রচনা : আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস (২০+ পয়েন্ট) - PDF

↬ International Mother Language Day

↬ একুশে ফেব্রুয়ারি

↬ একুশে ফেব্রুয়ারী

↬ ২১শে ফেব্রুয়ারী

↬ শহীদ দিবস


“আবার ফুটেছে দেখ কৃঞ্চচূড়া
থরে থরে শহরের পথে

কেবল নিবিড় হয়ে কখনওবা
একা হেঁটে যেতে মনে হয়, ফুল নয় ওরা,

শহীদের ঝলকিত রক্তের বুদ্বুদ
স্মৃতিগন্ধে ভরপুর

একুশের কৃঞ্চচূড়া আমাদের চেতনারই রঙ।”
— শামসুর রাহমান

বাইসনের সেই গুহা থেকে মানুষ বেরিয়ে এলো, দেখল নতুন পৃথিবী— আবিষ্কার করলো নিজেকে আলাদাভাবে। সেদিন বুঝতে পারেনি তারাও এ পৃথিবীতে শিল্পের উন্মেষ ঘটাবে। আর জীবনের প্রয়োজনেই তারা গুহাতে এঁকেছিল শিকারের অসংখ্য কৌশল। তারপর এ মানুষ বিপদসঙ্কুল জীবনযাত্রাকে আরো সহজসাধ্য করার তাগিদ অনুভব করল। কল্পনা করল এক অনাবিষ্কৃত সারল্য। সেই কল্পনা বাস্তবে রূপ নিল। সৃষ্টির স্বপ্ন হলো উন্মোচিত। আবিষ্কৃত হলো লেখার হরফ। সেই হায়ারোগ্লিফিকের যুগ থেকে অক্ষর এখন মিক্তবিহঙ্গ।

International Mother Language Day

পরিশেষে সৃষ্টি হল ভাষা। অঞ্চলভেদে এর পার্থক্য ক্রমে বাড়তে লাগল। তারপর গড়িয়ে গেল হাজার বছর। বাদ পড়ল না বঙ্গোপসাগরবিধৌত এ অঞ্চলটিও। জন্ম নিল আর্য–অনার্যসহ সংস্কৃত আর বাংলার ঐশ্বর্য, রূপ বৈচিত্র্যে মুগ্ধ হয়ে আরব, ইরান, তুরান আফগান, তুর্কি, মোগলের সহমিলনে জন্ম নিল এক শিশু। শিশুটি আর কেউ নয়, বাঙ্গালা। এরই পরিবর্তিত রূপ বাংলা।

একুশের স্বরূপ : একটি ভাষা থেকে উৎপত্তি হলো বাঙালি জাতির। যে জাতির রয়েছে হাজার বছরের বীরত্বগাথা। এ জাতি বীরের জাতি। যে জাতির অন্যতম সৃষ্টি মহান একুশ। একুশ— একটি চেতনা, একটি বৈশ্বিক প্রতীক, এক মহাবিস্ফোরণ। একুশ এখন সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে পৃথিবীর প্রায় ৬৭০০ ভাষার সাথে। পৃথিবীর সব ভাষাই আজ একুশের বন্ধনে আবদ্ধ। একুশ হলো বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের এবং বিভিন্ন জাতি ও ভাষাগোষ্ঠীর হিরন্ময় প্রতীক।

ভাষা আন্দোলনের সূচনা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী স্বাধীনতার প্রস্তাব নিয়ে ভারতে আসে ক্যাবিনেট মিশন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠারও অনেক আগে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর জিয়াউদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেন। কিন্তু পূর্ব বাংলা থেকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করেন। এভাবেই পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্ব থেকেই রাষ্ট্রভাষার বিতর্ক শুরু হয়েছিল।

ভাষা আন্দোলন : ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পূর্ব থেকেই বাংলা ভাষাকে লড়াইয়ে নামতে হয় উর্দুর প্রতিপক্ষ হিসেবে। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদই প্রথম বাংলাকে উর্দির প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেন। তিনি বলেন,

“ভারতে যেমন হিন্দি রাষ্ট্রভাষা হতে যাচ্ছে, পাকিস্তানেও তেমনিই উর্দু রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত।”

