খুদে গল্প : লাল চুড়ি

'লাল চুড়ি' শিরোনামে একটি খুদে গল্প লেখ।

লাল চুড়ি

নির্বাচনী প্রচারণায় বেরিয়েছি। ঘুরতে ঘুরতে কখন যে সকাল পেরিয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এসেছে টের পাইনি। ছোট ভাই ফেরার জন্য তাড়া দিচ্ছে। চোখের সামনে পথের বাঁকে একসারি বাড়ি দেখে এগিয়ে গেলাম। প্রথম বাড়ির পাঁচিলের গায়ে আধ ভেজা দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল কৃষকায় এক মহিলা কুলায় চাল বাছছেন। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। কেমন এক অদ্ভুত দৃষ্টি মেলে ধরলেন আমার দিকে, আমি তাকে নিরীক্ষণ করছি। তার চোখে কী যেন আবিষ্কার করতে চাইছি। হঠাৎ দরজা দিয়ে ১৪-১৫ বছরের একটি সুন্দরী মেয়েকে ঢুকতে দেখে পঞ্চাশোর্ধ মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার মেয়ে বুঝি? মহিলা না সূচক মাথা নেড়ে আর্তস্বরে কেঁদে উঠলেন। কিছু বুঝতে না পেরে মহিলার অশান্ত কান্নায় বিচলিত হয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলাম। কিশোরী মেয়েটি আমাকে বলল- 'আপা, খালাম্মার মেয়ের ছবি দেখবেন, আসেন। ওর সঙ্গে ঘরে ঢুকে ঔ মহিলার আদরের মেয়ে সাজুর ছবি দেখলাম। আমার সঙ্গে ফটোর মুখবয়বের সাদৃশ্য কতটুকু জানিনে, কিন্তু কন্যাহারা শোকাতুর ঐ জননীর চোখে নাকি আমি তারই প্রতিচ্ছবি। আমারই মধ্যে তিনি খুঁজে পেয়েছেন তাঁর হারানো সাজুকে। ঘর থেকে বেরোতেই দেখি মহিলা এক গাছা টুকটুকে লাল কাচের চুড়ি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখেই এগিয়ে এসে আমার বাঁ হাতটি তার হাতে নিয়ে বললেন- 'মাগো এ হাতটায় শুধু ঘড়ি না পইরা এই চুড়ি কয়টা পরেন। আমি পরাইয়া দেই। সধবা মানুষ, এরকম হাত ভালো দেখায় না। আমার স্বামীও চুড়ি ছাড়া শুধু ঘড়ি পড়া হাত নিয়া অনেকদিন আপত্তির সুর তুলেছেন। আমি হাসতে হাসতে বলেছি- ঘড়ির সাথে চুড়ি পড়লে তো আনস্মার্ট দেখায়। কিন্তু মহিলার কথায় আপত্তি করতে পারলাম না। আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম- আপনি আমাকে তুমি করেই বললে খুশি হবো। বিদায় বেলা তিনি আমার দু'হাত ধরে মিনতি করে বললেন - 'মাগো, তুমি আবার আইসো। নিজের জায়গা ফিরা যাইবার আগে এই হতভাগিনীকে একবার দেখা দিয়া যাইও।

'আসব বলে মহিলার কাছ থেকে হাত সরিয়ে, উদগত অশ্রু দমন করে ফেরার পথে পা বাড়ালাম। চলতে চলতে একবার পিছনে ফিরে চেয়ে দেখি মূর্তিমতী বিষাদের মতো মহিলা তখনও দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছেন। ছোট ভাইটি আমার হাতের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল- কী ব্যাপার আপা? ক্যানভাসিংয়ে এসে এতদিনকার বুলি-টুলি সব ভুলে গেলেন? সলজ্জ চোখ তুলে বললাম- চুড়ি তো? তাও আবার লাল কাচের চুড়ি। খুলে ফেলব। নইলে নেতৃত্বের উপযুক্ত নই বলে বিবেচিত হবে না? লোকে আমাকে ভোট দিবে না। পাড়ওয়ালা সাদা শাড়ি, মাথায় ঘোমটা, সাদাসিধে বেশবাস ছাড়া কি ভোটারদের প্রশংসা পাওয়া যায়? তারপর আমরা রিকশা নিয়ে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চললাম। চলতে চলতে মনে হলো- সন্তানের জন্য জননীর আকুতি যে কত নিবিড় এই ঘটনার আগে বুঝিনি। আমার সন্তানের কথা মনে পড়ল, মায়ের কথা মনে পড়ল, লাল চুড়ির দিকে তাকিয়ে আমার স্বামীর কথা মনে পড়ল। সবার সব মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠল। সেই মুখগুলোর মধ্যে আমি সেই মহিলাকেও দেখেছি।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post