ব্যাকরণ : ধ্বনির পরিবর্তন

ধ্বনির পরিবর্তন

ভাষা বহমান নদীর মতো। এই বহমানতা রক্ষিত হয় মৌখিকভাবে ধ্বনি পরিবর্তন এবং লেখার ক্ষেত্রে বিবর্তিত শব্দের মাধ্যমে। ১৮৭০ সালে বিশ্ব ধ্বনিবিজ্ঞানীরা একমত হয়ে বললেন যে, ভাষায় ধ্বনি পরিবর্তন একটি নিয়মিত ব্যাপার। কোনো ভাষার ধ্বনি পরিবর্তন স্বাভাবিকভাবে বন্ধ হয়ে গেলে তা মৃত ভাষায় পরিণত হবে এবং অতি পরিবর্তন হলে সে ভাষ তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য / স্বকীয়তা হারাবে।

ধ্বনির পরিবর্তন : কোনো ভাষার শব্দ বহুজনে ব্যবহার হতে হতে কখনো সেই শব্দের ধ্বনিসমূহে নির্দিষ্ট ক্রমরক্ষা হয় না অথবা এর কোনো কোনো ধ্বনি লোপ বা এতে ধ্বনির আগমন ঘটে কিন্তু আগের অর্থ বোঝায়। শব্দের ধ্বনিসমূহের এ রূপ পরিবর্তনকে ধ্বনি পরিবর্তন বলে। যেমন— 

স্কুল > ইস্কুল
পিশাচ > পিচাশ 
ঝিনাইদহ > ঝিনাইদ > ঝিনেদা ইত্যাদি। 

ধ্বনি পরিবর্তনের কারণসমূহ : 
  • উচ্চারণের দ্রুততা
  • উচ্চারণের সহজতা 
  • উচ্চারণের সময় অসাবধানতা 
  • মুখগহ্বরের প্রত্যঙ্গ আড়ষ্টতা বা হীনতা 

ধ্বন্যাগম : এক ধরনের ধ্বনি পরিবর্তন। উচ্চারণের কারণে অনেক শব্দে যে ধ্বনি নেই তাও এসে গেলে তাকে ধ্বনির আগম বা ধ্বন্যাগম বলে। আগত ধ্বনি স্বরধ্বনি হলে তাকে স্বরাগম এবং আগত ধ্বনি ব্যঞ্জনধ্বনি হলে তাকে ব্যঞ্জনাগম বলে। 

✔ ভাষার পরিবর্তন ধ্বনির পরিবর্তনের সাথে সম্পৃক্ত। ধ্বনি পরিবর্তন নানা প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়। নিম্নে সেগুলো উল্লেখ করা হলো—

আদি স্বরাগম (Prothesis) : উচ্চারণের সুবিধার জন্য বা অন্য কোনো কারণে শব্দের আদিতে স্বরধ্বনি এলে তাকে আদি স্বরাগম (Prothesis) বলে। যেমন— 

স্কুল > ইস্কুল, 
স্টেশন > ইস্টিশন, 
স্ত্রী > ইস্ত্রী, 
স্তাবল > আস্তাবল, 
স্টিমার > ইস্টিমার। 

এরূপ আরো— আস্তাবল, আস্পর্ধা ইত্যাদি। 

মধ্য স্বরাগম, বিপ্রকর্ষ বা স্বরভক্তি (Anaptyxis) : সময় সময় উচ্চারণের সুবিধার জন্য সংযুক্ত ব্যঞ্জন—ধ্বনির মাঝখানে স্বরধ্বনি আসে। একে বলা হয় মধ্য স্বরাগম, বিপ্রকর্ষ বা স্বরভক্তি (Anaptyxis)। যেমন—

অ — রত্ন > রতন, ধর্ম > ধরম, স্বপ্ন > স্বপন, হর্ষ > হরষ ইত্যাদি। 
ই — প্রীতি > পিরীতি, ক্লিপ > কিলিপ, ফিল্ম > ফিলিম ইত্যাদি। 
উ — মুক্তা > মুকুতা, তুর্ক > তুরুক, ভ্রূ > ভুরু ইত্যাদি। 
এ — গ্রাম > গেরাম, প্রেক > পেরেক, স্রেফ > সেরেফ ইত্যাদি।
ও — শ্লোক > শোলোক, মুরগ > মুরোগ > মোরগ ইত্যাদি। 

অন্ত্যস্বরাগম (Apotheosis) : কোনো কোনো সময় শব্দের শেষে অতিরিক্ত স্বরধ্বনি আসে। এরূপ স্বরাগমকে বলা হয় অন্ত্যস্বরাগম। যেমন—

