নিজে নিজে প্রবন্ধ রচনা লেখার নিয়ম

নিজে নিজে প্রবন্ধ রচনা লেখার নিয়ম

কোনও বিষয় সম্বন্ধে আমরা যাহা চিন্তা করি, সেইগুলি সুশৃঙ্খল ভাবে সাজাইয়া লিখিয়া গেলেই প্রবন্ধ রচনার প্রাথমিক কাজটি করা হইল। উপদেশ দিয়া প্রবন্ধ রচনা শিক্ষা দেওয়া যাইতে পারে— ইহা আমরা মনে করি না। কি করিয়া গল্প লিখিতে হয়, কি করিয়া কবিতা লিখিতে হয়, তাহা যেমন উপদেশ দিয়া বুঝান যায় না, —কি করিয়া প্রবন্ধ রচনা লিখিতে হয়, সে সম্বন্ধে শুষ্ক উপদেশ বিতরণ করিলেও সেইরূপ ফল কিছুই হয় না।

রচনার প্রধান উপকরণ দুইটি : বিষয়–বস্তু ও ভাষা। পরীক্ষার্থী ছাত্রগণের নিকট হইতে রচনার মৌলিকতা কেউই আশা করে না, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সকল বিষয়ের পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করাও সম্ভব হয় না। বিষয়বস্তুর দিক্ হইতে আমরা দেখিতে পাই অধিকাংশ ছাত্রের রচনাতেই ভাবের দৈন্য বড় বেশী ধরা পড়ে। কি ভাবে লিখিতে হইবে তাহা ত দূরের কথা, কি লিখিতে হইবে সে সম্বন্ধেও অধিকাংশ ছাত্রের বিশেষ ধারণাই নাই। প্রবন্ধ লিখিতে বসিলেই হাত ও মাথা একেবারে আড়ষ্ট হইয়া পড়ে। অনেক চিন্তা – ভাবনা – গবেষণার পর, অনেক কাটাকুটি করিয়া কেহ হয় তো লিখিলেন, ‘গরু একটি চতুষ্পদ জন্তু।’ অপ্রাসঙ্গিক বা অবান্তর কথা কিছু লিখিয়া, একই ভাবের দুই তিনবার পুনরাবৃত্তি করিয়া হঠাৎ একস্থানে এক রকম জোর করিয়া রচনার শেষ করিলেন।

রচনা লিখিতে গিয়া কি লিখিতে হইবে, এ সম্বন্ধে ছাত্রগণের স্পষ্ট ধারণা হয় না কেন? ইহার মূল কারণ অবশ্য চিন্তাশক্তির দীনতা। বর্ত্তমান সময়ে সাধরণ ছাত্রগণের মুখস্থ করিবার শক্তি যে পরিমাণে বাড়িতেছে, সেই অনুপাতে মৌলিক চিন্তা করিবার ক্ষমতা লোপ পাইতেছে। স্বাধীনভাবে নিজের মনের কথা প্রকাশ করিতে যেন ভয় হয়। মনে হয় যে কথা বলিতে চাহিতেছি, তাহা তো কোন রচনার পুস্তকে কেহ এ পর্য্যন্ত লেখেন নাই। সুতরাং যাহা কোনো পুস্তকে লেখা নাই বা যাহার কোন নজীরই নাই, সেইরূপ কথা বুঝি লেখা যায় না।

চিন্তা শক্তির এ দৈন্য দূর হইবে কিসে? রচনা লিখিতে গিয়া আমরা কি লিখিব? কোন্ কোন্ স্থান হতে আমাদিগকে উপকরণ সংগ্রহ করিতে হইবে?

