মার্চের দিনগুলি

রচনা : শিক্ষাসফরের গুরুত্ব

ভূমিকা : জ্ঞান লাভের উপায় বা মাধ্যম হল দুটি। একটি হল বই পড়া, অন্যটি শিক্ষাসফর। বই পড়ে তত্ত্বগত জ্ঞান লাভ করা যায়। আরো জানা যায় অনেক তথ্য। কিন্তু এগুলোই যথেষ্ট নয়। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের উক্তিটিও স্মরণযোগ্য : 

তাই, কোনো কিছু প্রত্যক্ষ দেখে অভিজ্ঞতা লাভ করা সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। প্রাচীনকালে যখন বই সহজলভ্য ছিল না, তখন জ্ঞানপিপাসু শিক্ষা-সফরে বেরিয়ে পড়তেন। তাদের অভিজ্ঞতা আজ আমাদের জন্য অতীতকে জানার সূত্র হয়ে গেছে। ইবনে বতুতা তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে লিখেছেন- 

শিক্ষাসফরের গুরুত্ব : গভীরভাবে জানা যায় অতীত উপমহাদেশের ইতিহাস লেখার রেওয়াজ ছিল না। যা ছিল তা হল কাব্য, মহাকাব্য, রামায়ণ-মহাভারত বেদ-পুরাণ ইত্যাদি। যে সময়ে উপমহাদেশের ইতিহাস লেখা হত না সে সময়কার ঐতিহাসিকগণ উপাদানের জন্য আমাদের বিদেশি পর্যটকদের উপর নির্ভর করতে হয়েছে। এখানেই বোঝা যায় সফরের গুরুত্ব কি অপরিসীম। ঐতিহাসিকগণ একের পর এক দেশ সফর করে মানব সভ্যতার ইতিহাস রচনায় অতি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গিয়েছেন। এ সফর বিশ্ব-ইতিহাস রচনায় যেমন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে, তেমনি বিশ্ব সাহিত্যকেও সমৃদ্ধ করেছে। 

শিক্ষাসফরের উদ্দেশ্য : শিক্ষা সফরের উদ্দেশ্য হল- বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা, বাইরের পরিবেশ থেকে বাস্তব জ্ঞান অর্জন করা। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু বিষয়েই পাঠদান করা হয়ে থাকে। সে সবের প্রায় প্রতিটি বিষয়ই আমাদের জীবন ও জীবন ব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত। তাই, পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে সে সমস্ত বিষয়ের সাথে চাক্ষুস পরিচয়ের গুরুত্ব অস্বিকার করা যায় না। পৃথিবীর কত যে বিচিত্র স্থান আছে, বৈচিত্র্যের কথা বই পড়ে সবটুকু জানতে পারি না, চাক্ষুষ অভিজ্ঞতার দ্বারা তা সম্পূর্ণ নতুনভাবে আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। কত বিচিত্র দেশ, বিচিত্র তার অধিবাসী- আরো বিচিত্র তাদের সাংস্কৃতিক জীবনধারা ও সামাজিক রীতিনীতি। দিকে দিকে কত অরণ্য-সমুদ্র-মরু-পর্বত। নিসর্গ প্রকৃতির কত অফুরান বৈভব, কত পশু-পাখি, জীবজন্তু। আমরা দেশ শিক্ষা সফরের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সেগুলোকে পূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে পারি। ফলে শিক্ষা-সফর শিক্ষার এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থা পুঁথির ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ। অধীত-বিদ্যা তাই আমাদের মনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে না। মহৎ উপলব্ধিতে সেই শিক্ষা পূর্ণ, সার্থক হয় না। রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন, ‘প্রত্যক্ষ বস্তুর সহিত সংস্রব ব্যতীত জ্ঞানই বলো, চরিত্রই বলো, নির্জীব ও নিষ্ফল হতে থাকে।’ তাই পুঁথির বিদ্যার সঙ্গে চাই বাস্তবের রাখী বন্ধন। মানুষে মানুষে তখন অনুভব করে প্রাণের মিতালি। ইতিহাস পাঠের একটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, শিলালিপি, পাণ্ডুলিপি প্রভৃতিতে। সোনারগাঁ, ময়নামতি, পাহাড়পুর, সুন্দরবন এসব যদি নিজের চোখে দেখা যায় তবে বইয়ের বিবরণ জীবন্ত হয়ে মনের পটে স্থায়ী হয়ে থাকে। ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় ইতিহাসের কত অতীত কীর্তি, কত কাহিনী আমাদের কাছে জীবন্ত হয়ে ওঠে। আমরা যেন সেই ধ্বংসস্তুপে দাঁড়িয়েও শুনতে পাই তার শাশ্বত বাণী। সে ক্ষেত্রে শিক্ষা সফরের কোনো বিকল্প নেই। এমনিভাবে ভাষাতত্ত্বের শিক্ষার্থীদের সাথে প্রত্যক্ষ পরিচয়ের জন্য রয়েছে প্রাচীন ভাষাগুলোর লিপি, ভাষাতত্ত্ব ও তার বিবর্তনের ধারা; ভূগোল শিক্ষার্থীদের সাথে প্রত্যক্ষ পরিচয়ের জন্য রয়েছে বিভিন্ন দেশের মাটি, শিলা, পাথর ইত্যাদি; প্রাণি বিজ্ঞানের ছাত্রদের প্রত্যক্ষ পরিচয়ের জন্য রয়েছে প্রাচীন ফসিল ও চিড়িয়াখানায় সুরক্ষিত বিভিন্ন জীবজন্তু; অন্যান্য বিষয়ের ক্ষেত্রেও রয়েছে বিভিন্ন প্রকারের উপাদান ও উপকরণ। তাই শিক্ষা সফর না করলে শিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। শিক্ষার সঙ্গে তার আধুনিক-সম্পর্ক। পাশ্চাত্য দেশে শিক্ষার সঙ্গে শিক্ষা সফরের আত্মার সম্পর্ক। 