দিশ্ > দিশা 
পোখত্ > পোক্ত
বেঞ্চ > বেঞ্চি 
সত্য > সত্যি ইত্যাদি। 

অপিনিহিতি (Apenthesis) : পরের ই—কার আগে উচ্চারিত হলে কিংবা যুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনির আগে ই—কার বা উ—কার উচ্চারিত হলে তাকে অপিনিহিতি বলে। যেমন—

আজি > আইজ
সাধু > সাউধ
রাখিয়া > রাইখ্যা 
বাক্য > বাইক্য 
সত্য > সইত্য 
চারি > চাইর 
মারি > মাইর ইত্যাদি। 

অসমীকরণ (Dissimilation) : একই স্বরের পুনরাবৃত্তি দূর করার জন্য মাঝখানে যখন স্বরধ্বনি যুক্ত হয়, তখন তাকে অসমীকরণ বলে। যেমন—

ধপ + ধপ > ধপাধপ
টপ + টপ > টপাটপ ইত্যাদি।

স্বরসংঙ্গতি (Vowel harmony) : একটি স্বরধ্বনির প্রভাবে শব্দে অপর স্বরের পরিবর্তন ঘটলে তাকে স্বরসঙ্গতি বলে। অর্থাৎ এখানে পরপর দুটি স্বরধ্বনি থাকবে এবং উচ্চারনের সময় তাদের একটি পরিবর্তিত হয়ে অন্যটির মতো হবে। যেমন— দেশি > দিশি, বিলাতি > বিলিতি, মুলা > মুলো, অতি > ওতি, কবুল > কোবুল, জুতা > জুতো, নৌকা > নৌকো, মিথ্যা > মিথ্যে, পূজা > পুজো, সুতা > সুতো, মিঠা > মিঠে, ধূলা > ধুলো, শিখা > শেখা, রূপা > রূপো, বন্যা > বুনো ইত্যাদি।

(ক) প্রগত (progressive) : আদিস্বর অনুযায়ী অন্ত্যস্বর পরিবর্তিত হলে প্রগত স্বরসংঙ্গতি হয়। যেমন— মুলা > মুলো, শিকা > শিকে, তুলা > তুলো।

(খ) পরাগত (Regressive) : অন্ত্যস্বরের কারণে আদ্যস্বর পরিবর্তিত হলে পরাগত স্বরসংঙ্গতি হয়। যেমন— আখো > আখুয়া > এখো, দেশি > দিশি ইত্যাদি।

(গ) মধ্যগত (Mutual) : আদ্যস্বর ও অন্ত্যস্বর অনুযায়ী মধ্যস্বর পরিবর্তিত হলে মধ্যগত স্বরসংঙ্গতি হয়। যেমন— বিলাতি > বিলিতি ইত্যাদি।

(ঘ) অন্যোন্য (Reciprocal) : আদ্য ও অন্ত্য দুই স্বরই পরস্পর প্রভাবিত হলে অন্যোন্য স্বরসংঙ্গতি হয়। যেমন— মোজা > মুজো ইত্যাদি।

(ঙ) চলিত বাংলায় স্বরসংঙ্গতি : গিলা > গেলা, মিলামিশা > মেলামেশা, মিঠা > মিঠে, ইচ্ছা > ইচ্ছে ইত্যাদি। পূর্বস্বর উ—কার হলে পরবর্তী স্বর ও—কার হয়। যেমন— মুড়া > মুড়ো, চুলা > চুলো ইত্যাদি। বিশেষ নিয়মে— উড়ুনি > উড়নি, এখনি > এখুনি হয়।

সম্প্রকর্ষ বা স্বরলোপ : দ্রুত উচ্চারণের জন্য শব্দের আদি, অন্ত্য বা মধ্যবর্তী কোনো স্বরধ্বনির লোপকে বলা হয় সম্প্রকর্ষ বা স্বরলোপ। যেমন— বসতি > বস্ তি, জানালা > জান্ লা ইত্যাদি।

(ক) আদিস্বরলোপ (Aphesis) : শব্দের আদিতে বা প্রথমে স্বরধ্বনি লোপ পেলে। যেমন— অলাবু > লাবু > লাউ, উদ্ধার > উধার, ধার ইত্যাদি।

(খ) মধ্যস্বর লোপ (Syncope) : শব্দের মধ্যে স্বরধ্বনি লোপ পেলে। যেমন— অগুরু > অগ্রু, সুবর্ণ > স্বর্ণ, বসতি > বস্ তি, গামোছা > গাম্ ছা, তৈআরি > তৈরি, উপরে > উপ্রে ইত্যাদি।