সঙ্গে সঙ্গে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এসেছিল এবং বাংলার জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ‘দৈনিক আজাদে’ এক প্রবন্ধে বলেন,

“অধিকাংশ জনসংখ্যার ভাষা হিসেবে বাংলাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত।”

বস্তুত ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দেখা যায়, পাকিস্তানের কেনো অঞ্চলের মানুষেরই মাতৃভাষা উর্দু নয়। পাকিস্তান জন্মের মাত্র তিন মাসের মধ্যেই ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে করাচি শিক্ষা সম্মেলনে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের উদ্যোগে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার একটি প্রস্তাব পাস করে নেওয়া হয়েছিল। এর প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সুদূরপ্রসারী।

সে বছর ৬ই ডিসেম্বর ১৯৪৭ ঢাকার রাজপথে তৎকালীন পূর্ববাংলার ছাত্রসমাজ এর বিরুদ্ধে তীব্র বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ২৩ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের গণপরিষদের আইনবিধি সংক্রান্ত কমিটির বৈঠকে ‘ইংরেজি’ ভাষার পাশাপাশি ‘উর্দু’ ভাষার নাম সংযুক্তির চেষ্টা করা হলে বাঙালি সংসদ সদস্য শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তার সাথে ‘বাংলা’ সংযুক্তির দাবি জানালে পাকিস্তানে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়।

১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ থেকে ১৫ই মার্চ পর্যন্ত লাগাতার সংগ্রামের ফসল হিসেবে পূর্ব বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ছাত্রদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন এবং রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার মর্যাদার প্রশ্নটি মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্ণর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ২১—এ মার্চ রেসকোর্সের জনসভায় বলেন,

“But let me make it very clear to you that the state Language of Pakistan is going to be Urdu and no other language. Any one who tries to mislead you is really the enemy of Pakistan.”

এবং ২৪ মার্চে কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বলে ঘোষণা দেন। সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র – জনতার মধ্যে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে এবং তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে খাজা নাজিমুদ্দিন মুসলিম লীগের এক জনসভার ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন,

“একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।”

এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফুসে উঠেছিল বাঙালি। পূর্ব বাংলায় শুরু হয়েছিল মহান ভাষা আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন নিরস্ত্র বাঙালি ছাত্র জনতার শান্তির মিছিলে গুলি চালায়। নিহত হয় সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারাহ আরো অনেকে। সে বছর একুশে ফেব্রুয়ারি বুকের রক্ত দিয়ে ছাত্রসমাজ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা ও স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছিল।

আজ বিস্মিত হতে হয় সেই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তৎকালীন বাঙালি মানসের চেতনার পরিপক্বতা দেখে। ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বরে ইউনেস্কো যে চেতনায় প্রস্তাবনা পাস করেছে, ১৯৫২ সালে তৎকালীন ভাষা সংগ্রামীরা সেই প্রেরণাকেই নাগরিকদের সামনে তুলে ধরেছিলেন। আর এটা হলো— সকল মাতৃভাষার মর্যাদা ও স্বীকৃতি।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস : বাংলা ভাষা আজ আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত ভাষা। একুশে ফেব্রুয়ারি আজ সমগ্র বিশ্বের বিভিন্ন মানুষদের নিজ ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। একুশে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ইউনেস্কোর সাধারণ পরিষদের ৩০ তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত হয়। ইউনেস্কোর ঘোষণা বলা হয়,

21st February is proclaimed International Mother Language Day throughout the world to commemorate the martyrs who sacrificed their lives on this day in 1952.

সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য বিষয় হলো— সাক্ষরিত আটাশটি দেশের মধ্যে পাকিস্তানও আছে। যে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরোধিতায় ঢাকার রাজপথ বাংলার সংশপ্তকদের রক্তে রঞ্জিত করেছিল, যা সত্যিকার অর্থে বাঙালির নৈতিক বিজয়।

যে দুইজন বাঙালি ভিনদেশি মাটিতে অবস্থান করে মাতৃভাষার এ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভের ক্ষেত্রে প্রথম উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন তাঁদের নাম রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে ৫২–র ভাষা আন্দোলনে নিহত সংশপ্তকদের নামের সাথে এদের আশ্চর্যরকম মিল। আর এভাবেই সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বহু বিবর্তনের মাধ্যমে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আজ সত্যিই অমরত্ব লাভ করেছে। আমরা গর্ব করি ৫২ সালের শহীদদের নিয়ে। এর পাশাপাশি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি এ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির ক্ষেত্রে যাদের অবদান রয়েছে।

বাংলা ভাষার প্রতি অবহেলা : বাংলা ভাষার প্রতি অনেক আগে থেকেই অবহেলা চলে আসছে। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও বাংলাকে অবহেলা করে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা করা হয়। কিন্তু বাংলার সচেতন মানুষ এ ঘোষণা মেনে নিতে পারেনি। তাদের সোচ্চার প্রতিবাদী কণ্ঠে সারা বাংলা জেগে ওঠে।

বাংলা ভাষার আন্দোলন : মূলত ১৯৪৮ সাল থেকেই বাংলা ভাষার আন্দোলন শুরু হয়। ধীরে ধীরে এ আন্দোলন সারা বাংলাদেশে তথা পূর্ব পাকিস্তানে ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্ররা এ আন্দোলনের সূত্রপাত করলেও ধীরে ধীরে সাধারণ জনগন এটাতে জড়িয়ে পড়ে এবং এই আন্দোলনকে সমর্থন জানায়। সরকার যতই ভাষা আন্দোলনের প্রতি দমননীতি চালায়, ততই আন্দোলন প্রকট হতে থাকে।

একুশে ফেব্রুয়ারি : ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবিতে ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে সভা–সমিতি ও মিছিল নিষিদ্ধ করে স্বৈরাচারী শাসক সরকার। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মিছিল বের করে। তারা সরকারের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। কিন্তু স্বৈরাচারী শাসক তাদের প্রতিহত করার জন্য মেডিকেল কলেজের সামনে মিছিলে বেপরোয়া গুলিবর্ষণ শুরু করে। আর এর ফলে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরো অনেক ছাত্র প্রাণ হারায়। যা পরবর্তীতে বাঙালির নবজাগরণকে আরো বেগবান ও কার্যকর করে।

রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি :
মোদের গরব মোদের আশা
আ—মরি বাংলা ভাষা।
— অতুল প্রসাদ সেন

কবিতার এ ছত্রেই লুকিয়ে আছে নিজের ভাষা নিজের করে নেওয়ার।মায়ের মুখে শেখা বুলি মায়ের কাছে ব্যক্ত করার। তাইতো ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি জঘন্য হত্যাকান্ডের খবর দ্রুত সারা বাংলদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এ খবরে সারা দেশের জনগন বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এরই ফলে পাকিস্তানি সরকার ১৯৫৬ সালের সংবিধানে বাংলাকে স্বীকৃতি দেয়।

শহীদ দিবস : ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির বর্বর হত্যাকান্ডের স্মৃতি স্মরণ করার জন্য প্রতি বছর ভাবগম্ভীর পরিবেশে শহীদ দিবস পালন করা হয়। কিন্তু শহীদ পালনের মধ্যেই একুশে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্য সীমাবদ্ধ থাকে না। তা বাঙালি জাতির জীবনের সব ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে।

পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ : বায়ান্নর ২১ শে ফেব্রুয়ারির নির্মম হত্যাকান্ডে বাংলাদেশে সুদূরপ্রসারী এক প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের মানুষ এই ঘটনার পর থেকে নিজের ন্যায্য অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে শিখে এবং অধিকার আদায়ের জন্য তৎপর হতে শেখে। ৫২–র ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে আমাদের নিরঙ্কুশ বিজয়, ৬৯–র গণঅভ্যুত্থান এবং সর্বশেষ ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের চূড়ান্ত বিজয় নিশ্চিত হয়। আজ আমরা যে স্বাধীন বাংলাদেশে বসবাস করছি, তার পেছনে রয়েছে ভাষা আন্দোলনের চেতনা।

