মার্চের দিনগুলি

রচনা : মুহররম (আশুরা)

সূচনা : বহু শত বছর পূর্বে কারবালা প্রান্তরে যে হৃদয়বিদারক ঘটনায় সপরিজন ইমাম হোসেন (রা)-এর মৃত্যু ঘটে, তাঁর স্মৃতি বহন করে বিশ্বের মুসলমানগণ প্রতি বছর শোক প্রকাশ করে। হিজরী সনের প্রথম মাস মুহররমে এই নিষ্ঠুর ঘটনা সংঘটিত হয়। এই শোক ঘটনার সাধারণত মুহররম আশুরা) বলে পরিচিত।

ইতিহাস : হযরত আলী (রা) যখন খলিফা পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তখন সিরিয়ার শাসনকর্তা মাবিয়া বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। যুদ্ধে মাবিয়ার পরাজয় ঘটল, কিন্তু কূট-কৌশলের আশ্রয় নিয়ে তিনি সন্ধির শর্ত অনেকখানি নিজের অনুকূলে আনয়ন করলেন। হির হল, আলীর মৃত্যুর পর মাবিয়া এবং মাবিয়ার মৃত্যুর পর আলীর পুত্র হাসান (রা) খিলাফত লাভ করবেন। গুপ্তঘাতকের হাতে আলীর অকালমৃত্যুর অন্তরালে মারিয়ার চক্রান্ত কার্যকরী ছিল বলে মদিনাবাসীগণ মনে করতেন। তাঁরা মাবিয়ার খিলাফত অস্বীকার করে হাসানকেই খলিফা ঘোষণা করলেন। হাসান ও মাবিয়ার যুদ্ধের পর এই শর্তে সন্ধি হল যে, মাবিয়া খলিফা পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন কিন্তু তার পর সেই আসন লাভ করবেন হাসানরা। কিন্তু অনতিবিলম্বে বিষ প্রয়োগের ফলে হাসানের মৃত্যু ঘটে। মাবিয়ার মৃত্যুর পরে মদিনাবাসীরা হোসেন (রা)-কেই খলিফা বলে ঘোষণা করে। কিন্তু মাবিয়ার পুত্র এজিদ তা অস্বীকার করে নিজেকে খলিফা বলে দাবি করলেন। সংঘর্ষ এড়াবার আর কোন পথ রইল না। সপরিবার কুফা যাত্রা করে দিগ্‌ভ্রান্ত হোসেন ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে এসে উপস্থিত হলেন। এজিদ পক্ষের অবরোধের ফলে ফোরাতের পানি ব্যবহার করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হল না। পিপাসায় কাতর হয়ে হোসেনের শিবিরে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার জীবনধারণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ল। অবশেষে বীরের ন্যায় যুদ্ধ করে হোসেন (রা) মৃত্যুবরণ করলেন।

প্রভাব : কারবালার প্রান্তরে এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের স্মরণে মুসলমানেরা মুহররম উৎসব পালন করে থাকে। এটা প্রধানত শিয়া সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠান। তুরস্ক ও ইরানে মুহররম উপলক্ষে ‘তাজিয়া’র অভিনয় হয়; অর্থাৎ কারবালা-কাহিনী নাট্যাকারে অভিনীত হয়। এই বেদনাদায়ক ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফারসি সাহিত্যে সমৃদ্ধ মর্সিয়া সাহিত্য গড়ে উঠেছে। এর অনুকরণে উর্দুতে এবং বাংলা সাহিত্যেও কারবালা-কাহিনী বিষয়ক কাব্য রচিত হয়েছে। আধুনিককালে মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’ এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য সাহিত্য-কৰ্ম। কিন্তু সকল দেশের সাহিত্যেই কারবালার মূল ইতিহাসের সাথে কল্পনার রঙ মিশেছে বহুল পরিমাণে। তাছাড়া কারবালার ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে রীতিতে শোক প্রকাশ করা হয়, তা সকলের অনুমোদন লাভ করেনি। ওয়াহাবী মতাবলম্বীগণ এবং আমাদের দেশের ফারায়েজী সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিগণ মনে করেন যে, এভাবে শোক প্রকাশ ধর্মবিরুদ্ধ এবং অনেকখানি পৌত্তলিকতার আদর্শে গঠিত।

অনুষ্ঠানের তাৎপর্য : বস্তুত আমাদের দেশে মুসলমানদের পর্বের মধ্যে মুহররম বেশ সাড়ম্বর ও বর্ণবহুল। ইমামদের কবরের অনুকরণে 'তাজিয়া' নির্মাণ করে শোভাযাত্রা করা এবং নিজেদের বুকে আঘাত করে শোভাযাত্রীদের শোক প্রকাশ করার মধ্যে যেমন কারুণ্যের পরিচয় আছে তেমনি যোদ্ধাবেশে কৃত্রিম অস্ত্রশস্ত্রে জত হয়ে যুদ্ধাভিনয় করার মধ্যে বীররসের প্রকাশ দেখা যায়। মুহররমের সাত ও নয় তারিখে শোভাযাত্রা এবং দশ তারিখে তাজিয়া প্রভৃতি মৃত্তিকায় প্রোথিত করতে যারা দেখেছেন, তাঁরা এই অনুষ্ঠানের আবেগের সঙ্গে পরিচিত।

উপসংহার : মুহররমের শোকপ্রকাশ আড়ম্বরের দিক দিয়ে আনন্দোসত্বকে অতিক্রম করে যায়, এ সমালোচনা অনেকখানি সত্য। তবু যে আদর্শের জন্য—সত্য ও ন্যায়ের মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে হাসান-হোসেন নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তার স্মৃতি আলোচনার তাৎপর্য আছে। এক সময়ে যে শোকাবহ ঘটনা কতিপয় মানুষের জীবনে দুঃখের গভীর অন্ধকার সৃষ্টি করেছিল এখন তা মানব ইতিহাসের এক বেদনার্ত অধ্যায় হিসেবে জাগরুক রয়েছে। অন্যায় সংগ্রামে ইমাম পরিবারের হত্যা চরম পাষন্ডতা ও অমানবিকতার নিদর্শন হিসেবে বিবেচ্য। আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর যে দৃষ্টান্ত তখন স্থাপিত হয়েছিল, তা সংগ্রামের চেতনার প্রতীক হিসেবে গ্রহণযোগ্য। সুতরাং মুহররম-উৎসব পালনের মাধ্যমে সত্য ও ন্যায়ের জন্য ত্যাগ স্বীকারের আদর্শ মানুষের জীবনে পালিত হোক, তাই সকলের কামনা। কবির ভাষায়—
“ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না।”
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post