রচনা : একটি রেল স্টেশনের আত্মকথা

ভূমিকা : অতীতের দিকে তাকালে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা কিছু কিছু মনে পড়ে। আমার জীবনে অতীত কেবলই অন্ধকার। বর্তমানই আমার জীবনে সবকিছু – সদাচঞ্চল কর্মমুখর বর্তমান নিয়েই আমার কারবার। কলরব মুখরিত আজকের দিনটিই আমার যথার্থ পরিচয়। বিগত দিনটির কলগুঞ্জন আজ নেই, আর আগামী দিনটির কোলাহল কিরূপে ধরা দেবে তা আমার জানা নেই। কারণ আমার পরিচয় আজকের জয়নগর রেল স্টেশন। বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে এক অখ্যাত রেলস্টেশন হিসেবেই পরিচিত।

অতীত ইতিহাস : আমার ভিত্তি কবে স্থাপিত হয়েছিল মনে পড়ে না। কার সুযোগ্য নেতৃত্বে এখানে এক বিজন পরিবেশে প্রথম আমার বুকে ট্রেন দাঁড়িয়ে আমার অস্তিত্ব ঘোষণা করেছিল সে ইতিহাস কোথাও লেখা নেই। এখানে রেল লাইন তৈরির সাথে সাথে আমার জন্ম হয়নি। এ এলাকার জনগণের চলাচলের সুবিধার জন্য কোন এক উদ্যোগী পুরুষ বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়ে আমাকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সংগ্রামী মানুষের যুগ যুগ ধরে সংগ্রামের জয়ের স্বাক্ষর এই জয়নগর। তারপর এই পথ দিয়ে অনেক মানুষ এসেছে অনেক গেছে। আমিও আর আদিরূপে থাকিনি। সমৃদ্ধি এসেছে আমার জীবনেও। আজ স্বাধীন দেশে আমার অবয়ব হয়েছে নতুন। রঙবেরঙের পণ্যসামগ্রী সম্বলিত ঝলমলে দোকানগুলো আমার জীবনে এনেছে জৌলুস। সরকার গ্রামের উন্নয়নে মনোযোগী হয়ে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ কর্মকাণ্ডের যে বিস্তার ঘটিয়েছে তাতে আমার জীবনে এসেছে সমৃদ্ধি।

স্মৃতিচারণ : আমার ফেলে আসা দিনগুলোর সুখ-দুঃখপূর্ণ অনেক স্মৃতি মনের কোণে জমে আছে। দিন-তারিখের হিসাব রাখতে পারিনি। নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেও কোন কোন ঘটনার স্মৃতি আমার বুকে মুখর হয়ে আছে। গাঁয়ের একটি দরিদ্র সন্তান যখন নিজের সাধনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে ফিরে এসে এখানে গাড়ি থেকে নেমে এসেছিল- সে দিন অগণিত লোক তাকে আন্তরিক সম্বর্ধনা জানাতে এসেছিল। জানি না সে আনন্দের স্মৃতি নিয়ে সে এখন কোথায়। কিন্তু সেদিনের আমার বুকের আনন্দের লহরী এখনও আম্লান হয়ে আছে। ঘোমটা পরা একটি বধু লাল শাড়ি পরে তার বরের সাথে এখানে গাড়িতে উঠে কোথায় চলে গেছে জানি না। তার চোখ থেকে যে তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়েছিল সংগ্রামে অংশগ্রহণেচ্ছু যে তরুণটি এখান থেকে একদিন গোপনে গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিল- আমি এখনও তার পথ চেয়ে রয়েছি। তার বুড়ো বাপ এখনও এখানে এসে চোখের পানি ফেলে। আমি তাকে ভুলি কেমন করে। এ ধরনের অনেক ঘটনাপ্রবাহ আমার বুকে ঘটেছে- কখনও আনন্দের, কখনও বেদনার। মনে হয় সবাই চলে গেছে আমি শুধু স্মৃতিভারে পড়ে আছি।

সাম্প্রতিক ঘটনা : সুদূর অতীতের সব কথা মনে না থাকলেও আজকালকার ঘটনাবলি আমার মনকে প্রায়ই চঞ্চল করে তোলে। প্রায়ই আমাকে অনেক বিরক্তিকর অবস্থায় পড়তে হয়। একদিন হয়ত শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে জয়নগর রেল স্টেশনের আঙিনা। বলিষ্ঠ প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরে অন্যায় অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়। তাদের রোষ প্রকাশ পায় আমার বুকে। তারা গাড়ি আটকে রাখে অনেকক্ষণ। যাত্রীদের কষ্টের কথা ভোলার নয়। আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে এমন চোরাচালানীর পদক্ষেপে কখনও আমার বুক মুখর হয়। আমি নীরবে তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করি। চঞ্চল জীবন প্রবাহের মধ্যে এক নীরব অভিযাত্রী।

উপসংহার : হাজার মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয়ে আমার দিন যায়, রাত যায়। সারাদিনে তিনটি গাড়ি উত্তর থেকে দক্ষিণে, তিনটি দক্ষিণ থেকে উত্তরে ছোটে। আমার বুকে তাদের ক্ষণিকের বিরতি। একদল লোক নেমে আসে, একদল উঠে যায়। ফেরিওয়ালাদের হাঁকডাকে মুখর হয় কিছুক্ষণের জন্য। ঢং ঢং ঘণ্টার শব্দ, সবুজ নিশান আর বিকট বাঁশির সঙ্গে ট্রেনের গর্জন আমার নিত্যসঙ্গী। অতীত হয়ে যায় নীরব- বর্তমান থেকে কলরব মুখরিত। এভাবেই চলছে আমার জীবনের প্রবাহ- অতীত থেকে বর্তমান হয়ে ভবিষ্যতের দিকে। একজন কবি তাঁর কথায় আমার অবস্থাটি এভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন :

সকাল বিকাল ইসটেশনে আসি,
চেয়ে চেয়ে দেখতে ভালবাসি।
ব্যস্ত হয়ে ওরা টিকেট কিনে।
ভাটির ট্রেনে কেউবা চড়ে, কেউবা চড়ে উজান ট্রেনে।
সকাল থেকে কেউবা থাকে বসে,
কেউবা গাড়ি ফেল করে তার শেষ মিনিটের দোষে।
দিনরাত গড় গড় ঘড় ঘড়,
গড়িভরা মানুষের ছোটে ঝড়।
ঘন ঘন গতি তার ঘুরবে,
কভু পশ্চিমে কভু পূর্বে।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post