রচনা : আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সিং

↬ পেশা যখন ফ্রিল্যান্সিং
↬ ঘরে বসে ইনকাম
↬ আউটসোর্সিং ইনকাম

ভূমিকা : তথ্যপ্রযুক্তি অগ্রগতির এই যুগে আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সিং শব্দটির সঙ্গে কম-বেশি সবাই পরিচিত। দেশে দিন দিন বাড়ছে আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সিং। বহু শিক্ষিত মানুষ এখন আর চাকরির পেছনে ছুটছেন না। আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সিং করে স্বাধীনভাবে ঘরে বসে আয় করছেন তারা। প্রতিদিনই যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন মুখ। এর মাধ্যমে তারা দেশে আনছেন বৈদেশিক মুদ্রা। রেমিটেন্স আহরণের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখছেন লাখো যুবক। বেকারত্ব দূরীকরণ করে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখছেন তারা। তবুও সমাজের কিছু মানুষ ভুল ধারণা পোষণ করে আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে। কিন্তু সব বাধাবিপত্তি ও ভুল ধারণা কাটিয়ে আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সিং দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে। 

কীভাবে এলো আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সিং : আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সিং বলতে কোনো ব্যবসায়িক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজের কাজ অন্যকে দিয়ে করিয়ে নেওয়াকে বোঝায়। এ ধারণাটি এসেছে আমেরিকান শব্দ outside resourcing থেকে। যার যাত্রা শুরু হয় আশির দশকে। আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সিং বলতে কখনো কখনো এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে কর্মী হস্তান্তর করাকেও বোঝায়। কিন্তু তা সবসময় নয়। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে সরকারি কাজসমূহ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বিদেশি বা দেশি ঠিকাদারি উভয়ই আউটসোর্সিংয়ের অন্তর্গত। কখনো আউটসোর্সিংয়ে দূরবর্তী দেশে নিজের প্রতিষ্ঠান স্থাপন অথবা পাশাপাশি কোনো দেশে প্রতিষ্ঠান স্থাপনাও অন্তর্ভুক্ত থাকে। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যায়। কারণ এতে স্থানীয় শ্রমিকদের চেয়ে কম বেতন প্রদান করতে হয়। এটি আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সিংয়ের ক্ষেত্রে একটি বড় অনুপ্রেরণা। 

আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সিং কী : আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সিং হচ্ছে মুক্ত স্বাধীন কর্মক্ষেত্র। অর্থাৎ স্বাধীনভাবে কাজ করে আয়ের একটি বৈধ পেশা। আরও একটু সহজভাবে বলা যায় যে, ইন্টারনেট ব্যবস্থার মাধ্যমে অন্য প্রতিষ্ঠানের কাজ করে দিয়ে ঘরে বসে আয় করার সহজ পদ্ধতির নামই আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সিং। আর যারা আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করেন তাদেরকে বলা হয় ফ্রিল্যান্সার। 

আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সিংয়ে কাজের ধরন : আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সিং ইন্টারনেটের মাধ্যমে করতে হয়। অনলাইনে বিভিন্ন মার্কেট প্লেস রয়েছে যেখানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন কাজ এসব মার্কেট প্লেসে দিয়ে থাকে। আর এ কাজগুলো প্রতিষ্ঠানের নিয়ম বা শর্ত অনুযায়ী করে দিয়ে আয় করা যায়। আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজগুলো বিভিন্ন ধরনের। যেমন ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিক্স ডিজাইন, নেটওয়ার্ক ও ইনফরমেশন সিস্টেম, লেখা ও অনুবাদ, প্রশাসনিক সহায়তা, ডিজাইন ও মাল্টিমিডিয়া, কাস্টমার সার্ভিস, বিক্রয় ও বিপণন, ব্যবসায় সেবা ইত্যাদি। এসব কাজ ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের শর্ত অনুযায়ী করে দিতে পারলেই অনলাইনে আয় করা সম্ভব। 

