প্রতিবেদন লেখার নিয়ম

প্রতিবেদন লেখার নিয়ম


সংজ্ঞা

‘প্রতিবেদন’ শব্দটি ইংরেজি Report-এর বাংলা পরিভাষা। ‘রিপোর্ট’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হচ্ছে- সমাচার, বিবরণী বা বিবৃতি। তবে এসব অর্থের পরিবর্তে বাংলায় ‘প্রতিবেদন’ শব্দটিই অধিক প্রচলিত। কোনো ঘটনা সম্পর্কে তথ্যভিত্তিক বর্ণনাত্মক বিবরণকে সাধারণত প্রতিবেদন বলা হয়। তবে কখনো কখনো কোনো সুনির্দিষ্ট ঘটনা বা বিষয়ে কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কোনো ব্যক্তি বা তদন্ত কমিশন কোনো খুঁটিনাটি অনুসন্ধানের পর সুপারিশসহ যে বিবরণ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রদান করে, তাও এক ধরনের প্রতিবেদন। এ ধরনের প্রতিবেদনকে অবশ্য তদন্ত প্রতিবেদন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

প্রতিবেদনের প্রকার

প্রতিবেদন সাধারণত তিন ধরনের হয়-
১ – সংবাদ প্রতিবেদন;
২ – সাধারণ প্রতিবেদন ও
৩ – কারিগরি প্রতিবেদন।

সংবাদ প্রতিবেদন

সংবাদপত্রে প্রকাশের নিমিত্তে লিখিত প্রতিবেদনকে সংবাদ প্রতিবেদন বলে। নিজস্ব সংবাদদাতা ও প্রতিবেদক এবং বিভিন্ন দেশি ও বিদেশি সংবাদ সংস্থার মাধ্যমে এসব সংবাদ প্রতিবেদন সংগ্রহ করা হয়।

সাধারণ প্রতিবেদন

সাধারণ প্রতিবেদনের পরিধি বা পরিসর অনেক বস্তৃত। সমিতি বা সংস্থার বার্ষিক রিপোর্ট; ব্যবসা-বাণিজ্যের অডিট বিষয়ক প্রতিবেদন; হত্যাকাণ্ড, দুর্ঘটনা ইত্যাদির কারণ অনুসন্ধান করে প্রণীত তদন্ত প্রতিবেদন প্রভৃতি এ ধরনের প্রতিবেদনের অন্তর্ভুক্ত।

কারিগরি প্রতিবেদন

কারিগরি কর্মক্ষেত্রে উদ্ভূত সমস্যার সমাধানে কিংবা উন্নয়ন প্রকল্পের কারিগরি দিকের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্যে প্রণীত যে প্রতিবেদন তাকে কারিগরি প্রতিবেদন বলে।

উল্লিখিত তিনটি ছাড়াও প্রতিবেদনের আরও শ্রেণিকরণ হতে পারে।

যেমন-
১. রীতিসিদ্ধ প্রতিবেদন;
২. রীতিবিরুদ্ধ প্রতিবেদন;
৩. বিধিবদ্ধ প্রতিবেদন;
৪. অবিধিবদ্ধ প্রতিবেদন;
৫. নিয়মিত প্রতিবেদন;
৬. বিশেষ প্রতিবেদন;
৭. সাময়িক প্রতিবেদন;
৮. প্রার্থিত প্রতিবেদন;
৯. নির্বাহী প্রতিবেদন;
১০. কোম্পানি প্রতিবেদন;
১১. অপ্রার্থিক প্রতিবেদন;
১২. সরকারি প্রতিবেদন;
১৩. তদন্ত প্রতিবেদন।

প্রতিবেদনের বৈশিষ্ট্য

প্রতিবেদন রচনার ক্ষেত্রে নিচের বৈশিষ্ট্যসমূহ সম্পর্কে সচেতন থাকা কর্তব্য-

১. পরিকল্পিত রূপরেখা : আঙ্গিক বা গঠন-কাঠামোর দিক থেকে প্রতিবেদনের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্রতিবেদন রচনার সময় একটি রূপরেখা তৈরি করে নিলে ভালো হয় না হলে প্রতিবেদন সুন্দর ও মানসম্মত হয় না।

২. যথাযথ ও সংহত ভাষা : বাড়তি, অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক তথ্যে যেন প্রতিবেদন ভারাক্রান্ত না হয় সেদিকে বিশেষ লক্ষ রাখা দরকার। সেজন্যে প্রতিবেদন রচনার সময় বাছাই করে কেবল অপরিহার্য তথ্যগুলোই সন্নিবিষ্ট করতে হবে।

৩. বস্তুনিষ্ঠ : প্রতিবেদন হতে হবে বস্তুনিষ্ঠ। অর্থাৎ কার্যকর প্রতিবেদনে অতিরঞ্জন বা অতিশয়োক্তি যেমন থাকতে পারবে না, তেমনি তা কোনোভাবেই পক্ষপাতিত্বমূলক হওয়া চলবে না। প্রকৃত ঘটনা ও তথ্য যথাসম্ভব নিরাবেগ ভাষায় স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করতে হবে।

৪. সহজবোধ্য : প্রতিবেদনের ভাষা হবে সহজ, সরল ও স্পষ্ট। কোনো বক্তব্য যেন দুর্বোধ্য এবং দ্ব্যর্থবোধক না হয় সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। প্রতিটি অনুচ্ছেদ শুরু করতে হবে প্রাসঙ্গিক বাক্য দিয়ে এবং প্রত্যেক অনুচ্ছেদে আলাদা আলাদা বিষয় সুসংহতভাবে পরিবেশিত হবে।

