মার্চের দিনগুলি

রচনা : কৃষিকাজে বিজ্ঞান

ভূমিকা : একটু পেছনে ফিরে তাকালে আজ চমকে উঠতে হয়- কত পরিবর্তন এসেছে আমাদের জীবনযাত্রায়। এ পরিবর্তন একশ বছর আগে মানুষের কল্পনাতেও ছিল না। কিন্তু আজ এটাই বাস্তব সত্য। আর এই সত্যের পেছনে অনন্য ও অভাবনীয় ভূমিকা রেখেছে বিজ্ঞান। আজকের বিশ্বে প্রতিটি মানুষকে বিজ্ঞান দান করেছে তার সর্বব্যাপী মহাশক্তি। বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে অভাবনীয় বেগ, সভ্যতার অগ্রযাত্রাকে করেছে দ্রুততর। ঘুচিয়ে দিয়েছে দূর-দূরান্তের ব্যবধান। বিজ্ঞানের বদৌলতে মানুষ প্রকৃতিকে করেছে তার আজ্ঞাবাহী। আর এই বিজ্ঞানই আজ তার সুদূরপ্রসারী কল্যাণী হাত বাড়িয়ে দিয়েছে কৃষিক্ষেত্রে।

মানবজীবনে কৃষির গুরুত্ব : কৃষি মানুষের অস্তিত্বের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। মানবজীবন ও মানবসমাজে এর গুরুত্ব অপরিসীম। জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে এটি মানুষের আদিমতম জীবিকার উপায়। দেশে দেশে কৃষিই সমাজের মেরুদণ্ড, কৃষিই সমাজের ভিত্তি। স্বভাবতই কৃষির ক্রমোন্নতিতেই সমাজের ও দেশের সর্বাঙ্গীন উন্নতি।

কৃষির প্রাচীন প্রেক্ষাপট : আদিম সমাজে মানুষ প্রয়োজনীয় খাদ্যের জন্যে নির্ভর করত বন্য পশু-পাখি, জীবজন্তু, ফলমূল ও মাছের উপর। একসময় মানুষ বীজ বপন ও ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে নিজের খাদ্য নিজেই যোগাতে শেখে। এভাবে মানব সভ্যতায় কৃষি ও কৃষকের আবির্ভাব ঘটে। প্রাথমিক অবস্থায় গরু, ঘোড়া, মোষ প্রভৃতি জন্তুর সাহায্যে লাঙল দিয়ে জমি চাষ করা হত। কৃষকেরা ফসলের জন্যে সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল ছিল আবহাওয়ার উপর। কখনও প্রচণ্ড খরায়, কখনও অতিবৃষ্টিতে ফসলহানি ঘটত । ফলে, কৃষকের ফসল পাওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাাঁড়িয়েছিল। আবার একই জমিতে বার বার একই ফসল উৎপাদনের ফলে জমির উর্বরতা কমে যেত। ফলে উৎপাদন হত কম। এছাড়া উন্নত বীজের অভাবে উৎপাদিত ফসলও ভাল হতো না। সুতরাং এক কথায় বলা যায়, কৃষির প্রাচীন প্রেক্ষাপট ছিল কৃষকদের হতাশার প্রতিচ্ছবি।

কৃষির আধনিকায়নে বিজ্ঞান : অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে কৃষির আধনিকায়নের সূচনা ঘটে। এর ফলে কৃষকেরা কৃষিক্ষেত্রে উন্নত ধরনের যন্ত্রপাতি ও কৃষি পদ্ধতির সাথে পরিচিত হয়। জন্তু আর কাঠের লাঙ্গলের পরিবর্তে কৃষকদের হাতে আসে কলের লাঙল, ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলার। উন্নত দেশগুলোতে জমি কর্ষণের পুরনো পদ্ধতিগুলো লোপ পেয়েছে। সেচ ব্যবস্থাতেও বিজ্ঞান অনেক পরিবর্তন এনেছে। কৃষকদের এখন ফসলের জন্য প্রকৃতির মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয় না। গভীর ও অগভীর নলকূপের সাহায্যে জমিতে পানি সেচের ব্যবস্থা করতে পারে। এ ক্ষেত্রে সেচের জন্যে ভূগর্ভস্থ পানি তুলতে ব্যবহৃত হচ্ছে বিদ্যুৎ শক্তি চালিত পাম্প। অতিবৃষ্টিও আজ কৃষককে ভীত করছে না। বিজ্ঞানের বদৌলতে জমির অতিরিক্ত জল নিষ্কাশন আজ অত্যন্ত সহজ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজ্ঞানীরা এখন কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে কৃষিক্ষেত্রে নতুন অকল্পনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছেন। উন্নতমানের বীজ উৎপাদনে বিজ্ঞান কৃষিক্ষেত্রে যে ভূমিকা রেখেছে তাও অভাবনীয়। বিশেষ করে কৃত্রিম উপায়ে উচ্চফলনশীল বীজ উৎপাদনে সাফল্য বিস্ময়কর। এসব বীজ সাধারণ বীজের তুলনায় ফসল উৎপাদনে তুলনামূলকভাবে সময়ও কম নেয়। সুতরাং বীজ নিয়েও কৃষকদের অতীতের অনিশ্চয়তা দূর করেছে বিজ্ঞান। আর শক্তিশালী রাসায়নিক সার আবিষ্কৃত হওয়ায় ফসল উৎপাদনে এসেছে অভূতপূর্ব সাফল্য। সাম্প্রতিক কালে বিশ্বের বৃষ্টিহীন শুষ্ক মরু অঞ্চলে চাষাবাদ শুরু করার প্রচেষ্টা চলছে বিজ্ঞানের সহায়তায়। সেদিন দূরে নয় যেদিন এক্ষেত্রেও বিজ্ঞানীরা সাফল্য অর্জন করবেন।