কীভাবে আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সিংয়ে আয় করবেন : অনলাইন মার্কেট প্লেসে কাজ করতে অবশ্যই কোনো একটি কাজের ওপর অভিজ্ঞতা থাকতে হবে এবং ভালো কাজ জানতে হবে। কারণ এখানে শুধু আপনি একা কাজ করবেন না। এখানে আপনার সঙ্গে আপনার মতো আরও অনেকে কাজ করবেন। সুতরাং ভালো কাজ জানা না থাকলে আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সিংয়ে সফলতা লাভ করা সম্ভব নয়। ভালো কাজের দক্ষতা থাকলেই কেবল এ জগতে ভালো ফল লাভ করা সম্ভব। আউটসোর্সিং বা ফ্রিলান্সিংয়ে সাফল্য পেতে হলে অভিজ্ঞতা, কর্মদক্ষতা, ধৈর্যশীলতা, দক্ষ পরিসেবা, ভালো মান এবং জানার আগ্রহ থাকতে হবে। এ ৬টি গুণ থাকলেই আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সিংয়ে সাফল্যজনক আয় করা সম্ভব। 

আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সিং কেন করবেন, কীভাবে করবেন : বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশেই আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সিং জগতে অনেক মানুষ কাজ করেন। কিন্তু তাদের সবাই শতভাগ সফল হতে পারেন না। এটি যেহেতু মুক্ত পেশা তাই এখানে আপনার জবাবদিহিতার চেয়ে আপনার কাজের জবাবদিহিতা বেশি। উপার্জনের জন্যই এ জগতে আসা। সুতরাং আপনি যার কাছ থেকে উপার্জন করবেন তার কাজ সঠিকভাবে করতে না পারলে উপার্জনের আশা করা বৃথা। আপনি যদি কাজ করার ক্ষেত্রে মনোযোগী না হন, যদি কাজে স্বচ্ছতা না থাকে তা হলে এক্ষেত্রে সফলতা লাভ করা অসম্ভব। আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সিংয়ে সবসময় নিজেকে দিয়ে মূল্যায়ন করতে হয়। অর্থাৎ আপনি নিজে যদি এ কাজটি অন্য কাউকে দিয়ে করাতেন তা হলে তার কাছ থেকে আপনি কী আশা করতেন এবং অবশ্যই তার চেয়ে একটু বেশিই দেওয়ার চেষ্টা করা উচিত। তা হলে যিনি আপনাকে কাজ দেবেন তিনি খুশি থাকবেন এবং আপনার কাজ পাওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যাবে। 

আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ কোথায় পাবেন : দেশে ও বিদেশে আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ পাওয়া যায় এমন অনেক ওয়েবসাইট আছে। আবার ভুয়া সাইটও রয়েছে অনেক। ফলে সতর্ক হয়েই কাজ শুরু করতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত ও নির্ভরযোগ্য কয়েকটি সাইটের ঠিকানা হলো: www.odesk.com, www.freelance.com, www.elance.com. www.getacoder.com, www.guru.com, www.vworker.com, www.scriptiance.com ইত্যাদি। সবকটি মোটামুটি একই রকম এবং এগুলো মোটামুটি পরীক্ষিত সাইট। এসব সাইটে কাজ করে আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সিংয়ে সফলতা লাভ করা সম্ভব। 

আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সিংয়ের জন্য কী কী প্রয়োজন : আউটসোর্সিংয়ের জন্য আপনার মূল হাতিয়ার হলো মেধা। কাজেই দামি যন্ত্রপাতি নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন খুব কমই। তবে কাজের ধরন অনুযায়ী আপনার অবশ্যই স্ক্যানার, গ্রাফিক্স ট্যাবলেট, দামি ক্যামেরা, মোটামুটি ভালো মানের একটি কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট সংযোগ থাকতে হবে।

আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সিংয়ে উপার্জন : মূলত ভালো উপার্জনের জন্যই আজকের যুবসমাজ আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সিংয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। যদিও উপার্জনের বিষয়টি পুরোপুরি নির্ভর করে কাজের ধরনের ওপর। অধিকাংশ কাজের হিসাব হয় ঘণ্টা হিসেবে। অর্থাৎ আপনাকে কাজের জন্য হায়ার করা হবে এবং প্রত্যেক ঘন্টার নির্ধারিত পারিশ্রমিক প্রদান করা হবে। গ্রাফিক ডিজাইনকে উদাহরণ হিসেবে ধরলে মাসে অনায়াসে হাজার ডলার উপার্জন করা সম্ভব। আর প্রোগ্রামার হলে উপার্জন হবে আরও অনেক বেশি। 

