তথ্যকোষ : বাংলা নববর্ষ উৎস ও ক্রমবিকাশ

উৎপত্তি

বাংলা সনের প্রবর্তন করেন মুঘল সম্রাট জালালউদ্দিন মোহাম্মদ আকবর। তিনি খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য তার সভার জ্যােতির্বিদ সিরাজীর সহযোগিতায় ১৫৮৪ সালে তারিখ-এ-এলাহি নামে নতুন একটি বছর গনণা পদ্ধতি চালু করেন। ঐ সময়ে প্রচলিত রাজকীয় সন ছিল 'হিজরি সন' যা চন্দ্রসন হওয়ায় প্রতি বছর একই মাসে খাজনা আদায় সম্ভব হতো না। বাংলা সন শূন্য থেকে শুরু হয়নি, যে বছর বাংলা সন প্রবর্তন করা হয়, সে বছর হিজরি সন ছিল ৯২৩। সে অনুযায়ী সম্রাটের নির্দেশে প্রবর্তনের বছরই ৯২৩ সালে যাত্রা শুরু হয় বাংলা সনের। এ ব্যাপারে ১০মার্চ মতান্তরে ১১মার্চ ১৫৮৪ সম্রাটের নির্দেশনামা জারি হয়। তবে এর কার্যকারিতা দেখানো হয় ১৫৫৬ সাল থেকে। কারণ ঐ সালটি ছিল সম্রাটের সিংহাসনে আরোহণের বছর।

ফসলি সন থেকে বাংলা সন

সম্রাট আকবরের নির্দেশে প্রচলিত হিজরি সনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজী উদ্ভাবন করেন 'ফসলি সন বা বাংলা সন'। ফসলের মওসুমের কথা বিবেচনায় রেখে এ নতুন সনের প্রবর্তন করা হয় 'ফসলি সন'। পরবর্তী পর্যায়ে বিভিন্ন অঞ্চলের নাম অনুযায়ী 'ফসলি সন' পরিবর্তিত রূপ ধারণ করে এবং বাংলাদেশে তা 'বাংলা সন ' নামে অভিহিত হয়।

১৪ এপ্রিল

বাংলা একাডেমির উদ্যােগে বিশিষ্ট ভাষাবিদ ড. মুহম্মাদ শহীদুল্লার নেতৃত্বে ১৯৬৩ সালে বাংলা পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি গঠন করা হয়। পরবর্তীতে এ কমিটি 'শহীদুল্লাহ কমিটি' নামে আখ্যায়িত হয়। এ কমিটি ১৪ এপ্রিলকে পহেলা বৈশাখ নির্ধারণের সুপারিশ করে। পরবর্তীতে 'বাংলা বর্ষপঞ্জি সংস্কার কমিটি' নামে আরেকটি কমিটির সুপারিশের আলোকে বাংলা একাডেমিতে ১২ সেপ্টম্বর ১৯৯৪ (বাংলা ২৮ ভাদ্র ১৪০১) অনুষ্ঠিত সভায় ১৪ এপ্রিলকে পহেলা বৈশাখ হিসেবে ধার্য করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরপর ১৩ আগস্ট ১৯৯৫ (২৯শ্রাবণ ১৪০২) এ দু'সভার মাধ্যমে গঠিত টাস্কফোর্স ১বৈশাখ ১৪০২ থেকে, অর্থাৎ ১৪এপ্রিল ১৯৯৫ থেকে এটি কার্যকরের সিদ্ধান্ত নেয়। এভাবেই ১৪এপ্রিলকে পহেলা বৈশাখ রূপে (শুভ নববর্ষ) প্রতিবছরই পালন করা হয়।

বাংলা নববর্ষ এর উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান

সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই রাজধানী ঢাকার রমনা বটমূলে ছায়ানটের সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বাংলা নববর্ষের আনুষ্ঠানিকতা। বৈশাখী আয়োজনে রাজধানী তথা দেশের সবচেয়ে বড় আসর এটি।ছায়ানটের শিল্পীদের সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে। স্থানটি বটমূল নামে পরিচিত হলেও প্রকৃতপক্ষে যে গাছের ছায়ায় মঞ্চ তৈরি হয় সেটি একটি অশ্বথ গাছ। ১৯৬০ এর দশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সালে ছায়ানটের এ বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা হয়।
 

হালখাতা

বাংলা নতুন বছরের শুরুতে পুরনো হিসাব-নিকাশ চুকিয়ে ব্যবসায়ীদের নতুন খাতা খোলার এক আনুষ্ঠানিক উদ্যেগ হালখাতা। এ উপলক্ষ্যে সাধারণত নিয়মিত ক্রেতাদের আমন্ত্রণ জানানো, মিষ্টি দ্বারা আপ্যায়ন এবং পুরনো বকেয়া পরিশোধ করে নতুন করে খাতায় নাম লিখানো হয়।

বৈসাবি

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী প্রতিবছর বাংলা চৈত্র মাসের ৩০ও ৩১ তারিখ এবং বৈশাখের ১তারিখ নববর্ষ পালন করে। বাংলা বছরের শেষ ২ দিন ও নতুন বছরের প্রথম দিন দেশের ক্ষুদ্র নৃ -গোষ্ঠীসমূহ সাংগ্রাই, বিজু, বৈসুক, বিষু, বিহু, সাংগ্রাং, সাংলান, ফাগুয়া প্রভৃতি নামে এ উৎসব পালন করলেও সমতলে এটি 'বৈসাবি' নামে পরিচিত। ত্রিপুরাদের 'বৈসুক' মারমাদের 'সাংগ্রাই' ও চাকমাদের 'বিজু' এ তিন নামের আধ্যক্ষর নিয়ে বৈসাবি নামের উৎপত্তি। ১৯৮৫ সাল থেকে সম্মিলিত উদ্যেগে বৈসাবি উৎসব পালিত হয়ে আসছে।

মঙ্গল শোভাযাত্রা

বাংলাদেশের জনগনের লোকজ ঐতিহ্যের প্রকীক মঙ্গল শোভাযাত্রা। দেশের লোকজ সংস্কৃতি উপস্থাপনের মাধ্যমে সব শ্রেণির মানুষকে একত্র করার লক্ষ্যে ১৯৮৫ সালে যশোরের 'চারুপীঠ' নামের একটি সংগঠন প্রথমবারের মতো বর্ষবরণ করতে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করে। যশোরের সে শোভাযাত্রার পর ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যােগে আয়োজন করা হয় প্রথম শোভাযাত্রার। ১৯৯৫ সালের পর থেকে এ আনন্দ শোভাযাত্রাই 'মঙ্গল শোভাযাত্রা' নামে পরিচিতি লাভ করে। শিল্পী ইমদাদ হোসেন 'মঙ্গল শোভাযাত্রা'র নামকরণ করেন। ৩০ নভেম্বর ২০১৬ জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (UNESCO) এর নির্বস্ত্তক বা অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পায় বাংলা নববর্ষ বরণের বর্ণিল উৎসব 'মঙ্গল শোভাযাত্রা'।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post