মার্চের দিনগুলি

সধারণ জ্ঞান : পল্লী কবি জসীম উদ্দীন

পল্লী কবি জসিম উদ্দীন

পল্লী কবি জসীম উদ্দীন শুধু বাংলাদেশের সাহিত্যেই নয় সমগ্র বাংলা সাহিত্যে একটি স্বতন্ত্র আসন অলংকৃত করে আছেন। গ্রাম বাংলার জীবনালেখ্য তাঁর কাব্যে চমৎকার সার্থকতা সহকারে বিধৃত হয়েছে। পল্লীর অশিক্ষিত মানব মানবীর সুখ-দুঃখ তাঁর কাব্যে চমৎকারভাবে বিধৃত হয়েছে। যুগের বিক্ষোভ ও আলোড়ন থেকে নিজেকে সন্তর্পণে সরিয়ে রেখে তিনি গ্রামীণ প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্যের মধ্যে নিজেকে বিলীন করেছিলেন। তিনি পল্লীজীবনের কথা বলেছেন, পল্লী ও তাঁর মানুষকে বাঙ্ময় করে তুলেছেন। দেশীয় ঐতিহ্য-নির্ভর লোকজীবনের আবহমানের ঐতিহ্যের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কযুক্ত হয়ে তাঁর কাব্যরীতি বিকশিত হয়েছিল। পল্লী কবি জসীমউদ্দীন ১৪ মার্চ ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর প্রয়াণদিবস স্মরণে আমাদের এ আয়োজন। 

জন্ম : ফরিদপুরের তাম্বুলখানা গ্রামে (মাতুলালয়) জন্মগ্রহণ করেন ১ জানুয়ারি ১৯০৩। 
উপাধি : পল্লী কবি । 
ছদ্মনাম : তুজম্বর আলী। 
মৃত্যু : ১৪ মার্চ ১৯৭৬, ঢাকা। 

সাহিত্যকর্ম 
  • কাব্যগ্রন্থ : রাখালী (১৯২৭) [প্রথম কাব্যগ্রন্থ], নকশী কাঁথার মাঠ (১৯২৯) : এ কাহিনিকাব্যের ইংরেজি নাম 'Field of the Embroidered Quilt' (অনুবাদক: EM Milford)।, ধানখেত (১৯৩৩). সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৪), সুচয়নী, মা যে জননী কান্দে (১৯৬৩), বালুচর (১৯৩০), মাটির কান্না। 
  • কবিতা : কবর, রাখাল ছেলে, আসমানী। 
  • উপন্যাস : বোবা কাহিনী (১৯৬৪) [একমাত্র উপন্যাস]। 
  • নাটক : মধুমালা (১৯৫১), বেদের মেয়ে (১৯৫১), গ্রামের মায়া, পল্লীবধূ, পদ্মপাড়। 
  • শিশুতোষ গ্রন্থ : হাসু (১৯৩৮), ডালিমকুমার (১৯৫১), এক পয়সার বাঁশী। 
  • ভ্রমণকাহিনি : চলে মুসাফির (১৯৫২), যে দেশে মানুষ বড় (১৯৬৮), হলদে পরীর দেশ (১৯৬৭)। 
  • গানের সংকলন : রঙ্গিলা নায়ের মাঝি (১৯৩০), জারিগান, গাঙ্গের পাড়। 
  • আত্মজীবনী : জীবন কথা। 

‘নকশী কাঁথার মাঠ’ যেন সুসম্পূর্ণ পল্লী জীবনের ভাষ্য 
‘নকশী কাঁথার মাঠ’ কাব্যগ্রন্থের রূপাই চরিত্রটি বাস্তবের এক ব্যক্তিকে উপজীব্য করে নেওয়া। যার প্রকৃত নাম রূপা। তার বাড়ি ময়মনসিংয়ের গফরগাঁও উপজেলার শিলাসী গ্রামে। ‘রূপা কাব্যের রূপাইয়ের মতো বলবান বীর ও সেরা লাঠিয়াল ছিলেন। ১৯২৮ সালের শেষদিকে ময়মনসিংহ গীতিকা সংগ্রহ করতে জসীমউদ্দীন গফরগাঁওয়ে এসেছিলেন। সেখানে কবি তার সাহিত্যচর্চার অন্যতম সঙ্গী খ্যাতনামা সাহিত্যিক মৌলভী শেখ আবদুল জব্বারের বনগাঁও গ্রামের বাড়িতে উঠেন। এখানে অবস্থানকালে বনগাঁও গ্রামে জমির ধান কাটা নিয়ে এক বড়ো ধরনের দাঙ্গা (স্থানীয় ভাষায় কাইজ্জা) হয়। সেই দাঙ্গায় শিলাসী গ্রামের নেতৃত্ব দেন রূপা। কবি সেই দাঙ্গা দেখেন। ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ কাব্যের মূল উপজীব্য হয়ে ওঠে সেই দাঙ্গার ঘটনা। সেখানেই কবির সঙ্গে রূপার পরিচয়। সাজুও এক বাস্তব চরিত্র, যার নাম ছিল ললিতা। রূপার প্রতিবেশী গ্রাম মশাখালীর বাসিন্দা। রূপা ললিতাকে ভালোবাসতেন। তাদেরকে উপজীব্য করেই কবি ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ কাব্যটি রচনা করেছেন। 

