খুদে গল্প : ধরাতলে নরাধম

'ধরাতলে নরাধম' শিরোনামে একটি খুদে গল্প লেখ।

ধরাতলে নরাধম

আমার ছেলেবেলা কেটেছে গ্রামে, যৌথ পরিবারের সঙ্গে। বাড়িভর্তি, মাঠভর্তি ছেলে-মেয়ের হৈ হুল্লোড়, খেলা-ধুলা, ঘুড়ি ওড়ানো, মাছ ধরা, গ্রামের পুকুরে ডুব সাঁতার, পাখির বাচ্চা চুরি, স্কুল পালানো, বর্ষায় বৃষ্টিতে ভিজা, মোচার খোলার তরি ভাসানো, গুলতি দিয়ে কাক তাড়ানো, শিমুল ফুল দিয়ে মালা গাঁথা, কলার খোল কেটে রুটি বিস্কুট বানানো, কাঁঠাল পাতা দিয়ে টাকা বানিয়ে সেসব কেনা, বাঁশের চোঙা কাঠি দিয়ে বরই চটকে খাওয়া- কতরকম কাজের মধ্য দিয়ে, আনন্দের মধ্য দিয়ে কেটেছে ছেলেবেলার সেসব দিন। ছেলেবেলার কত ঘটনা মনে পড়ে। আমি তখন ক্লাস টু তে পড়ি। বই পড়ে মনে রাখার চেয়ে শুনে শুনেই তখন বেশি মনে থাকত। দাদার কাছে গল্প শুনতে শুনতে সে অভ্যাস গড়ে ওঠেছিল। তারপর বড় হয়ে জেনেছি দাদার বলা সেই গল্পগুলো কোনটি বনফুলের, কোনটি বিদ্যাসাগরের অনুবাদ। যাক সে কথা, তো আমি তখন ক্লাস টু'র ছাত্র। ঘরে আমার মা, আমার শিক্ষক, বাইরে দাদা। দাদা আর মা আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। দাদার সঙ্গে বাড়ির কাছে হাটে যেতাম। আমাদের স্কুলের প্বার্শে বাজার। সপ্তাতে দু দিন, শনি ও মঙ্গলবার হাট বসত। লক্ষ্মীপুরের হাট লক্ষ্মীর বাজারের এক পাশে ঈদগাহ মাঠ, এক পাশে পাকা রাস্তা, অন্য দুদিকের একদিকে ধানখেত অন্যদিকে বিশাল পুকুর। এই এলাকায় তিনটি গাছ ছিল- পাকা রাস্তার পাশে '৭১ এর গুলির চিহ্ন বুকে নিয়ে বিশাল রেইনট্রি গাছ। আমরা তখন বলতাম এরাইচ গাছ। ঈদগাহের মাঠের কোনে ঐরকম এক ক্ষত চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রকান্ড বট গাছ। ক্ষত বলতে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই গাছ দুটির গায়ে এতো গুলি লেগেছিল ছিল যে, তা কাঠ পুড়ে ক্ষত হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব অপারেশন হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। এখানে পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে একটি গণকবর আছে। আর পুকুরের পশ্চিম পাশে ছিল বিশাল বড় একটি নিমগাছ। নিমগাছ এতো বড় হয়! কল্পনাও করা যায় না। বহুদূর থেকে দেখা যেত এ গাছ। এই গাছের একটু দূরে পশ্চিম দিকে মুখ করে একজন ডাক্তার বসতেন। তার নাম দুদু ডাক্তার। ফরসা গোলগাল চেহারা, চোখে চশমা। তিনি চটের পর সাদা চাঁদর বিছিয়ে খোলা জায়গায় ঔষধপত্র নিয়ে বসতেন। এক পাশে তিনি আসন নিতেন আর তিন পাশে ঔষধের শিশি থাকত, মাঝখানে থাকত নানারকম ট্যাবলেট। খোলা ট্যাবলেট থাকত কৌটার মধ্যের। কৌটার উপর লেবেল লাগানো থাকত। প্রেশার মাপার যন্ত্রপাতি থাকত একপাশে। আমি দাদার সাথে হাটে গেলে সেখানে যেতাম। দাদার সাথে তার বেশ খাতির ছিল। আমাকে তিনি লজেন্স খাওয়াতেন। দুটো দিলে একটা ভাইয়ের জন্য নিয়ে যেতাম। বড় ভাই খেয়ে বলত খুব মজা। অন্যদিনের মতো সেদিনও তিনি দোকান সাজিয়ে বসেছেন। এমি একটু দূরে দাদার হাত ধরে দাঁড়িয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছি হঠাৎ একটা লোক এসে ঐ বিছানার ওষুধপত্র সব ছুড়ে ফেলে দিল। ওষুধের কতগুলো শিশি ভেঙে গেল। ডাক্তার সাহেব থামাতে পারলেন না। তিনি শুধু প্রেসার মাপার যন্ত্রগুলো হাতে নিয়ে সরে দাঁড়ালেন। এর মধ্যে কেউ একজন বলল লোকটা কসাই। কেউ একজন তাকে এখানে বসার জায়গা দিয়েছে। সে জন্যই তারা তাকে বসতে দিবে না। তাঁর জিনিসপত্র এরকম পড়ে যেতে দেখে আমার খুব কান্না পেল। আমি কাঁদছি দেখে ডাক্তার সাহেব এগিয়ে এসে আমাকে কাছে টানলেন। আমার হাত ধরে ঝাঁকি দিয়ে কান্না থামাতে বললেন। বললেন- ছিঃ ছিঃ কাঁদে না, কাঁদে তো ছোট মানুষরা, তুমি তো অনেক বড় মানুষ, তুমি কাঁদছ কেন? তারপর আমার নাম, স্কুলের নাম, কোন ক্লাসে পড়ি সব জিজ্ঞাসা করল। ঐ দিকে দাদা চলে গেছেন ভিড়ের মধ্যে। লোকজন জড়ো হয়েছে কেন ডাকাত তার জিনিসপত্র তছনছ করলো তা জানতে। ডাক্তার সাহেব আমার শরীর ধরে ঝাঁকি দিলেন। আমার মনোযোগ আকর্ষন করলেন, আমি তাঁর দিকে তাকালাম। তিনি আমাকে আজকে ঘটনা উদ্দেশ্য করে একটি ছড়া শুনালেন-
উই আর ইঁদুরের দ্যাখো ব্যবহার
যাহা পায়,তাহা কেটে করে ছারখার
কার্ড কাটে, কাষ্ঠ কাটে, কাটে সমুদয়
ধরাতলে নরাধম খল আছে যতো
ঠিক তারা উই আর ইঁদুরের মতো।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post