা সার্টিফিকেট অর্জনের সাথে একাত্ম করে ফেলেছি। কিন্তু সার্টিফিকেট অর্জন আর প্রকৃত শিক্ষা এক নয়। আনন্দের সাথে জ্ঞানের চর্চার মাধ্যমে যে শিক্ষা অর্জিত হয় সেটিই প্রকৃত শিক্ষা।

১৮
আমরা সকলেই ভ্রমণকারী। সকলেই পথ চলিতেছি। কেবল শিক্ষাভেদে, সংসর্গভেদে, লক্ষ্যভেদে কেহ সুপথে, কেহ বিপথে চলিতেছি। বিপথে চলিলে যে শেষে হিংস্র জন্তু সমাকুলে গহীন বনে প্রবেশ করিয়া অকালে প্রাণ হারাইতে হইবে, পাপ পশু আমাদিগকে গ্রাস করিবে, ইহা নিশ্চিত। আবার সুপথে চলিলে যে অপ্রমেয় পুরুস্কার লাভ হইবে সত্য সুন্দর শান্তিদাতার প্রেমের নন্দনকাননে প্রবেশের সৌভাগ্য ঘটিবে, ইহাও সত্য কথা। কিন্তু ভ্রমণে সব সময়ে যদি পথের কিনারা হয়, যেই হিরন্ময় চিরঅজ্ঞাত দেশের যতটুকু ভৌগোলিক সন্ধান মিলিয়াছে, তাহা উপযুক্ত ভ্রমণকারীর মুখে বা লিখিত বিবরণ হইতে অবগত হইতে পারি, তবে বোধ হয় দুর্বল মন অনেক বল পাইবে, পথের দুর্গমতা আতঙ্কের কারণ হইবে না, দীর্ঘদিন ঘুরিয়া হয়তো-বা বিপথে পড়িয়া ব্যর্থকাম ভগ্নহৃদয়ে অনুশোচনার তীব্র দংশন জ্বালা সহিতে হইবে না।
সারাংশ : প্রতিটি মানুষই জীবনের পথে চলমান- কেউ পাপের পথে, কেউ পূণ্যের পথে। তাই পাপের পথে চললে যেমন মানুষকে শাস্তি ভোগ করতে হয় তেমনি পূণ্যের পথে চললে সে স্বর্গের সন্ধান পায়। আর পূণ্যের পথে চলার জন্য পূণ্যবান ব্যক্তির অথবা ধর্মগ্রন্থের উপদেশ গ্রহণ করাই উত্তম।

১৯
আমার মনে হয়, যে দেশের নরনারীর মধ্যে পরস্পরের হৃদয় জয় করিয়া বিবাহ করিবার রীতি নাই, বরঞ্ছ তাহা নিন্দার সামগ্রী, যে দেশে নরনারী আশা করিবার সৌভাগ্য, আকাঙ্ক্ষা করিবার ভয়ঙ্কর আনন্দ হইতে চিরদিনের জন্য বঞ্ছিত, যাহাদের জয়ের গর্ব, পরাজয়ের ব্যথা কোনটাই জীবনে একটিবারও বহন করিতে হয় না, যাহাদের ভুল করিবার দুঃখ, আর ভুল না করিবার আত্মপ্রসাদ, কিছুরই বালাই নাই, যাহাদের প্রাচীন এবং বহুদর্শী সমাজ সর্ব প্রকারের হাঙ্গামা হইতে অত্যন্ত সাবধানে দেশের লোককে তফাৎ করিয়া, আজীবন কেবল ভালোটি হইয়া থাকিবারই ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছেন, তাই বিবাহ ব্যাপারটা যাহাদের শুধু নিছক ইংরেজি তা সে যতই বৈদিক মন্ত্র দিয়া ইংরেজি পাকা করা হোক, সে দেশের লোকের সাধ্যই নাই মৃত্যুঞ্চয়ের অন্নপাপের কারণ বোঝে। বিলাসীকে যাঁহারা পরিহাস করিয়াছিলেন, তাঁহারা সাধু গৃহস্থ এবং সাধ্বী গৃহিণী। অক্ষয় সতীলোক তাঁহারা সবাই পাইবেন, তাও আমি জানি, কিন্তু সেই সাপুড়ের মেয়েটি যখন একটি পীড়িত শয্যাগত লোককে তিল তিল করিয়া জয় করিতেছিল, তাহার তখনকার সেই গৌরবের কণামাত্র হয়তো আজিও ইহাদের কেহ চোখে দেখেন নাই। মৃত্যুঞ্জয় হয়তো নিতান্তই একটা তুচ্ছ মানুষ ছিল, কিন্তু তাহার হৃদয় জয় করিয়া দখল করার আনন্দটাও তুচ্ছ নহে, সেই সম্পদও অকিঞ্চিৎকর নহে।
সারাংশ : হৃদয় জয় করে কাউকে আপন করে পাওয়ার আনন্দ কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে বিরল। মৃত্যুঞ্জয়ের হৃদয় জয়ের যে অসামান্য গৌরব বিলাসী অর্জন করেছিল তা আধুনিক যুগের মানুষের কাছে বোধগম্য নয়। বৈদিক মন্ত্র দিয়ে হৃদয় জয়ের বিরল অনুভূতি বোঝার সাধ্যও তাই কারো নেই।

২০
আমাদের আকাঙ্ক্ষাকে শিশুকাল থেকেই কোমর বেঁধে আমরা খর্ব করি। অর্থাৎ সেটাকে কাজে খাটাবার আগেই তাকে খাটো করে দিই। অনেক সময় বুড়ো বয়সে সংসারের ঝড়-ঝাপটার মধ্যে পড়ে আমাদের আকাঙ্ক্ষার পাখা জীর্ণ হয়ে যায়, তখন আমাদের বিষয়-বুদ্ধি অর্থাৎ ছোট বুদ্দিটাই বড়ো হয়ে ওঠে; কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, শিশুকাল থেকেই আমরা বড়ো রাস্তায় চলবার পাথেয় হালকা করে দিই। প্রথম কয় বৎসর এক রকম বেশ চলে। ছেলেরা যেই থার্ড ক্লাসে গিয়ে পৌঁছায় অমনি বিদ্যা অর্জন সম্বন্ধে তাদের বিষয়-বুদ্ধি জেগে ওঠে। অমনি তা হিসেব করে শিখতে বসে। তখন তারা বলতে আরম্ভ করে, আমরা শিখবো না, আমরা পাশ করবো। অর্থাৎ যেপথে যথাসম্ভব কম জেনে যতদূর সম্ভব বেশি মার্ক পাওয়া যায়, আমরা সেই পথে চলব। এইত দেখছি শিশুকাল থেকেই ফাঁকি দেবার বুদ্ধি অপবলম্বন।
সারাংশ : মাত্রাতিরিক্ত প্রতিযোগিতা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। পরীক্ষায় ভাল ফলাফলকে শিশুকাল থেকে লক্ষ হিসেবে নেওয়ায় শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য জ্ঞানার্জন ব্যহত হচ্ছে, যা আমাদেরকে মেরুদন্ডহীন জাতিতে পরিণত করবে।