একুশের প্রভাব : বাংলাদেশের মানুষের জীবনের সব ক্ষেত্রেই একুশের প্রভাব লক্ষ করা যায়। একুশে ফেব্রুয়ারির আত্নত্যাগ থেকে আমরা যে চেতনা লাভ করেছি, তা পরবর্তীতে সকল আন্দোলনের প্রেরণা হিসেবে কাজ করে। একুশের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সমগ্র জাতি একতাবদ্ধ হতে শিখেছে। তাদের ভিতরে দেশপ্রেমের উন্মেষ ঘটেছে একুশের পর থেকে। একুশের চেতনা থেকে অত্যাচার শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার শক্তি ও প্রেরণা লাভ করেছে গোটা জাতি।

বর্তমানের একুশ : প্রতি বছর অত্যন্ত ভাবগম্ভীর পরিবেশের ভেতর দিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করা হয়। নতুন নতুন চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে জাতীয় জীবনে দেখা দেয় একুশে ফেব্রুয়ারি। এখন সারা বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে শহীদ মিনার তৈরি হয়েছে। আগের চেয়ে মানুষ এখন একুশে ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে বেশি সচেতন হয়েছে। বর্তমানে একুশ নিয়ে অনেক অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা আয়োজন করা হয়ে থাকে। এসব কিছুর মূলে থাকে একুশের স্মৃতিচারণ নতুন করে একুশের চেতনায় উদ্দীপ্ত হওয়া।

একুশের চেতনা : এই মহান একুশের আছে এক অবিনাশী চেতনা। এই একুশে ফেব্রুয়ারি দিয়েই আমরা আপন সত্তা আবিষ্কার করতে পেরেছি। আমরা এর মাধ্যমে পেয়েছি স্বাধিকার অর্জনের প্রেরণা। কিন্তু এই প্রেরণা এবং চেতনাকে ধ্বংস করার জন্য সাম্প্রদায়িক শাসকগোষ্ঠী ষড়যন্ত্র করতে থাকে। এরই ফলে অনেক শহীদ মিনার ভেঙে ফেলা হয়। এত কিছুর পরেও কেউ এই একুশের চেতনাকে ধ্বংস করতে পারে নি। বাঙালি জাতির মনের ভিতর এই চেতনা গ্রথিত আছে। মহান একুশের চেতনা ও প্রভাব নিয়ে অনেক কবি সাহিত্যিক অনেক সাহিত্য রচনা করেছেন। একুশের চেতনাকে কাজে লাগিয়ে তাই শামসুর রাহমান রচিত ' বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা ' নামক কবিতার দুটি চরণ না বললেই নয়—

“তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে কী থাকে আমার?
উনিশ শো' বাহান্নোর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি
বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী।”

অমর একুশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও তাৎপর্য : বাঙালির ইতিহাসে অসংখ্য উজ্জ্বল মাইলফলক আছে, যা অর্জনের সমৃদ্ধতায় উজ্জ্বল। এমনই একটি মাইলফলক নিঃসন্দেহে ১৭ই নভেম্বর ১৯৯৯। ইউনেস্কোর সিদ্ধান্তে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ২১ শে ফেব্রুয়ারির স্বীকৃতি বাঙালির জন্যে এ উজ্জ্বল মাইলফলকের সূচক। এ সিদ্ধান্তের দুটো দিক বিশেষভাবে বিবেচ্য—

(১) আন্তর্জাতিক
(২) আমাদের ক্ষেত্রে দৈশিক।

প্রথমত এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বিশ্বের প্রায় ৪ হাজারেরও বেশি ভাষাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত ২১ শে ফেব্রুয়ারি শুধু বাংলাদেশের বাঙালির সম্পদ — অব্যয় — অক্ষয় সম্পদ।

অমর একুশের মধ্যে নিহিত বাঙালির ভাষাভিক্তিক স্বাতন্ত্র্যের বীজ। সুতরাং অমর একুশকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে বাঙালির প্রতীকী বিজয় হয়েছে। ভাষা শহীদদের আত্মদানের আন্তজার্তিক স্বীকৃতি মিলেছে। হাজার বছরের বাঙালির জন্যে, তাদের মাতৃভাষা বাংলার জন্য অন্য আর কী বড় অর্জন হতে পারে! ইউনেস্কোর স্বীকৃতির মাধ্যমে অমর একুশে এখন বিশ্বে তাৎপর্যপূর্ণ প্রতীক — যা বাঙালির গর্ব আর অহংকারের দ্যোতক।

