রচনা : পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য

↬ মাতা-পিতার প্রতি কর্তব্য

↬ মাতা-পিতার প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য


ভূমিকা : জগতে মাতাপিতার তুল্য, হৈতষী, পরম শ্রদ্ধাভাজন গুরু আর কেউ নেই। তাদের ত্যাগ তিতিক্ষার জন্য আমরা আজ এ সুন্দর পৃথিবীর আলো, বাতাস, রূপ-রস-গন্ধ ভোগ করতে পারছি। মাতাপিতার কাছে আমরা চিরঋণী। যে ঋণ শোধ করার ক্ষমতা কোন সন্তানের নেই। তাই তাঁদের প্রতি কর্তব্য পালন করা একান্ত কর্তব্য।

মাতাপিতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য : মাতাপিতার প্রতি কর্তব্য পালন যে কত গুরুত্বপূর্ণ তার প্রমাণ মানবজীবনের অখন্ডনীয় দলিল কোরআন এবং মানব আদর্শের প্রতীক হাদীসে প্রমাণিত। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ ঘোষণা করেন,
‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করো না এবং মাতাপিতার সাথে উত্তম আচরণ কর।’
মহামানব হযরত মুহম্মদ (স) বলেছেন,
‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত’

হিন্দু শাস্ত্রে মায়ের স্থান উল্লেখ করে বলেছে-
‘জননী এবং জন্মভূমি স্বর্গের চেয়েও শ্রেষ্ঠ’

বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটকে আছে,
‘মাতাপিতার সেবা করাই সবচেয়ে উত্তম।’

পাশ্চাত্য মনীষী রাস্কিন বলেছেন এ পৃথিবীতে তিনটি কর্তব্য রয়েছে-
“Duty towards God, duty towards parents and duty towards mankind.”

সন্তানের প্রতি মাতাপিতার প্রত্যাশা ও দান : জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সন্তানের জীবনে মাতাপিতার প্রভাব সবচেয়ে বেশি। মা-বাবার মনে সন্তানের প্রতি অপরিসীম কল্যাণ চেতনা কাজ করে। সন্তানকে বড় করে তোলার জন্য মা-বাবা সীমাহীন ত্যাগ স্বীকার করেন। সন্তান কীভাবে সুখী হবে সেদিকে তাঁদের সব সময় খেয়াল থাকে।
“আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে”

প্রত্যেক সন্তানের জন্য মাতাপিতার এ এক শাশ্বত কামনা। মাতৃগর্ভে মায়ের দেহের বিন্দু বিন্দু রক্তই এক সময় আমাদের অস্তিত্বের একমাত্র অবলম্বন ছিল। আর ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর মাতাপিতাই হয়ে পড়েন আমাদের একান্ত আপনার, মঙ্গলকামী। মাতাপিতাই সন্তানের মঙ্গল কামনায় সর্বদা তটস্থ থাকেন। শিক্ষা-দীক্ষায়, কাজে-কর্মে সন্তানকে একজন আদর্শ মানুষরূপে গড়ে তোলাই প্রতিটি পিতা-মাতার একমাত্র আরাধ্য বিষয়। সন্তানের মঙ্গলের জন্য এমন কোন কাজ নেই যা মাতাপিতা করেন না। মা-বাবা নিজে না খেয়ে সন্তানকে খাওয়ান, নিজে না পরে সন্তানের পোশাকের ব্যবস্থা করেন। সন্তানের মুখে দুমুঠো খাবারের গ্রাস তুলে হাসি ফুটলেই তাঁদের মুখে হাসি ফোটে। সন্তানের জন্য উৎকণ্ঠায় মাতাপিতা বিনিদ্র রজনী যাপন করেন। সন্তান অসুস্থ হলে মা-বাবার চোখে ঘুম থাকে না। সন্তানের যে কোন অমঙ্গল মা-বাবার জন্য বেদনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি বিপথগামী ও অবাধ্য সন্তানের জন্যও মা-বাবার মহানুভূতি ও ভালবাসা কোন অংশেই কম থাকে না। সন্তান প্রতিবন্ধী হলেও মাতাপিতা কম স্নেহ করেন না, মনের ভালোবাসার কোন কমতি থাকে না। সন্তানের জীবনে মাতাপিতার এই প্রভাবের প্রেক্ষিতে সন্তানের কর্তব্য হয়ে ওঠে সীমাহীন।

