রচনা : কালবৈশাখীর রাত

↬ একটি দুর্যোগময় রাত


ভূমিকা : 
কবিদের এক মহান রাজা রবীন্দ্রনাথ 
তােমার কাছে দাঁড়িয়েছিলেন করজোড়ে 
যা পুরানাে শুষ্ক মরা, অদরকারী
 কালবােশেখের একটি ফুয়ে উড়িয়ে দিতে। 
ধ্বংস যদি করবে তবে, শােনাে তুফান 
ধ্বংস করে বিভেদকারী পরগাছাদের 
পরের শ্রমে গড়ছে যাত্রা মস্ত দালান 
বাড়তি তাদের বাহাদুরী গুড়িয়ে ফেলো।
– আল মাহমুদ

বাংলাদেশের সড়ঋতুর মধ্যে গ্রীষ্ম সবচেয়ে খরতাপের ঋতু, ভয়ঙ্কর ঋতু। গ্রীষ্ম দিয়ে আমাদের ঋতুচক্রের যাত্রা শুরু হয়। শেষ যত রােমান্টিক বসন্তের পর ঘামঝরা গ্রীষ্মের আগমন ঘটে। এ সময়ে নদীনালা, খালবিল, পুকুর ডােবায় তেমন একটা পানি থাকে না। শূন্য প্রান্তর শুকিয়ে মাটি ফেটে হা-করে থাকে। চারদিকে শুধু ধূলি আর ধূলি। রসহীন রােদের সুতীব্র উত্তাপে মাথার মগজ গলে যেতে চায় না। পায়ে মেঠো পথে হাঁটা যায় না। গ্রীষ্মের প্রথম মাস বৈশাখ, কালবৈশাখীর মাস। ঝড় তুফানের তাণ্ডবলীলা শুরু হয় এ মাস থেকে।

ঝড়ের পূর্বাভাস : বৈশাখ মাস। ভাের থেকেই কেমন যেন এক ধরনের গুমট ভাব ছিল আকাশে। দুপুর বেলার গরমটা একেবারে অসহ্য লাগল। প্রবল বেগে বাতাস বইছে — তবু গরমের দাপটে ঘরে থাকা যায় না। ঘাম ঝরছে অবিরাম। বারবার ঘাম মুছতে হচ্ছে। দুপুর শেষ হয়ে এল। দুপুরের পরপরই হঠাৎ বাতাস বন্ধ হয়ে গেল। প্রকৃতি নিথর নিস্তব্ধ হয়ে গেল। গাছের একটি পাতাও নড়ছে না। আকাশের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে। একখণ্ড মেঘ দেখা দিল মেঘখণ্ড ক্রমে ক্রমে ঘনতর হতে হতে কালাে হয়ে ওঠল এবং দেখতে দেখতে পূর্ব-দক্ষিণ আকাশকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। আকাশে উড়ন্ত শকুনেরা পাখা সঙ্কুচিত করে ভুত বেগে নিচে নেমে এল। কাক, চিল, বক প্রভৃতি পাখির ঝাক কলরব করতে করতে গাছের শাখায় আশ্রয় নিল। আরও ছােট পাখিগুলাে কেমন ছুটাছুটি করতে লাগল। রাখাল বালকেরা ব্যস্ত হয়ে গরু বাছুরগুলােকে তাড়িয়ে নিয়ে বাড়ির দিকে ছুটল। আবহাওয়ার অবস্থা ভারি হতে হতে কালবৈশাখীর পূর্বাভাস স্পষ্ট হয়ে ওঠল।

