মার্চের দিনগুলি

রচনা : নৈতিক মূল্যবোধ

↬ নৈতিক অবক্ষয় ও মূল্যবোধ


ভূমিকা : মানুষের জীবনবোধের সঙ্গে নৈতিকতার একটি অবিচ্ছেদ্য ও গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। কারণ মানুষ প্রাণীজগতের সদস্য হলেও পশু নয়। মানুষের সাধনা মনুষ্যত্ব অর্জনের সাধনা। সেই সাধনার লক্ষ্য এমন কিছু বিশেষ গুণাবলি অর্জন যা মানুষকে ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত বিচার করার শক্তি দেয় এবং মন্দ, অন্যায় ও অনুচিত কাজকে পরিহার করে নৈতিক আদর্শের অনুবর্তী করে তোলে। এই নৈতিক মূল্যবোধের আশ্রয়েই গড়ে উঠেছে মানব সমাজ। মানুষের জীবনের ভালো-মন্দ, উৎকর্ষ-অপকর্ষ বিচারের মানদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে নৈতিক মূল্যবোধ।

নৈতিক মূল্যবোধের স্বরূপ ও গুরুত্ব : নৈতিক মূল্যবোধ মানুষের জীবনে অনুসরণযোগ্য এমন কিছু আচরণ বিধি, যা মানুষের জীবনব্যবস্থা ও জীবনপদ্ধতিকে করে তোলে সুন্দর, নির্মল ও রুচি স্নিগ্ধ। নৈতিকতা মানুষকে অন্যায়ের পতন-বন্ধুর পথের বিপদ থেকে বাঁচায়। স্বার্থপরতার প্রলুব্ধ কর আকর্ষণ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে আত্ম ত্যাগের মহামন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করে। নৈতিক মূল্যবোধ মানুষকে দেয় প্রবল ও দৃঢ় মানসিক শক্তি যার বলে মানুষ যাবতীয় দুর্নীতিকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করতে শেখে, অন্যায় ও অবৈধ পন্থা অবলম্বন সচেতনভাবে পরিহার করতে শেখে।

নৈতিক মূল্যবোধ মানব চরিত্রকে করে তোলে সুষমামণ্ডিত। ধর্মের কল্যাণধর্মী মর্মবাণী অনুসরণ করা, মিথ্যাকে কায়মনোবাক্যে পরিহার করা, সত্য ও ন্যায়ের আদর্শে পরিচালিত হওয়া, সজ্ঞানে অন্যের ক্ষতি না করা, পরহিতব্রতে যথাসম্ভব নিজেকে সমর্পণ করা -এসবের মাধ্যমেই মানুষের জীবনে নৈতিক মূল্যবোধের উজ্জ্বল প্রকাশ ঘটে। নৈতিক মূল্যবোধে আলোকিত মানুষ সমাজে যতই বাড়ে ততই সমাজজীবন হয়ে ওঠে নিষ্কলুষ ও সৌন্দর্যবিভামণ্ডিত। তাই মানুষের আত্মিক সামাজিক উৎকর্ষের জন্যে এবং জাতীয় জীবনে উন্নয়ন ও অগ্রগতি নিশ্চিত করার জন্যে সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের লালন, চর্চা ও বিকাশের বিশেষ গুরুত্ব আছে। এই কারণে শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্যই হচ্ছে মানবচিত্তে নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ গড়ে তোলা।

মূল্যবোধের অবক্ষয় : দুঃখের বিষয় মানব সভ্যতা যখন একুশ শতকের দ্বার প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে তখন মানুষ মূল্যবোধের সংকটে পীড়িত। বিশ্বে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য-লালসা ও পরিভোগ-প্রবণতা মানুষকে লোভী ও স্বার্থান্বেয়ী করে তুলছে। মানবধ্বংসী মরণাস্ত্রের বিস্তার বিজ্ঞানের অনৈতিক ব্যবহারেরই মারাত্মক ফল। দুনিয়াজোড়া মাদক ব্যবসা, গণমাধ্যম করায়ত্ত করে স্থূল ভোগবাদী অপসংস্কৃতির প্রচারণা, হলুদ সাংবাদিকতা ইত্যাদি নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়েরই বহঃপ্রকাশ।