২১ শে ফেব্রুয়ারির আন্তজার্তিক স্বীকৃতি লাভ বাঙালি জাতির জন্য এক বিরাট গৌরব। সারা বিশ্বের মানুষ বাংলাদেশ নামে একটি দেশের কথা, বাঙালও জাতি ও ভাষার কথা জানতে পারছে। ভাষার আগ্রাসাসনের বিরুদ্ধে আন্তজার্তিক মাতৃভাষা দিবস এক বিরাট ভূমিকা পালন করে থাকবে। এ দিবসের তাৎপর্য উল্লেখ করে বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী হুমায়ুন আজাদ বলেন—

‘আমি মুগ্ধ, আমি প্রীত, আমাকে
স্বীকৃতি দিয়েছে, আমার প্রাণের
কথা আমার ভাষায় জানতে পারব
বলে আমার হৃদয় স্পন্দন বেড়েছে,
সত্যি গর্বিত আমি।’

এ দিবসটির প্রায়োগিকতা তিনটি। যেমন :

(১) বাঙালি আত্মবিকাশে বিশ্বময় সহায়তাপ্রাপ্ত হবে।
(২) বাঙালির জাতিসত্তা ফুটে উঠবে।
(৩) জ্ঞান–বিজ্ঞানের জগতে ফুটে উঠবে বাঙালির অবিস্মরনীয় অবদান।


মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা : ইউনেস্কো ২০০০ সাল থেকে বিশ্বে আন্তজার্তিক মাতৃভাষা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। এরই প্রেক্ষিতে সদস্য দেশগুলোর কাছে তারিখ নির্ণয়ের সুপারিশ চাওয়া হয়। বাংলাদেশও দিবসটি পালনের জন্য একুশে ফেব্রুয়ারির গৌরবগাথা বা তাৎপর্য তুলে ধরে। মাতৃভাষার জন্য জীবন দিয়েছে, রক্ত দিয়েছে, একমাত্র বাঙালিরা। তাই ইউনেস্কো এই আত্মত্যাগের বিষয়টিকে সম্মান জানিয়েই একুশে ফেব্রুয়ারি কে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

সাহিত্য ক্ষেত্রে একুশের অবদান : একুশ শুধু আমাদের অধিকার সচেতন করে তোলেনি, এর পাশাপাশি আমাদের সাহিত্যের অনেক ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে। আমাদের জাতীয় জীবনের চেতনার প্রতিফলন সাহিত্যক্ষেত্রেও ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যায়। আমাদের কথাসাহিত্য, নাটক, ছোটগল্প, কবিতা কিংবা সংগীতে একুশের চেতনাকে তুলে ধরা হয়েছে। ২১ শে ফেব্রুয়ারি বাংলার দামাল ছেলেরা জীবন দিয়ে যে প্রতিবাদ শুরু করেছিল, সেটা সাহিত্যের মাধ্যমে সক্রিয় করে রেখেছে কবি সাহিত্যিকরা। একুশ আমাদের প্রেরণা, আমাদের বিশ্বাসরে রঙে রঙিন। বাঙালির চেতনার উৎসমূলে শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে লেগেছে একুশের রং মুক্তির রং। কথা সাহিত্য নাটক কবিতা ও সংগীতে একুশ কথা বলে। আমাদের তরুণেরা রক্তের যে অঞ্জলি দিয়েছে ৫২ তে ভাষার জন্যে সেই রক্তগঙ্গায় স্নাত হয়ে কাব্যলক্ষ্মী দিয়েছে বর। অসংখ্য এই সাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম— সিকানদার আবু জাফর, মুনীর চৌধুরী, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আবুল ফজল, শামসুর রাহমান সব আরো অনেকে একুশের চেতনায় মুখর হন। কবহ আবু জাফর ওবায়েদুল্লাহর ভাবনায় —

