ভাষণ : ২২ শ্রাবণ : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়ান দিবস

২২ শ্রাবণ উপলক্ষ্যে একটি ভাষণ প্রস্তুত করো।

২২ শ্রাবণ : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়ান দিবস

শ্রদ্ধেয় সভাপতি এবং সমাগত সুধীবৃন্দ –
আজ আমরা এক পরম পুণ্যলগ্নে এখানে সমবেত হয়েছি। সমগ্র বাঙালি জীবনে ২২ শ্রাবণ শুধু স্মরণীয় দিন নয়, আমাদের জীবনের মহত্তম আবেগকে আশ্রয় করে আছে এ দিনটি।

১৩৪৮ বঙ্গাব্দের এ দিনটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মৃত্যুবরণ করেন। আশি বছরের জীবনে তিনি চিন্তাচেতনায়, রচনায়, অনুভাবনায় বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি এবং সর্বোপরি বাঙালির জীবনকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে, আমাদের সাহিত্যের সঙ্গে আমাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে, আমাদের সংগীতের সঙ্গে, মোটকথা আমাদের জীবনের প্রতিটি শোভনতম আবেগের সঙ্গে বিজড়িত হয়ে য়আছেন। তিনি আমাদের কাছে শুধু একজন ব্যক্তিমাত্র নন; একটি জাতির সমগ্র জীবনের আধার। বাঙালি জাতির জীবনে বিশ শতকের প্রথম চল্লিশ বছরকে রবীন্দ্রযুগ বলেই চিহ্নিত করা যায়।

বাল্যকালেই রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-প্রতিভার স্ফুরণ ঘটেছিল। বয়সের সাথে সাথে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর এ প্রতিভার বিকাশ অব্যাহত ছিল। মহামনীষীদের জীবনেও এমন দৃষ্টান্ত বিরল। তাঁর দীর্ঘ জীবনে সারস্বত-সাধনা সৃষ্টির কত বিচিত্র পথেই না ঐশ্বর্য লাভ করেছে! ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথের বিপুল সৃষ্টি-সম্ভারের কণিকামাত্র। কবিকৃত এ কাব্যের ইংরেজি অনুবাদ পড়ে সেদিন ইউরোপ বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হয়েছিল। এ কাব্যই বাঙালির ঘরে বহন করে আনে বিশ্ববিজয়ীর বরমাল্য— ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার। পরাধীন ভারতবর্ষে এর চেয়ে বড় গৌরব সেদিন আর কিছু ছিল না। দেশ ও কালের সাথে তাঁর চিন্তা ছিল ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত। ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ— সর্বত্রই তিনি শ্রেষ্ঠ। নবযুগে বাঙালির সঙ্গীত তাঁরই দান। একটি সমুদ্রকে যেমন গণ্ডুষে তুলে ধরা যায় না, একটি আকাশকে যেমন মুঠিতে ধরা সম্ভব নয়, রবীন্দ্রপ্রতিভাকেও তেমনি কোনো সভায় উপস্থাপন করা অসম্ভব। অনাগত কালে আরো মহত্তম প্রতিভার আবির্ভাবের পূর্বে তিনি আমাদের মাঝে শ্রেষ্ঠতম মনীষী।

প্রিয় সুধী,
রবীন্দ্রনাথই আমাদেরকে আঞ্চলিক সংকীর্ণতার গণ্ডী ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক মানসিকতার অধিকারী করে তুলেছিলেন। সভ্যতা কোনো জাতির নিজস্ব সম্পত্তি নয়; তা সমগ্র মানবজাতির। দেশকে গভীরভাবে ভালোবেসেও তিনি ছিলেন বিশ্বের নাগরিক। মানুষের ক্ষুদ্র চেতনা, অন্ধ বুদ্ধি, সংকীর্ণ সংস্কার এবং মানুষের প্রতি অবিশ্বাস তাঁকে আহত করত সবচেয়ে বেশি। তাঁর কণ্ঠেই আমরা প্রথম শুনেছি— দেশ মৃন্ময় নয়, দেশ চিন্ময়। তিনি চিন্ময় মানুষকেই ভাবীকালের অগ্রদূত বলে ঘোষণা করেছেন। এ মানুষ নির্মাণের জন্যে তিনি গড়েছিলেন শান্তিনিকেতন। মৃত্যুর উপান্তে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিধ্বংসী দিনগুলোতে তিনি মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানোকে পাপ বলে অভিহিত করেছিলেন। তিনি মানবতার জয়গান গেয়েছেন, সত্য ও কল্যাণের প্রশস্তি গেয়েছেন। মূলত তাঁর সারা জীবনের সাধনা ছিল সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের সাধনা। আমরা মানবতার পূজারী রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে জানাই আমাদের সশ্রদ্ধ সালাম। রবীন্দ্রভাবনা যেন সবার মধ্যে সম্প্রসারিত হয়— এ কামনা এবং রবীন্দ্রপ্রেমীদের সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বক্তব্য এখানেই শেষ করছি।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post