খুদে গল্প : একজন বিপ্লবীর মা

'একজন বিপ্লবীর মা' শিরোনামে একটি খুদে গল্প লেখ।

একজন বিপ্লবীর মা

মায়ের সাথে দেখা করতে এসে ধরা পড়ল হাশেম। আজিজ দারোগা গত সাত দিন সাত রাত ধরে অভিযান চালিয়ে তাঁকে ধরে ভেবেছিল পুরো গ্রুপের খবর পেয়ে যাবে। কিন্তু হাশেম মুখ খুলছে না। দারোগা হাশেমকে মৃত্যুর ভয় দেখায়, ছেড়ে দেওয়ার লোভ দেখায়। ব্যাখ্যা করে বলে- গোঁয়ার কোথাকার, বেকুবের হদ্দ। ভাবছে ভারি বীরত্ব হচ্ছে; দলের প্রতি খুব বিশ্বাস দেখানো হচ্ছে। আরে বোকা তাতে তোর লাভটা কী হলো। বরং খবরটা দিলে কিছু টাকা পয়সাও হয়ত পেতিস।... তারপর গলায় স্বর কোমল করে হাশেমের মাকে উদ্দেশ্য করে বলে- এ কেমন হলো বুড়ি, তোমার ছেলেটা সত্যি ভারি বোকা। কিন্তু সে যাকগে। তোমার কোনো ভয় নেই আজিজ দারোগা লোক খারাপ নয়, সে আজ নিজের চোখেই দেখবে। বলো, তুমিই বলো ওরা সব দলবলসহ কোথায় লুকিয়েছে? কোথায়? হাশেমের মা নির্বিকার, চুপ করে থাকে। দারোগা আশ্চর্য হয়। বলে আরে, তুমিও চুপ! তোমারও কি মাথা খারাপ হয়ে গেল বুড়ি! ছেলেটার কথা ভাবলে না একবার। পাশের একশো পুলিশ কে উদ্দেশ্য করে বলে- দেখ, দেখ, চাঁদ মিয়া, বুড়ির আক্কেলটা দেখ একবার। এ নাকি আবার মা।... এত্তটুকু বাচ্চা হয়ে ওর কোলে আসছিল সেই কবে, আর আজ শক্ত সমর্থ কেমন জোয়ান ছেলে। বুড়ির একটি কথায় সে ছেলে আজ প্রাণে বেঁচে যায়। কিন্তু বুড়ি মুখ খুলবে না। এর চেয়ে বেকুবের কথা শুনেছ কোনো দিন?... ছেলের ছোটবেলার কথা মনেও পড়ে না বুঝি, বুড়ি? সেই প্রথম যখন মা মা বলে মুখে আধো আধো বুলি ফুটল, তারপর মোটাসোটা শিশু হাঁটতে গিয়ে বারবার পড়ে যেত। আঁধার রাতে তুমি বুঁকের কাছে নিয়ে শুয়ে থাকতে। তারপর একটু বড় হলে মাঠে বাপের জন্য দুপুর বেলা ভাত আর তামাক নিয়ে যেত।... সে ছেলে আজ কেমন জোয়ান হয়েছে। অ্যাঁ? আরেকটু পরে গাছের ডালের তার মরা দেহটা ঝুলবে। কাক-শকুন এসে ঠুকরে ঠুকরে মাংস খাবে। অ্যাঁ! কী বল, বুড়ি? তোমার ছেলে... হাশেমের মা তখন প্রতিবাদ করে বলে- আমার ছেলে তো কোন দোষ করে নাই। আজিজ দারোগা তখন তাঁর চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে- করেছে, করেছে। সে সাংঘাতিক দোষ করেছে। বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে সে। তার চাইতেও বড় দোষ করেছে, কোন দলে যোগ দিলে লাভ হবে সেটা বুঝে না। অতবড় অপরাধের ক্ষমা নেই বুড়ি। বুড়ি রেগে গিয়ে বলল আমার ছেলের গায়ে একটি আঘাত করেছেন তো আমার অভিশাপে আপনার বংশ ছারখার হয়ে যাবে। দারোগা ধমক দিল- চুপ কর হারামজাদি। শকুনের অভিশাপে গরু মরে না। নিয়ে যাও মা ছেলে দুটোকেই, চোখের সামনে ফাঁসিতে ঝুলাবো। যাও দড়ি দিয়ে সামনের গাছেই ফাঁসি লাগাও। হুকুম পালনকারী একটু ভেবে দেখতে বললেন- আজিজ দারোগা তাকে বললেন না, না, ভাবাভাবির কিছু নেই আর এটা বাড়াবাড়িও না। বড় সাহেবের হুকুম, যে অবস্থায় যেমন করে হোক এই বিপ্লবী দলকে ধরতেই হবে। যারা এ কাজে সামান্য বাধা দিবে তাদের শাস্তি সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুদন্ড... এই তো মাত্র দুটি প্রান। দরকার হলে দশ বিশজন কে আমি পিঁপড়ের মতো পায়ের নিচে পিষে মারবো। এই নাও পিস্তল, শেষবারের মতো প্রশ্ন করবে। যদি না বলে, তাহলে খতম করে দিবে। আগে ছেলেকে, পরে বুড়িকে। 'খতম করে দিবে' শব্দটা কানে যায় এতোক্ষণ বেহুশ হয়ে পড়ে থাকা সখিনার। সে ভয় ভুলে কোনোভাবে উঠে দাঁড়ায়। হাশেমকে মেরে ফেলেছে কিনা জানতে চায়। দারোগা জানায় এখনো বেঁচে আছে, তবে আর বেশিক্ষণ থাকবে না। সখিনা বিপ্লবীদের অবস্থান জানিয়ে তার বিনিময়ে হাশেমকে ছেড়ে দিতে বলে। দারোগা আজিজ মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিপ্লবীদের অবস্থান জেনে নেয়। খুশিতে চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে ঘাতক পুলিশ আজিজের। সখিনা তাকে আল্লাহর কসম দিয়ে প্রতিজ্ঞা করার কথা মনে করিয়ে দেয়। আজিজ ক্রূর হাসিতে মুখ বিকৃত করে বলে- ও ব্যাটার জন্য ফাঁসির দড়ি টানাবার মতো সময় নষ্ট করার সময় আমার নেই। তাই এক গুলিতে সোজা উপরে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। তারপর একট গুলিত শব্দ, একটি ভারি দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ার শব্দ। সখিনা আর্তনাদ করে উঠল। হাশেমের মা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে কান্দিস না সখিনা। কান্দুম ক্যান আমরা? আমার হাশেম মানুষের মতোন মরছে। কোন ছোট কাম তো হে করে নাই। চাষি মান্দারের মুখে হাসি ফুটানোর লাইগা হে জান দিছে। হের মতোন জান কয়জন দিতে পারে, সখিনা? রুস্তম পালোয়ানের মতো হের নামেও মানুষ গান বানাইব। জানের চাইয়াও বড় জিনিস আছেরে সখিনা! সেটা অধিকার, দেশের স্বাধীনতা।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post