কর্তব্যের প্রয়োজনীয়তা বা গুরুত্ব : মাতাপিতার কষ্ট, ধৈর্য, সাধনা ও শ্রমের ফলশ্রুতি হিসেবে সন্তানের সুন্দর জীবন গড়ে ওঠে। মা-বাবা যদি সন্তানের প্রতি অবহেলা দেখান তবে সে সন্তান কখনই যথার্থ মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে পারে না। যাঁরা এ বিশ্বে নিজেদের জীবনের কল্যাণকর বিকাশ দেখিয়েছেন এবং বিশ্বের বুকে স্বীয় গৌরব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন তাঁরা শৈশবে সুযোগ্য মাতাপিতার স্নেহ ও শিক্ষায় লালিত-পালিত হয়েছেন। মাতাপিতার মহান ও সীমাহীন অবদানের প্রেক্ষিতে তাঁদের প্রতি কর্তব্য পালন করে বা তাঁদের সেবা করে তাঁদের এই ঋণ পরিশোধ করা যায় না। মা-বাবার প্রতি কর্তব্য পালনের অর্থ তাঁদের সাধনার প্রতিদান দেওয়া নয়। তাঁদের ঋণ পরিশোধ্য নয় একথা বিবেচনা করেই তাঁদের সর্বাধিক সুখ-শান্তির ব্যবস্থা করতে হবে এবং তাঁদের পূর্ণ সন্তুষ্টির দিকে সদাসর্বদা মনোযোগী হতে হবে।

কর্তব্যের ধরন : সন্তানের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য মাতাপিতার অনুগত ও বাধ্য হওয়া। মাতাপিতার অবাধ্য হলে তারা যেরূপ ব্যাথিত হন, এমন আর কিছুতেই হন না। রাম পিতৃসত্ব পালনের জন্য চৌদ্দ বছর বনবাস করেছিলেন, ভীমসেন মাতার আজ্ঞায় রাক্ষসমুখে যেতেও দ্বিধাবোধ করেন নি। শাস্ত্রে আছে বিদ্বান এবং ভক্তিমান নয় এমন সন্তানের জন্মের প্রয়োজন নেই। সর্বদা পিতা-মাতার সাথে ভদ্রতা ও নম্রতার সাথে মার্জিত ভাষায় কথা-বার্তা বলা প্রত্যেকটি সন্তানের জন্য একান্ত কর্তব্য। তাছাড়া পিতা-মাতার বৃদ্ধাবস্থায় যখন তারা চলতে ফিরতে অক্ষম হয়ে পড়েন তখন তাঁদেরকে চলতে ফিরতে সাহায্য করা, রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে সেবা-যত্ন করা। সন্তান যখন বড় হয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করে তখন মাতাপিতার ভরণপোষণের ভার পড়ে সন্তানের ওপর। মা-বাবার তখন বয়স বেড়ে প্রৌঢ়ত্বে বা বার্ধক্যে পৌঁছান। তাঁদের কর্মজীবন থেকে অবসর নিহে হয়। অনেকেই তখন সন্তানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এই অবস্থায় সব রকম সুখের ব্যবস্থা করা সন্তানের কাজ। নিজের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য না থাকলেও মাতাপিতার সুখের বিষয়টি অগ্রাধিকার দিতে হবে। মোটকথা, শৈশবে আমাদের অসহায় মুহূর্তে মাতাপিতা যেমনি আমাদের একান্ত অবলম্বন ছিলেন ঠিক তেমনিভাবে বৃদ্ধাবস্থায় তাদেরকে ছায়ার মত অনুসরণ করা প্রত্যেকটি সন্তানের জন্য অবশ্য কর্তব্য। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন,
“পিতা-মাতার সাথে সৌজন্যমূলক আচরণ করবে।”

