রচনা : বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ

ভূমিকা : বন্য পরিবেশে বন্যপ্রাণীদের সৌন্দর্য বিকাশের যেমন যথার্থ ক্ষেত্র, বন্যপ্রাণী ছাড়া বনের সৌন্দর্যের পূর্ণতা তেমনই অসম্ভব। অথচ কাণ্ডজ্ঞানহীন মানুষ সংকীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে যথেচ্ছ অরণ্যনিধনে মত্ত হয়েছে। অরণ্যের বিস্তার যত কমছে বন্যপ্রাণীরা ততই হারাচ্ছে তাদের স্বচ্ছন্দ বিচরণের স্থান অরণ্যের অধিকার। ফলে বণ্যপ্রাণীরা যেমন বসবাসের স্থান হারাচ্ছে, সেই সঙ্গে নির্বিচারে নিধনে বন্যপ্রাণী অবলুপ্ত হতে চলেছে। অথচ, মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ জরুরি।

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ
Save Animal

বন ও বন্যপ্রাণীর সম্পর্ক : যে প্রাণী সাধারণত গৃহে পালন করা হয় না, কিন্তু অরণ্যে বা বনে স্বাধীনভাবে বিচরণ করে তাদের বন্যপ্রাণী বলে। বন ও বন্যপ্রাণীর সম্পর্ক অচ্ছেদ্য। একটির আলোচনা করতে গেলে স্বাভাবিকভাবে অপরটি এসে পড়ে। বন ছাড়া বন্যপ্রাণীর অস্তিত্ব রক্ষা করা সম্ভব নয়। আবার বন্যপ্রাণী ছাড়াও বনের সৌন্দর্যের পূর্ণতা সম্ভব নয়। তাই বন ও বন্যপ্রাণী উভয়ের অস্তিত্ব রক্ষা জরুরি।

বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী : বাংলাদেশের প্রকৃতির কোলে যে প্রাণীরা স্বাধীনভাবে বিচরণ করে তাদের এদেশের বন্যপ্রাণী বলা যায়। তারা অরণ্যের শ্যামল ছায়ায় জন্মায় এবং অরণ্যের স্নেহে প্রবর্ধিত হয়। আমাদের দেশে পার্বত্য অঞ্চল ও সুন্দরবন প্রাণীদের স্বাধীন বিচরণ ভূমি | পার্বত্য অঞ্চলের প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে- হাতি, চিতাবাঘ, নেকড়ে বাঘ। আর সুন্দরবনের রয়াল বেঙ্গল টাইগার বিশ্ববিখ্যাত এবং সুখ-দর্শন হরিণ সুন্দরবনের সৌন্দর্য। তাছাড়া হায়না, চিতাবাঘ, নেকড়ে বাঘ, ওলবাঘ, শিয়াল, শূকর প্রভৃতি প্রাণী। সুন্দরবনের গাছে গাছে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। নদীতে কুমির ও মাছসহ সহস্র জলজপ্রাণী। তবে সুন্দরবনে একসময় গভার পাওয়া যেত। এখন আর দেখা যায় না। অনেক প্রাণীই আমাদের দেশ থেকে অবলুপ্তি হয়ে গেছে।

বন্যপ্রাণী বিলুপ্তির কারণ : বর্তমানে প্রযুক্তিবিদ্যার প্রসার ঘটেছে। বেড়েছে লোকসংখ্যা। নগর-সভ্যতার বিস্তার হয়েছে। দিকে দিকে গড়ে উঠেছে ছোটো-বড়ো কত ক্ষুদ্র-বৃহৎ কলকারখানা। পত্তন হয়েছে শিল্পনগরীর। মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে বন কেটে বসত গড়েছে। ফলে লোপ পেয়েছে গহিন অরণ্য। হারিয়ে গেছে অনেক সাধারণ বনভূমি সুন্দরবনের বৃহৎ অংশ জুড়ে মানুষ এখন নতুন গ্রাম-গঞ্জের পত্তন করেছে। সুন্দরবন আজও অরণ্য সম্পদ লুণ্ঠন ও প্রাণী নিধনের অবাধ লীলাক্ষেত্র মিলিয়ে যাচ্ছে অরণ্যাচারী ক পশু-পাখি। যা প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় আজ বিপর্যয়ের অশুভ ছায়াপাত।