আমাদের দেশেও নৈতিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে ব্যাপক অবক্ষয়ের লক্ষণ আজ প্রকট। সীমাহীন দুর্নীতি সর্বস্তরে গ্রাস করেছে সমাজজীবনকে। নীতিহীন, বিবেকহীন মানুষ সদম্ভে সমাজে বিচরণ করছে এবং ন্যায়নীতির কণ্ঠরোধ করার জন্যে তারা উঠে-পড়ে লেগেছে। অন্যায় ও অবৈধ পন্থায় বিত্তের পাহাড় গড়ছে লুটেরা ধনীরা। তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সমাজ জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও। এখন সমাজে অবৈধ পন্থায় ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ, প্রতিপত্তি, ভোট আদায়ের এক অনভিপ্রেত অস্থির প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এর জন্যে বল প্রয়োগও হয়ে গেছে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। ফলে নৈতিক অবক্ষয় সংক্রমক ভাইরাসের মতো সমাজ জীবনের সর্বত্র বিস্তৃত হয়ে পড়েছে। এমন কি শিক্ষাঙ্গনে, চিকিৎসা সেবায়, বিচার ব্যবস্থায় পর্যন্ত দুর্নীতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ও রাষ্ট্রীয় জীবনে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ঘটেছে ব্যাপক বিস্তার। মূল্যবোধের এই অবক্ষয় এখন বিবেকবান সব লোককেই গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলেছে।

মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণ : মূল্যবোধের এই অবক্ষয়ের কারণ কী? কোনো একক কারণে যে মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে তা নয়। জাতীয় জীবনে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত না হওয়া, রাষ্ট্রীয় জীবনে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ব্যর্থতার রেশ, অর্থনৈতিক জীবনে দারিদ্র্য ও পরিভোগ প্রবণতার ব্যাপক মেরুকরণ, শিক্ষিত সমাজে বিপুল বেকারত্ব, গণমাধ্যমে স্থূল রুচিহীন ও বিকৃত রুচির বিনোদনের ব্যবস্থা, জনজীবনে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, খুন, জখম, ছিনতাই ইত্যাদির অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার -এমন নানা কারণ ও নানা লক্ষণ আজ মূল্যবোধের অবক্ষয়কে ঘিরে প্রকট হয়ে উঠছে।

অবক্ষয় রোধে পদক্ষেপ : এই নেতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়রোধ করা এখন আমাদের সামনে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় কর্তব্য হসেবে উপস্থিত। এই অবক্ষয় রোধে প্রথম ও প্রধন গুরুত্ব পরিবারের। পাশাপাশি রাষ্ট্র ও সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক অঙ্গনে নৈরাজ্যের অবসান ঘটিয়ে সমঝোতার পরিস্থিতি সৃষ্টি, সমাজ জীবনে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা, শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিক মূল্যবোধকে বিশেষ গুরুত্ব দান, নীতিবোধ সম্পন্ন দক্ষ জনপ্রশাসন গড়ে তোলা ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং তা আন্তরিকভাবে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়ে আমাদের অগ্রসর হতে হবে।

উপসংহার : আমাদের সামনে আজ একুশ শতকের পথচলা। নতুন শতকে আমাদের জীবন যেন সুন্দর ও মানবিক মূল্যবোধে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে সেজন্যে সবার আগে নজর দিতে হবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ওপর। শিক্ষার্থীদের সামনে রাখা চাই নৈতিক মূল্যবোধের আদর্শ। সত্য ন্যায় ও সুন্দরের প্রতি জাগাতে হবে তাদের ভালোবাসা। নৈতিক মূল্যবোধের পুনঃপ্রতিষ্ঠায় এখন আমাদের সবাইকে হবে হবে সচেতন, উদ্যোগী ও সক্রিয়। এর জন্যে প্রয়োজনে গড়ে তুলতে হবে ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন। তা না হলে নৈতিক অধোগতির যে পিছুটান আমাদের জাপটে ধরেছে তার হাত থেকে আমরা নিস্তার পাব না।

1 Comments

  1. একটা বই বার করেন, খুব ভাল হবে। ধন্নবাদ

    ReplyDelete
Post a Comment
Previous Post Next Post