তিনি আরো বলেন তোমরা পিতা-মাতার জন্য সর্বদা দোয়া প্রার্থনা কর-
‘হে আল্লাহ, আমার পিতা-মাতা শৈশবে যেমন স্নেহ মমতা দিয়ে আমাকে লালন পালন করেছিলেন, আপনি তাঁদের প্রতি তেমনি সদয় হোন।’

যে সন্তান পরিণত বয়স পর্যন্ত মাতাপিতার সেবা করার সুযোগ পান তিনি ধন্য। স্বীয় কর্ম ও চরিত্র দ্বারা মাতাপিতার তুষ্টিসাধন করা সন্তানের একান্ত কর্তব্য। আজকাল অনেক সন্তানকে মাতাপিতার প্রতি বিরাগী হতে দেখা যায়; এমন কি মাতাপিতাকে ঘৃণার চক্ষে দেখে এমন কুপুত্রেরও অভাব হয় না। যে মাতাপিতা জন্ম দিয়েছেন, শিক্ষিত হয়ে সে মাতাপিতাকে অবহেলা করা যে কত বড় পাপ তা কল্পনাও করা যায় না। সে সন্তান নরকগামী হয়। যে সন্তান প্রাণপণে মাতাপিতার তুষ্টিসাধন করতে পারে তার জীবন ধন্য- তার জন্ম সার্থক।

মাতাপিতার প্রতি কর্তব্য পালনের মহান দৃষ্টান্ত : এই বিশ্ব চরাচরে আজ যাঁরা অমরত্বের স্বাদ নিয়ে মানব হৃদয়ে বেঁচে আছেন তাদের অধিকাংশেরই জীবন ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তাঁরা প্রত্যেকেই পিতৃ-মাতৃভক্তির এক একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। হযরত বায়েজীদ বোস্তামী, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মাতৃভক্তির চিরকালই ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে দীপ্যমান। এছাড়া, হযরত আব্দুল কাদির জিলানী, হাজী মুহম্মদ মহসীন, জর্জ ওয়াশিংটন ও আলেকজান্ডার প্রমুখ ইতিহাস প্রসিদ্ধ ব্যক্তিগণ মাতাপিতার প্রতি যে শ্রদ্ধাভক্তি দেখিয়েছেন তা যুগ-যুগান্তরে অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।

শিক্ষাজীবনে ও ছাত্রজীবনে কর্তব্য : মাতাপিতার প্রতি ছাত্রছাত্রীদের কর্তব্য খুবিই গুরুত্বপূর্ণ। শৈশবে লেখাপড়াকালীন অবস্থায় সন্তানের প্রধান কাজ হবে মা-বাবার স্বপ্ন সফল করে তোলার জন্য নিরলস সাধনা করা। সন্তান লেখাপড়া শিখে বড় হয়ে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হোক এটাই তাঁদের কামনা। সন্তান যোগ্য হয়ে পরবর্তী জীবনে কতটুকু সাহায্য করবে এ কথা কখনোই কোন বাবা-মা ভাবেন না। তাঁরা চান সন্তান বড় হয়ে মানুষ হোক। এই অবস্থায় প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীর কাজ হবে মাতাপিতা যেভাবে জীবন গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশিকা দান করেন সেভাবেই তাদের চলা। যেহেতু তাঁরা কখনই সন্তানের অকল্যাণ কামনা করেন না, সেজন্য তাঁদের আদেশ-নিষেধ বিনা বাক্যব্যয়ে পালন করতে হবে। মাতাপিতার আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে সন্তানদের চলতে হবে। আজকাল সমাজ যে অবক্ষয় দেখা যাচ্ছে তাতে মাতাপিতারা নিজেদের সন্তান নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। সন্তানদের কার্যকলাপ যদি মাতাপিতার উদ্বেগাকুল হৃদয়কে শান্ত রাখতে পারে তাহলেই তাঁদের প্রতি যথার্থ কর্তব্য পালন করা সম্ভব হবে।

