রচনা : সমাজসেবা

↬ সমাজসেবা ও মানবসেবা

↬ সমাজসেবার প্রয়ােজনীয়তা


অন্ধজনে দেহাে আলাে, মৃতজনে দেহে প্রাণ।
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ভূমিকা : মানুষ সামাজিক জীব। সমাজই মানুষের গড়া প্রথম প্রতিষ্ঠান। পরস্পর নির্ভরশীলতা ছাড়া মানুষের সামাজিক জীবন সুখকর হতে পারে না। সেজন্য কোনাে সমর্থ মানুষ যদি তার কল্যাণের হাত প্রসারিত না করে তাহলে মানুষের জীবন থেকে দুঃখ-বেদনা দূর হতে পারে না। জীবনের সুন্দর বিকাশের জন্য মানুষ একে অপরের সহায়তার প্রত্যাশী। আবার নিজের স্বার্থ সাধনের মধ্যে মানবজীবনের সার্থকতা নিহিত রয়েছে মহৎ মানুষ সে ব্যক্তি যিনি নিজের স্বার্থের কথা বিবেচনা না করে পরের উপকারের জন্য জীবন উৎসর্গ করেন। মানব চরিত্রের এ বৈশিষ্ট্য থেকে সমাজসেবার প্রবণতা এসেছে বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষ একদিন সমাজ গড়েছিল এবং এখনাে তারা সমাজ ছাড়া বেঁচে থাকতে করে না। তাই সমাজসেবা আমাদের প্রধান কর্তব্য।

সমাজ গঠনের উদ্দেশ্য : সৃষ্টির প্রথমে মানুষ খুবই অসহায় ছিল। বন্যজন্তুর ভয়ে সব সময় তাদের ভীত থাকতে হতাে। কীভাবে ঘরবাড়ি তৈরি করতে হয়, তা তাদের জানা ছিল না। তারা পর্বতের গুহায় কিংবা গাছের শাখায় বাস করত। নিজের আহারের সন্ধানে বের হয়ে অনেক সময় তারা বন্যজন্তুর শিকারে পরিণত হতাে। তবে মানুষকে আল্লাহ বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে পৃথিবীতে পয়দা করেছিলেন। তাদের সমস্যার সমাধান তারা। নিজেরাই একদিন করে নিল। বন্য হিংস্র জন্তুর আক্রমণ থেকে বেঁচে থাকার জন্যই মানুষ সমাজবদ্ধ হলাে এবং সৃষ্টি করল সমাজ। সমাজ গড়ে তুলে মানুষ সব জীবজগতের ওপর নিজেদের আধিপত্য কায়েম করল এবং ধীরে ধীরে তারা গােটা পৃথিবীর মনিব হয়ে বসল। মানুষ কেউই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়– পরস্পর নির্ভরশীল। অতএব, একের প্রয়ােজনে অপরকে অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে। পৃথিবীতে সুখী সমাজ গড়ে তুলতে হলে এটি একান্ত প্রয়ােজন।

সমাজসেবার তাৎপর্য : সমাজ বলতে একটি বিশেষ গন্ডির জনগােষ্ঠী বােঝায়। কিছুসংখ্যক লােককে নিয়ে গড়ে ওঠে সমাজ। বিশেষ গন্ডির মানুষকে নিয়ে গঠিত সমাজের কল্যাণকর্মই সমাজসেবা। সমাজসেবা বলতে সমাজের অন্তর্গত মানুষের নানা ধরনের কল্যাণ কাজ বােঝায়। এদিক থেকে জনসেবার সঙ্গে সমাজসেবার কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। দেশের জনগণের সার্বিক কল্যাণের জন্য যে কাজ তা জনসেবা বলে বিবেচিত হতে পারে। কিন্তু সমাজসেবা সমাজের মানুষের কল্যাণের জন্য প্রত্যেক সমাজের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। তার সমস্যা পৃথক। সমাধানের উপায়ও একরকম নয়। সমাজের সমস্যা নিরসন করে সেখানকার মানুষের কল্যাণই সমাজসেবা। সমাজের মধ্যে বসবাসরত মানুষের বিভিন্ন দিকের কল্যাণই সমাজসেবা বলে আখ্যায়িত হতে পারে। অনেক মহাপুরুষ পৃথিবীতে জন্ম নিয়ে সমাজসেবার ওপর গুরুত্ব আরােপ করেছিলেন।