২১
আমাদের মনের ভাবে একটা স্বাভাবিক প্রবৃত্তি এই, সে নানা মনের মধ্যে নিজেকে অনুভূত করিতে চায়। প্রকৃতিতে আমরা দেখি, ব্যাপ্ত হইবার জন্য, টিকিয়া থাকিবার জন্য প্রাণীদের মধ্যে সর্বদা একটা চেষ্টা চলিতেছে। যে জীব সন্তানের দ্বারা আপনাকে বহুগুণিত করিয়া যত বেশি জায়গা জুড়িতে পারে, তাহার জীবনের অধিকার তত বেশি বাড়িয়া যায়, নিজের অস্তিত্বকে সে তত অধিক সত্য করিয়া তোলে। মানুষের মনোভাবের মধ্যেও সেই রকমের একটা চেষ্টা আছে। তফাতের মধ্যে এই যে, প্রাণের অধিকার দেশে ও কালে মনোভাবের অধিকার মনে এবং কালে। মনোভাবের চেষ্টা বহুকাল ধরিয়া বহু মনকে আয়ত্ব করা।
সারাংশ : নিজ মনের অনুভূতি অন্যের মনে ছড়িয়ে দেয়ার অপরিসীম আনন্দ মানুষের মাঝেই বিদ্যমান। প্রাণী জগতে নিজেদের বিস্তারকে কেন্দ্র করে এই আকাঙ্ক্ষার জন্ম। এই বিস্তার যত অধিক হয় নিজেদের প্রতিষ্ঠার ভীত তত সুদৃঢ় হয়। মনোভাবের এই সুনিপুণ বীজ মন থেকে মনে বপন হয়।

২২
আমাদের মধ্যে বিলাসিতা বাড়িয়াছে বলিয়া অনেকে কল্পনা করেন যে, ইহা আমাদের ধন-বৃদ্ধির লক্ষণ। কিন্তু এ কথা বিচার করিয়া দেখিতে হইবে যে, পূর্বে যে অর্থ সাধারণের কাজে ব্যয়িত হইত, এখন তা ব্যক্তিগত ভোগে ব্যায়িত হইতেছে। ইহাতে ফল হইতেছে, দেশের ভোগ-বিলাসের স্থানগুলি ফাঁপিয়া উঠিতেছে কিন্তু পল্লীগুলিতে দারিদ্র্যের অবধি নাই। দেশের অধিকাংশ অর্থ শহরে আকৃষ্ট হইয়া কোঠাবাড়ি, গাড়ি-ঘোড়া, সাজ-সরঞ্জাম, আহার-বিহারেই উড়িয়া যাইতেছে। অথচ যাঁহারা এরূপ ভোগ-বিলাস ও আড়ম্বরে আত্মসমর্পণ করিয়াছেন, তাঁহাদের প্রায় কেহই সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে নাই, তাঁহাদের অনেকেরই টানাটানি, অনেকেরই ঋণ, অনেকেরই পৈতৃক সম্পত্তি মহাজনের দায়মুক্ত করিবার জন্য চিরজীবনই নষ্ট। কন্যার বিবাহ দেওয়া, পুত্রকে মানুষ করিয়া তোলা, পৈতৃক কীর্তি রক্ষা করিয়া চলা, অনেকেরই পক্ষে বিশেষ কষ্টসাধ্য হইয়াছে। যে ধন সমস্ত দেশের বিচিত্র অভাব মোচনের জন্য চারিদিকে ব্যাপ্ত হইত, সেই ধন সঙ্কীর্ণ স্থানে আবদ্ধ হইয়া যে ঐশ্বর্যের মায়া সৃজন করিতেছে তাহা বর্ণনাযোগ্য নহে। সমস্ত শরীরকে প্রতারণা করিয়া কেবল মুখেই যদি রক্ত সঞ্চার হয়, তবে তাহাকে স্বাস্থ্য বলা যায় না। দেশের ধর্মস্থানকে, বন্ধুস্থানকে, জন্মস্থানকে কৃষ করিয়া কেবল ভোগস্থানকে স্ফীত করিয়া তুলিলে বাহির হইতে মনে হয় যেন দেশের শ্রীবৃদ্ধি হইতে চলিল। সেই জন্যই এ ছদ্মবেশী সর্বনাশ আমাদের পক্ষে অতিশয় ভয়াবহ। মঙ্গল করিবার শক্তিই ধন, বিলাম ধন নহে।
সারাংশ : ধন সম্পদ জড়ো করে আমরা ভোগ বিলাসের শহর গড়ছি ঠিকই, কিন্তু গ্রামগুলোকে বানাচ্ছি দরিদ্র পল্লী। আড়ম্বরের কাছে আত্মসমর্পিত মানুষগুলোও তাই ঠিক সুখের ঠিকানা খুঁজে পায় না। কেননা অন্যের মঙ্গল সাধনের আনন্দ ভোগ বিলাসের মাঝে নেই। সুখের ঐশ্বর্য্য ছড়িয়ে আছে সকল মানবের মাঝে।

২৩
আমাদের দেশের শিল্পকারের উপদেশ হলো- পরিপাটি করে মূর্তি গড়, পরিচ্ছন্ন করে পালিশ কর পাথরের দেবমূর্তি, কিন্তু খবরদার মানুষ মূর্তি গড় না নোংরা কাজ সেটা। গ্রিক শিল্পকার ঠিক এর উল্টো কথা বললে মানুষগুলোকে করে তোলো দেবতার মতো সুন্দর। আবার চীনের শিল্পকার বললে খবরদার, দেবভাবাপন্ন মানুষকে গড় তো দৈহিক সৌন্দর্যকে একটু স্থান দিও না চিত্রে বা মূর্তিতে। নিগ্রোদের গড়া মূর্তি, যার আদর আর কাটতি খুব ইউরোপে, তার মধ্যে বেঢপ বেয়াড়া রূপই আশ্চর্য কৌশলে সুন্দরভাবে দেখিয়েছে মানুষ। মন এই তেমাথা পথে ত্রিশঙ্কুতে পড়ে বলতে চায়- ‘মন বেচারার কি দোষ’ আছে। নিজের মন ছাড়া যখন সুন্দর অসুন্দরের আদর্শ কোথাও নেই, কোনকালেই নেই এবং ছিলও না, থাকবেও না এটা নিশ্চয় তখন ও নিয়ে মাথা ঘামানো কেন? বিচার-বিতর্কে নিষ্পত্তি হলো গিয়ে এক কথা। তিনিই রস, তিনিই সুন্দর, তাঁর সৃষ্টি হলো অসুন্দরে মিলিয়ে অপরূপ সুন্দর। সৌন্দর্যে পূর্ণচন্দ্র কুত্রাপি, নাস্তি, পরিপূর্ণতা অপরিপূর্ণতা অস্তি।
সারাংশ : শিল্প গড়ার ক্ষেত্রে শিল্পীর মনের ক্যানভাসে যে চিত্র অংকিত হয় তার বাস্তব রূপ না পেলে শিল্পের সৌন্দর্য্য বাধাগ্রস্ত হয়। সৌন্দর্য প্রকাশের প্রকৃত পট হল মানুষের মন। একমাত্র মনেই শিল্পের আসল বহি:প্রকাশ ঘটে।