বিশেষ একটি পরিবারে, কোন গ্রামে বা শহরে একটি বিশেষ আবহাওয়ার মধ্যে আমাদের জীবন কাটিতেছে। পিতামাতা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের স্নেহ–ভালবাসা আমরা পাইয়াছি। অনেক সাধু–সজ্জন আমরা দেখিয়াছি, আবার স্বার্থপর কুটিল লোকও আমাদের অজ্ঞাত নাই। আমাদের সমাজের বা দেশের বিশেষ বিশেষ উৎসব ও ঘটনা আমরা জানি। দেশের লোকের আচার ব্যবহার রীতি–নীতি সুখ–দুঃখ কতকটা স্বচক্ষে দেখি। কতকটা গল্পে আলোচনায় বা বই পড়িয়া জানিতে পারি। আমাদের পরিচিত জগতের বাহিরে যে বৃহত্তর জগৎ রহিয়াছে তাহার শোভা সৌন্দর্য্য, বিচিত্র জীবনযাত্রা খানিকটা বই পড়িয়া জানি, খানিকটা ছবি, সিনেমা প্রভূতির দ্বারা পরোক্ষভাবে আমাদের দৃষ্টিগোচর হইতেছে। স্বদেশের বা স্বদেশের বাহিরের ক্ষণজন্মা মহাপুরুষগণের জীবনকথাও আমাদের অজ্ঞাত নহে। এই যে এতকাল ধরিয়া আমরা যাহা কিছু দেখিয়াছি, শুনিয়াছি, পড়িয়াছি ও ভাবিয়াছি তাহা আমাদের মনে অভিজ্ঞতার আকারে স্তরে স্তরে সজ্জিত হইয়া রহিয়াছে। এই উপকরণ হইতে প্রবন্ধ রচনার উপকরণ সংগ্রহ করি। অধ্যয়ন, চিন্তা ও পর্য্যবেক্ষণের ফলে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয় তাহা যেমন বিভিন্ন লোকের পক্ষে বিভিন্ন প্রকারের, সেইরূপ নিজ অভিজ্ঞতাকে অবলম্বন করিয়া বিভিন্ন লেখক যে রচনা লিখিবেন তাহা বিভিন্ন প্রকারের হইবে। শ্রেষ্ঠ রচনার নিদর্শন নিজস্ব ভঙ্গি (Personal touch) কেবল ভাষাগত বৈশিষ্ট্য নয়, ভাবগত বা উপকরণ - বিন্যাসের বৈশিষ্ট্য। এই নিজস্ব ‘ছাপটি’ না থাকিলেই রচনা গতানুগতিক ও শ্রীহীন হইয়া পড়ে, আলোচনা পূর্ণাঙ্গ হইলেও তাহা কাহারও হৃদয় স্পর্শ করে না৷ সুতরাং শিক্ষাবিদগণের উচিত— নিজস্ব অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা হইতেই রচনার উপকরণ সংগ্রহ করিতে চেষ্টা করা।

সকলের সকল বিষয়ে অভিজ্ঞতা থাকে না, আবার অনেক সময়ই আমাদের পূর্ব্বসঞ্চিত অভিজ্ঞতা কালক্রমে মলিন ও অস্পষ্ট হইয়া পড়ে। এইখানে প্রয়োজন হয় কল্পনাশক্তির৷ কল্পনার অর্থ অসীম আকাশে একেবারে উধাও হইয়া উড়িয়া যাওয়া নয়— আলোচ্য বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করিয়া যাহা চক্ষুর অন্তরালে আছে তাহা দৃষ্টির বিষয়ীভূত করিয়া তোলা। একটা গল্প খানিকটা পড়িয়া শেষটা আমরা অনুমান করিয়া লইতে পারি যে যে কল্পনাবলে, একটা চিত্র বা ছবি অস্পষ্ট বা ঝাপসা দেখা গেলে ছবিখানার পূর্ণরূপটি মনে করিতে পারি যে কল্পনাবলে, প্রবন্ধ রচনা করিবার সময় অনেক ক্ষেত্রেই সেই কল্পনার সাহায্য লইতে হয়। কল্পনাশক্তি না থাকিলে কেহ সুলেখক হইতে পারে না।

যে কোন বিষয়েরই হউক প্রবন্ধ রচনা করিতে যাইয়া ভয় পাইবার কোনো কারণ নাই। প্রবন্ধের বিষয়টি লইয়া কিছুক্ষণ নিবিষ্টচিত্তে চিন্তা করিলেই মোটামুটি কতকগুলি ভাব মনে আসিয়া থাকে। এ সময় কি ভাবে প্রবন্ধ আরম্ভ করিতে হইবে ও কি ভাবে তাহা শেষ করিতে হইবে, তাহা স্থির করিয়া লওয়া প্রয়োজন। এর পর যে ভাবগুলি মনে আসে সেগুলি একস্থানে লিখিয়া যে কথার পর যে কথা বলিলে ভাল হয়, সেইভাবে সাজাইতে হইবে। তারপর লিখিতে বসিলেই যে সমস্ত কথা লেখা হয় নাই বা পূর্ব্বে চিন্তা করা হয় নাই, এইরূপ অনেক কথা মনে পড়িবে। নূতন কথাগুলি বাদ দিবার কোন প্রয়োজন নাই, সেগুলিকেও যথাস্থানে সন্নিবিষ্ট করিতে হইবে।