সমাজসেবার প্রয়ােজনীয়তা : সমাজে নানা ধরনের লােকজন বসবাস করে। তাদের নানা সমস্যা থাকে। এসব সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা এককভাবে কারও নেই। সামাজিক কুসংস্কার, অর্থনৈতিক সংকট, জনসংখ্যা বৃদ্ধিজনিত সমস্যা, নিরক্ষরতা, যাতায়াতের সমস্যা, ধর্মের অজ্ঞতা, স্বাধিকার চেতনার অভাব ইত্যাদি ধরনের সমস্যায় সমাজ পরিপূর্ণ। এসব সমস্যা থেকে রেহাই না পেলে সমাজে মানুষের দুর্গতির শেষ থাকে না। তাদের উন্নতির পথ বন্ধ থাকে। এসব সমস্যা দূর করার জন্য নিবেদিতপ্রাণ সমাজসেবকের অবদান থাকা প্রয়োজন। পরােপকারী মানুষ সমাজের এসব সমস্যা দূর করে সেখানে সুন্দর সমাজ গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে।

সমাজ ও ধর্ম : ব্যক্তির নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য একদিন সমাজ গড়ে উঠেছিল। আবার ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার জন্য ধর্ম মানুষকে নানাভাবে সহায়তা করেছে। তবে সমাজকে বাদ দিয়ে কখনাে ধর্ম তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে না। পৃথিবীতে সমাজের সৃষ্টি হয়েছে এবং তারপর এলেছে ধর্ম। তাই সমাজসেবা করলেই ধর্মের বিধানগুলাে পুবাে পুরি পালন করা হয়ে যায়। প্রত্যেক ধর্মেই বলা হয়েছে, অন্যের হক নষ্ট করা যাবে না এবং ধনী-গরিব, অন্ধ-আতুর, দুগ্ধ-কাঞ্জলি, শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সব মানুষের সেবা করতে হবে। এটি মূলত সমাজসেবাই আদর্শ। দিনরাত মসজিদে বসে আল্লাহর নাম যিকির করতে হবে, ধর্ম এর ওপর গুরুত্ব আরােপ করে নি। বরং দিনে মাত্র পাঁচবার মহান আল্লাহর নাম স্মরণ করে পরিবার পরিজন ও প্রতিবেশীর সেবায় অর্থাৎ, সমাজের সেবায় আত্মনিয়ােগ করতেই ধর্ম মানুষকে নির্দেশ দিয়েছে। কারও ঘরে অভাব থাকলে সে প্রতিবেশীকে অভুক্ত রাখতে পারবে না। ধর্ম বারবার এ কথার ওপর জোর দিয়েছে। অতএব, সমাজসেবাই যে ধর্মের গােড়ার কথা– তাতে এ কথাটিই স্পষ্ট বােঝা যাচ্ছে।

সমাজসেবা ও ছাত্রসমাজ : যখন সমগ্র সমাজ থাকে অজগর নিদ্রায় নিমগ্ন তখনই ছাত্রসমাজের ঘুম ভাঙে। যুগে যুগে ছাত্রসমাজের ইতিহাসে রয়েছে তার উজ্জ্বল সাক্ষ্য। সমাজের অন্যায়, অসত্য ও প্রবনার বিরুদ্ধে তাদের চিরন্তন সংগ্রাম। যেখানে ব্যথা-বেদনার হাহাকার, আর্ত পীড়িতের ক্রন্দন রােল, সেখানেই ছাত্রসমাজের নির্ভীক উপস্থিতি। সবুজ, সতেজ ছাত্রসমাজ জাতির সবচেয়ে বলিষ্ঠতম অংশ। নবীন প্রাণশক্তি অফুরন্ত উচ্ছ্বাসে ভরপুর; তাদের দেহমন, হৃদয়ে তাদের অসীম দুঃসাহস, বাহুতে নবীন বল। তাদের চোখে উদ্দীপনার জ্বলন্ত মশাল, বুকে অসম্ভবকে চ্যালেঞ্জ করার দুর্জয় প্রতিশ্রুতি। প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা এই তরুণ দল জাতির অসীম শক্তি ও সম্ভাবনার প্রতীক। সামাজিক স্বাধীনতা, প্রগতি ও কল্যাণের স্বার্থে জীবন বলিদানের জন্য তারা চির-অজগীকারবদ্ধ। সামাজিক শক্তির এই সবচেয়ে সতেজ অংশটি বিকাশের যথাযােগ্য সুযােগ লাভ করলে বহু অসাধ্য সাধিত হতে পারে, সামাজিক কল্যাণের বহু রুদ্ধদ্বার উদঘাটিত হতে পারে। বাংলাদেশের মতাে গরিব দেশে, যেখানে সাধারণ মানুষের দুঃখ-দারিদ্র্যের অন্ত নেই, নিরক্ষরতা ও অশিক্ষা-কুশিক্ষার শুদ্ধতাপে যেখানে নিরানন্দ মরুভূমি তার দ্বায়ী আসন পেতে বসেছে, যেখানে রােগ-তাপ-জর্জরতায় এবং প্রাকৃতিক দৈব-দুর্বিপাকে লাখ লাখ মানুষের জীবন প্রতিবছর বিপন্ন ও অসহায় হয়ে পড়ে সেখানে ছাত্রসমাজের ভূমিকা অসামান্য। অর্থাৎ, বাংলাদেশের মতাে নিরক্ষরতা-পীড়িত, দারিদ্র-জর্জর, রােগ জর্জর সমস্যা জর্জর দেশে ছাত্রসমাজের সামনে পড়ে আছে সমাজসেবার বিস্তীর্ণ প্রান্তর। প্রকৃতির নিষ্করুণ রুদ্রশাপে এদেশে মানুষের দুঃখ-দুর্গতির অন্ত নেই। বন্যা-প্লাবন-জলােচ্ছাস এবং ভূমিকম্প, ঘূর্ণিবাত্যা ধসের ফলে প্রতিবছরই বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্যে ঘনিয়ে আসে দুঃখের অমারাত্রি। এসব ক্ষেত্রে ছাত্রসমাজ স্বেচ্ছাকৃতভাবেই অনেক সময় সমাজসেবায় ঝাপিয়ে পড়ে। দুঃখ-সংকটের আবর্ত মাঝে নিজেদের নিক্ষেপ করে তারা বিপন্নের উদ্ধারে রচনা করে আত্মত্যাগের নতুন ইতিহাস।