২৪
আমাদের জন্য এদেশে শিক্ষার বন্দোবস্ত সচরাচর এইরূপÑ প্রথমে আরবীয় বর্ণমালা, অতঃপর কুরআন শরীফ পাঠ। কিন্তু শব্দগুলোর অর্থ বুঝাইয়া দেওয়া হয় না, কেবল স্মরণশক্তির সাহায্যে টিয়াপাখির মতো আবৃত্তি কর। কোন পিতার হিতৈষণার মাত্রা বৃদ্ধি হইলে, তিনি দুহিতাকে ‘হাফেজা’ করিতে চেষ্টা করেন। সমুদয় কুরআনখানি যাঁহার কণ্ঠস্থ থাকে, তিনিই ‘হাফেজ’। আমাদের আরবি শিক্ষা ঐ পর্যন্ত। পারস্য এবং উর্দু শিখিতে হইলে, প্রথমেই ‘করিমা ববখশা-এ বরহালে মা’ এবং একেবারে (উর্দু) ‘বানাতন্ নাস’ পড়। একে আকার ইকার নাই, তাতে আবার আর কোন সহক পাঠ্যপুস্তক পূর্বে পড়া হয় নাই, সুতরাং পাঠের গতি দ্রুতগামী হয় না। অনেকের ঐ কয়খানি পুস্তক পাঠ শেষ হওয়ার পূর্বেই কন্যা-জীবন শেষ হয়। বিবাহ হইলে বালিকা ভাবে, ‘যাহা হোক, পড়া হইতে রক্ষা পাওয়া গেল।’ কোন কোন বালিকা রন্ধন ও সূচিকর্মে সুনিপুণা হয়। বঙ্গদেশেও বালিকাদিগকে রীতিমতো বঙ্গভাষা শিক্ষা দেওয়া হয় না। কেহ কেহ উর্দু পড়িতে শিখে, কিন্তু কলম ধরিতে শিখে না। ইহাদের উন্নতির চরমসীমা সল্মা চুমকির কারুকার্য, উলের জুতা-মোজা ইত্যাদি প্রস্তুত করিতে শিক্ষা পর্যন্ত।
সারাংশ : নারীদের পশ্চাদপদতার প্রধান কারণ ভুল শিক্ষা গ্রহণ করা। কোন কিছু বুঝার চেয়ে মুখস্ত করাতেই মেয়েদের আগ্রহী করে তোলা হয়। ফলে নারীদের বিদ্যার দৌড় হয় দু’ একটি বই মুখস্ত করা পর্যন্ত। বিয়ের পর তাদের প্রধান শিক্ষার বিষয় হয় রান্না এবং সেলাই কাজ।

২৫
আমাদের প্রচলিত পাঠ্যবিষয়সমূহ নীরস প্রকৃতির। এ কারণে তা হৃদয়গ্রাহী হয় না। খাদ্য হজমের প্রয়োজনে যেমন পরিমিত নির্মল বায়ু সেবন আবশ্যক, তদ্রুপ পাঠ্যবিষয় বোঝার প্রয়োজনে আনুষঙ্গিক কিছু সহায়ক গ্রন্থ পাঠ করা দরকার, যা আনন্দদায়ক।
সারাংশ : আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় পাঠ্য বিষয়সমূহের সাথে আনন্দের কোনো সম্পর্ক নেই বলে তা আমাদের হৃদয়গ্রাহ্য হয় না। তাই পাঠ্য বিষয়কে হৃদয়গ্রাহী করে তুলতে এর পাশাপাশি সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে সাহিত্য ও অন্যান্য আনন্দদায়ক গ্রন্থ পাঠ করা অত্যাবশ্যক।

২৬
আমার বিবেচনায় স্বাস্থ্যরক্ষার উপায় গৃহ ও পল্লী পরিষ্কার; বিশুদ্ধ জল ও বায়ুর ব্যবস্থা নির্ধারণ। এইসব বিষয়ে শিক্ষাবিস্তার এবং আদর্শ গঠিত পল্লী প্রদর্শন অতি সহজেই হইতে পারে। ইহার উপায় মেলা স্থাপন। পর্যটনশীল মেলা দেশের একপ্রান্ত হইতে আরম্ভ করিয়া অল্প দিনেই অন্যপ্রান্তে পৌঁছিতে পারে। এই মেলায় স্বাস্থ্যরক্ষা সম্বন্ধে ছায়াচিত্রযোগে উপদেশ, স্বাস্থ্যকর ক্রীড়া-কৌতুক ও ব্যায়াম প্রচলন, যাত্রা, কথকতা,গ্রামের শিল্প-বস্তুর সংগ্রহ, কৃষি-প্রদর্শনী ইত্যাদি গ্রামহিতকর বহুবিধ কার্য সহজেই সাধিত হইতে পারে। আমাদের কলেজের ছাত্রগণও এই উপলক্ষে তাহাদের দেশ পরিচর্যা বৃত্তিকার্য পরিণত করিতে পারেন।
সারাংশ : পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ঘর-বাড়ি, বিশুদ্ধ জল এবং বায়ুর ব্যবস্থা স্বাস্থ্য রক্ষার অন্যতম পূর্বশর্ত। এসব বিষয়ে গ্রামবাসীকে সচেতন করার অন্যতম মাধ্যম হলো মেলা। যেখানে আদর্শ গঠিত পল্লি প্রদর্শন, স্বাস্থ্যরক্ষার উপর নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ও স্বাস্থ্যকর ক্রীড়া-কৌতুক প্রদর্শনের মাধ্যমে সহজেই গ্রামবাসী সুস্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠবে। স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরাও এ কাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে।

২৭
আমাদের চাষী বলে, মাটি হইতে বাপ-দাদার আমল ধরিয়া যাহা পাইয়া আসিতেছি তাহার বেশি পাইব কী করিয়া? এই কথা চাষীর মুখে শোভা পায়, পূর্বপ্রথা অনুসরণ করিয়া চলা তাহাদের শিক্ষা। কিন্তু সেই কথা বলিয়া আমরা নিষ্কৃতি পাইব না। এই মাটিকে এখনকার প্রয়োজন অনুসারে বেশি করিয়া ফলাইতে হইবে, না হইলে আধপেটা খাইয়া, জ্বলে অজীর্ণ রোগে মরিতে কিংবা জীবন্মৃত হইয়া থাকিতে হইবে। এই মাটির ওপরে মন এবং বুদ্ধি খরচ করিলে এই মাটি হইতে যে আমাদের দেশের মোট চাষের ফসলের চেয়ে অনেক বেশি আদায় করা যায় তাহার অনেক দৃষ্টান্ত আছে। আজকাল চাষকে মূর্খের কাজ বলা চলে না, চাষের বিদ্যা এখন মস্ত বিদ্যা হইয়া উঠিয়াছে।
সারাংশ : মাটির ফসল ফলানোর ক্ষমতা যে সুনির্দিষ্ট নয় এ কথা আমাদের দেশের চাষীদের ধারণার অতীত। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান দেখিয়েছে যে, কৃষিবিদ্যার সঠিক প্রযোগে এই মাটি থেকেই অধিক ফসল ফলানো সম্ভব। আর এর মাধ্যমেই দূর হতে পারে চাষীদের দুঃখ-দুর্দশা।