সফরের সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্ক : শিক্ষা সফর শিক্ষার একটি প্রধান অঙ্গ। জীবনের সাথে শিক্ষার সম্পর্ক যেমন নিবিড়, শিক্ষার সঙ্গে সফরের সম্পর্কও তেমন নিবিড়। শিক্ষার প্রতিটি ক্ষেত্রেই সফরের গুরুত্ব রয়েছে। শ্রেণীকক্ষের শিক্ষার মধ্যে পূর্ণতা আনার জন্যই শিক্ষাসফর। দেশ ভ্রমণের সাথে এর কিছুটা পার্থক্য রয়েছে; দেশভ্রমণের মূল উদ্দেশ্য আনন্দ তার পাশাপাশি জ্ঞানার্জন। কিন্তু শিক্ষাসফরের মূল উদ্দেশ্য শিক্ষাগ্রহণ। পৃথিবীর কত যে বিচিত্র স্থান আছে, তার বৈচিত্র্যের কথা বেই পড়ে সবটুকু জানতে পারি না কিংবা উপলব্ধি করতে পারি না, চাক্ষুষ অভিজ্ঞতার দ্বারা তা সম্পূর্ণ নতুনভাবে আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। কত বিচিত্র দেশ, বিচিত্র তার অধিবাসী- আরো বিচিত্র তাদের সাংস্কৃতিক জীবনধারা ও সামাজিক রীতিনীতি। শিক্ষা সফর দ্বারা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সেগুলোকে পূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে পারি। শিক্ষাসফর না করলে শিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। গ্রন্থের বাইরে জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার দ্বারা যে শিক্ষালাভ হয়, তা হয় বাস্তবধর্মী। এই শিক্ষার জন্যই শিক্ষাসফরের আবশ্যকতা অপরিহার্য। 