জ্ঞানবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জীবনের অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি পায়, অধ্যয়ন ও পর্যবেক্ষণের ফলে মনে নানা ভাব সঞ্চিত হইতে থাকে। লিখিবার সময় একটু স্থির হইয়া চিন্তা করিলেই চলনসই প্রবন্ধের উপযুক্ত ভাবের অভাব হয় না।

প্রবন্ধের সৌষ্ঠব সম্পাদনের জন্য ভাষার মাধুর্য্য অতি প্রয়োজন। কথাগুলি কেবল মামুলি ধরণে বলিয়া গেলে পাঠকের নিকট হৃদয়গ্রাহী হয় না, গতানুগতিকভাবে লেখা মানুষের বিরক্তিকরই হইয়া থাকে। সুতরাং ভাষা হৃদয়গ্রাহী ও শ্রুতিমধুর করিতে সকলেরই যত্নবান হওয়া উচিত।

কি উপায়ে ভাষার সৌন্দর্য্য বিধান করা যায়— এ সম্বন্ধে কোন উপদেশ বা সহজ সঙ্কেত দেওয়া চলে না। অনেক সময় ছাত্রেরা শিক্ষকগণকে জিজ্ঞাসা করেন,— ‘কি রকম style এ লিখবো Sir, বঙ্কিমবাবুর না রবিবাবুর?’ এইরূপ কথা শুনিতে শুনিতে আমরা অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছি বলিয়া এই ধরনের কথা শুনিয়া এখন আর আশ্চর্য্য হই না। বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ এই উভয়ের রীতিই যেন সম্পূর্ণ আয়ত্ত করা হইয়াছে— এখন যে কোন একটা রীতিতে লিখিলেই হয়! বঙ্কিমচন্দ্রের রীতি তাঁহারই নিজস্ব, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রীতিও তাঁহার নিজস্ব, ইচ্ছা করিবামাত্রই ইহার যে কোন একটা রীতিতে লেখা চলে না। শিক্ষার্থীগণের প্রতি অনুরোধ তাঁহারা যেন প্রত্যেকেরই নিজস্ব রীতিতে রচনা করেন। প্রত্যেকেরই কথা বলিবার যেমন নিজস্ব একটা বিশেষ ভঙ্গি আছে, তেমনি লিখিবারও একটা বিশেষ রীতি আছে। চিন্তার সঙ্গে ভাষার রীতির একটা সম্বন্ধ আছে, চিন্তা ও ভাষায় সামঞ্জস্য রক্ষা করিয়া চলিলেই রচনা সুন্দর হয়।

কোন বিষয়ে চিন্তা করিতে বসিলেই আমরা বুঝিতে পারি, কতকগুলি বিষয় আমাদের অনুভূতিকে অত্যন্ত গভীরভাবে স্পর্শ করে। এই সমস্ত গভীর উপলব্ধির বিষয় ভাষায় প্রকাশ করিতে গেলে ভাষা হালকা করিলে চলে না। ভাবের গাম্ভীর্য্য থাকিলে ভাষাও গম্ভীর হওয়া প্রয়োজন। আবার নিতান্ত সাধারণ ভাব প্রকাশের জন্য আমাদের নিত্য ব্যবহার্য্য সাধারণ ভাষাও উপযোগী। ভাব লঘু হইলে ভাষাও হালকা হইবে।