২৮
আমি ভালোবেসেছি এ জগৎকে, আমি প্রণাম করেছি মহৎকে- আমি কামনা করেছি মুক্তিকে। যে মুক্তি পরম পুরুষের কাছে আত্মনিবেদনে- আমি বিশ্বাস করেছি মানুষের সত্য মহামানবের মধ্যে যিনি ‘সদা জানানং হৃদয়ে সন্নিবিষ্ট’। আমি আবাল্য অভ্যস্ত ঐকান্তিক সাহিত্য সাধনার গন্ডিকে অতিক্রম করে একদা সেই মহামানবের উদ্দেশ্যে যথাসাধ্য আমার কর্মের অর্ঘ্য, আমার ত্যাগের নৈবেদ্য আহরণ করেছি- তাতে বাইরের থেকে যদি বাধা পেয়ে থাকি অন্তর থেকে পেয়েছি প্রসাদ। আমি এসেছি এই ধরণীর মহাতীর্থে- এখানে সর্বদেশ, সর্বজাতি ও সর্বকালের ইতিহাসের মহাকেন্দ্রে আছেন নরদেবতা, তারাই বেদীমূলে নিবৃত্তে বসে আমার অহংকার, আমার ভেদবুদ্ধি ক্ষালন করবার চেষ্টায় আজও প্রবৃত্ত আছি।
সারাংশ : একজন জীবনসাধকের কাছে এ জগতই সত্য। তিনি মানুষের সত্যে বিশ্বাস করেছেন, মানুষও তার মনুষ্যত্বকে মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন। আর তাই মহামানবের কাছে তিনি তাঁর সকল কিছু সমর্পণ করে ক্ষুদ্রতা, সংকীর্ণতার গন্ডি থেকে নিজেকে মুক্ত করার সাধনায় রত।

২৯
আমি ভাগিনীদের কল্যাণ কামনা করি, তাহাদের ধর্মবন্ধন বা সমাজবন্ধন ছিন্ন করিয়া তাহাদিগকে একটা উন্মুক্ত প্রান্তরে বাহির করিতে চাহি না, মানসিক উন্নতি করিতে হইলে হিন্দুত্ব বা খ্রিষ্টানকে খ্রিষ্টানি ছাড়িতে হইবে এমন কোনো কথা নাই। আপন আপন সম্প্রদায়ের পার্থক্য রক্ষা করিয়াও মনটাকে স্বাধীনতা দেওয়া যায়। আমরা যে কেবল উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে অবনত হইয়াছি, তাই বুঝিতে ও বুঝাইতে চাই।
সারাংশ : উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে নারী তার মনের স্বাধীনতা হারিযেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ধর্মবন্ধন বা সমাজবন্ধন ছিন্ন করার কোনো প্রয়োজন নেই। নিজ ধর্মে বা সমাজে থেকেই সুশিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে মানসিক উন্নতি সাধন করা যায়।

৩০
আমি লাইব্রেরিকে স্কুল কলেজের উপরে স্থান দিই এই কারণে যে, এ স্থানে লোক স্বেচ্ছায় স্বচ্ছন্দচিত্তে স্বশিক্ষিত হবার সুযোগ পায়। প্রতিটি লোক তার স্বীয় শক্তি ও রুচি অনুসারে নিজের মনকে নিজের চেষ্টায় আত্মার রাজ্যে জ্ঞানের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। স্কুল কলেজে বর্তমানে আমাদের যে অপকার করছে সে অপকারের প্রতিকারের জন্য শুধু নগরে নগরে নয়, গ্রামে গ্রামে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা কর্তব্য। আমি পূর্বে বলেছি যে লাইব্রেরি হাসপাতালের চাইতে কম উপকারী নয়, তার কারণ আমাদের শিক্ষার বর্তমান অবস্থায় লাইব্রেরি হচ্ছে এক রকম মনের হাসপাতাল।
সারাংশ : স্বশিক্ষিত হবার সুযোগ আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় নেই। পুথিগত শিক্ষা থেকে বের হয়ে এসে স্বেচ্ছায় ও স্বচ্ছন্দে লেখাপড়ার জন্য দরকার লাইব্রেরি। শিক্ষার বর্তমান রুগ্নদশার চিকিৎসার জন্য শহর, গ্রাম সর্বত্র লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা দরকার।

৩১
আল্লাহ তাআলা এই সংসার সৃষ্টি করিয়াছেন। তিনি পরম দয়ালু, সর্বদা আমাদের মঙ্গল করেন ও লালন-পালন করেন। তিনি আমাদের খাদ্য দিয়াছেন; আমরা তাহা আহার করি। তিনি আমাদের পানি দিয়াছেন; আমরা তাহা পান করি। তিনি আমাদিগকে বায়ু দিয়াছেন, তাহা আমরা নিশ্বাস দ্বারা গ্রহণ করিয়া বাঁচিয়া থাকি। তিনি আমাদের সুখী করিবার জন্য সমস্তই দিয়াছেন। আমরা যাহা করি, তিনি তাহা বুঝিতে পারেন। আমরা তাঁহাকে দেখিতে পাই না। কিন্তু তিনি সকল স্থানেই আছেন। চলো আমরা তাঁহার ইবাদত করি।
সারাংশ : মহান সৃষ্টিকর্তা এই জগৎ সংসার সৃষ্টি করে মানুষের প্রয়োজনীয় সকল কিছুই দিয়েছেন। তাঁকে দেখা না গেলেও তিনি সর্বত্রই বিরাজমান এবং আমাদের সকল কিছুই তিনি জানেন। তাই আমাদের উচিত পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলার ইবাদত করা।

৩২
ইসলাম কথা ও কাজে এক। মুসলমান মুখে মুখে সাম্য ও মানবতার কথা স্বীকার করিয়াই সন্তুষ্ট হয় না। ঈমান, শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার ভিতর দিয়া সে তাহার দৈনন্দিন জীবনে সাম্য ও মানবতার আদর্শকে সুন্দরভাবে রূপদান করিবার চেষ্টা করে। মসজিদে যাও, দেখিবে বাদশাহের পাশে ক্রীতদাস দাঁড়াইয়া খোদার উদ্দেশ্যে মাথা নত করিতেছে। ইসলামে সাদা-কালোর ভেদ নাই, দাস-প্রভুর তফাৎ নাই। তাই ইসলাম ভৌগোলিক সীমা লঙ্ঘন করিয়া বর্ণবৈষম্য তুলিয়া দিয়া সমস্ত মুসলমানকে ভ্রাতৃত্ব-বন্ধনে আবদ্ধ করিয়াছে।
সারাংশ : সাম্য ও মানবতা ইসলাম ধর্মের মূল কথা। এটি কেবল তত্ত্বেই সীমাবদ্ধ নয়, কাজেও এ কথার প্রমাণ রয়েছে। ঈমান, শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার মধ্যদিয়ে সাম্য ও মানবতার বাণী সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দিয়ে ইসলাম গোটা বিশ্বের মুসলমানকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করেছে।