নদীর অবস্থা : সন্ধ্যার দিকে নদীর অবস্থা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করল। উচু ঢেউগুলাে প্রবল বেগে ছুটে এসে নদীর পাড়ে আঘাত খেয়ে ভেঙে পড়ছিল। অনেক দূর থেকে শােনা যাচ্ছিল ঢেউ ভাঙার শব্দ। রেডিও, টেলিভিশন থেকে সতর্কবাণী প্রচারের সাথে সাথে হুশিয়ার মাঝিরা আগেই নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। যেসব নৌকা তখন নদী পাড়ি দিয়ে আসছিল, তাদের আরােহীরা ভয়ে আর্তরব জুড়ে দিল। প্রচন্ড ঢেউয়ের মােকাবেলা করতে করতে দাড়িয়ে সামাল সামাল, ‘হুঁশিয়ার’ বলে চিৎকার করতে লাগল মাঝিরা। ‘বদর বদর’ বলে তারা প্রাণপণে দাঁড় টানতে শুরু করল। একটি নৌকা স্কুল ঘাটের কাছাকাছি এসে ডুবে গেল। লােকজন কোনাে রকমে তীরে উঠে জীবন রক্ষা করল এবং নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যে ছুটাছুটি শুন করে দিল। 

আবহাওয়ার পরিবর্তন : ক্রমে ক্রমে অন্ধকার হয়ে এল। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাতে শুরু করল। আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটল। হঠাৎ করে প্রবল বেগে শো শো শব্দে বাতাস বইতে শুরু করল। এতক্ষণ ধবে যে বিস্ফোরিত শব্দে বাজের গর্জন চলছিল — তাও থেমে গেল। কেমন একটা গুম গুম ভাব। সবার মনে আতঙ্কের সৃষ্টি হলাে। পথচারীরা স্কুল ঘরে, পথের পাশে যে বাড়িতে যে পারল আশ্রয় নিল। শুকনাে পাতা ও খড়কুটা শূন্যে উড়তে লাগল। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকানিতে এসব দৃশ্য কারাে চোখ এড়িয়ে গেল না। সামনে যা কিছু পড়ল তাতেই বাতাস এসে আঘাত করল। মড়াৎ মড়াৎ শব্দে কোনাে কোনাে গাছের ডাল ভাঙল, কোনােটার ফলমূল ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ল, কোনােটা আবার ছিন্নমূল হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ল। যে স্কুল ঘরটিতে মানুষজন আশ্রয় নিয়েছিল তারও টিনের চাল উড়ে গেল এবং আশ্রয় নেওয়া লােকেরা ছুটাছুটি করে চলে এল লােকালয়ের দিকে। কালবৈশাখীর এই তাণ্ডবের বর্ণনা দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন -
হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ,
ধূলায় ধূসর বুদ্র উড্ডীন পিঙ্গল জটাজাল, 
তপঃক্লিষ্ট তপ্ত তনু, মুখে তুলি বিশাল ভাল 
কারে দাও ডাক 
হে ভৈরব, হে মুদ্র বৈশাখ। 
ছায়ামূর্তি যত অনুচর।
দগ্ধতাম্র দিগন্তের কোন্ ছিদ্র হতে ছুটে আসে।

লােকালয়ের অবস্থা : লােকালয়ের অবস্থাও ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। কোনাে ঘরের চাল উড়ে গেল, বেড়া পড়ে গেল, কোনোটা আবার মটমট শব্দ করে ধূলিসাৎ হলাে। গরুবাছুরগুলাে গোয়ালের এক কোলে জড়সড় হয়ে দাড়িয়ে কাঁপতে লাগল। কোনাে কোনাে গােয়ালের চল উড়ে গেল। বিদ্যুতের চমকানিতে দেখা গেল গরুদের করুণ দৃশ্য। মানুষেরা আযানের বাণী চিৎকার দিয়ে আওড়াতে লাগল। নানা দোয়া কালাম পড়তে লাগল। কালবৈশাখীর প্রচন্ড আঘাতে ঘর ভেঙে পড়বে ভেবে কেউ নিজের দুর্বল ঘর ছেড়ে অন্য কোথাও আশ্রয় নিল। কেউবা আঘাত খেয়ে কাতর আর্তনাদ করতে লাগল। মুষলধারে শুরু হলাে বৃষ্টি। শুরু হলাে বজের গর্জন। পরিস্থিতি এতই ভয়াবহ রূপ ধারণ করল যে, আর বুঝি রক্ষা পাওয়া যাবে না। 