জীবনের জটিলতা থেকে জসীমউদ্দীনের কবিতা মুক্ত। বরং জীবনের সহজ সরল অভিব্যক্তিই তাঁর কাব্যে দেখা যায়। পল্লীর অশিক্ষিত মানব-মনবীর সুখ দুঃখ আনন্দবেদনা তাঁর অধিকাংশ কাব্যের বিষয়বস্তু। তাঁর সমকালীন সাহিত্যিকেরা যখন সাহিত্য রচনায় পশ্চিমা আদর্শমুখী তখন জসীমউদ্দীন মনোনিবেশ করলেন পল্লীগ্রামের প্রতি। বিষয় ও কাঠামোগত দিক থেকে স্বদেশি ঐতিহ্যকে গ্রহণ করে তিনি কাব্যজগতে স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছেন। ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ জসীমউদ্দীনের প্রথম কাহিনিকাব্য। এ কাব্যের মৌল আবেদন এর আশ্চর্য মানবিকতায়। লৌকিক জীবনের চিরায়ত চিত্র উপস্থাপনের পাশাপাশি অঙ্কুশ তাড়নাকে আবেগঘনভাবে তুলে ধরেছেন। ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ কাব্যোপন্যাসটি রূপাই ও সাজু নামক দুই গ্রামীণ যুবক-যুবতির অবিনশ্বর প্রেমকাহিনি। এ কাব্যের নায়ক রূপাই গাঁয়ের ছেলে। কৃষ্ণকায়, কাঁধ পর্যন্ত চুলের রূপাই নামকরা লাঠিয়াল। সে ভালো বাশিও বাজাতে পারে। কবি জসীমউদ্দীন বলেন— 

এই গাঁয়ের এক চাষার ছেলে লম্বা মাথার চুল—
কালো মুখেই কালো ভ্রমর, কিসের রঙিন ফুল!
কাঁচা ধানের পাতার মত কচি-মুখের মায়া,
তার সাথে কে মাখিয়ে দেছে নবীন তৃণের ছায়া। 

রূপাইর সঙ্গে পাশের গ্রামের মেয়ে সাজুর ভালোবাসা হয়। তারপর তারা বিয়ে করে সুখের সংসার পাতে। এক চাঁদনি রাতে বাড়ির আঙ্গিনায় সাজু রূপাইয়ের কোলে শুয়ে গল্প করে। পূর্ণিমার আলোতে সাজুর রূপ দেখে দারুণ মুগ্ধ হয় রূপাই। কিন্তু অজানা এক আশঙ্কায় রূপাই শঙ্কিত হয়। এত সুখ সইবে তো? এমন সময় হঠাৎ খবর আসে বনগেঁয়োরা তাদের গাজনা চরের পাকা ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছে। রূপাই ছুটে যায় বনগেঁয়োদের প্রতিরোধ করতে। সেখানে লড়াইয়ে কয়েকটি খুন হয় এবং রূপাই খুনের মামলার আসামি হয়ে ফেরারি হয়। এদিকে সাজু প্রতি রাতে মাটির প্রদীপ জ্বেলে রূপাইর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। দিন চলে যায় রূপাই আর আসে না। হঠাৎ এক গভীর রাতে রূপাই এসে দাঁড়ায় সাজুর সামনে। সাজু দেখে রূপাইর সারা গায়ে কাদা মাটি ও রক্তের দাগ। সাজু বলে আমি তোমাকে আর যেতে দেব না। রূপাই বুঝানোর চেষ্টা করে আমাকে না গিয়ে তো উপায় নেই। ধরা পড়লে ফাঁসি হয়ে যাবে। রূপাই চলে যাওয়ার সময় সাজু বলেছিল, তুমি তো চলে যাবে আমাকে কার কাছে রেখে যাবে? তখন রূপাই বলে— 

সখী দীন দুঃখীর যারে ছাড়া কেহ নাই, 
সেই আল্লার হাতে আজি আমি তোমারে সঁপিয়া যাই
মাকড়ের আঁশে হস্তী যে বাঁধে, পাথর ভাসায় জলে,
তোমারে আজি সঁপিয়া গেলাম তাঁহার চরণ তলে। 