৩৩
ইহাই যৌবন, এই ধর্ম যাহাদের তাহারাই তরুণ। তাহাদের দেশ নাই, জাতি নাই, অন্য ধর্ম নাই। দেশ-কাল-জাতি ধর্মের সীমার উর্ধ্বে ইহাদের সেনানিবাস। আজ আমরা- মুসলিম তরুণেরা- যেন অকুণ্ঠিত চিত্তে বলিতে পারি- ধর্ম আমাদের ইসলাম, কিন্তু প্রাণের ধর্ম আমাদের তারুণ্য, যৌবন। আমরা সকল দেশের, সকল কালের। আমরা মুরিদ যৌবনের। এই জাতি-ধর্ম কালকে অতিক্রম করিতে পারিয়াছে যাহাদের যৌবন, তাহারাই আজ মহামানব, মহাত্মা, মহাবীর। তাহাদিগকে সকল দেশের সকল ধর্মের সকল লোক সমান শ্রদ্ধা করে।
সারাংশ : যৌবনকে যারা হৃদয়ে ধারণ করেছে তারাই তরুণ। দেশ, কাল, ধর্ম, জাতি সব কিছুর ঊর্ধ্বে তরুণের অবস্থান। যৌবনের এই ধর্মই মানুষকে করে তুলেছে মহামানব, তাকে স্থান দিয়েছে সকল মানুষের হৃদয়ে।

৩৪
এ দেশে লোকে যে যৌবনের কপালে রাজটিকার পরিবর্তে তার পৃষ্ঠে রাজদ- প্রয়োগ করতে সদাই প্রস্তুত সে বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই। এর কারণ হচ্ছে যে, আমাদের বিশ্বাস মানবজীবনে যৌবন একটা মস্ত ফাঁড়া, কোনো রকমে সেটি কাটিয়ে উঠতে পারলেই বাঁচা যায়। এ অবস্থায় কী জ্ঞানী কী অজ্ঞানী সকলেই চান যে এক লম্ফে বাল্য হতে বার্ধক্যে উত্তীর্ণ হন। যৌবনের নামে আমরা ভয় পাই। কেননা তার অন্তরে শক্তি আছে। অপরপক্ষে বালকের মনে শক্তি নেই, বৃদ্ধের দেহে শক্তি নেই, বালকের জ্ঞান নেই, বৃদ্ধের প্রাণ নেই। তাই আমাদের নিয়ত চেষ্টা হচ্ছে দেহের জড়তার সঙ্গে মনের জড়তার মিলন করা, অজ্ঞতার সহিত সন্ধি স্থাপন করা। তাই আমাদের শিক্ষানীতির উদ্দেশ্যে হচ্ছে ইঁচড়ে পাকানো আর আমাদের সমাজনীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে জ্ঞান দিয়ে পাকানো।
সারাংশ : অন্তরের শক্তি, প্রাণপ্রাচুর্য যৌবনের মূলকথা। কিন্তু সমাজের দৃষ্টিতে যৌবন মানে উচ্ছৃঙ্খলতা। আর তাই সমাজ শাসন করে সর্বদা তার শক্তিকে দমিয়ে রাখতে চায়। কিন্তু যৌবন মানে উচ্ছৃঙ্খলতা নয়, যৌবন মানে সত্য ও সুন্দর। তাই সমাজের উচিত যৌবনকে তার শক্তি ও সম্ভাবনা প্রকাশের সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া।

৩৫
এ জগতে যিনি উঠেন, তিনি সাধারণের মধ্যে জন্মিয়া, সাধারণের মধ্যে বাড়িয়া, সাধারণের ওপর মস্তক তুলিয়া দাঁড়ান; তিনি অভ্যন্তরীণ মালমশলার সাহায্যে বড় হইয়া থাকেন। কুষ্মান্ড-লতা যেমন যষ্ঠির সাহায্যে মাচার ওপর ওঠে, তেমনি কোন কাপুরুষ, কোন অলস শ্রমকাতর মানুষ কেবলমাত্র অপরের সাহায্যে এ জগতে প্রকৃত মহত্ত্ব লাভ করিয়াছে? এ জগতে উঠিয়া-পড়িয়া, রহিয়া-সহিয়া, ভাঙ্গিয়া-গড়িয়া, কাঁদিয়া-কাটিয়া মানুষ হইতে হয়; ইহা ছাড়া মনুষ্যত্ব ও মহত্ত্ব লাভের অন্য পথ নাই।
সারাংশ : পৃথিবীতে কিছু মানুষ রয়েছে যারা সর্বসাধারণের মধ্য থেকেই নিজ প্রচেষ্টায় মহৎ হয়ে ওঠেন। নিজ প্রচেষ্টা ব্যতীত কেবলমাত্র অন্যের সাহায্য নিয়ে প্রকৃত্ব মহত্ত্ব লাভ করা যায় না। তাই নিজ উদ্যোগ, শ্রম, মেধা, অধ্যবসায়, ধৈর্য ও দুঃখ লাঘবের ক্ষমতা প্রভৃতি গুনাবলীর দ্বারা সকল প্রকার প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে মনুষ্যত্ব ও মহত্ত্ব অর্জন করা সম্ভব।

৩৬
এ যুগে পাঠক হচ্ছে জনসাধারণ, সুতরাং তাদের মনোরঞ্জন করতে হলে অতি সস্তা খেলনা গড়তে হবে, নইলে তা বাজারে কাটবে না। এবং সস্তা করার অর্থ খেলা করা। বৈশ্য লেখকের পক্ষেই শূদ্র পাঠকের মনোরঞ্জন করা সঙ্গত। অতএব সাহিত্যে আর যাই কর না কেন, পাঠক সমাজের মনোরঞ্জন করবার চেষ্টা করো না।
সারাংশ : পাঠকের মনোরঞ্জন করতে গেলে সাহিত্য তার ধর্মচ্যুত হয়। সাহিত্যের উদ্দেশ্য আনন্দ দেয়া, মনোরঞ্জন নয়। মনোরঞ্জন করতে গেলে সাহিত্য খেলনার মত সামান্য হয়ে যায়।

৩৭
এই সৌরজগৎ কিরূপে বিধি-নির্দিষ্ট নিয়মাধীন থাকিয়া সুশৃঙ্খলভাবে চলিতেছে, তাহা চিন্তা করিলে উচ্ছৃঙ্খল জীবন নিয়মিত হয়। চারদিকে এই প্রকা- বিশ্ব কী সুন্দর সুশৃঙ্খলভাবে চলিতেছে। সূর্য প্রত্যেক দিন নির্দিষ্ট সময়ে উদিত হইতেছে, নির্দিষ্ট সময়ে অস্ত যাইতেছে, চন্দ্রের ষোলকলা নির্দিষ্ট নিয়মানুসারে বৃদ্ধি পাইতেছে এবং ক্ষয় পাইতেছে। অন্যান্য গ্রহনক্ষত্রাদি যাহার যেদিন যেভাবে যতটুকু চলার কথা ততটুকুই চলিতেছে। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত- ছয় ঋতু নির্দিষ্ট চক্রে ঘুরিতেছে, অগ্নি নির্দিষ্ট নিয়মে তাপ দিতেছে, বায়ু নির্দিষ্ট নিয়মে বহিতেছে, মেঘ নির্দিষ্ট নিয়মে সঞ্চারিত হইতেছে- ইহা চিন্তা করিলে নির্দেষ্ট নিয়ম ত্যাগ করিয়া কর্ণধারহীন তরণীর ন্যায় কে আপনার জীবনকে উচ্ছৃঙ্খল করিবে।
সারাংশ : নিয়মানুবর্তিতা প্রকৃতির এক অপার সৌন্দর্য্য। সৌরজগতের বিশালাকার গ্রহ থেকে ক্ষুদ্রতিক্ষুদ্র নক্ষত্র সবাই সুশৃংখল নিয়মাধীন। যা মানবজীবনকে উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন বর্জন করার এক সুস্পষ্ট আহ্বান।

