মার্চের দিনগুলি

রচনা : একটি নতুন পয়সার আত্মকাহিনী

আমি এক নতুন পয়সা। এই পৃথিবীতে আমি নবাগত। আমার বয়স অল্প কিন্তু এই বয়সেই আমি জীবন ও জগত সম্বন্ধে বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। এই পৃথিবীর দ্রব্য গোত্রের মধ্যে শ্রেষ্ঠ গোত্রে আমার জন্ম কিন্তু আমি নীচকুলে। আমি পয়সার ঘরে জন্মেছি। আমি টাকা নই, আধুলি নই, সিকি ও নই, আনাও নই – পয়সা; তবু আবার নতুন পয়সা। এককালে পয়সার কিছু দিন ছিল কিন্তু আজকালকার দিনে নতুন পয়সাকে কেউ হিসাবে আনতে চায় না, সবাই যত্ন করে লুকিয়ে রাখে।

আমার জন্মের একটু ইতিহাস আছে। একদিন বাংলাদেশে টাকা, আনা, গণ্ডার হিসাব প্রচলিত ছিল। কিন্তু এই গণ্ডার হিসাব বড় গোলমালে। কারণ সংখ্যা জিনিসটা দশে দশে লাফিয়ে চলে যেমন, শত শত, সহস্র অযুত ইত্যাদি। এই দশের হিসাবকে বলা হয় দশমিক হিসাব। গণ্ডায় হিসাব মিলাতে গেলে সংখ্যার হিসাব বড় গোলমাল মনে হয়। টাকা পয়সার হিসাব ও ওজনের হিসাব দশমিকের ধারায় হলে অনেক সুবিধা হতো। তাই অনেক দেশ আজকাল দশমিকের হিসাব গ্রহণ করেছে। এই ধারা গ্রহণ করেছে ফ্রান্স। পূর্বের অনেক দেশের মুদ্রার হিসেবে তা চলছে। এই হিসাবেস শতক নিম্নতম মুদ্রা। পূর্বেও ৬৪ পয়সায় এক টাকা হতো এখন ১০০ পয়সায় এক টাকা হয়। দশমিকের কামনা থেকেই আমার জন্ম। তই আমার দামও কমল, মানও কমল।

আরও আমার মনে পড়ে, আমি সবেমাত্র টাকশাল হতে আমার অন্যান্য বন্ধুদের সাথে পোস্ট অফিসে নীত হয়েছি। একটি নির্দিষ্ট দিনে আমাকে বাজারে ছাড়া হবে। কাউন্টারে কী ভীড়। ছেলেবুড়ো সব লাইন ধরেছে ডাকের জিনিস কেনার জন্য। কারা ফেরত পাবে নতুন পয়সা; একটি ছোট ছেলে পুরানো একটি আনা দিল পোস্ট কার্ডের জন্য। ডাক কর্মচারী একটি পোস্ট কার্ডসহ আমাকে তার হাতে তুলে দিল, ছেলেটির খুশি দেখে কে! কাউকে এমন খুশী হতে আমি কখনও দেখিনি। ছেলেটি দৌঁড়ে গিয়ে আমাকে তার দিদির হাতে দিল। তারপর একের পর এক বাড়ির সবাই আমাকে হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। অনেকেই অবাক হয়ে “ওমা কত ছোট!” কিন্তু এ রকম আদর আমার কপালে বেশী দিন সইল না।

বাজারে এখনও পুরানো পয়সার রাজত্ব চলছে। একজন দুধওয়ালা আমাকে দেখে বলল “মা, আমরা মূর্খ মানুষ, এই হিসাব আমরা বুঝি না, পুরানো পয়সা দিন।” আমি আবার গৃহিণীর কোটায় ফিরে আসলাম। আমি অচল অবস্থায় পড়ে রইলাম। জানি না কতদিন পর গৃহিণী আমাকে একজন ভিখারীর হাতে সমর্পণ করল। ভিখারীও যেন মোটেই সন্তুষ্ট হলো না। ভাবটা যেন, একটা আনাও হয়, ডাবল পয়সাও নয়, দুটো পয়সা হলেও একটা কথা ছিল- এ যে একেবারে নতুন পয়সা। তারপর সে পড়লাম বাজারের এক তরকারীরওয়ালার হাতে। আমাকে নিয়ে বাজারে যে কত ঝগড়া হলো তা আর কি বলব। পুরানো পয়সা আর নতুন পয়সা নিয়ে হিসাব মেলানোই কষ্ট। বিশেষ করে অশিক্ষিতের হাতে পড়লে তো কথাই নেই।

তারপর গিয়ে পড়লাম এক বিড়ির দোকানে। আমার বদলে একটি ছেলে একটি বিড়ি কিনে মহাআনন্দে টানতে টানতে চলে গেল। এখান থেকে আমি বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চল করলাম। সকলে সকলকে ঠকাতে চায়। দোকানী চায় ক্রেতাকে ঠকাতে। কিন্তু ক্রেতাও ছাড়ার পাত্র নয়। সে চায় যত কম টাকায় পারা যায়, তা দিয়ে পণ্য কিনতে। শেষটায় তৃপ্তি এই যে, উভয়ে জিতেছে মনে করে চলে যায়। সেই দোকানে ছিল বাহারি রকমের লজেন্স। পাড়ার ছেলেমেয়েরা মাঝে মধ্যে আসত লজেন্স কিনতে, ইতোমধ্যে আমার আরেকটি সংগি জুটে গেল। তার নিকটও আমি সকল দুর্দশার কাহিনী শুনলাম। তার জীবনও যেন অন্যের মতো।

অবশেষে পড়লাম একজন ছাপোষা কেরানীর হাতে। বর্ষার এক সন্ধ্যায় স্তিমিত আলোতে সে বাজার করে ঘরে ফিরল। ছোট মেয়ে ডলি বাবার কাছে বসে হাত পাততেই আমাকে তিনি তার মেয়ের হাতে তুলে দিলেন। ভাবলাম অবশেষে বাঁচা গেল। কিন্তু একি! একটু দেখেই সে মুখ ভার করে আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল। বাবা-মা উভয়েই হেসে উঠল। আমি দরজার কোণে পড়ে রইলাম। আমাকে কেউ উদ্ধারের চেষ্টা করল না। বুঝলাম, আমার মূল্য, মনে মনে বললাম।

1 Comments

Post a Comment
Previous Post Next Post