রচনা : প্রাচীন কীর্তির পাদপীঠ – সোনারগাঁ

ভূমিকা : বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকা হতে ২৭ কিলোমিটার পূর্বে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের মোগড়াপাড়া বাস স্টেশনের উত্তর পাশে এককালের বাংলার রাজধানী ও প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি সোনারগাঁ অবস্থিত। এককালে এটি অত্যন্ত প্রসিদ্ধ বন্দর নগরী বলে পরিচিত ছিল। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের গ্রীক লেখক টমেরীর লেখায় বাংলাদেশে সোনার খনি ছিল বলে উল্লেখ রয়েছে। সুবর্ণ গ্রাম বা সোনারগাঁ সে স্মৃতি বহন করছে। 

সোনার গাঁয়ের আয়তন : প্রাচীনকালে সোনার গাঁয়ের পরিধি ছিল উত্তর-দক্ষিণে ৮০ কিলোমিটার ও পূর্ব-পশ্চিমে ৩০ কিলোমিটার। মেঘনা, শীতলক্ষ্যা ও ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গমস্থলে অবস্থিত হওয়ায় এটি প্রসিদ্ধ নদী বন্দর ও ব্যবসা বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠেছিল। 

প্রাচীন ইতিহাস : প্রখ্যাত ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারানীর তারিখই ফিরোজ শাহীতে সোনারগাঁ নামের উল্লেখ আছে। ১২৮১ খ্রিস্টাব্দে দিল্লীর সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন বাংলার মুগিস তুগরিলের বিরুদ্ধে এক অভিযানে বাংলায় আসেন। তিনি তুগরিলকে পর্যুদস্ত করার জন্য সোনারগাঁয়ের রাজা ধনুজ রায়ের সাহায্য কামনা করেন। এতে বুঝা যায়, সোনারগাঁ তখনও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এক বিশেষ স্থানের অধিকারী ছিল। 

বাংলার সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের আমলে সোনারগাঁ স্থায়ীভাবে মুসলমানদের করতলগত হয়। সোনারগাঁ টাকশাল হতে ১৩০১ খ্রিষ্টাব্দে মুদ্রা প্রকাশ করা হয়। ১৩১৭ খ্রিস্টাব্দ হতে ফিরোজ শাহের পুত্র গিয়াস উদ্দিন বাহাদুর শাহ সোনারগাঁয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী সুলতানরূপে শাসন শুরু করেন এবং প্রকৃতপক্ষে তখনই সোনারগাঁ পূর্ব বাংলার রাজধানীতে পরিণত হয়। ১৩২২ খ্রিস্টাব্দে ফিরোজ শাহ ইন্তেকাল করার পর বাহাদুর শাহ একই নামে লাখনৌতির সিংহাসন অধিকার করেন। পরবর্তীকালে দিল্লীর সুলতান বাহাদুর শাহকে পরাজিত করে বাংলাকে পুনরায় দিল্লী সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। তখন বাংলাকে তিনটি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়। সোনারগাঁয়ে দক্ষিণ ও পূর্ব বাংলার প্রশাসনিক কেন্দ্র স্থাপিত হয় এবং বাহরাম খাঁকে সোনারগাঁয়ের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়। ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে বাহরাম খানের মৃত্যুর পর দিল্লী হতে নতুন শাসনকর্তা আগমনের কিছুকাল বিলম্ব হওয়ার সুযোগে বাহরাম খানের শিলাদার ফখরুদ্দিন সোনারগাঁয়ের শাসনভাব নিজ হস্তে গ্রহণ করেন। তাঁর উপাধি ছিল ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ। তাঁকে শায়েস্তা করার জন্য গৌড়ের শাসনকর্তা কদর খান ও সাথ গাঁওয়ের শাসনকর্তা ইয়াহিয়াকে প্রেরণ করা হয়। ফখরুদ্দিন সোনারগাঁ ত্যাগ করে মেঘনার পূর্ব তীরে আশ্রয় গ্রহণ করেন। কদর খান সোনার গাঁ দখল করলেও ফখরুদ্দিন লোভ দেখিয়ে কদর খানের সৈন্যদের নিজ দলভূক্ত করেন এবং কৌশলে সমস্ত নদীপথ বন্ধ করে দেন। ফলে ১৩৩৯ খ্রিস্টাব্দে এক যুদ্ধে কদর খান পরাজিত ও নিহত হন। সোনারগাঁ পুনরায় ফখরুদ্দিনের দখলে আসে। তিনি ১৩৪৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সোনারগাঁয়ে রাজত্ব করেন। তাঁর রাজত্বকালেই আফ্রিকা মহাদেশের বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা বাংলাদেশ ভ্রমণে আসেন। ইবনে বতুতার বিবরণে জানা যায়, সুলতান ফখরুদ্দিন দরবেশগণকে খুব শ্রদ্ধা করতেন এবং তাঁর বিনা ভাড়ায় নৌকায় দেশের একেকস্থানে যাতায়ত করতে পারতেন এবং প্রয়োজনমত খাদ্য ও অর্থ পেতেন। 

