রচনা : বয়স্কাউট : বালকসেনা

ভূমিকা : এ পৃথিবী আসলে একটি সংগ্রামক্ষেত্র। এখানে টিকে থাকতে হলে প্রতিনিয়ত সংগ্রামের মাধ্যমেই জীবন পরিচালনা করতে হয়। এজন্যই আমরা লক্ষ্য করতে পারি যে, পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ নিজ নিজ কাজে সর্বদা ব্যস্ত। অপরের সুখ-দুঃখের কথা ভাববার, অপরের মঙ্গল-অমঙ্গলের ব্যাপারে চিন্তা করার কারও কোন সময় নেই। সুতরাং, আত্মচিন্তা ও আত্মসুখ বিসর্জন দিয়ে পরের মঙ্গল সাধন করা খুব সহজ ব্যাপার নয়। আর এ ‘কঠিন কাজটিই বয়স্কাউটকে নীতিগতভাবে ব্রত হিসাবে গহণ করতে হয়। বয়স্কাউট বা বালকসেনারা বয়সে নেহায়েত কচি; তাদের মন অত্যন্ত কোমল। তাদের সুকুমার বৃত্তিগুলো অত্যন্ত পবিত্র ও স্পর্শকাতর। সংসারের পঙ্কিলতা, ক্লেদ ও গ্লানি তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না বলেই তারা সহজেই পরার্থে আত্মনিয়োগ করতে পারে। 

বয়স্কাউট আন্দোলনের গোড়ার কথা : ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ মেফেকিং অবরোধের সময় এক ভীষণ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ইতিহাসে এ যুদ্ধ ‘বুয়র যুদ্ধ’ নামে খ্যাত। বুয়র যুদ্ধে অন্যতম সেনানায়ক স্যার ব্যাডেন পাওয়েল যুদ্ধের সময় এক দুর্গ হতে অন্য দুর্গে সংবাদ আদান-প্রদানের জন্য বালকদের একটি স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করেন। তারা সংবাদ আদান-প্রদান ছাড়াও রুগ্ন ও আহতদের যুদ্ধ ক্ষেত্র হতে তুলে এনে সেবা শুশ্রুষা করত। এভাবেই বয়স্কাউট আন্দোলনের প্রথম সূত্রপাত হয়। যুদ্ধ শেষে এই স্বেচ্ছাসেবক দলের বালকেরা তাদের গৌরবোজ্জ্বল অবদানের জন্য পুরস্কৃত হয়। পরবর্তীকালে স্যার পাওয়েল মনে করলেন যুদ্ধক্ষেত্রে কাজ করার মত শান্তির সময়ও এরূপ স্বেচ্ছাসেবক দল আর্ত-পীড়িত ও মানবতার সেবায় বিরাট অবদান রাখতে পারে। সুতরাং, যুদ্ধশেষে তিনি স্বেচ্ছাসেবক দলটি ভেঙ্গে না দিয়ে তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে মানবতার সেবায় উদ্বুদ্ধ করে তোলেন। আর্ত-পীড়িত ও মানবতার সেবা ও দেশের কল্যাণে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে এদের বলিষ্ঠ ও কার্যকর অবদান লক্ষ্য করে দ্রুত এর প্রসার ঘটতে থাকে। এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বয়স্কাউট আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। 

বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই বয়স্কাউট দল আছে। ১৯১৬ সালে সর্বপ্রথম ডাক্তার মল্লিক ও এ্যানিবেসান্ত অবিভক্ত ভারতবর্ষে স্কাউট দল গঠন করেন। বর্তমানে আমাদের বাংলাদেশের প্রায় সব মাধ্যমিক বিদ্যালয়েই স্কাউট দল আছে। ঢাকায় জাতীয় স্কাউট সদর দফতর অবস্থিত। এছাড়া প্রত্যেক বিভাগীয় হেড কোয়ার্টারে আঞ্চলিক স্কাউট দফতর ও প্রত্যেক থানায় থানায় স্কাউট অফিস রয়েছে। 

বয়স্কাউটদের কর্তব্য : স্কাউট আন্দোলন সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক একটি সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান আর্ত-পীড়িত ও দুস্থ মানবতার সেবা ও জাতির কল্যাণ সাধনই স্কাউট জীবনের ব্রত। বস্তুত বয়স্কাউট বলতে এরূপ একটি বালক দলকে বুঝায় যারা মানব সমাজের যে কোন প্রকার সাহায্যের জন্য সদা প্রস্তুত থাকে। যে কোন মানুষ যে কোনভাবে বিপদগ্রস্ত হোক না কেন, তাকে তাৎক্ষণিক সাহায্য করাই বয়স্কাউটের কাজ। রাস্তাঘাটে বিপদ-আপদ দুর্ঘটনার মুহূর্তে, অগ্নিকাণ্ড, বন্যা, ঘুর্ণিঝড় বা অন্য যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় বয়স্কাউট দল তাদের সাধ্যানুসারে বিপদগ্রস্ত লোকদের সাহায্যার্থে এগিয়ে যায়। বর্তমানে বালকেরাই শুধু বয়স্কাউট আন্দোলনে যোগ দিচ্ছে তা নয়, দেশের বালিকারাও এ মহান ব্রতে দীক্ষা গ্রহণ করতে যাচ্ছে। বাংলাদেশে বহু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গার্ল গাইডস দল রয়েছে। 