৫. সংগতিপূর্ণ উদ্দেশ্য : প্রতিবেদনের একটি সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য থাকে। প্রতিবেদন রচনার সময় মূল উদ্দেশ্য থেকে সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য যেন বিচ্যুত না হয়, সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে।

প্রতিবেদনের প্রয়োজনীয়তা

প্রতিবেদন আধুনিক জীবনের অপরিহার্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। প্রতিবেদন বলতে একসময় কেবল পত্র-প্রত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদকেই বোঝানো হতো। কিন্তু সম্প্রতি প্রতিবেদনের পরিসর সম্প্রসারিত হয়েছে। কোনো বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি, যেমন- পরীক্ষায় দুর্নীতি, হাসপাতালে চিকিৎসার অনিয়ম, এডিস মশার উপদ্রব প্রভৃতি বিষয়ের ওপর রচিত প্রতিবেদনের মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির জন্যে সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। আইন-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য ও কর্মজীবনের বিচিত্র জটিল ক্ষেত্রে প্রতিবেদনের উপযোগিতা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোনো সমস্যা ও সংকটে প্রতিবেদনের মাধ্যমে যে তথ্য পাওয়া যায় তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেও সংকট থেকে উত্তরণের পথ পাওয়া যায়।

অতএব কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ, সংগঠন, নির্দেশনা, নিয়ন্ত্রণ, ফলাফল নিরূপণ, সমন্বয় সাধন প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রতিবেদন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বিশেষত তদন্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রামাণ্য দলিল হিসেবে গণ্য হয় প্রতিবেদনটি। সুতরাং আধুনিক জীবনে প্রতিবেদনের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

প্রতিবেদকের দায়িত্ব

প্রতিবেদন তৈরি করার ক্ষেত্রে একজন প্রতিবেদককে প্রাথমিকভাবে তিনটি কাজ করতে হয়-
১. পর্যবেক্ষণ;
২. লিপিবদ্ধ, শ্রুতিবদ্ধ বা দৃশ্যবদ্ধকরণ;
৩. প্রতিবেদন প্রণয়ন।

প্রতিবেদককে প্রত্যক্ষ ঘটনার সাক্ষী হতে হয়, না হলে কোনো ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সে সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করতে হয়। অনেক সময় প্রতিবেদন রচনার ক্ষেত্রে হয়ত অতীতে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনার সঙ্গে তাকে যোগসূত্র রচনাও করতে হয়। এক্ষেত্রে প্রতিবেদক ইতিহাস লেখকের কাজ করে থাকেন। প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে প্রতিবেদককে সাধারণ ৬টি ‘ডব্লিউ’ (Who, What, When, Where, Why, How) দ্বারা প্রশ্নের মাধ্যমে বিষয়ের স্পষ্টতা আনতে হয়। তবে সকল ক্ষেত্রেই প্রতিবেদন হতে হয়- তথ্যনির্ভর। মনে রাখা দরকার, যথাযথ তথ্য ছাড়া প্রতিবেদন বস্তুনিষ্ঠ হয় না। উপযুক্ত পর্যবেক্ষণ, যথাযথ প্রর্যালোচনা, প্রয়োজনীয় বিচার-বিশ্লেষণ ও যথেষ্ট সতর্কতার সাথে প্রতিবেদন রচনা করতে হয়। প্রতিবেদন সাধারণত দুই থেকে তিন পৃষ্ঠার মধ্যে শেষ করা বাঞ্ছনীয়। তাছাড়া প্রতিবেদন চিত্র, নকশা, সারণি ইত্যাদি সংবলিত বাঁধাই করা খাতার আকারেও তৈরি হতে পারে।

সংবাদ প্রতিবেদনের নিয়ম

সংবাদ প্রতিবেদন রচনার কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে। সাধারণত সংবাদ প্রতিবেদন রচনার ক্ষেত্রে যেসব অপরিহার্য তা নিম্নরূপ।

১. শিরোনাম : প্রতিবেদনের শিরোনাম হবে সমালোচনাধর্মী ও আকর্ষণীয়।

২. সূচনা-অনুচ্ছেদ : সংবাদের পরের অংশের তুলনায় প্রথম বা সূচনা-অনুচ্ছেদের গুরুত্ব বেশি দিতে হবে। প্রথম অনুচ্ছেদ হবে সংক্ষিপ্ত, স্পষ্ট, স্বচ্ছ ও আকর্ষণীয়।

৩. উৎস-সূত্র : সূচনা অনুচ্ছেদেই প্রতিবেদনের উৎস-সূত্র বর্ণিত হবে। যেমন, বাসস জানাচ্ছে; কিংবা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকতা জানান ইত্যাদি।

৪. ব্যক্তিনাম পরিহার : প্রতিবেদনে ব্যক্তিনাম পরিহার করে পদমর্যাদা (সচিব, কর্মকর্তা, কারখানার শ্রমিকরা কিংবা ভুক্তভোগী এলাকাবাসী, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যক্তি ইত্যাদি ব্যবহার করা উচিত।

এছাড়া সংবাদ প্রতিবেদনে সময়, স্থান, সংখ্যা ইত্যাদি প্রয়োজনমতো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বিষয়ের উল্লেখ থাকতে হয়।

2 Comments

  1. ইতিহাসের কোন কিছু তুলে ধরতে হলে প্রতিবেদনে কি কি উল্লেখ করতে হবে

    ReplyDelete
  2. আমার পদ্মা সেতুর প্রভাব প্রতিবেদন টা লাগবে দয়া করে দিবেন

    ReplyDelete
Post a Comment
Previous Post Next Post