রচনা : পানি বণ্টন চুক্তি

ভূমিকা : প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে সহযোগিতা প্রসারিত করা সম্ভব হলে সবারই কল্যাণ। বাংলাদেশের বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সকল বিরোধ মিটিয়ে নিজেদের উন্নয়নে বেশি মনোযোগ দানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ করে। বাংলাদেশ ভারত ঐতিহাসিক পানি বণ্টন চুক্তি তেমনি একটি যুগান্তকারী ঘটনা। নিজেদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের ভিত্তিতে সম্পাদিত এই চুক্তি দীর্ঘদিনের একটি সমস্যার অবসান ঘটিয়েছে এবং সে সঙ্গে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা পালনে সহায়ক হয়েছে।

পানি চুক্তি : আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা লাভের ছয় মাসের মধ্যেই যুগান্তকারী বাংলাদেশ ভারত পানি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ১৯৯৬ সালের ১২ই ডিসেম্বর তারিখে বাংলাদেশেল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবগৌড়া নয়াদিল্লীতে এই চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ১৯৭৭ সালের পর এই প্রথম আনুষ্ঠানিক চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তির ফলে বাংলাদেশ পুরো শুকনো মৌসুমে ফারাক্কার মাধ্যমে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি পাবে। ফারাক্কায় ৭০ হাজার কিউসেক পানি থাকলে ভারত ও বাংলাদেশ অর্ধেক অর্ধেক হিসেবে পানি লাভ করবে। চুক্তিটি ৩০ বছরের জন্য সম্পাদিত হয়েছে। তবে পাঁচ বছর পর পর তা পর্যালোচনা করা হবে।

চুক্তির প্রধান প্রধান বিষয় : ভারত বাংলাদেশকে যে পরিমাণ পানি দিতে সম্মত হয়েছে তা ছাড়া হবে ফারাক্কার বাঁধ দিয়ে। নির্ধারিত ফর্মুলা অনুসারে প্রতি বছর পয়লা জানুয়ারি থেকে ৩১শে মে পর্যন্ত ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ফারাক্কায় গঙ্গার পানি বণ্টন হবে। ফারাক্কায় গত ৪০ বছরে (১৯৪৯-৮৮) ১০ দিনের গড় পানি প্রাপ্তির ভিত্তিতে একটি তফসিল করা হয়েছে। ফারাক্কায় ৪০ বছরের গড় পানি প্রবাহ বজায় রাখার জন্য উজানের দেশ সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে। কোন দশ দিনের সময়কালে ফারক্কার পানি প্রবাহ ৫০ হাজার কিউসেকের নিচে নেমে এলে দুই সরকার কোন পক্ষের ক্ষতি না করে সমতা ও ন্যায়পরায়ণতার নীতিমালার ভিত্তিতে জরুরিভাবে পানি প্রবাহে সমন্বয় সাধনের জন্য অবিলম্বে আলোচনায় বসবে। ফারাক্কায় বাংলাদেশের জন্য যে পানি ছাড়া হবে তা ভারতের যুক্তিসংগত ব্যবহার ছাড়া ফারাক্কা ও গঙ্গার মধ্যবর্তী স্থান যার উভয় তীর বাংলাদেশের ভূখণ্ডে, ২০০ কিউসেকের বেশি হ্রাস করা হবে না। এই চুক্তি স্বাক্ষরের পর সমানসংখ্যক সদস্য নিয়ে দুই সরকারের মনোনীতি প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হবে। এই যৌথ কমিটি হার্ডিঞ্জ ব্রীজসহ ফারাক্কা, ফারাক্কার নিচে, ফিডার চ্যানেলে ও নেভিগেশন লকে দৈনন্দিন প্রবাহ পর্যবেক্ষণ ও রেকর্ডের জন্য উপযোগী টিম গঠন করবে। দুই সরকার শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পনি বৃদ্ধির দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা সমাধানে একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতা করার প্রয়োজনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। সমতা, স্বচ্ছতা এবং অপরপক্ষকে ক্ষতি না করার নীতিমালার ভিত্তিতে উভয় সরকার অন্যান্য অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন চুক্তি সম্পাদনে সম্মত হয়েছে। দুই সরকার এই চুক্তির অধীনে পানি বণ্টন, ব্যবহারের প্রয়োজনে সমতা, স্বচ্ছতা ও পরস্পরকে ক্ষতি না করার নীতিমালার ভিত্তিতে অন্যপক্ষের চাহিদা অনুসারে এবং সমন্বয়ের জন্য পাঁচ বছর অন্তর অথবা প্রয়োজন হলে এর আগে পর্যালোচনা করবে। ১৯৯৬ সালের ১২ই ডিসেম্বর নয়াদিল্লীতে হিন্দি, বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় চুক্তিটি সম্পাদিত হয়। বিবরণীর মধ্যে কোন বিরোধ দেখা দিলে সেক্ষেত্রে ইংরেজি বিবরণটি কার্যকর থাকবে।

চুক্তির ফলাফল : বাংলাদেশ ভারত পানি বণ্টন চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে দু দেশের মধ্যে দীর্ঘ দিন ধরে বিরাজমান সমস্যার অবসান ঘটল। এতে দু দেশের মধ্যে যে তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছিল তারও অবসান ঘটে এই চুক্তির মাধ্যমে। সর্বোপরি গঙ্গার পানি প্রাপ্তির নিশ্চয়তার মাধ্যমে বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকারের যথাযোগ্য স্বীকৃতি লাভ সম্ভব হল। গুরুত্বের দিক থেকে এই চুক্তিকে একটি ঐতিহাসিক চুক্তি হিসেবে বিবেচনা করা যায়।

উপসংহার : বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে সম্পাদিত এই ঐতিহাসিক পানি বণ্টন চুক্তি সরকারের একটি বিশেষ সাফল্যের নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য যেমন এর উপযোগিতা রয়েছে, তেমনি সরকারের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয়ও এতে প্রকাশ পেয়েছে। এই চুক্তি থেকে দেশ উপকৃত হোক এটাই অভিপ্রেত।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post