খুদে গল্প : হায়েনার আনাগোনা

'হায়েনার আনাগোনা' শিরোনামে একটি খুদে গল্প লেখ।

হায়েনার আনাগোনা

ধরে নেওয়ার মাসখানের পর জীবিত ফিরে এলো দেলোয়ার। সেদিন স্বামীর জন্য মিলিটারিদের পা জড়িয়ে ধরেছিল অন্তঃসত্ত্বা কমলা। হায়েনারা তার কান্না বন্ধ করেছিল। লাথি দিয়ে ফেলে একটি গুলির শব্দে। দশ বারো বছরের ছেলেটি আড়াল থেকে সব দেখে নিঃশব্দে পালিয়েছিল। অক্ষত অবস্থায় দেলুকে ঘরে ফিরতে দেখে গ্রামবাসী অবাক হলো। সবার কাছেই ব্যাপারটি অবিশ্বাস্য মনে হলো। সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল দেলুর দিকে। তার ছেলে রহমত এসে জানতে চায় কী করে বেঁচে এলো বাবা? দেলু ছেলের জোরাজুরিতে বলে, ‘আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে রেখেছিল লম্বা একটা ঘরে। সেখানে অনেক লোক। প্রতিদিন সেখান থেকে দু'জন করে বাইরে নিয়ে গুলি করে মারত। আমরা জানালা দিয়ে দেখতাম। আমার পাশের লোকটিকে আগের দিন মেরে ফেলেছে। ভাবলাম এবার আমার পালা, সেদিন আর কেউ এলো না। পরদিন সকালে দেখলাম ডানদিকের দুজনকে নিয়ে যাচ্ছে। একজন বয়স্ক, অন্যজনের বয়স কম। হয়তো বাবা ছেলে কিংবা দুই বাবা অথবা কেউ কারও কিছু নয়। তারা ছেলেটিকে চোখ বেঁধে ফেলল। বয়স্ক লোকটি চোখ বাঁধতে দিল না। বাইরে নিয়ে গিয়ে ছেলেটির মুখে নল ঢুকিয়ে গুলি করল। আর বয়স্ক লোকটিকে ব্রাশ ফায়ারে উড়িয়ে দিল। শার্ট ফুটো ফুটো হয়ে উড়ছে।... ছেলে তাড়া দিয়ে বলল- ‘সে ঘটনা নয়, তুমি বাঁচলে কী করে সেটা বলো?’ - দেলু ছেলের কথায় উত্তর দিল না, চুপ থাকল। দুজন খাল পাড়ের রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছে। কারও মুখে কথা নেই। ছেলে বাবার হাত ধরে ঝাঁকি দিয়ে তার মনোযোগ আকর্ষণ করে বলল- দক্ষিণ পাড়ার আমজাদ চাচার কথা তোমার মনে আছে বাবা? ঐ যে আমার সাথে পড়ে আমির-আসিরের আব্বা। সে বাড়ি থেকে বের হয়ে মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়েছিল। সেখানে তাকে গুলি করেছে। সারারাত মসজিদের ভেতর লাশ পড়েছিল, সকালবেলা গ্রামের লোকজন তাকে ওখানেই কবর দিয়েছে। দেলোয়ার তখনও চুপ করে আছে। ছেলে বাবার হাত ধরে নিজের বাড়ির অভিমুখে এগিয়ে চলছে। তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। কিন্তু কোনো বাড়িতে সাঁঝের বাতি জ্বলছে না। দূর থেকে একটা গন্ধ আসছে, বকুল ফুলের গন্ধ। ছেলেও কিছু বলছে না। আর একটু এগিয়ে সে বকুল ফুলের গাছটা চোখে পড়ল রহমতের। গাছটার কাছে গিয়ে ছেলে বলল- নিশিকান্তকে তোমার মনে আছে বাবা, ঐ যে নিশিকান্ত, সুন্দর, চোখগুলো বড় বড়। নিশির এক দাদি ছিল দু'চোখে ছানি পড়া, সংসারে আর কেউ ছিল না। সেই নিশিকে এই গাছটাতে গেঁথে মেরেছে। বুড়ি দাদি রোজ গাছের নিচে এসে বসত আর চেঁচাত ‘কী রে নিশি গাছ থেকে নামবি নে...’। তার পর যে কোথায় চলে গেল সে বুড়ি, কেউ জানে না। নিশি গাছটায় বহুদিন গেঁথেছিল। দূর থেকে দেখা যেত দু হাত ছড়ানো, নিশি সমস্ত পাড়াটার দিকে চেয়ে আছে। দেলোয়ার ছেলে রহমতের কথায় কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। গাছটার দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করে হাঁটতে লাগল। তখন অন্ধকার হয়ে এসেছে, দূর থেকে একটা আলো এগিয়ে আসছে তাদের দিকে, গাড়ির হেডলাইট, রহমত বুঝতে পারল- বাবাকে তাড়া দিয়ে বলল, বাবা পালাও মিলিটারি। রহমত দেখল তার বাবা দাঁড়িয়ে আছে। ততক্ষণে গাড়িটা আরো কাছাকাছি এসে পড়েছে। দেলোয়ার শার্টের নিচে কোমরে পেঁচানো পাকিস্তানের চান তারা পতাকা শূন্যে মেলে ধরল। বাবার বেঁচে থাকা আর ফিরে আসার রহস্য জেনে হাফপ্যান্টের পকেট থেকে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত লাল সবুজের পতাকা বের করে বুকের উপর মেলে ধরে রহমত। বলল জয় বাংলা, জয় বাংলা।সাথে সাথে কতগুলো গুলির শব্দ। তারপর সব নিস্তব্ধ।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post