৩৮
এই সেই রমযান মাস যাতে মানববৃন্দের পথপ্রদর্শক এবং সৎপথ ও মীমাংসার উচ্চ নিদর্শন কোরআন শরীফ অবতীর্ণ হইয়াছে। এই সেই রমযান যাহার মধ্যে প্রভুর প্রথম দান মানুষকে সার্থক ও সুন্দর করিয়াছে। দারুণ গ্রীষ্মের দাবদাহের শেষে স্নিগ্ধ বারিধারার মতো ইহারই মধ্যে প্রথম অবতীর্ণ হইয়াছে কোরআনের মহাবাণী গভীর অন্ধকারে শান্তি ও মুক্তির প্রথম জ্যোর্তিবিভাগ। প্রভু জানাইয়াছেন, হে মানুষ। আমি আছি। আমি অনন্ত, অজয়, চিন্ময়, অরুপ। আমি তোমার সৃষ্টিকর্তা, আমি তোমার পালনকর্তা। আমাকে জানো। ‘একরা বেসমে রাব্বিক’-‘তোমারই প্রতিপালকের নামে পড়ো।’ তাহাই মুসলমানের মনোবীণায় রমযান এমন মহান বিরাট সুরের ঝংকার তুলিয়াছে।
সারাংশ : পবিত্র রমজান মাসে আল্লাহতায়ালা কোরআন শরীফ নাযিল করেছেন যা মানবজাতির শ্রেষ্ঠ পথ নির্দেশনা। এই পবিত্র কোরআনের বাণীর দ্বারাই মানুষ আল্লাহর পরিচয় ও অপরিসীম ক্ষমতা সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করেছে। তাই মুলসমানদের নিকট রমজান মাস অতীব মূল্যবান।

৩৯
এই শ্মশানে আসিলে সকলেই সমান হয়। পন্ডিত, মূর্খ, ধনী, দরিদ্র, সুন্দর, কুৎসিত, মহৎ, ক্ষুদ্র, ব্রাহ্মণ, শুদ্র, ইংরেজ, বাঙালি এইখানে সকলেই সমান। নৈসর্গিক, অনৈসর্গিক সকল বৈষম্য এখানে তিরোহিত হয়। শাক্য-সিংহ বলো, শঙ্করাচার্য বলো, ঈশা বলো, মুসা বলো, রামমোহন বলো কিন্তু এমন সাম্যসংস্থাপক এ জগতে আর নাই। এ বাজারে সব একদর- অতিমহৎ এবং অতিক্ষুদ্র। মহাকবি কালিদাস এবং বটতলার নাটক লেখক একই মূল্য বহন করে।
সারাংশ : শ্মশানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি, শিক্ষা, বাহ্যিক সৌন্দর্য, আকার, আর্থিক প্রাচুর্য, দীনতা প্রভৃতি প্রকারভেদে সকল ধরনের মানুষ সমান। কেননা রাজা-প্রজা, কবি, জ্ঞানী, নিরক্ষর সকলেই এখানে সমান পরিচয় বহন করে এবং সকলেই মৃত।

৪০
একজন সৈন্যাধ্যক্ষ তাঁর অনুচরদের ডেকে বলেছিলেন, নিজেদের চেয়ে শত্রুপক্ষের সৈন্যকে ভালো করে চিনে রেখো, যুদ্ধজয়ের অর্ধেক সেখানেই। যে চিকিৎসক ব্যাধির সঙ্গে সংগ্রামে চলেছেন, তাঁকে এই কথাটা ভালো করে মনে রাখতে হবে। মানুষের সকল শত্রুর বড় শত্রু হলো ওইসব জীবাণু। তারা আড়ালে থাকে, অনেক তোড়জোড় করে তাহাদের খুঁজে বের করতে হয়, তাদের রাজনীতির পরিচয় পেতে হয়, তাদের ধ্বংসের উপায় ঠিক করতে হয়।
সারাংশ : জগতে কতিপয় স্বার্থানেন্বেষী লোক রয়েছে যারা মানবতা ও সভ্যতার শত্রু। মানবতাবিরোধী এসব শত্রুদের মেধা, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শীতা দ্বারা চিহ্নিত করে তাদের কৌশল, নীতি, শক্তি, সামর্থ্য, উদ্দেশ্যসহ যাবতীয় কর্মকা- সম্পর্কে জেনে সঠিক দমনব্যবস্থা গ্রহণ করাই মানব কল্যাণীদের কর্তব্য।

৪১
একটা বরফের পিন্ড ও ঝরনার মধ্যে তফাৎ কোনখানে? না, বরফের পিন্ডের মধ্যে নিজস্ব গতি নেই। তাকে বেঁধে টেনে নিয়ে গেলে তবে সে চলে। কিন্তু ঝরণার যে গতি সে তার নিজের গতি, সেজন্য এই গতিতেই তার ব্যাপ্তি, তার মুক্তি, তার সৌন্দর্য। এই জন্য গতিপথে সে যত আঘাত পায়, ততই তাকে বৈচিত্র্য দান করে। বাধায় তার ক্ষতি নেই, চলায় তার শান্তি নেই। মানুষের মনেও যখন রসের আবির্ভাব না থাকে, তখনই সে জড়পি-। তখন ক্ষুধা-তৃষ্ণা-ভয়-ভাবনাই তাকে ঠেলে কাজ করায়। তখন প্রতি কাজে পদে পদেই তার ক্লান্তি। সেই নীরস অবস্থাতেই মানুষ অন্তরের নিশ্চলতা থেকে বাহিরেও কেবলই নিশ্চলতা বিস্তার করতে থাকে। তখনই তার যত খুঁটিনাটি, যত আচার-বিচার, যত শাস্ত্র-শাসন। তখন মানুষের মন গতিহীন বলেই বাইরেও আষ্টেপৃষ্ঠে সে বন্ধ।
সারাংশ : মানুষ তার মনকে বরফের পিন্ডের মতো গতিহীন না করে যদি ঝরনার যদি অঝোর ধারার মতো গতিশীল করে তবে জীবনের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠে। আর মন যদি গতিহীন হয় তাহলে নানা সীমাবদ্ধতা ও কুসংস্কার মানুষের পরিপূর্ণ বিকাশে বাধা দান করে।