প্রবন্ধ লিখিতে বসিয়া আরও একটি বিষয় লক্ষ্য করা দরকার। সাধারণত পরীক্ষার্থীগণকে তিন চারিিটি বিষয় হইতে একটি বিষয় নির্ব্বাচিত করিয়া প্রবন্ধ লিখিতে হয়। আর একটি বিষয়ের আলোচনা লঘুভাবেও করা যায়, আবার গম্ভীর ভাবেও করা যায়। যখন প্রবন্ধ লিখিতেছি, তখন আমার মনের গতি বা ভাব কিরূপ তাহা লক্ষ্য করা বিশেষ প্রয়োজন।আমাদের মন অনেক সময় চঞ্চল ও নানা বিষয়ে বিক্ষিপ্ত থাকে। আবার প্রবন্ধের বিষয়টি লইয়া চিন্তা করিতে বসিলে মনঃসংযোগের ফলে নানা কথা মনে আসে, সমস্ত মন প্রাণ যেন আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া উঠিতে থাকে, ভাবের পর ভাব, কথার পর কথা যেন অনায়াসে উৎসারিত হইতে থাকে। মনের এই অবস্থায় গম্ভীর ভাষায় অনেক কথাই বলা যায়। কিন্তু মনের চঞ্চল অবস্থায় সহস্র চেষ্টাতেও চিত্ত স্থির হয় না, কোনো বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করিবার ক্ষমতাই যেন তখন আর থাকে না। মনের এই অবস্থায় যদি প্রকাণ্ড ভূমিকা ফাঁদিয়া গম্ভীরভাবে রচনা আরম্ভ করা যায়, তবে শেষ পর্য্যন্ত রচনায় ভাষা ও ভাবের গাম্ভীর্য্য ও সামঞ্জস্য রক্ষা করা সম্ভাবপর হয় না। সুতরাং এই সময়ে হালকা ভাবে রচনা আরম্ভ করাই ভাল।

প্রচলিত পাঠ্যপুস্তকগুলিতে প্রবন্ধের বিষয়গুলিকে বর্ণনামূলক, বিবৃতিমূলক ও চিন্তামূলক এই তিন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। এই রকম শ্রেণীবিভাগ অনেক সময়ই শিক্ষার্থীগণের সহায়ক না হইয়া প্রবন্ধরচনার পক্ষে বিঘ্নস্বরূপ হইয়া দাঁড়ায়। সমস্ত প্রবন্ধই মূলত: ‘হযরত মহম্মদের জীবন’, ‘তাজমজল,’ বা ‘ব্রতচারী আন্দোলন’ — এই বিষয়গুলির যে কোন একটি সম্বন্ধে প্রবন্ধ লিখিতে হইলে কেবল বিবরণ দিলেই চলিবে, চিন্তার কোন প্রয়োজন নাই— এমন কথা কেহই বলিবেন না। চিন্তা আছে বলিয়াই দশজনের লিখিত দশটি প্রবন্ধ দশ রকমের হয়।

এই পুস্তকে কতকগুলি রচনা দেওয়া হইল। প্রত্যেকটি রচনা পড়িবার পূর্ব্বে রচনার বিষয়টি লইয়া কিছুক্ষণ চিন্তা করিলে কতকগুলি ভাব মনে পড়িবে। সঙ্গে সঙ্গে সেই ভাবগুলি কি ভাবে প্রকাশ করিতে হইবে, সে সম্বন্ধেও একটা নিজস্ব পদ্ধতি নিজের মনের কাছে ধরা পড়িবে। নিজের কাছে ভাব ও ভাষার দিক্ দিয়া প্রবন্ধের বিষয়টি যখন স্পষ্ট হইয়া উঠিল, তখনই প্রবন্ধটি পড়িতে হইবে। পড়িলে দেখা যাইবে হয়ত প্রবন্ধটিতে কতকগুলি নূতন ভাব আছে। কোন কোন প্রবন্ধে যদি নূতন কোন ভাব দেখিতে না পাওয়া যায়, তবুও পরিচিত ভাব প্রকাশের অন্তত: একটা নূতন পদ্ধতির সন্ধান মিলিবে। আমাদের বিশ্বাস বিভিন্ন বিষয়ের এই শতাধিক প্রবন্ধ পড়িলেও ও সঙ্গে সঙ্গে চিন্তা করিলে প্রবন্ধ রচনার কৌশল আয়ত্ত হইবে ও যে কোনও বিষয়ে চলনসই একটা প্রবন্ধ লিখিবার ক্ষমতা জন্মিবে।

মূলভাবনা : নব–প্রবেশিকা রচনা ও অনুবাদ (কলকাতা)
সংগ্রহ : আজিবুল হাসান
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post