উন্নত বিশ্বের কৃষি : উন্নত দেশগুলোর কৃষি ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিজ্ঞাননির্ভর। জমিতে বীজ বপন থেকে শুরু করে ঘরে ফসল তোলা পর্যন্ত সমস্ত কাজেই রয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছোঁয়া। বিভিন্ন ধরণের বৈজ্ঞানিক কৃষিযন্ত্র যেমন, মোয়ার (শস্য ছেদনকারী যন্ত্র), রপার (ফসল কাটার যন্ত্র), বাইন্ডার (ফসল বাঁধার যন্ত্র), থ্রেশিং মেসিন (মাড়াই যন্ত্র), ম্যানিউর স্প্রেডার (সার বিস্তারণ যন্ত্র) ইত্যাদি উন্নত দেশগুলোর কৃষিক্ষেত্রে এনেছে বৈপ্লবিক সাফল্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া প্রভৃতি দেশের খামারে একদিনে ১০০ একর পর্যন্ত জমি চাষ হচ্ছে কেবল এক একটি ট্রাক্টরের মাধ্যমে। সেগুলো আবার একসাথে তিন-চারটি ফসল কাটার যন্ত্রকে একত্রে কাজে লাগাতে সক্ষম। তারা কৃষিকাজে ব্যাপকভাবে অগ্রগামী। যেমন বলা যায় জাপানের কথা। জাপানে জমির উর্বরাশক্তি বাংলাদেশের তুলনায় এক চতুর্থাংশ। কিন্তু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে তারা এদেশের তুলনায় ৬ গুণ বেশি ফসল উৎপাদন করছে।

কৃষি ও বাংলাদেশ : বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ। এদেশের মাটি ও জলবায়ু অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় কৃষির অনুকূলে। কিন্তু উন্নত দেশগুলো যখন প্রতিকূল অবস্থা ঘুচিয়ে ফসল উৎপাদনের বৈজ্ঞানিক নেশায় মেতেছে সেখানে বাংলাদেশের কৃষকেরা তার কাঠের লাঙল আর একজোড়া জীর্ণ বলদ নিয়ে চেয়ে আছে আকাশের পানে বৃষ্টির প্রতীক্ষায়। একথা সত্যি যে বাংলাদেশেও কৃষি নিয়ে গবেষণা হচ্ছে এবং বিভিন্ন ধরনের গবেষণায় সফলতাও এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশের শতকরা আশিভাগ কৃষক এখনও সনাতন পদ্ধতিতে কৃষিকাজ করে চলেছে। শিক্ষা, সচেতনতা, মূলধন, পুঁজি ইত্যাদির অভাবে তারা কৃষিকাজে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। তারা শ্রম দিচ্ছে কিন্তু উপযুক্ত ফসল পাচ্ছে না। কেননা তারা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কৃষিকাজ করতে পারছে না।

উপসংহার : বিজ্ঞান আজ অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। উন্নত দেশগুলোতে বিজ্ঞানের সাহায্যে পাহাড় কেটে জঙ্গল পরিষ্কার করে বিভিন্নভাবে কৃষি জমি তৈরি করা হচ্ছে। ফসল আবাদের প্রতিটি পদক্ষেপে তারা বিজ্ঞানকে কাজে লাগাচ্ছে। এর ফলস্বরূপ তারা কৃষিক্ষেত্রে লাভ করছে বিরাট সাফল্য। কৃষিক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পন্থা অবলম্বনের ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। সুজলা-সফলা আমাদের এই দেশে বিজ্ঞানের জাদুর ছোঁয়া আমরা যত বেশি কাজে লাগাতে পারব ততই কৃষি আমাদের দেবে সোনালি ফসলসহ নান ফসলের সম্ভার। কৃষকদের সচেতনতা, সরকারি ও বেসরকারিভাবে তাদের সাহায্য প্রদান এবং বাংলাদেশে কৃষি নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণাই পারে আমাদের স্বপ্ন পূরণ করতে- বাংলাদেশকে একটি সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যমলা দেশ হিসেবে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে।


আরো দেখুন :

5 Comments

  1. Jodi cotation Ditan aro valo hoito

    ReplyDelete
  2. রচনাটি সুন্দর হয়েছে।

    ReplyDelete
  3. "শতকরা আশি ভাগ কৃষক সনাতন পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে"- এখানে আশিভাগ তথ্যটি কি সঠিক? আমি 2005 সালে প্রকাশিত 'ড. মাহবুবুল হকের বাংলা ব্যাকরণ ও রচনা' বইটিতে দেখেছি আশি শতাংশ। বর্তমানেও কি এটি প্রযোজ্য?

    ReplyDelete
Post a Comment
Previous Post Next Post