এটাই ইহলোকে রূপাইর সাথে সাজুর শেষ দেখা। সাজু কি আর করবে বৃষ্টির জন্য কুলা নামানোর দিনে রূপাইয়ের সাথে প্রথম দৃষ্টি বিনিময় থেকে শুরু করে রূপাইয়ের চলে যাওয়ার রাত পর্যন্ত সমস্ত অতীত স্মৃতি কাঁথার ওপর ফুটিয়ে তুলতে থাকে সুঁই-সুতা দিয়ে। সেই কাঁথা বোনা শেষ হলে সাজু কাঁথাটা তার মায়ের হাতে তুলে দিয়ে বলল-
মা, আমার মরণের পরে যেখানে কবর দেওয়া হবে, সেই কবরের ওপরে যেন এ নকশী কাঁথাখানা বিছিয়ে দেওয়া হয়। আর যদি কোনোদিন রূপাই এসে আমার খোঁজ করে, তাকে বোলো, তোমার আশায় সাজু ওই কবরের নিচে আছে।

বহুদিন পর গাঁয়ের লোকেরা গভীর রাতে বেদনার্ত এক বাঁশির সুর শুনতে পায়, আর ভোরে সবাই এসে দেখে সাজুর কবরের পাশে এক ভিনদেশি লোক মরে পড়ে আছে। কবির ভাষায়— 

কেহ কেহ নাকি গভীর রাত্রে দেখেছে
মাঠের পরে মহা-শূন্যেতে উড়াইছে কেবা নকশী
কাঁথাটি ধরে;
হাতে তার সেই বাঁশের বাঁশিটি বাজায় করুণ সুরে, 
তারি ঢেউ লাগি এ-গাঁও ও-গাঁও গহন
ব্যথায় ঝুরে। 

‘নকশী কাঁথার মাঠ’ কাব্যের দুটি চরিত্র সাজু ও রূপাইয়ের করুণ পরিণতির সাথে মানুষের চিরন্তন সুখ দুঃখের গল্প একীভূত হয়ে আছে। কবি এই আখ্যানের একবারে শেষ পর্বে করুণ বেদনাকে প্রকাশ করেছেন— 

আজো এই গাঁও অঝোরে চাহিয়া ওই
গাঁওটির পানে,
নীরবে বসিয়া কোন কথা যেন
কহিতেছে কানে কানে। 

আধুনিক বাংলা সাহিত্যে নাগরিক জীবনের সর্বাত্মক প্রভাবের মধ্যেও পল্লীর জীবন মাধুর্যের ছবি এঁকে জসীমউদ্দীন শিক্ষিত মহলে যে সাড়া ফেলেছিলেন তা এককথায় অতুলনীয়। ‘নকশী কাঁথার মাঠ' সেই অতুলনীয় সার্থকতার প্রথম ও শ্রেষ্ঠ পরিচয় বহনকারী কাব্য। এ কাব্যে খাঁটি লোককাব্যের নৃত্যের ছন্দে গ্রামবাংলার দুটি তরুণ-তরুণীর অনাবিল প্রেম আর করুণ পরিণতির বর্ণনা রয়েছে। 

নকশী কাঁথার মাঠকে আবহমান বাংলার দর্পণ বলা যেতে পারে। পল্লীজীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, প্রেম-বিরহ, ঝগড়া-বিবাদ ইত্যাদি সূক্ষ্মভাবে বর্ণনা করা হয়েছে এতে। প্রতিটি অধ্যায়ের শুরুতে ব্যবহৃত লোকগানগুলো একে ভিন্নমাত্রা দান করেছে। গ্রামীণ জীবনের মাধুর্য ও কারুণ্য, বৈচিত্র্যহীন ক্লান্তি এবং মানুষের অসহায়তা এই কাব্যের উপকরণ। আধুনিক বাংলা কাব্যের ইতিহাসে এই কাব্য একটি বিশেষ স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় বহন করে। 

জসীমউদ্দীন আবেগের আবরণে আবহমান বাংলার চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর কাব্য পড়ে পাঠক একই সাথে কবিতা ও গল্প পড়ার স্বাদ পায়। তাই কেউ কেউ ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ কে কাব্যোপন্যাস বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর চিত্রিত গ্রাম-বাংলার প্রকৃতির শাশ্বত রূপ পাঠক্‌কে আজও আকর্ষণ করে। এ কাব্যের অকৃত্রিম জীবনবোধ, অকুণ্ঠ পল্লীপ্রীতি ও গ্রামীণ নর-নারীর বাস্তবোচিত চরিত্র সৃষ্টির ক্ষেত্রে জসীমউদ্দীনের গভীর অন্তর্দৃষ্টি, সর্বোপরি লোককাব্যের উপযোগী ভাষা ও আবহ নির্মাণের কলাকৌশল কাজ করেছে। তাই ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ যেন একটি সুসম্পূর্ণ পল্লীজীবন-ভাষ্যরূপে একটি সুডৌল কাহিনিতে পরিণতি লাভ করেছে।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post