(গ) অন্ত্যস্বর লোপ (Apocope) : শব্দের শেষে বা অন্তে স্বরধ্বনি লোপ পেলে। যেমন— আশা > আশ, আজি > আজ, চারি > চার (বাংলা), সন্ধ্যা > সঞঝা > সাঁঝ, আশা (আ) > আশ। (স্বরলোপ বস্তুত স্বরাগমের বিপরীত প্রক্রিয়া।)

ধ্বনি বিপর্যয় : শব্দের মধ্যে দুটি ব্যঞ্জনের পরস্পর পরিবর্তন ঘটলে তাকে ধ্বনি বিপর্যয় বলে। অর্থাৎ এরা উচ্চারনের জন্যে কতক সময় স্থান পরিবর্তন করে। যেমন— ইংরেজি বাস্ক > বাংলা বাসক, জাপানি রিক্সা > বাংলা রিস্কা ইত্যাদি। অনুরূপ— পিশাচ > পিচাশ, লাফ > ফাল, নকশা > নশকা, কলমি > কমলি, বাক্স > বাসক, লাফ > ফাল > তলোয়ায়

সমীভবন (Assimilation) : শব্দমধ্যস্থ দুটি ভিন্ন ধ্বনি একে অপরের প্রভাবে অল্প - বিস্তর সমতা লাভ করে। এ ব্যাপারকে বলা হয় সমীভবন। অর্থাৎ৷ উচ্চারনের সময় পাশাপাশি অবস্থিত দুটি ব্যঞ্জনধ্বনি একই রকম হয়ে যাওয়া কিংবা একই রকম হওয়ার প্রবণতাকে সমীভবন বলে। যেমন— জন্ম > জম্ম, কাঁদনা > কান্না, দুর্গা > দুগ্গা ইত্যাদি

(ক) প্রগত সমীভবন : পূর্ব ধ্বনির প্রভাবে পরবর্তী ধ্বনির পরিবর্তন ঘটে। অর্থাৎ পরবর্তী ধ্বনি পূর্ববর্তী ধ্বনির মতো হয়, একে প্রগত সমীভবন বলে। এখানে পরিবর্তনটি ২য় ধ্বনিতে ঘটে এবং ২য় ধ্বনি ১ম ধ্বনির মতো হবে। যেমন— চক্র > চক্ ক, পক্ব > পক্ক, পদ্ম > পদ্দ, লগ্ন > লগ্ গ, চন্দন > চন্নন ইত্যাদি।

(খ) পরাগত সমীভবন : পরবর্তী ধ্বনির প্রভাবে পূর্ববর্তী ধ্বনির পরিবর্তন হয়, একে পরাগত সমীভবন বলে। এখানে ১ম ধ্বনিটি পরিবর্তন হয় এবং পরিবর্তন হয়ে সেটি পরের ধ্বনির মতো হয়। যেমন— গল্প > গপ্প, তৎ + হিত > তদ্ধুত, তৎ + জন্য > তজ্জন্য, তৎ + হিত > তদ্ধিত, উৎ + মুখ > উন্মুখ ইত্যাদি।

(গ) অন্যোন্য সমীভবন : যখন পরস্পরের প্রভাবে দুটো ধ্বনিই পরিবর্তিত হয় তখন তাকে বলে অন্যোন্য সমীভবন বলে। যেমন— সংস্কৃত সত্য > প্রাকৃত সচ্চ। সংস্কৃত বিদ্যা > প্রাকৃত বিজ্জা ইত্যাদি।

দ্বিত্ব ব্যঞ্জন বা ব্যঞ্জনদ্বিত্বা : কখনো কখনো জোর দেয়ার জন্য শব্দের অন্তর্গত ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব উচ্চারণ হয়, একে বলে দ্বিত্ব ব্যঞ্জন বা ব্যঞ্জনদ্বিত্বা। যেমন— পাকা > পাক্কা, সকাল > সক্কাল ইত্যাদি। 

ব্যঞ্জন বিকৃতি : শব্দ-মধ্যে কোনো কোনো সময় ব্যঞ্জন পরিবর্তিত হয়ে নতুন ব্যঞ্জনধ্বনি ব্যবহৃত হয়। একে বলে ব্যঞ্জন বিকৃতি। যেমন— কবাট > কপাট, ধোবা > ধোপা, ধাইমা > দাইমা ইত্যাদি। 