৪২
একটি নবযুগ আমাদের দুয়ারে এসে উপস্থিত; মান্য অতিথির মতো সংবর্ধনা করে না আনলে সে ঘরে আসতে নারাজ। অনাহূত গৃহে প্রবেশ করতে সকলেরই লজ্জা হয়। নবযুগও লজ্জা অনুভব করছে। তার লজ্জা ভাঙানোর ভার আমাদের ওপর। কিন্তু অতিথি এল, সে শত্রু, না মিত্র প্রকৃত হিতাকাক্সক্ষী, না প্রতারক, তা না জেনে তো তাকে গ্রহণ করা যায় না। তাই তার যথাসম্ভব পরিচয় দেওয়া দরকার। আগন্তুক আমাদের পর নয়, মানবসভ্যতার শিশু, অতীত ও বর্তমানের সন্তান, সে নিজ থেকেই এসেছে; তার সম্বন্ধে আমাদের অবহিত হতে হবে মাত্র, আর এক্ষেত্রে অবহিত হওয়ারই সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা। তাঁর কণ্ঠে যে অস্পষ্ট বাণী তার অর্থ, হে মানুষ ভয় করো না; তোমার মধ্যে যা শ্রেষ্ঠ মূল্যবান অবিনশ্বর ও অশেষ সম্ভাবনাপূর্ণ তার রক্ষার ভার আমার হাতে। আর সে জন্যেই আমার আগমন। বর্তমান যুগের কি সেসব রক্ষার ক্ষমতা নেই? শ্রেষ্ঠ ও মূল্যবানকে ভুলে বর্তমানে আমরা কি শুধু অপকৃষ্টের সাধনা করে চলেছি? ব্যতিক্রম হয়তো আছে, তবে মোটের ওপর কথাটায় সায় না দিয়ে উপায় কী? মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিব্যক্তি সৃজনশীলতা আজ শোচনীয়রূপে পরাভূত, ধূর্ততা ও ফন্দিবাজি তার স্থানে সমাসীন। এ দুরবস্থাকে মুক্তি দেয়ার জন্যেই নবযুগের আগমন।
সারাংশ : সমাজকে পরিবর্তনের জন্যই নবযুগের সৃষ্টি। তবে নবযুগ আনয়নে পরিশ্রম, সাধনা ও সংগ্রাম দ্বারা এর যথার্থতা বিচার করতে হবে। আর এভাবেই নবযুগ অতীত ও বর্তমানের মধ্য থেকে সৃষ্ট হয়ে সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত ও সৃজনশীল করে গড়ে তোলে।

৪৩
এমন কথা কেউ বলতে পারে না, সূর্যটা আমার। আকাশটা আমার। একজন মানুষ এ কথা বলতে পারে না। এমনকী কোনো একক জনগোষ্ঠীও এ দাবি তুলতে পারে না। কিন্তু তবু আকাশের কিছু অংশ যদি আমার নিজের মনের মতো না হয়, তবে সমস্ত আকাশটাই আমার কাছে মিছে। সূর্যের কিছু রোদে আমার যদি স্বতন্ত্র অধিকার না থাকে, তবে সূর্যটাও আমার কাছে মিছে ছাড়া আর কিছু নয়। তেমনি আমার ঘর আছে বলেই অপরের ঘরের দাম আমি বুঝি। আমার অস্তিত্বের মর্যাদা আমার কাছে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে।
সারাংশ : গোটা পৃথিবী একটা হলেও মানুষ এর কিছু অংশ একান্ত আপন করে নেয় যা তার দেশপ্রেমকে জাগ্রত করে। মানুষ তার নিজ অস্তিত্ব ও দেশপ্রেমের উপলব্ধি দ্বারাই অপরের দেশাত্ববোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারে।

৪৪
এটা স্মরণ রাখা কর্তব্য যে, পৃথিবীতে যেখানে তুমি থামবে, সেখান হতেই তোমার ধ্বংস আরম্ভ হবে। কারণ তুমিই কেবল একলা থামবে, আর কেউ থামবে না। জগৎ-প্রবাহের সঙ্গে সমগতিতে যদি না চলতে পারে তো প্রবাহের সমস্ত সচল বেগ তোমার ওপর এসে আঘাত করবে, একেবারে বিদীর্ণ বিপর্যস্ত হবে কিংবা অল্পে অল্পে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে কালস্রোতের তলদেশে অন্তর্হিত হয়ে যাবে। হয় অবিরাম চলো এবং জীবনচর্চা করো, নয় বিম্রাম করো এবং বিলুপ্ত হও পৃথিবীর এই রকম নিয়ম।
সারাংশ : গতিশীল ও কর্মময় জীবনে সর্বদা মানুষকে সমানতালে সামনে এগিয়ে যেতে হয়। অন্যথায়, গতির আঘাতে জীবন স্থবির, ক্ষয়প্রাপ্ত, বিলুপ্ত ও বিপর্যপ্ত হয়ে সাগরের অতল গহ্বরে হারিয়ে যায়। তাই কর্মময় জীবন চর্চায় গতিশীলতা পৃথিবীর স্বাভাবিক নিয়ম।

৪৫
কথায় কথায় মিথ্যাচার, বাক্যের মূল্যকে অশ্রদ্ধা করা এসব সত্যনিষ্ঠ স্বাধীন জাতির লক্ষণ নয়। স্বাধীন হবার জন্য যেমন সাধনার প্রয়োজন, তেমনি স্বাধীনতা রক্ষার জন্য প্রয়োজন সত্যনিষ্ঠা ও ন্যায়পরায়ণতা। সত্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধহীন জাতি যতই চেষ্টা করুক তাদের আবেদন নিবেদন আল্লাহর কাছে পৌঁছাবে না, তাদের স্বাধীনতার দ্বার থেকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়া হবে। যে জাতির অধিকাংশ ব্যক্তি মিথ্যাচারী, সেখানে দু’একজন সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তির বহু বিড়ম্বনা সহ্য করতে হবে। কিন্তু মানবকল্যাণের জন্য, সত্যের জন্য যে বিড়ম্বনা ও নিগ্রহ তা সহ্য করতেই হবে।
সারাংশ : স্বাধীন হবার জন্য যেমন সাধনা প্রয়োজন তেমনি একে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজন ন্যায়পরায়ণতা ও সত্যনিষ্ঠা। মিথ্যাবাদিতা ধ্বংস ডেকে আনে এবং জীবনকে পরাধীনতার দিকে ঠেলে দেয়। যে জাতির অল্পসংখ্যক লোক সত্যবাদী, তারা অনেক সময় বিড়ম্বনা ও নিগ্রহের স্বীকার হলেও দেশ ও জাতির স্বার্থে তারা তা সহ্য করে থাকেন।

