খুদে গল্প : ঘুড়ি

‘ঘুড়ি’ বিষয়ে একটি খুদে গল্প রচনা করো :

ঘুড়ি

তখন কেবল সন্ধ্যা নেমেছে, রাত আসেনি। বারান্দায় পড়তে পড়তে আকাশ-বাতাস এক করে কীসের একটা গঁগঁ আওয়াজ। ভয়ে অবাকে-নাকি আনন্দে জানি না, মাকে ডাক দিলাম।

— কিরে! হলো কী! খানিকখুন হয়নি পইড়তে বসিচু। একোনি এরোম ম্যা ম্যা করতিচু ক্যা?

— মা, এটি আইসি দ্যাকো কিরোমগা একটা গঁগঁ আওয়াজ হইচ্চে। শুইনতে পাচ্চো? 

আমার হেবি ভয় লাগতিচে মা। – হারামজাদা পড়াচোর কোতিকার! মুনে হুইচ্ছে গঁগঁ শব্দ কোতি থাইকি আসতিচে তা য়ুই জানে না! মিস্তিরিবাড়ির বারিক চ্যাংরাডা কদমতলাত যায় কোয়ারি উড়াচ্চে। অইডি কোয়ারির শব্দ বাপ। ভয় নাই। ভালো কইরি পইড়ি যা। আমি কুটিডা লাগায় আসতিচি ৷ সেই প্রথম কোয়ারির নাম শুনলাম মার মুখে। তখন আমি হাইস্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণিতে। কোয়ারির সঙ্গে সঙ্গে সে রাতের মতো পড়াশোনা আমার আকাশে উঠল। সাথে ঘুমও। সারারাত চিন্তা করলাম কতদিক কতপথ কতকিছুর! সেই গঁগঁ আওয়াজ দুচোখ বন্ধ করে শিশুতোষ পথে হেঁটে বেড়ালে আজও বোধহয় শুনতে পাব সেই আওয়াজ। সে রাতের পরেরদিন আরবি বাদ। সকালে ঘুম থেকে উঠেই আরবি পড়ার নাম করে সোজা ছুট মিস্ত্রিবাড়ির করিম ভাইয়ের কাছে- গতকাল রাতের গ গ শব্দের উৎস জানতে। ঢুকতেই করিম ভাইয়ের বারান্দার ওপর দেখি পলিথিন আর পুরাতন তেনাকাপড় দিয়ে করা চারকোণার বিশাল কী যেন একটা কিছু। আমি তো থ। দৈত্যের মতো কাঠামোটির চারপাশে ঘুরছি, ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছি। বাঁশের তক্তা চিরেচিরে করা বাতাগুলো দিয়ে কী নিপুণ কৌশলে দৈত্যটির সমস্তদেহ প্রস্তুত! কী তার চারকোনায় নির্ভুল খোপভাগ! পলিথিন-কাপড় সংযোগ! আর কী মোটা কটের সুতা দিয়ে করা তার গলার ফাঁস!বিকেলে করিম ভাই আমাকে নিয়ে গেলেন ডিঙিডোবাগাঙের শুকনো লম্বা ফালিতে। আমরা দুজন মিলে উড়িয়ে দিলাম আমার স্বপ্নঘুড়ি। আকাশে উড়লে কী তার বাহার! বাতাসের দোলায় লেজ নাড়াবার তার কী ভঙ্গি! স্থির হয়ে মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে বাতাস ফুঁড়েফুঁড়ে শীতল ধাপে ধাপে তার আকাশমুখী যাত্রা। যেন সে আকাশকে দখলে নেবে, আকাশের সাথে করবে উদ্দাম মাখামাখি! প্রথম বিকেলেই ছাড়তে ছাড়তে করিম ভাই ছেড়ে দিলেন এক কাটিঙের সমস্ত সুতা। ঘুড়ি আমার তখন পৃথিবীর উচ্চতা সীমানা ছাড়িয়ে! উড়ুউডু! আচানক বাতাসের বঁকদলের অতর্কিত ধাক্কায় ঘুড়ি ঘাই মারতে শুরু করল। করিম ভাই বলল, 'যাঃ লাটাই ধইরি দৌড় দে। শালার বাতাস হোটাৎ কইরি গুড্ডির সাইডে লাকতিচে। যেটি যায় দেকপু যে বাতাস ঘুড্ডির বুক বরাবর আচে ওটি যায়াই থাইমি যাবু'। তারপর ঘুড্ডির তালে তাল মিলিয়ে মিলিয়ে আমি দৌড়চ্ছি-হাঁটছি-ঘুরছি।

ঘুড়ি ওড়ানোর পাড়া পাড়া খেলায় জুয়েল গফুর-শামীমদের হারিয়ে ঘুড়ির উচ্চতার প্রতিপত্তিতে বেসামাল আত্মহারা হয়ে তাদের কটাক্ষ করেছি বহুবার। হেরেছিও অনেক! কিন্তু যেদিন দুপুরবেলার রোদমেশানো হালকা ফিনফিনে বাতাসের সাথে দৌড়ের পাল্লা দিয়ে ওঠাতে পেরেছি একটিবার সেদিন বিকেলে আর আমার ঘুড়ির সুদূর উচ্চতার দূরত্ব ছোঁয় কে?
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post