গভীর রাতের অবস্থা : বৃষ্টি এবং ঝড়ের গতিবেগ আরও বাড়ল। গুডুম গুডুম বজের গর্জন, মড়াৎ মড়াৎ শব্দ ছাড়া আর কিছুই শােনা যায় না। বৃষ্টি আর দমকা বাতাসের দাপটে বেড়ার ফুটো দিয়ে পানি এসে আমাদের ঘরের মেঝে ডােবার মতো হয়ে গেল। হঠাৎ দরজায় ঠকঠক শব্দ শুনে খিল খােলা মাত্র  হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলেন বড় চাচা, বড় চাচি ও তাদের ছেলেমেয়েরা। তাদের ঘরের চাল উড়ে কোথায় গেছে বলতে পারেন না। এমনিভাবে ভংকর প্রলয় নৃত্য চলল মাঝরাত পর্যন্ত। শেষ রাতের দিকে ঝড় কমল। বৃষ্টি তখনও থামেনি। কিছুটা বাতাসও বয়ে যাচ্ছে দক্ষিণ দিক থেকে। সবাই মিলে ঘরের পানি কাঁচলাম। মসজিদের দিক থেকে ফজরের আযান এল কানে। বাবা ও চাচা টুপি মাথায় দিয়ে ছাতি নিয়ে মসজিদে গেলেন নামাজ পড়ার জন্যে। 

ঝড়ের পরের দৃশ্য : ভাের হলাে। বৃষ্টি থামল। গৃহস্থেরা দা বটি হাতে নিয়ে ঘরের বাইরে বের হয়ে এল। রাস্তায় বহু গাছ ভেঙে পড়ে আছে। ঘরের চাল, বেড়া পড়ে আছে। গাছের ডাল কেটে, ঘরের চাল, বেড়া সরিয়ে পথ পরিষ্কারের কাজ শুরু হলাে। গৃহস্থেরা প্রথমেই গােয়ালের পথ পরিষ্কার করে নিল। কোনাে কোনাে গোয়াল ঘর কাৎ হয়ে আছে, কোনােটা দুমড়ে মুচড়ে মাটিতে পড়ে গেছে। কারও কারও গােয়াল থেকে রশি ছিড়ে গরুগুলাে কোথায় পালিয়ে গেছে। কোনটার গলায় ফাঁসি লাগার মতাে অবস্থা। গৃহস্থেরা তাড়াতাড়ি রশি কেটে গরুগুলােকে বাঁচানাের ব্যবস্থা করল। এক স্থানে দেখা গেল এক পথচারী বজ্রাহত হয়ে দাড়িয়ে আছে। তাকে স্পর্শ করার সাথে সাথে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তার দেহে প্রাণের স্পন্দন নেই। পথেঘাটে মাঠে ময়দানে কত পাখি মরে ও আধমরা হয়ে পড়ে আছে তার কোনাে হিসাব নেই। ডিমসহ পড়ে আছে অসংখ্য বাবুই পাখির বাসা। রাশি রাশি আম পড়ে গাছতলা ভরে আছে। ঘরদোর ও গরুবাছুরের দুর্দশার কারণে ওদিকে কারও মনােযােগ নেই। এমন ভয়ঙ্কর কালবৈশাখীর রাত আগে আমি আর কখনো দেখি নি।

উপসংহার : প্রকৃতির রুদ্ররােষের কাছে আমরা অসহায়। বৈশাখ মাস এলে প্রতিবছরই কালবৈশাখী হয়। কোনাে কোনাে অঞ্চলে ভয়াবহ এবং কোনাে কোনাে অঞ্চলে ছােট ধরনের ঝড় হয়। কিন্তু ঝড় থেকে রেহাই পায় না বাংলাদেশের মানুষ। প্রকৃতির এই তাণ্ডবলীলা মােকাবেলা করেই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post