৪৬
কবিতার শব্দ কবির অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির প্রতীক। বাক্যের মধ্যে প্রবন্ধের মধ্যে প্রত্যেক শব্দ আপন আপন বিশিষ্টতায় উজ্জ্বল। যাঁরা কবিতা লিখবেন, তাঁদের মনে রাখতে হবে যে, অনুভূতিদীপ্ত শব্দসম্ভার আয়ত্তে না থাকলে প্রত্যেকটি শব্দের ঐতিহ্য সম্পর্কে বোধ স্পষ্ট না হলে, কবিতা নিছক বাকচাতুর্থ হয়ে দাঁড়াবে মাত্র। কবিতাকে জীবনের সমালোচনাই বলি বা অন্তরালের সৌন্দর্যকে জাগ্রত করবার উপাদানই বলি, কবিতা সর্বক্ষেত্রেই শব্দের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এই শব্দকে আমাদের চিনতে হবে।
সারাংশ : কবিতায় শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে কবিকে নিজস্ব গভীর অভিজ্ঞতা, অনুভূতিদীপ্ত শব্দসম্ভার, ভাষার প্রাঞ্জলতা, রূপ-রীতি ও শব্দের প্রচলিত ও বুৎপত্তিগত অর্থের দিকে মনযোগী হতে হবে। কেননা কবিতার ভিত্তি শব্দের সঠিক ব্যবহারের মধ্যেই নিহিত। অন্যথায় কবিতা বাকবৈভবের সম্ভারের পরিবর্তে বাকচাতুর্যে পরিণত হবে।

৪৭
কলম্বাস যখন আমেরিকা আবিষ্কার করিতে কৃতসংকল্প হন, তখন লোকে তাহাকে বাতুল বলে নাই কি? নারী আপন স্বত্ব-স্বামিত্ব বুঝিয়া আপনাকে নরের ন্যায় শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করিতে চাহে, ইহাও বাতুলতা বৈ আর কি? পুরুষগণ স্ত্রীজাতির প্রতি যতটুকু সম্মান প্রদর্শন করেন, তাহাতে আমরা সম্পূর্ণ তৃপ্ত হইতে পারি না। লোকে কালী, শীতলা প্রভৃতি রাক্ষস প্রকৃতির দেবীকে ভয় করে। পূজা করে সত্য। কিন্তু সেইরূপ বাঘিনী, নাগিনী, সিংহী প্রভৃতি দেবীও কি ভয় ও পূজা লাভ করে না? তবেই দেখা যায় পূজাটা কে পাইতেছেন রমনী কালী, না রাক্ষসী নৃমুন্ড মালিনী।
সারাংশ : সমাজ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে হলে, প্রচলিত প্রথা ভাঙতে হলে, শত বাঁধা-বিঘ অতিক্রম করতে হয়। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এই বাঁধা-বিপত্তি জয় করে নারীকে তার অধিকার আদায় করে নিতে হবে।

৪৮
কাব্য, সংগীত প্রভৃতি রসসৃষ্ট বস্তু বাহুল্যবিরল রিক্ততার অপেক্ষা রাখে। তাদের চারদিকে যদি প্রকাশ না থাকে তাহলে সম্পূর্ণ মূর্তিতে তাদের দেখা যায় না। আজকালকার দিন সেই অবকাশ নেই, তাই এখানকার লোকে সাহিত্যে বা কলা সৃষ্টির সম্পূর্ণতা থেকে বঞ্চিত। তারা রস চায় না, মন চায়। চিত্তের জাগরণটা তাদের কাছে শূন্য, তারা চায় চমক-লাগা ভিড়ের ঠেলাঠেলির মধ্যে অন্যমনস্কের মতো যদি কাব্যকে, গানকে পেতে হয় তাহলে তার খুব আড়ম্বরের ঘটা করা দরকার। কিন্তু, সে আড়ম্বরে শ্রোতার কানটাকেই পাওয়া যায় মাত্র, ভিতরের রসের কথাটা আরো বেশি করে ঢাকাই পড়ে। কারণ সরলতা, স্বচ্ছতা আর্টের যথার্থ আভরণ।
সারাংশ : শিল্প-সাহিত্যের প্রকৃত রস গ্রহণ করতে হলে অবকাশের প্রয়োজন যা মানুষের চিত্তকে জাগ্রত করে। কিন্তু বর্তমানে মানুষ অবকাশের চেয়ে আড়ম্বরতায় ব্যস্ত। এই আড়ম্বরতা শিল্প-সাহিত্যের সরলতা ও স্বচ্ছতাকে দূর করে মানুষের মনে রসের শূন্যতা সৃষ্টি করেছে।

৪৯
কাব্যরস নামক অমৃতে যে আমাদের অরুচি জন্মেছে তার জন্যে দায়ী এ যুগের স্কুল এবং তার মাস্টার। কাব্য পড়বার ও বোঝবার জিনিস, কিন্তু স্কুলমাস্টারের কাজ হচ্ছে বই পড়ানো ও বোঝানো। লেখক এবং পাঠকের মধ্যে এখন স্কুলমাস্টার দন্ডায়মান। এই মধ্যস্থদের কৃপায় আমাদের সঙ্গে কবির মনের মিলন দূরে থাক, চার চক্ষুর মিলনও ঘটে না। স্কুলঘরে আমরা কাব্যের রূপ দেখতে পাই নে, শুধু তার গুণ শুনি। টীকা-ভাষ্যের প্রসাদে আমরা কাব্য সমসৎ সফল নিগূঢ় তত্ত্ব জানি। কিন্তু সে যে কী বস্তু তা চিনিনে। আমাদের শিক্ষকদের প্রসাদে আমাদের এ জ্ঞান লাভ হয়েছে যে, পাথুরে কয়লা হীরার সবর্ণ না হলেও সগোত্র; অপর পক্ষে হীরক ও কাচ যমজ হলেও সহোদর নয়।
সারাংশ : কাব্য পড়ার ও বোঝার বিষয়। শিক্ষকের সহায়তায় কাব্যের তাত্ত্বিক রূপ জানা গেলেও এর প্রকৃত রস আস্বাদন করা সম্ভব হয় না।

৫০
কিসে হয় মর্যাদা ? দামি কাপড়, গাড়ি, ঘোড়া ও ঠাকুরদাদার কালের উপাধিতে? - মর্যাদা এইসব জিনিসে নাই। আমি দেখতে চাই তোমার ভিতর, তোমার মাথা দিয়ে কুসুমের গন্ধ বেরোয় কিনা। তোমায় দেখলে দাসদাসী দৌড়ে আসে। প্রজারা তোমায় দেখে সন্ত্রস্ত হয়, তুমি মানুষের ঘাড়ে চড়ে হাওয়া খাও, মানুষকে দিয়ে জুতা খোলাও, তুমি দিনের আলোতে মানুষের টাকা আত্মসাৎ কর। বা-মা-শ্বশুর-শাশুড়ি তোমায় আদর করেন। আমি তোমায় অবজ্ঞায় বলব- যাও।
সারাংশ : সমাজে মানুষের মর্যাদা অর্থ-সম্পদ, ক্ষমতা, আভিজাত্য ইত্যাদি দ্বারা নির্ধারিত হয় না। মিথ্যা আভিজাত্য, অহমিকা, অর্থলোভ, দুশ্চরিত্র ইত্যাদি মানুষকে অবজ্ঞার পাত্রে পরিণত করে।


সারাংশ (১ থেকে ৫০)
সারাংশ (৫১ থেকে ১০০)
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post