“চিঠিটা তার পকেটি ছিল
ছেড়া আর রক্তে ভেজা।”

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রথম আনন্দ — উৎসব : মহান ২১ শে ফেব্রুয়ারি আন্তজার্তিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পাওয়ায় সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ১৯৯৯ সালের ৭ই ডিসেম্বর উৎসবের আয়োজন করে। ২০০০ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে এ উৎসবটি পালিত হয়। দিনভর রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে আয়োজিত হয় আনন্দ শোভাযাত্রা — একুশ আমার অহংকার, একুশ পৃথিবীর অলংকার ইত্যাদি স্লোগানে দিগ্বিদিক হয় মুখরিত। আলোচনা নাচ গান, আবৃত্তি ইত্যাদি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয় এ অনুষ্ঠানে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে সুবীর নন্দীর গানের মাধ্যমে মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়। এরপর আলোচনা সভা শেষে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আনন্দ মিছিল বের হয় এবং ১১:১৫ মিনিটে তিনি শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পন করেন। সন্ধ্যায় পল্টন ময়দানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে শেষ হয় এই আনন্দ উৎসবের।

আন্তজার্তিক মাতৃভাষা দিবস সংস্কৃতির সেতুবন্ধন : আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটিকে বিশ্বের প্রায় ১৮৮ টি দেশ প্রতিবছর পালন করে। ফলে তারা বাংলাদেশের ভাষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য এবং সভ্যতাকে জানতে আগ্রহী হচ্ছে। বাংলার বিখ্যাত সব কবি সাহিত্যিক এবং তাদের সৃষ্টি সম্পর্কে জানছে। বিশ্বের দরবারে বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি একটি বিশিষ্ট স্থান লাভ করছে। বিশ্ব জানতে পারছে, বাঙালিই প্রথম এবং একমাত্র জাতি যারা ভাষার জন্য প্রাণ দিতে কুণ্ঠিত হয়নি। মে দিবসে বিশ্ববাসী যেমন শিকাগোর শ্রমিকদের এবং তাদের আন্দোলনকে স্মরণ করে তেমনি এ দিনে বিশ্ব বাংলার ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। ফলে আমাদের মাতৃভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার সঙ্গে বিশ্ববাসীর সেতুবন্ধন তৈরি হচ্ছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন ও বাংলাদেশের গুরুত্ব : এখন শুধু আমরা বাঙালিরা শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে সম্মান জানানোর জন্য শহীদ মিনারে যাই না। এখন পুরো বিশ্বের বিভিন্ন স্তরের মানুষ শহীদ মিনারে ছুটে যায় শহীদদের সম্মান জানানোর জন্যে। তাই একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি মাতৃভাষা রক্ষার প্রতীক হয়েছে। বিশ্ববাসী এখন বাংলাদেশকে শ্রদ্ধা করে, সম্মান করে আমাদের মাতৃভাষাপ্রীতির কারণে।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়— একুশ আজ বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেয়েছে। এ দুর্লভ অর্জন যেমন আনন্দের, তেমনই এ দিবসের দর্শন তথা মর্মবাণী বা চেতনা বাস্তবায়নে আমাদের এখনও অনেক কর্তব্য রয়েছে। এতে শুধু আত্মতৃপ্তির অবকাশ নেই। আমাদেরও উদ্যোগ নিতে হবে আমাদের প্রাণপ্রিয় ভাষা, সংস্কৃতিকে রক্ষা এবং সমৃদ্ধ করার জন্য। সর্বস্তরে বাংলা শুদ্ধভাবে এখনও প্রচলন হয়নি। এটিকে কেবল জাতীয় পর্যায়েই নয়, আন্তজার্তিক প্রেক্ষাপটেও নজর দেওয়া আশু প্রয়োজন। তাহলেই অমর একুশে ফেব্রুয়ারির সেই আত্মত্যাগ সার্থক হবে এবং শেষকালে সেই মহান বাংলার ছেলেদের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা এবং প্রাণপন ভালোবাসা ও অশ্রুশিক্ত নয়নে জানাতে চাই—

ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু ঝরা এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি।



2 Comments

Post a Comment
Previous Post Next Post