বিশিষ্ট ব্যক্তির দিনলিপি
১৭ মে, সোমবার ১৯৭১
  রেডিও-টিভিতে বিখ্যাত ও পদস্থ ব্যক্তিদের ধরে নিয়ে প্রোগ্রাম করিয়েও কর্তাদের
  তেমন সুবিধা হচ্ছে না বোধ হয়! তাই এখন বুদ্ধিজীবী ও শিল্পীদের ধরে ধরে তাদের
  দিয়ে খবরের কাগজে বিবৃতি দেওয়ানোর কূটকৌশল শুরু হয়েছে। আজকের কাগজে ৫৫ জন
  বুদ্ধিজীবী ও শিল্পীর নাম দিয়ে এক বিবৃতি বেরিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো
  টিচার, রেডিও-টিভির কোনো কর্মকর্তা ও শিল্পীর নাম বাদ গেছে বলে মনে হচ্ছে না।
  এঁদের মধ্যে কেউ কেউ সানন্দে এবং সাগ্রহে সই দিলেও বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবী ও শিল্পী
  যে বেয়নেটের মুখে সই দিতে বাধ্য হয়েছেন, তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আর যে
  বিবৃতি তাদের নামে বেরিয়েছে, সেটা যে তাঁরা অনেকে না দেখেই সই করতে বাধ্য
  হয়েছেন, তাতেও আমার সন্দেহ নেই। আজ সকালের কাগজে বিবৃতিটি প্রথমবারের মতো পড়ে
  তাঁরা নিশ্চয় স্তম্ভিত হয়ে বসে রইবেন খানিকক্ষণ! এবং বলবেন, ধরণী দ্বিধা হও!
  এরকম নির্লজ্জ মিথ্যাভাষণে ভরা বিবৃতি স্বয়ং গোয়েবলসও লিখতে পারতেন কিনা
  সন্দেহ। এই পূর্ব বাংলার কোন প্রতিভাধর বিবৃতিটি তৈরি করেছেন, জানতে বড় ইচ্ছে
  হচ্ছে।
২০ নভেম্বর, শনিবার ১৯৭১
  আজ ঈদ। ঈদের কোনো আয়োজন নেই আমাদের বাসায়। কারও জামাকাপড় কেনা হয়নি।
  দরজা-জানালার পর্দা কাচা হয় নি, ঘরের ঝুল ঝাড়া হয় নি। বসার ঘরের টেবিলে রাখা
  হয় নি আতরদান। শরীফ, জামী ঈদের নামাজও পড়তে যায় নি।
  কিন্তু আমি ভোরে উঠে ঈদের সেমাই, জর্দা রেঁধেছি। যদি রুমীর সহযোদ্ধা কেউ আজ আসে এ
  বাড়িতে? বাবা-মা-ভাই-বোন, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো গেরিলা যদি রাতের অন্ধকারে
  আসে এ বাড়িতে? তাদেরকে খাওয়ানোর জন্য আমি রেঁধেছি পোলাও, কোর্মা, কোপ্তা,
  কাবাব। তারা কেউ এলে আমি চুপিচুপি নিজের হাতে বেড়ে খাওয়াবো। তাদের জামায়
  লাগিয়ে দেবার জন্য একশিশি আতরও আমি কিনে লুকিয়ে রেখেছি।
২৯ নভেম্বর, সোমবার ১৯৭১
  যতটা ভয় পাওয়া গিয়েছিল, ততটা খারাপ কিছু ঘটে নি। সকাল থেকে গাড়ি-রিকশা বাস
  চলে নি। দোকানপাট বন্ধ ছিল— অবাঙালিদের গুলো জোশে, বাঙালিদের-গুলো ভয়ে। এগারোটার
  দিকে লুলুকে সঙ্গে নিয়ে হেঁটে হেঁটে আজিমপুরে এক বাসায় গেলাম। পথে দুটো মিছিল
  দেখলাম। উর্দু, ইংরেজিতে ‘ভারত বিধ্বস্ত’ করার বেশ কয়েকটা শ্লোগান লেখা
  প্ল্যাকার্ড উঁচিয়ে মোহাম্মদপুরের দিক থেকে আসা মিছিল। বারোটায় হরতাল শেষ।
  দেড়টার সময় বাসায় ফিরলাম রিকশা চড়ে। মিছিল, মিটিং নাকি সন্ধ্যে পর্যন্ত
  চলেছে। আজ থেকে ঠিক তিরানব্বই দিন আগে পাক হানাদাররা রাত বারোটার সময় এসে আমার