সমাজসেবার পদ্ধতি : সমাজসেবার জন্য নানা রকম পদ্ধতি রয়েছে। সমাজের সমস্যার প্রকৃতির সঙ্গে এই পদ্ধতির সংযােগ আছে। যেখানে যে পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায় সেখানে তা করা উচিত। শহরের বিভিন্ন মহল্লায় এবং পল্লির বিভিন্ন অঞ্চলে নানা রকম সেবা সংগঠন করে তার মাধ্যমে জনসাধারণের সেবা করা যেতে পারে। এসব সংঘের সভ্য হয়ে যুবক-যুবতিরা নিজ নিজ এলাকা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে পারে, রাস্তাঘাট নির্মাণ ও পুনঃনির্মাণ করতে পারে এবং দুস্থ লােকের সেবা করতে পারে। নিরক্ষরতার সমস্যা মােকাবেলায় গণশিক্ষা কেন্দ্র খুলতে হবে। সেখানে আর্থিক সমর্থন দরকার। আবার নিজের শ্রম নেওয়া যেতে পারে। স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে সমাজের অনেক উপকার করা যায়। অনেক ক্ষেত্রে শুধু বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে সমাজের কল্যাণ আনয়ন করা সম্ভব। আর্থিক বা বিভিন্ন সেবা দ্বারা সমাজের মঙ্গল করা যেতে পারে। সমাজের মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করলে তাতে বেশি উপকার হয়। এতে একদিকে যেমন সমাজের উপকার হয়, অন্যদিকে তেমনই সেবায় আনন্দ পাওয়া যায়।

উপকারিতা : সমাজসেবার মাধ্যমে মানুষের তথা সমাজের অনেক উপকার সাধন করা যায়। সমাজের দুঃখ-দুর্দশা মােচনের জন্য সমাজসেবীরা কাজ করে থাকে। যেসব সমস্যা সমাজে বসবাসরত মানুষ সমাধান করতে পারে না, সেসব সমস্যা সমাজসেবীরা দূর করতে সাহায্য করে। এতে সমাজ সমস্যামুক্ত হয়। সমাজে বসবাস আনন্দদায়ক হয়। সমাজ এগিয়ে যায় উন্নতির দিকে। তাই সবার মধ্যে সেবামূলক মনােভাব গড়ে ওঠা দরকার।

উপসংহার : মানুষ সামাজিক জীব। সমাজ তাদের ব্যক্তিস্বাধীনতার নিরাপত্তা বিধান করেছে এবং আরও নানা রকম সুবিধা ভােগ করার সুযােগ দিয়েছে। নিজের স্বার্থে মগ্ন থাকাই জীবন নয়। পরের কারণে জীবন উৎসর্গ করার মধ্যেই আনন্দ নিহিত। অতএব, সমাজের কল্যাণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা আমাদের প্রত্যেকের অবশ্য কর্তব্য।


আরো দেখুন :
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post