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ নীতি : বন্যপ্রাণী বিলুপ্তিতে প্রকৃতির ভারসাম্য নীতিতে আজ বিপর্যয়ের অশুভ ছায়াপাত মানব সভ্যতার সামনে আজ এক মহাসংকট। তাই বিশ্বের সর্বত্র বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। জর্জ ক্যাটলিন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের আন্দোলনে পথিকৃৎ। ইনি মার্কিন শিল্পী ও লেখক। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণার্থে জাতীয় উদ্যান ন্যাশনাল পার্ক গড়ে তোলার প্রথম প্রস্তাবক হলেন তিনি। তারপর এই আন্দোলনের ঢেউ গিয়ে প্রতিহত হয় আর্জেন্টিনায় অস্ট্রেলিয়ায় ও বিশ্বের বহু দেশে। কেননা বন্যপ্রাণী প্রকৃতির। ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা পালন করে। প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণীর সঙ্গে প্রতিটি প্রাণীর শৃঙ্খল বন্ধন। সেজন্যই সর্বত্র গৃহীত হয়েছে প্রাণী সংরক্ষণ নীতি। প্রাণী সংরক্ষণের নীতি বাস্তবায়নের ফলে অনেক প্রাণী বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অভয়ারণ্য।

বন সংরক্ষণ : আগেই বলা হয়েছে বন ও বন্যপ্রাণীর সম্পর্ক অচ্ছেদ্য। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য প্রথম ও প্রধান উপায় হলো বন সংরক্ষণ করা। বন যেমন বন্যপ্রাণীর অস্তিত্ব রক্ষা করে, তেমনই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। গাছপালা প্রস্বেদন প্রক্রিয়া ও বাষ্পীয়ভবনের মাধ্যমে আবহাওয়া বিশুদ্ধ রাখে। তাই এই বনভূমি রক্ষার জন্য প্রয়োজন, অরণ্যের অবাধ ও যথেচ্ছা উচ্ছেদ নিবারণ করা। নতুন চারা গাছ লাগানো এবং তার পরিচচর্যা করা। অপরিণত গাছ কাটা থেকে বিরত থাকা। বনভূমি থেকে কাঠের চোরাচালান বন্ধ করা। পাহাড়ের ঢাল, সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চল, নদীর কিনারা ও সড়কের দুপাশে গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করা। বিদেশি বা আগ্রাসী প্রজাতির গাছ দিয়ে কৃত্রিম বনায়ন না করে দেশীয় অর্থকরী বৃক্ষরোপণের ব্যবস্থা করা। সরকার কর্তৃক বন গবেষণার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

উপসংহার : পৃথিবীতে প্রাণী ও উদ্ভিদ মিলিয়ে ১৫ লক্ষ প্রজাতির পরিচয় মানুষের জানা। বিজ্ঞানীদের অনুমেয় জানা-অজানা মিলিয়ে প্রজাতির সংখ্যা এক কোটি অতিক্রম করতে পারে। বাংলাদেশের অরণ্যভূমিতে এখনও বাস করে প্রায় ২০০০ প্রজাতির পাখি, ৩৫০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৩০ হাজার প্রজাতির পোকামাকড়, প্রায় ৫০০ প্রজাতির উভচর প্রাণী, সরীসৃপ ও মাছ। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, তাদের মাত্র ৩ থেকে ৪ শতাংশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছে। অবশিষ্ট অংশ মানুষের যথেচ্ছ শিকারের বলি হচ্ছে। বনজ প্রাণী ও সম্পদ নিয়ে মানুষের শুভবোধের জাগরণ অত্যপ্ত জরুরি। এ দায়িত্ব নিতে হবে সরকারি ও বেসরকারি শুভাকাঙ্ক্ষী মানুষকে।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post