  রুমীকে ধরে নিয়ে গেছে।
২ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার ১৯৭১
  আজ সারাদিন বেরোই নি। গতকালকার কেনা জিনিসপত্রগুলো দিয়ে ছোট ছোট প্যাকেট
  বানিয়েছি কিন্তু কেউ আসে নি কিছু নিতে। অবশ্য আজকেই কেউ আসবে, এমন কথাও তো কেউ
  দিয়ে রাখে নি। তবু ভেতরে ভেতরে কে যেন বলছিল, কেউ আসবে। আমার অনুমান সত্য হল না।
  আতিকুল ইসলামের সাথে ফোনে কথা হল দুপুরে। ওর কিছু ওষুধের প্যাকেট নিয়ে যাবার কথা
  ছিল। ও-ও জানাল বেশ কিছুদিন হয় ওর কাছেও কেউ আসছে না। আমি বললাম, ‘অন্তত আমার
  কাছ থেকে প্যাকেটগুলো নিয়ে তোমার বাসায় রাখ। হঠাৎ এসে পড়লে যাতে দিতে পার।’
  ‘আচ্ছা বুবু, তাই করব।’ বলে ফোন রেখে দিল আতিক। কিন্তু আসে নি।
১৬ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার ১৯৭১
  আজ সকাল ন’টা পর্যন্ত যে আকাশযুদ্ধ বিরতির কথা ছিল, সেটা বিকেল তিনটে পর্যন্ত
  বাড়ানো হয়েছে। দুপুর থেকে সারা শহরে ভীষণ চাঞ্চল্য ও উত্তেজনা। পাক আর্মি নাকি
  সারেন্ডার করবে বিকেলে। সকাল থেকে কলিম, হুদা, লুলু যারাই এল সবার মুখেই এক কথা।
  দলে দলে লোক ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি তুলে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে কারফিউ উপেক্ষা করে।
  পাকিস্তানি সেনারা, বিহারিরা সবাই নাকি পালাচ্ছে। পালাতে পালাতে পথেঘাটে
  এলোপাথাড়ি গুলি করে বহু বাঙালিকে খুন-জখম করে যাচ্ছে। মঞ্জুর এলেন তাঁর দুই
  মেয়েকে নিয়ে, গাড়ির ভেতরে বাংলাদেশের পতাকা বিছিয়ে। তিনিও ঐ এক কথাই বললেন।
  বাদশা এসে বলল, এলিফ্যান্ট রোডের আজিজ মোটরসের মালিক খান জীপে করে পালাবার সময়
  বেপরোয়া গুলি চালিয়ে রাস্তার বহু লোক জখম করেছে।
  মঞ্জুর যাবার সময় পতাকাটা আমাকে দিয়ে গেলেন। বললেন, ‘আজ যদি সারেন্ডার হয়, কাল
  সকালে এসে পতাকাটা তুলব।’ আজ শরীফের কুলখানি। আমার বাসায় যাঁরা আছেন, তাঁরাই
  সকাল থেকে দোয়া দরুদ কুল পড়ছেন। পাড়ার সবাইকে বলা হয়েছে বাদ মাগরেব মিলাদে
  আসতে। এ.কে. খান, সানু, মঞ্জু, খুকু সবাই বিকেল থেকেই এসে কুল পড়ছে। জেনারেল
  নিয়াজী নব্বই হাজার পাকিস্তানি সৈন্য নিয়ে আত্মসমর্পণ করেছে আজ বিকেল তিনটের
  সময়। যুদ্ধ তাহলে শেষ? তাহলে আর কাদের জন্য সব রসদ জমিয়ে রাখব?
  আমি গেস্টরুমের তালা খুলে চাল, চিনি, ঘি, গরম মসলা বের করলাম কুলখানির জর্দা
  রাঁধবার জন্য। মা, লালু, অন্যান্য বাড়ির গৃহিণীরা সবাই মিলে জর্দা রাঁধতে বসলেন।
  রাতের রান্নার জন্যও চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ ইত্যাদি এখান থেকেই দিলাম। আগামীকাল
  সকালের নাশতার জন্যও ময়দা, ঘি, সুজি, চিনি, গরম মসলা এখান থেকেই বের করে রাখলাম।