পেশা হিসেবে আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সিং : তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বায়নের এ যুগে কাজের ক্ষেত্র বর্তমানে শুধু নিজ দেশ কিংবা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। কাজের ক্ষেত্র এখন বিশ্বব্যাপী উন্মুক্ত। বর্তমানে বিদেশে গিয়ে দৈহিক পরিশ্রম করেই যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে হবে এমন নয়। তথ্যপ্রযুক্তির জয়কারের এ যুগে দেশে বসেই প্রযুক্তির সুবিধা ব্যবহার করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সম্ভাবনাময় একটি খাত হচ্ছে আউটসোর্সিং। ভারত, চীন, বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের অনেক তরুণ এখন পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন আউটসোর্সিং। বিভিন্ন দেশ ইতোমধ্যেই এটিকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতিও দিচ্ছে।বাংলাদেশও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। ফিল্যান্সারদের খুব শিগগিরই স্বীকৃতি প্রদান করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। 

আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান : বর্তমানে আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সিং পরিভাষাটি এ দেশের অনেকের কাছেই পরিচিত। আমাদের দেশে প্রচুর ওয়েবসাইট ডেভেলপার,গ্রাফিক্স ডিজাইনার, রাইটার, মার্কেটার বিভিন্ন অনলাইন মার্কেট প্লেসে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছেন। আবার অনেকে নতুন ফ্রিল্যান্সার হিসেবে মার্কেটে প্রবেশ করার চেষ্টা করছেন। তবে বর্তমান বিশ্বে আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সিং তালিকায় বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। এখানে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ ফ্রিল্যান্সার রয়েছে। তাদের মধ্যে পাঁচ লাখ কাজ করেন মাসিক আয়ের ভিত্তিতে। তারা প্রতিবছর প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স অর্জন করছেন। তাদের সার্বিক মূল্যায়ন ও যুবসমাজের এই মুক্ত পেশায় উদ্বুদ্ধকরণের লক্ষ্যে একটি প্লাটফর্ম করেছে তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, দেশের সাড়ে ছয় লাখ ফ্রিল্যান্সারকে পরিচয়পত্র দিতে কাজ শুরু করেছে সরকার। তাদের জন্য একটি ফ্রি আইডি কার্ড চালু করতে যাচ্ছে সরকার। এই কার্ডে তাদের ব্যক্তিগত তথ্য, মোবাইল নম্বরসহ বিশেষ কোড থাকবে, যার মাধ্যমে তাকে শনাক্ত করা সম্ভব হবে এবং ব্যাংক লোনসহ বিভিন্ন সুবিধা প্রদান করা হবে। অর্থাৎ পেশা হিসেবে ফ্রিল্যান্সিং সরকারি স্বীকৃতি পাচ্ছে। 

উপসংহার : আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সিং-এর আক্ষরিক অর্থ মুক্ত পেশা। অর্থাৎ গৎবাঁধা নিয়মের বাইরে নিজের ইচ্ছেমতো সময়ে এবং পছন্দের ধরন অনুযায়ী কাজ করার নাম আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সিং। নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করা এ স্বাধীন পেশাজীবীদের বলা হয় ফ্রিল্যান্সার। চাকরিজীবীদের মতো এঁরা বেতনভূক্ত নন। কাজ ও চুক্তির ওপর নির্ভর করে আয়ের পরিমাণ কম বা বেশি হতে পারে। তবে স্বাধীনতা আছে, ইচ্ছেমতো ঘরে বসে বিশ্বের যেকোনো দেশ থেকে ইনকামের সুযোগও পর্যাপ্ত। আর এ জন্যই আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সিং স্বাধীনমনা লোকদের আয়ের জন্য একটি সুবিধাজনক সেরা পন্থা। এক্ষেত্রে সাফল্য থাকে নিজের হাতের মুঠোয়।


আরো দেখুন :
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post