উপসংহার : আমাদের স্মরণ রাখতে হবে আকাশের চেয়ে উঁচু যদি কিছু থাকে তবে তা পিতা এবং পৃথিবীর চেয়ে যদি গুরু ভার কিছু থাকে তবে তা মাতা। সৃষ্টিকর্তার আনুগত্য স্বীকারের পরই মাতাপিতার প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য পালন সকল ধর্মে স্বীকৃত। কাজেই কোন অবস্থাতেই মাতাপিতাকে কষ্ট দেওয়া উচিত নয়। কারণ মাতাপিতার প্রতি কর্তব্য পালনের মধ্যে রয়েছে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক শান্তি ও মুক্তির পথ।


একই রচনা আরেকটি বই থেকে সংগ্রহ করে দেয়া হলো


ভূমিকা : 
“যে মাতাপিতাকে সন্তুষ্ট করে, সে আমাকে সন্তুষ্ট করে।” -আল কুরআন

“মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেস্ত।” -আল হাদিস

জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী।” -সংস্কৃত শাস্ত্র

পিতা-মাতা আমাদের জন্মদাতা। পিতা-মাতার সমতুল্য আপনজন পৃথিবীতে আর নেই। সংস্কৃতে একটা কথা আছে, “জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী।” অথাৎ, জননী ও জন্মভূমি স্বর্গ হতেও শ্রেষ্ঠ। মহানবি হযরত মুহম্মদ (স) বলেছেন, “মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেস্ত।” কেননা, ভূমিষ্ঠ হবার আগে ও পরে সন্তানের জন্য মা-ই সবচেয়ে বেশি দুঃখকষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করেন। সেই সাথে পিতাও। তাঁদের ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকারের জন্যই সন্তান বড় হতে পারে। তাঁরা পৃথিবীতে মহান আল্লাহর রহমত স্বরূপ। সন্তান জন্মের পর থেকেই পিতামাতা নিজেদের সুখের কথা ভুলে গিয়ে সন্তানের সুখের কথা ভাবেন। সন্তানকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন। তাই পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য অনেক।

পিতা-মাতার অবদান : পিতা-মাতার জন্যই সন্তান এই সুন্দর পৃথিবীর রূপ-রস, আরাম আয়েশ, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছে। শিশুসন্তানের প্রতি পিতা-মাতার অবদান অপরিসীম ও বর্ণনাতীত। মা অতি কষ্টে দশ মাস দশ দিন সন্তানকে তাঁর গর্ভে ধারণ করেন। সন্তান ভূমিষ্ট হবার পর থেকেই মা অসুস্থ ও দুর্বল শরীর নিয়ে সন্তানের সেবাযত্ন করেন। মাতৃস্তন্য পান করে শিশু বেঁচে থাকে। সন্তানের জন্য মায়ের চিন্তার যেন শেষ নেই। পল্লীকবি জসীমউদ্দীন তাঁর ‘পল্লী জননী’ কবিতায় লিখেছেন-
“রাত থমথম স্তব্ধ নিঝুম, ঘোর-ঘোর আঁধিয়ার
নিঃশ্বাস ফেলি তাও শোনা যায়, নাই কোথা সাড়া কার।
রুগ্ন ছেলের শিয়রে বসিয়া একেলা জাগিছে মাতা,
করুণ চাহনি ঘুম ঘুম যেন ঢুলিছে চোখের পাতা।
শিয়রের সাথে নিবু নিবু দীপ ঘুরিয়া ঘুরিয়া জ্বলে,
তারি সাথে সাথে বিরহী মায়ের একেলা পরান দোলে।”