বাংলাদেশে শিক্ষাসফরের জন্য পর্যটন-স্থান : বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণ-পূর্বে বঙ্গোপসাগরের বেলাভূমি প্রমোদভ্রমণ কেন্দ্র হিসেবে প্রকৃতি নিজের হাতে গড়ে তুলেছে পৃথিবীর এক রহস্যময় সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। যা পর্যটকদের কাছে খুবই লোভনীয় একটি স্থান হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে। আমাদের দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে, বিশেষভাবে মৎস্য – বিভাগের শিক্ষার্থীরা এখানে এসে বিভিন্ন সামুদ্রীক পরিবেশ, সামুদ্রীক প্রাণী ও মৎস্যের সাথে পরিচিতি লাভ করে। অপরদিকে খুলনা জেলার সুন্দরবনও একইভাবে পর্যটকদের আকর্ষণ করে। এছাড়া বাংলাদেশের প্রান্তবর্তী জনপদ রাঙ্গামাটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। সিলেটের চা বাগান, তামাবিল, জাফলং, পটুয়াখালীর কুয়াকাটা, চট্টগ্রামে ফয়েজ লেক, যমুনা সেতু ইত্যাদি পর্যটনের স্থান হিসেবে বেশ সমাদৃত। এসব স্থানে এসে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন পরিবেশ, বনায়ন, ভূ-প্রকৃতি এবং বিভিন্ন ধরনের বৃক্ষের সাথে পরিচিতি লাভ করতে পারে। 

বাংলাদেশের পুরাকীর্তি : বৌদ্ধযুগে রাজশাহী জেলার পাহাড়পুরে প্রভু-বুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভের ধ্বংসাবশেষ সত্যিই দেখার মত এবং এর থেকে অনেক কিছু জানার মতও আছে। পাহাড়পুরের বৌদ্ধ-আশ্রম, আশ্রমের কিছুদূরে সত্যপীরের-ভিটা, প্লেটের উপর তাম্রলিপি ও ব্রোঞ্জ-নির্মিত মূর্তি- এসব পুরাকীর্তির নিদর্শন এখানে রয়েছে। এরকম আরো কয়েকটি স্থানের নাম হল- বগুড়া জেলার ইতিহাস-প্রসিদ্ধ করতোয়া নদীর তীরে এবং ঢাকা-দিনাজপুর বিশ্বরোডের পাশে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী মহাস্থানগড়। প্রাচীন বৌদ্ধযুগের বহু ধ্বংসাবশেষ এখানে বিদ্যমান। এছাড়া নওগাঁ, জয়পুরহাট, কুমিল্লা-ময়নামতিতেও রয়েছে বৌদ্ধ সংস্কৃতির ধ্বংসাবশেষ। ঢাকার আহসান মঞ্জিল, ঢাকেশ্বরী মন্দির, কার্জন হল, লালবাগের কেল্লা, হোসনী-দালান, সোনার-গাঁ লোকশিল্প-যাদুঘর; দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দির, নাটোরের দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি, বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ, নোয়াখালীর বজরা মসজিদ- এ সবই প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন ও ইতিহাস প্রসিদ্ধস্থান হিসেবে আমাদের দেশ ইতহাস-ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সভ্যতায় অনেক সমৃদ্ধ হয়ে আছে, ফলে সকল বিভাগের শিক্ষার্থীরা, বিশেষভাবে ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থীরা এসব অঞ্চলে শিক্ষাসফরের মাধ্যমে বেশ উপকৃত হতে পারে। 

শিক্ষা সফরের প্রক্রিয়া : বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে শিক্ষা সফরের সম্পর্ক; তাই বিষয় নির্ধারণ করে শিক্ষা সফরের জন্য স্থান নির্বাচন করতে হবে। সাধারণত দলীয়ভাবে শিক্ষার্থীরা এবং শিক্ষকগণ শিক্ষাসফরে গিয়ে থাকেন। 

উপসংহার : শিক্ষাকে বাস্তবধর্মী ও আরো অধিক কার্যকরী করার জন্য শিক্ষাসফরের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। শিক্ষা সফরকে শিক্ষারই একটি অনিবার্য অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।


আরো দেখুন :

1 Comments

  1. খুব উপকৃত হয়েছি।
    ধন্যবাদ😊😊

    ReplyDelete
Post a Comment
Previous Post Next Post