খুদে গল্প : স্মৃতির মণিকোঠায়

'স্মৃতির মণিকোঠায়' শিরোনামে একটি খুদে গল্প লেখ।

স্মৃতির মণিকোঠায়

'৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজের বাড়িঘর ছেড়ে আত্মরক্ষার জন্য একটু নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছি। কোথাও মিলছে না। যেখানে যাই সেখান থেকেই লোকজন অন্য কোথাও পালিয়ে যাচ্ছে। আমরা পঁচিশজন মানুষ। পাঁচজন সমর্থ পুরুষ ছাড়া বাকি সবাই নারী-শিশু। শেষ পর্যন্ত আমরা ভারতের পথে পা বাড়ালাম। ছোট্ট একটা নৌকাতে আমরা সবাই ভীতসন্ত্রস্ত। কখন পাকিস্তানি বর্বরদের শিকারে পরিণত হই। কিংবা তাদের দোসর, দালাল - রাজাকারদের হাতে লাঞ্চিত হই, ভাবনার শেষ নেই। মা আমাদের ভাই বোনদের ডেকে বললেন, আমরা নৌকা থেকে নেমে হেটে ভারতে যাবো। যদি পথে কোনো বিপদ হয়, যদি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যাই, তাহলে তোমরা আমাদের জন্য দাঁড়াবে না। যেদিকে পারও পালাবে। আমরা নৌকা থেকে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছি। তখন একজন লোক এসে খবর দিল এই চরে নামা ঠিক হবে না। এখানে ডাকাতের বসবাস। তারা প্রচন্ড হিংস্র, আগে মানুষ হত্যা করে, পরে তাদের শরীর থেকে হাতড়িয়ে টাকা, গয়না জিনিসপত্র তুলে নেয়। তবু আব্বা সবাইকে নিয়ে নামলেন। আমাদের সবার কাছেই কমবেশি টাকা পয়সা ছিল। মহিলাদের কাছে অল্পস্বল্প গহনাও ছিল। চরে নামার পর এক বৃদ্ধের সঙ্গে আব্বার আলাপ হলো। সেই বৃদ্ধ আমাদেরকে ভারতে যেতে সাহায্য করবেন বলে আব্বাকে জানালেন। কিন্তু নৌকা থেকে সবাই খালি হাতে প্রথমে ঐ বৃদ্ধের বাড়িতে যেতে হবে। সেখান থেকে তিনি তার লোকের মাধ্যমে আমাদের ভারতে পাঠিয়ে দিবেন। আমরা ভয়ে জড়সড়। কিন্তু আব্বা তার শর্ত মেনে নিয়ে রাজি হলেন। এর মধ্যে ঐ লোকটি এসে জানিয়ে গেল- ঐ বৃদ্ধ লোকটি এখানকার ডাকাত দলের সর্দার। চাইলে ভালোও করতে পারেন, আবার মন্দও করতে পারেন। চরে নেমে আমরা বৃদ্ধের বাড়ির উদ্দেশ্য চললাম। আমাদের বুকের কাঁপন থামেনি, ঘনঘন পানির পিপাসা হচ্ছে। সঙ্গে যা ছিল তা ফুরিয়ে গেছে। বৃদ্ধের কাছে পানি চাইলাম। বৃদ্ধ পাশের বাড়িতে ঢুকতেই সর্দার, সর্দার বলে সবাই তাকে আদাব / নমস্কার করল, সে শুধু বলল- এরা আমার মেহমান, দূর থেকে এসেছে। তৃষ্ণা পেয়েছে। জি সর্দার বলে ছুটে গিয়ে কলসিসহ পানি নিয়ে এলো তিনজন। তখন ভয় আরও বেড়ে গেল। তবু পানি খেলাম। অনেকটা পথ আসার পর বাড়িতে এলাম। রাস্তা থেক উঠে একটা ঘর, একটা উঠোন। তারপর একটা বড় ঘর। এর বেশি কিছু আজ মনে নেই। আমরা সবাই সেই বড় ঘরটায় চৌকিতে বসলাম। বৃদ্ধ লোকটি আমাদের নির্ভয়ে থাকতে বললেন। একটু পর আমাদের খাবার দেয়া হলো। ক্ষুধার্ত অবস্থায় ভালো ভালো খাবার পেয়ে ভয় গেলাম ভুলে। সবাই পেট পুরে খেলাম। বৃদ্ধ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তার লোকদের হুকুম দিলেন আমাদের ভালোভাবে খাওয়ানোর জন্য। তিনি আব্বাকে অনুরোধ করলো অন্তত একদিন তার বাড়িতে বিশ্রাম নিয়ে তারপর ভারতে যেতে। কিন্তু আব্বার রাজি হলেন না। তার আপ্যায়নের জন্য আব্বা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আবেগ প্রকাশ করলেন। ডাকাত সর্দার নিজেও আবেগে কেঁদে ফেললেন। তারপর চোখ মুছে বললেন, শেখ সাহেব সেদিন বলেছিলেন, তোমাদের যার যা কিছু আছে তা নিয়ে প্রস্তুত থাকো। সে থেকেই আমরা এই চরে প্রস্তুত হয়ে আছি ঐ পাকিস্তানি বর্বর হানাদারদের নিশ্চহ্ন করতে। যদি কখনো তারা এই পথে আসে তা হলে একজনকেও জীবিত ছাড়বো না ইন শাহ আল্লাহ। আমরা সবাই নিজের অজান্তেই বলে উঠলাম জয় বাংলা। তারপর আমরা সবাই হাসিমুখে বিদায় নিলাম । বৃদ্ধ আমাদের জন্য চার পাঁচজন লোক ঠিক করে দিলেন এবং কীভাবে আমাদের ভারতে পৌঁছে দিবেন তা তাদের বুঝিয়ে দিলেন। ভারতে গিয়ে নিরাপদ আশ্রয় পেলাম। বাবা তার সঙ্গীদের সাথে আবার সেই পথে বাংলাদেশে এসে যুদ্ধ করলেন। ঐ ডাকাত সর্দারকে আর খুঁজে পাননি। সেখানকার ঘরবাড়িগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই দুরবস্থার মধ্যে এমন মহানুভবতা, খাবার, আশ্রয়, পথের দিশা দানকারী সেই ব্যক্তির কথা আমরা ভুলতে পারিনা। তিনি যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকবেন আমাদের স্মৃতির মণিকোঠায়।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post