নিজেদের আরাম আয়েশ ভুলে গিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রমের ভেতর দিয়ে পিতা-মাতা সন্তানদের বড় করে তোলেন এবং লেখাপড়া শেখান। সন্তানের আহার যোগাড় করেন। সন্তান যাতে সুশিক্ষা লাভ করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে সেজন্য পিতামাতার চেষ্টার অন্ত থাকে না। প্রত্যেক পিতামাতাই তাঁদের সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলতে চান। পিতা নিজে কষ্ট স্বীকার করেও সন্তানের জন্য ধন সঞ্চয় করে যেতে চেষ্টা করেন। তাঁদের এরূপ নিঃস্বার্থ ত্যাগের তুলনা নেই। সন্তানের কোন অসুখবিসুখ হলে পিতামাতার তখন চিন্তার শেষ থাকে না। আহার নিদ্রার কথা ভুলে গিয়ে তাঁরা তখন সন্তানের আরোগ্য লাভের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে হাত তুলে দোয়া চান সন্তানের জন্য। এমনকি নিজের জীবনের বিনিময়ে তাঁরা সন্তানের জীবন ভিক্ষা চান। মাতাপিতার এরূপ অবদান অতুলনীয়। কবি জসীমউদ্দীন লিখেছেন-
“নামাজের ঘরে মোমবাতি মানে, দরগায় মানে দান,
ছেলেরে তাহার ভাল করে দাও, কাঁদে জননীর প্রাণ।
ভাল করে দাও আল্লাহ্-রছুল! ভাল করে দাও পীর।
কহিতে কহিতে মুখখানি ভাসে বাহিয়া নয়ন নীর!”

পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য : মানুষের মতো মানুষ হয়ে পিতা-মাতার মুখ উজ্জ্বল করা সন্তানের অন্যতম কর্তব্য। সন্তান যদি সুশিক্ষিত হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সমর্থ হয় ও সুনাম অর্জন করতে পারে, তবে পিতামাতা সবচেয়ে বেশি সুন্তুষ্ট হন এবং গৌরববোধ করেন। পিতা-মাতার সন্তান হিসেবে প্রত্যেক ছেলেমেয়ের মনে রাখা উচিত, যেহেতু বাবা মা সবসময় সুখে-দুঃখে, বিপদে আপদে সর্ব অবস্থায় তাদের কল্যাণ কামনা করেন, সেহেতু তাদের উচিত পিতামাতার উপদেশ নির্দেশ মেনে চলা।
আমরা কিন্তু অনেক সময় পিতা-মাতার আদেশ নির্দেশ পালন করি না। বরং কখনো কখনো তাঁদের উপদেশের বিপরীত কাজ করে থাকি। এতে পিতামাতা যে কতটা মানসিক কষ্ট ভোগ করেন তা কি আমরা কখনো ভেবে দেখেছি? সন্তানের অপরিণত বুদ্ধিই পিতা-মাতার কষ্ট ভোগের কারণ হয়। সন্তানের বয়স কম থাকলে পিতা-মাতার নির্দেশ ও উপদেশ পালনের মাধ্যমেই তারা নির্ভুল পথে চলতে পারে। সন্তান ছোট হোক, বড় হোক, বুদ্ধিমান কিংবা বুদ্ধিহীন হোক, পিতামাতা সব সময় তার মঙ্গল কামনা করেন। সন্তান যদি পিতা-মাতার উপদেশ ও নির্দেশ মেনে চলে তবে সেটা যেমন সন্তানের জন্য মঙ্গলজনক তেমনি সমাজের জন্যও কল্যাণকর।

সন্তান যদি চরিত্রবান হয়, জ্ঞানীগুণী বলে সমাজের প্রশংসা পায়, তাহলেই পিতা-মাতার ঋণ কিছুটা পরিশোধ হতে পারে। তাই পিতা-মাতার মুখ উজ্জ্বল করা ও তাঁদের গৌরব বৃদ্ধি করার জন্য প্রত্যেক সন্তানেরই তৎপর হওয়া উচিত। কিন্তু সন্তান যদি পিতা-মাতার অবাধ্য হয় এবং উচ্ছৃঙ্খলতার স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়, তবে তার জীবনে সাফল্য অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। পিতা-মাতার আদেশ নির্দেশ অমান্য করে চলার অর্থ হচ্ছে জীবনে ব্যর্থতাকে বরণ করা। ফলে তাদের চারিত্রিক অধঃপতন ঘটবে আর সমাজের কাছে নিন্দার পাত্র হবে। পিতা-মাতা সন্তানের মঙ্গলে কথা ভেবে তাদের লেখাপড়ায় মনোযোগী হতে বলেন। সন্তান যদি লেখাপড়ায় ফাঁকি দেয় এবং মানুষ না হয়ে অমানুষ হয়, তবে তারা বড় হয়ে অর্থাভাবে কষ্ট ভোগ করে। তখনই তারা পিতা-মাতার উপদেশের তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারে। কিন্তু তখন শুধু অনুতাপে দগ্ধ হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।