স্কাউট আন্দোলনের দীক্ষা : প্রত্যেক স্কাউট ও গাইডকে ভর্তি হবার সময় নিম্নরূপ শপত করতে হয় :
“আমি স্রষ্টা, স্বদেশ, জনসাধারণ, দেশ-নেতৃবৃন্দ ও শাসন কর্তৃপক্ষকে মেনে চলব এবং তাদের প্রতি সর্বদা আমার যথাযথ বর্তব্য পালন করব।” 
১. স্কাউট সর্বদা বিশ্বস্ত হবে। 
২. পিতামাতা, শিক্ষক, দলনেতার আজ্ঞানুবর্তী ও দেশসেবক হবে। 
৩. প্রত্যেক স্কাউট অপর স্কাউটের বন্ধু ও সহায়ক হবে। 
৪. স্কাউট সর্বদা প্রফুল্ল, মিতব্যয়ী, সাহসী, নিয়মানুবর্তী, সময়ানুবর্তী ও পরিচ্ছন্ন হবে। 
৫. স্কাউট পরোপকারে সদা প্রস্তুত ও সর্বজীবে দয়ালু হবে। 

স্কাউট দল গঠন ও প্রশিক্ষণ : প্রথমত পাঁচজন স্কাউট নিয়ে একটি প্যাট্রল গঠন করা হয়। কমপক্ষে চারটি প্যাট্রল নিয়ে একটি বয়স্কাউট দল গঠন করা হয়। প্রত্যেক দল একজন স্কাউট শিক্ষকের নিয়ন্ত্রণে থাকে। স্কাউট শিক্ষককে ‘স্কাউট লীডার’ বলা হয়। প্রত্যেক স্কাউটকেই নিয়মিত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে নিজেকে দেশ সেবার যোগ্য করে গড়ে তুলতে হয়। সপ্তাহে এক বা দু’দিন বিদ্যালয় মাঠে বা অন্য কোন উন্মুক্ত স্থানে নানা প্রকার খোলাধুলা, ব্যায়াম, শরীর চর্চা, আর্তের সেবা, পথঘাট পরিষ্কার, সংবাদ আদান-প্রদান, গ্রন্থি বন্ধন, প্রাথমিক চিকিৎসা, রান্না ইত্যাদি অনেক কলাকৌশল আয়ত্ত করতে হয়। প্রশিকা শিক্ষায় উত্তীর্ণ স্কাউটকে ‘টেন্ডার ফুট’ বা ‘কচি কদম’ বলা হয় এবং ব্যাজ প্রদান করা হয়। প্রশিক্ষণে উৎকর্ষতা অনুসারে প্রত্যেক স্কাউট এরূপে ধাপে ধাপে দ্বিতীয় কদম, দৃপ্ত কদম বা প্রথম শ্রেণী এবং প্রেসিডেন্ট স্কাউট ব্যাজ পর্যন্ত অর্জন করতে পারে। প্রেসিডেন্ট স্কাউট হওয়া অত্যন্ত গৌরব ও সম্মানের ব্যাপার। 

স্কাউট আন্দোলনের সুফল : স্কাউট আন্দোলনে দীক্ষা গ্রহণ দেশের কিশোর ও তরুণদের আদর্শ জীবন গঠনে খুবই কল্যাণকর। এর মাধ্যমে শুধু শারীরিক শিক্ষা ও দৈহিক স্বাস্থ্যই ভাল হয় না বরং দেশপ্রেম, মানবপ্রেম এবং নৈতিক শিক্ষা অর্জিত হয়। স্কাউট আন্দোলনে যোগদান করে ছাত্ররা ধীরস্থির, চরিত্রবান, মিতাচারী, সংযমী, সময়নিষ্ঠ ও আজ্ঞানুবর্তী হিসাবে গড়ে উঠে। এছাড়া তাঁদের শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি এবং প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব বৃদ্ধি পায়। পরোপকার, সেবা মনোবৃত্তি ও সাহসিকতা অর্জনে স্কাউট আন্দোলন যথেষ্ট সহায়তা করে। এছাড়া সময়ে সময়ে আঞ্চলিক, জাতীয়, বিভিন্ন মহাদেশীয় ও বিশ্ব স্কাউট র‌্যালী ও জাম্বুরিতে স্কাউটগণ অংশগ্রহণ করে পরস্পরকে জানতে ও বুঝতে চেষ্টা করে। এতে পরস্পরের মধ্যে সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত হয়। 

উপসংহার : বয়স্কাউট একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। ভোগে নয় ত্যাগ ও কর্ম সম্পাদনেই মুক্তি- এ শাশ্বত স্কাউটদের জীবনের ব্রত বলে তারা ব্যাষ্টির ক্ষুদ্র গণ্ডি হতে সমষ্টির অসীমে মিলনের সুযোগ পায়। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ লাভ করে স্কাউটরা শুধু দেশের আদর্শ নাগরিক হিসাবেই গড়ে উঠে না, বরং তারা সচেতন বিশ্ব নাগরিক। সুতরাং, যে দেশে স্কাউট আন্দোলন যত বেশি জোরদার, সে দেশের ভবিষ্যৎ কল্যাণের সম্ভাবনা তত বেশি।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post