খুদে গল্প : কোনো এক হরিপদ

'কোনো এক হরিপদ' শিরোনামে একটি খুদে গল্প লেখ।

কোনো এক হরিপদ

মানুষ পালাচ্ছে। যেভাবে পারছে ছুটে চলছে; নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য। কোথায় মিলবে সে আশ্রয় কেউ জানে না। ঠিকানা জানা নেই, পথ জানা নেই, তবু চলছে তারা। নারীদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। একদিকে শত্রুর অট্টহাসি অন্যদিকে নিষ্পাপ শিশুর চিৎকার, নিরীহ মানুষের আর্তনাদ ছাপিয়ে গুলির শব্দ। আগুন, ধোঁয়া, সাইরেন, লাশ, রক্ত, ধ্বংসযজ্ঞ। মিলিটারির ভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে, গ্রাম ছেড়ে, আশ্রয়ের আশায় পাশের গ্রামের দিকে পা বাড়ায় মন্টু ডাক্তার। ডাক্তার বাড়ির সবাই তার সাথে। বাচ্চা ছেলেকে কোলে নিয়ে দুর্বল রোগা হরিপদও ছুটছে তাদের সাথে। মন্টু ডাক্তারকে আশেপাশের দুই দশ গ্রামের সবাই চেনে। কত রাতে কতবার কত রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়েছে, ভিজিট নেয় নি। এই দুর্দিনে কেউ না কেউ থাকে আশ্রয় দিবেই। কিন্তু আশার গুড়ে বালি তার। যে গ্রামের উদ্দেশ্য তারা যাচ্ছিল, সে গ্রামের পাকিস্তানি সমর্থকরা আগে থেকে মিলিটারিদের খবর দিয়েছিল যে হিন্দুরা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। তাঁরা গ্রামের ভিতরে ঢুকতেই কে যেন দেখিয়ে দিল ঐ যে হিন্দুরা পালিয়ে যাচ্ছে। ছেলেকে কোলে নিয়ে হাটতে গিয়ে পিছিয়ে পড়েছিল ক্ষীণকায় হরিপদ। দু'সপ্তাহ হতে চলল, নদীর ঘাটে জল আনতে গিয়ে হরিপদের বউ আর ফেরেনি। কেউ একজন বলেছিল কেরামত রাজাকারের লোকেরা অলকাকে ধরে নিয়ে গেছে। হরিপদ কলা গাছের ঝোপের আড়াল থেকে দেখল, একে একে সবাইকে গুলি করছে। মন্টু ডাক্তারের দুই মেয়ে তনুশ্রী আর অনুশ্রীকে জোর করে গাড়িতে তুলছে। মন্টু ডাক্তার বাধা দিল, কিন্তু একজন মিলিটারি তার বুকে লাথি মেরে ফেলে দিয়ে ঠ্যা ঠ্যা কতগুলো গুলি ছুড়ল। মেয়ে দুটোই চিৎকার করতেই তাদের মুখ চেপে ধরল। তারপর মিলিটারি গাড়ি ঘুরিয়ে গ্রামে ঢুকে গেল। হরিপদ তখন ছেলের মুখ চেপে ধরে কলাগাছের ঝোপের আড়ালে বসে আছে। রাজাকার দুটো চলে যাওয়ার পর সেখান থেজে বের হয়ে নিজের গ্রামের পথ ধরল হরিপদ। গ্রামের কাছে যেতেই দেখল পুরো গ্রামে আগুন দিয়েছে মিলিটারি, আর যাকে পাচ্ছে গুলি করছে। বটগাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখল সেই রাস্তার বিপরীত দিক থেকে মিলিটারি গাড়ি এগিয়ে আসছে। ভয়ে ছেলেকে নিয়ে পাশের খালে নেমে পড়ল সে। গাড়ি কাছাকাছি আসতেই ছেলেকে নিয়ে জলে ডুব দিল হরিপদ। জল থেকে উঠে খালের পাড়ে শ্যাওড়া গাছের ঝোপের আড়ালে দাঁড়াল হরিপদ। গাড়ি চলে গেছে। কোথাও কেই নেই। তবু চাপা স্বরে ছেলেকে ডাকল - খোকা, খোকা, খোকা উঠ, অ্যাই খোকা, আমার হারাধন, চোখ খোল বাবা, চোখ খোল। হারাধনের চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার লক্ষণ দেখে চিৎকার কর উঠল হরিপদ। সেই চিৎকার ছাপিয়ে পর পর দুটি গুলির শব্দ, তারপর সব স্তব্ধ হয়ে গেল।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post