ব্যঞ্জনচ্যুতি : পাশাপাশি সমউচ্চারণের দুটি ব্যঞ্জনধ্বনি থাকলে তার একটি লোপ পায়। এরূপ লোপকে বলা হয় ব্যঞ্জনচ্যুতি। এর অপর নাম ধ্বনিচ্যূতি। যেমন— বউদিদি > বউদি, বড় দাদা > বড়দা ইত্যাদি। 

অন্তর্হতি : পদের মধ্যে কোনো ব্যঞ্জনধ্বনি লোপ পেলে তাকে অন্তর্হতি বলে। যেমন— ফাল্গুন > ফাগুন, ফলাহার > ফলার, আলাহিদা > আলাদা ইত্যাদি। 

অভুশ্রুতি : বিপর্যস্ত স্বরধ্বনি পূর্ববর্তী স্বরধ্বনির সাথে মিলে গেলে এবং তদানুযায়ী পরবর্তী স্বরধ্বনির পরিবর্তন ঘটলে তাকে বলে অভিশ্রুতি। যেমন— করিয়া থেকে অপিনিহিতির ফলে 'কইরিয়া' কিংবা বিপর্যয়ের ফলে 'কইরা' থেকে অভিশ্রুতিজাত 'করে'। এরূপ— শুনিয়া > শুনে, বলিয়া > বলে, হাটুয়া > হাউটা > হেটো, মাছুয়া > মেছো ইত্যাদি। 

র—কার লোপ : আধুনিক চলিত বাংলায় অনেক ক্ষেত্রে র—কার লোপ পায় এবং পরবর্তী ব্যঞ্জন দ্বিত্ব হয়। যেমন— তর্ক > তক্ক, করতে > কত্তে, মারল > মাল্ল, করলাম > কল্লাম।

হ—কার লোপ : আধুনিক চলিত ভাষায় অনেক সময় দুই স্বরের মাঝামাঝি হ—কারের লোপ পায়। যেমন— পুরোহিত > পুরুত, গাহিল > গাইল, চাহে > চায়, সাধু > সাহু > সাউ, আরবি আল্লাহ্ > বাংলা আল্লা, ফারসি শাহ্ > বাংলা শা ইত্যাদি। 

য়—শ্রুতি ও ব—শ্রুতি : শব্দের মধ্যে পাশাপাশি দুটো স্বরধ্বনি থাকলে যদি এ দুটো স্বর মিলে একটি দ্বি—স্বর (যৌগিক স্বর) না হয়, তবে এ স্বর দুটোর মধ্যে উচ্চারণের সুবিধার জন্য একটি ব্যঞ্জনধ্বনির মতো অন্তঃস্থ 'য়' ( বা অন্তঃস্থ 'ব' উচ্চারিত হয়। এই অপ্রধান ব্যঞ্জনধ্বনিটিকে বলা হয় য়—শ্রুতি ও ব—শ্রুতি। যেমন— মা + আমার = মা (য়) আমার > মায়ামার। যা + আ = যা (ও) য়া = যাওয়া। এরূপ— নাওয়া, খাওয়া, দেওয়া ইত্যাদি। 

এবার কিছু বিষয় প্রশ্ন আকারে দেওয়া হলো

 প্রশ্ন : র— ভ্রান্তি কীভাবে হয়?
উত্তর : অন্য ব্যঞ্জনের পূর্বে র—ধ্বনির আগমন পূর্বক উচ্চারণের মাধ্যমে র—ভ্রান্তি হয়ে থাকে। সাধারণত গ্রাম্য ও অশিক্ষিতজনের উচ্চারণে এই প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। অল্পশিক্ষিত লেখকের হাতে, যেখানে 'র' নেই সেখানে 'র'-এর আমদানি এই ভ্রান্তির কারণেই ঘটে থাকে বলে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন। যেমন— সাহায্য > (সাহারয্য) সাহার্য্য; চিন্তান্বিত > চিন্তার্ণিত; মোকদ্দমা > মোকর্দমা ইত্যাদি। 

প্রশ্ন : শূণ্যীকরণ কাকে বলে?
উত্তর : শব্দে/ হ/ ধ্বনির আগে বা পরে যদি স্বরধ্বনি থাকে তবে উচ্চারণের সময় অনেক ক্ষেত্রে/ হ/ ধ্বনির লোপ ঘটে। হ/ ধ্বনির এই লোপকরণ-রীতির নামই শূণ্যীকরণ। যেমন— বহে > বএ; রহে > রএ; সহে > সএ। আঞ্চলিক বা চলতিরীতির বাংলায় এর উদাহরণলভ্য।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post