ভাষণ : ছাত্ররাজনীতির একাল ও সেকাল

‘ছাত্ররাজনীতির একাল ও সেকাল’ শীর্ষক সেমিনারে উপস্থাপনের জন্য প্রধান বক্তা হিসেবে একটি মঞ্চভাষণ প্রস্তুত কর।


ছাত্ররাজনীতির একাল ও সেকাল

শ্রদ্ধেয় সভাপতি, মাননীয় প্রধান অতিথি, সম্মানিত বক্তাবৃন্দ ও উপস্থিত সুধীমণ্ডলী–
যুগে যুগে পরিবেশ পরিস্থিতির প্রয়োজনে, সমাজ ও রাষ্ট্রের চাহিদা মেটাতে ছাত্ররাজনীতির রূপ বদলায়। ছাত্ররা যেহেতু সমাজেরই অংশ এবং রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কর্ণধার সেজন্য ছাত্ররাজনীতিও এসব পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে পরিবর্তিত হয়। প্রকৃতপক্ষে অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশে ইতিবাচক ছাত্ররাজনীতির গুরুত্ব অপরিসীম রাজনীতির একাল বলতে আমরা বুঝি বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তীকাল আর সেকাল বলতে বুঝি স্বাধীনতা পূর্ববর্তীকাল। সেকালের ছাত্ররাজনীতি ছিল নীতি-আদর্শনির্ভর, গঠনমূলক, শ্রেয়বোধনির্ভর। তখনকার দিনে দেশ এবং দেশের মানুষের কল্যাণ ও উন্নতিই ছিল বড় কথা। ছাত্রদের নিজেদের ইতিবাচক স্বার্থকে অক্ষুণ্ণ রেখে তারা দেশের স্বার্থের কথা ভাবতেন, প্রয়োজনে আন্দোলন করতেন, জীবন উৎসর্গ করতেন। 

আমরা যদি ১৯৪৭ পরবর্তী পাকিস্তানের কথা বলি, তাহলে দেখব ১৯৪৮ সালে যখন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার ঘোষণা এলো তখন সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত ছাত্ররা প্রতিবাদ করেছিল, 'No' 'No'। তাঁরা আমাদের বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে প্রতিবাদ সভা করেছিল, রাজপথে মিছিল-স্লোগানে উত্তাল হয়ে উঠেছিল। সর্বস্তরের সাধারণ মানুষকে সাথে নিয়ে তারা দেশব্যাপী রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। রক্ত ও জীবন দিয়ে তারা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছিল। একইভাবে ১৯৬২ সালের শিক্ষা কমিশনের অন্যায্য সুপারিশের বিরুদ্ধে ছাত্ররাই রুখে দাঁড়িয়েছিল।

এভাবে এগারো দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জনে ছাত্ররাজনীতি তথা ছাত্রদের ভূমিকা ও অবদান কৃতজ্ঞতার সঙ্গে জাতি স্মরণ করে, ভবিষ্যতেও করবে। কেননা তা ছিল ছাত্ররাজনীতির স্বর্ণযুগ।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ ছাত্ররাজনীতির একালে অতীত গৌরব অক্ষুণ্ণ থাকেনি বরং নীতি-আদর্শহীনতা ও দেশপ্রেমহীনতার কারণে তা কলঙ্কিত হয়েছে। একালে ছাত্ররাজনীতি দলীয় লেজুড়বৃত্তিতে ব্যস্ত, অর্থ-সম্পদের মোহে ব্যক্তির-আখের গোছাতে তৎপর। যে কারণে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, দখলদারিত্ব, মারামারি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, হত্যা ও গুমের মতো বেআইনি, অবৈধ ও অনৈতিক কাজের আখড়া হয়েছে ছাত্র রাজনীতির কার্যালয়। মাঝখানে ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া প্রচলনে ছাত্রসমাজের তথা ছাত্ররাজনীতি একবারের জন্য তাদের নীতি-আদর্শ-দেশপ্রেম সমুন্নত রেখেছিল। কিন্তু তারপরই আবার ধস নামতে শুরু করছে। এখনকার ছাত্ররাজনীতি লাগামছাড়া, নিয়ন্ত্রণহীন। যে কারণে স্বস্তি নেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে, জনজীবনে। চাঁদাবাজি, ভাঙচুর, লুটপাট, সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানো একালের ছাত্ররাজনীতিকে কলুষিত করছে। শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষ এ ধরনের ছাত্ররাজনীতি চায় না, সমর্থনও কোরে না।

এখনকার ছাত্ররাজনীতি দেশ, সমাজভিত্তিক না হয়ে স্ব স্ব সমর্থিত দল, দলীয় মতবাদ, নেতা-নেত্রীভত্তিক দেখা যায়। কাজেই এখনকার আকাঙ্ক্ষা ছাত্ররাজনীতিকে ফিরে আসতে হবে সেকালের স্বর্ণযুগে, যে যুগে ছাত্ররা আন্দোলনে নামত শুধু শাসকের দেশ ও সমাজবিরোধী কাজের প্রতিবাদে। দলীয় মনোভাবে নয়।

ছাত্রদেরকে প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি প্রকৃত নীতি-আদর্শের চর্চায় ফিরে আসতে হবে। অপরাজনীতি ও বিভ্রান্তির পথ পরিহার করে প্রকৃত মানুষ হওয়ার জন্য সচেষ্ট হতে হবে। যাতে বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্ম দেশগঠনে ও মানুষের কল্যাণে সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারে। ছাত্রসমাজের প্রতি সেই আহ্বান জানিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করছি। আপনাদের সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ।

1 Comments

Post a Comment
Previous Post Next Post