পিতা-মাতার সেবা শুশ্রুষা করা সন্তানের প্রধান কর্তব্য। তাঁরা অসুস্থ হয়ে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। এতটুকু দেরি করা যাবে না, কেননা তাতে তাঁরা মনে কষ্ট পেতে পারেন। তাঁদের সেবাযত্নের বিন্দুমাত্র ত্রুটি যাতে না ঘটে, সেদিকে বিশেষভাবে লক্ষ রাখতে হবে। পিতামাতর বৃদ্ধ বয়সে উপযুক্ত সন্তান স্ত্রী ছেলে-মেয়ে নিয়ে অন্যত্র চলে গেলে সে মহাপাপী হবে। সন্তানের সবসময় মনে রাখতে হবে, শিশুকালে পিতা-মাতা তাকে মানুষ করে তোলার জন্য যত্ন নিয়েছেন, লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেছেন এবং বড় হলে সুখে শান্তিতে বসবাসের জন্য যথারীতি চেষ্টা চালিয়েছেন। তাই আজীবন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেও সন্তানের কর্তব্য পালন করা হবে না, বৃদ্ধ বয়সে পিতামাতা যাতে সুখে শান্তিতে জীবন যাপন করতে পারেন সেদিকে তীক্ষ্ন দৃষ্টি দিতে হবে এবং তার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যদি কোনো সন্তান পিতা-মাতার প্রতি অযত্ন ও অবহেলা দেখায় তবে তার পাপের শেষ থাকবে না।

পিতা-মাতার প্রতি সম্মান : প্রত্যেক ধর্মেই পিতা-মাতাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করতে এবং তাঁদের সন্তুষ্টি বিধান করতে বলা হয়েছে। পবিত্র কুরআন শরীফে ভক্তি ও শ্রদ্ধার ক্ষেত্রে আল্লাহর পরেই পিতা-মাতার স্থান নির্দিষ্ট করা হয়েছে। আল্লহ বলেছেন, “যে মাতা-পিতাকে সন্তুষ্ট করে, সে আমাকে সন্তুষ্ট করে।” মহানবি হযরত মুহম্মদ (স) বলেছেন, “মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেস্ত।” হিন্দুশাস্ত্রে আছে, “পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম।” জননী আর জন্মভূমিকে স্বর্গের চেয়েও পবিত্র এবং পূজনীয় বলে বিবেচনা করে সংস্কৃতে বলা হয়েছে, “জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী।” হযরত আবদুল কাদের জিলানী (র), হযরত বায়েজীদ বোস্তামী, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ পিতা-মাতার বাধ্য ও অনুগত ছিলেন। পিতা-মাতার এই সম্মান রক্ষার দায়িত্ব পালন করার জন্য প্রত্যেক মানব সন্তানকে সচেতন হওয়া দরকার।

উপসংহার : পিতা-মাতা সন্তানের পরম হিতৈষী। এমন আপনজন দুনিয়াতে আর কেউ নেই। অল্প বয়সে যে ব্যক্তি পিতামাতাকে হারায় সে এ জগতে সত্যি ভাগ্যহীন। পিতামাতার স্নেহ, মায়ামমতা বেহেশতের শ্রেষ্ঠ দান। তা যে ব্যক্তি বেশিদিন ভোগ করতে পারে, তার জীবন বেশি ধন্য হয়। পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য পালনের মাধ্যমে আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ করে পৃথিবীতে স্মরণীয়, বরণীয় এবং মর্যাদা লাভ করা যায়।


আরো দেখুন :

3 Comments

  1. Rochona ta sundor kintu onek boro

    ReplyDelete
    Replies
    1. yes...kothata shotti...but it is informative!!!

      Delete
  2. পড়লাম ভালোই লাগলো কিনতু প্রচুর বড়ো।

    ReplyDelete
Post a Comment
Previous Post Next Post