ফখরুদ্দিন মোবারক শাহের মৃত্যুর পর ইখতিয়ার উদ্দিন গাজী শাহ সোনারগাঁয়ের সুলতান হন। ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে পরাজিত করে ইলিয়াস শাহ সোনারগাঁ দখল করেন। সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহই সর্বপ্রথম বাংলার সাথে লাখনৌতি রাজ্যকে একত্র করে সমগ্র ভূ-খণ্ডের বাংলা নামকরণ করেন। বাংলার তদানীন্তন রাজধানী গৌড় হলেও পরবর্তী আড়াইশ’ বছর সোনারগাঁ বাংলার পূর্বাঞ্চলের প্রধান শাসনকেন্দ্র ছিল। বস্তুত তখন হতেই সোনারগাঁ বাংলার দ্বিতীয় রাজধানীর মর্যাদা লাভ করেন। 

১৩৫৭-১৩৮৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সিকান্দর শাহের রাজত্বকালে তাঁর পুত্র গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ সোনারগাঁ আসেন এবং বহু সৈন্য সংগ্রহ করে সসৈন্যে বাংলার রাজধানী গৌড়ের পথে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে আরিচাঘাটে উত্তরে তেওতা নামক স্থানে সিকান্দার শাহের সৈন্যদলের সাথে মুখোমুখি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে সিকান্দর শাহ নিহত হন। গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের রাজত্বকালে চীন সম্রাট বাংলায় কয়েকবার দূত প্রেরণ করেন এবং তাঁরা সোনারগাঁ ভ্রমণ করেন। সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ ইরানের বিখ্যাত কবি হাফিজকে সোনারগাঁ ভ্রমণ করার জন্য আমন্ত্রণলিপি পাঠান। কিন্তু কবি বার্ধক্যের ভারে আসতে না পেরে সুন্দর একটি কবিতা লিখে সুলতানের নিকট প্রেরণ করেন। সোনারগাঁয়ের শাহ চিল্লাপুর গ্রামে অদ্যাবধি তাঁর মাজার বিদ্যমান। 

চতুর্দশ শতকে সোনারগাঁ পূর্ব বাংলার রাজধানীর মর্যাদা লাভের পর বহু সুফী সাধক সেনারগাঁ আসেন। মধ্য বাংলায় ইসলাম প্রচারে তাঁদের বিরাট অবদান রয়েছে। হজরত শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা সোনারগাঁয়ে হাদিস শিক্ষাদানের জন্য একটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। প্রখ্যাত সুফী সাধক হজরত নুর কুতুবুল আমলের পুত্র শেখ আনোয়ার এবং পৌত্র শেখ জাহিদ সোনারগাঁয়ে অবস্থান করে ইসলামী শিক্ষাদানে মনোনিবেশ করেন। সুলতান জালাল উদ্দিন ফতে শাহ সোনারগাঁয়ের মোগড়া পাতায় একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। মোগল আমলে সোনারগাঁয়ের ঈসা খাঁ মোগল শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে কিংবদন্তী নায়ক হিসাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন।


আরো দেখুন :

1 Comments

Post a Comment
Previous Post Next Post