রচনা : কালবৈশাখী

উপস্থাপনা : এ চলমান জীবনের বিচিত্র যাত্রায় ছোট-বড় কত ঘটনা সর্বদাই ঘটেছে। তার কিছু মনে থাকে, কিছু হারিয়ে যায় বিস্মৃতির অতলে। আমার জীবনে এমনি একটি ঘটনা ঘটেছিল কিশোর বয়সে, যার স্মৃতি এখনও আমার মনে আতঙ্কের শিহরণ জাগায়। গীষ্মের ছুটি আসন্ন প্রায়। ঠিক হল-সবাই মিলে আমরা দেশের বাড়িতে যাব। ঢাকায় থাকি, প্রাসাদ-নগরীর যান্ত্রিকতা থেকে কিছুদিনের জন্য মুক্তি পাব এই আনন্দে আমরা ভাই-বোনেরা উচ্ছ্বাসিত হয়ে উঠলাম। তারপর জল ও স্থলপথে দেশের বাড়িতে এলাম। 

ঝড়ের পূর্বের দিন : বড় সুন্দর আমাদের গ্রাম। চারদিকে সবুজের সমারোহ। আম-কাঁঠালের বাগান। মাথা উঁচু করে তাল, নারকেল, সুপারি গাছ আর বাঁশের ঝাড়। বুনো ঝোপ ও শেয়াল কাঁটার বনে হলদে ফুলের সমারোহ। গ্রামের ছায়াঘেরা স্পর্শে মনটা আমাদের সকলেরই ভরে উঠল। নিরঙ্কুশ স্বাধীন জীবনে অবাধ সঞ্চারণ করছি আমরা। সবুজের দাক্ষিণ্যে আর প্রাচুর্যে মনও আমাদের সবুজ হয়ে উঠেছে। 

ঝড়ের সময় : সেদিন ছিল শনিবার। দুপুরের পর থেকেই চারদিকে আবহাওয়া ঘোলাটে হয়ে ওঠল। যত বিকেল হতে থাকল, চারদিকের গুমোট ভাব আরো বেড়ে উঠল। চারদিকে যেন থমথম করছে। মনে হচ্ছে গাছপালাগুলো যেন সব নিঃশ্বাস বন্ধ করে স্থির নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে ওরা যেন ভয় পেয়েছে। আকাশে ধূসর রঙের মেঘ। কেবল পশ্চিম-উত্তর আকাশে এক খণ্ড নিবিড় কাল মেঘ আস্তে আস্তে সূর্যকে আড়াল করে দিচ্ছে। আমার মনে হল সূর্যও যেন ভয় পেয়ে আড়ালে লুকোচ্ছে। আকাশ, মাটি, গাছপালা সব যেন নীরব, নিথর, নিস্পন্দ হয়ে এক ভয়াবহতার মুখোমুখি হবার জন্য প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্রমে ক্রমে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। ধীরে ধীরে জমাট কালো অন্ধকার জল, স্থল, অন্তরীক্ষে ছড়িয়ে পড়ছে। 

দেখতে দেখতে অবস্থা আরও ভয়াবহ হয়ে উঠল। আমাদের বাড়ির বৃদ্ধরা বললেন, এখন নাকি ঝড় উঠবে। গাছপালা, আকাশ-বাতাস সব মাতাল হয়ে উঠল। একটানা ঝড়ো হাওয়া বইছে। দূরে থেকে প্রবল বেগে এসে গাছপালা ঘরবাড়ির উপর আছড়ে পড়ছে। মনে হচ্ছে যেন একটা বিরাট রাক্ষসী উন্মত্ত ক্রোধে তাণ্ডব নৃত্য করে বেড়াচ্ছে। তারই অশান্ত চরণ বিক্ষেপে প্রকৃতিতে এই আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছে। ঝড়ের গোঁ গোঁ শব্দ, বজ্রের বিকট শব্দ এবং বিদ্যুৎ চমকের চোখ ঝলসানো তীব্র আলোকচ্ছটা যেন তার লেলিহান জিহ্বা মেলে আকাশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছুটোছুটি করছে। চারদিক ধুলোয় ভরে গিয়েছে। জানালা ফাঁক করে বাইরে তাকিয়ে দেখি, গাছগুলো একবার মাটিতে নুয়ে পড়ছে, আবার মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। দেখতে দেখতে বৃষ্টি এল তুমুল শব্দে। ঝড়ের তাণ্ডবে আর বৃষ্টির ঝাপটায় বাইরে যেন প্রলয় হতে চলছে। 

সারারাত এভাবে একটানা ঝড়-বৃষ্টি চলল। প্রবল ঝড়ের বেগে বাড়ি-ঘর কাঁপছে। টিনের চালে ঝড়-জলের ঝাপ্টা ঘরটিকে মুহূর্তে ভঙ্গে চুরমার করে দিবে বলে মনে হচ্ছিল। কোথাও মড় মড় করে গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়ছে। টিনের চালা উড়িয়ে ফেলছে আর কড়ু কড়ু করে কখনো বা বাজ পড়ছে। 

জড়ের পরে : ভোরে জেগে বাইরে এসে যে দৃশ্য দেখলাম, তা যেন কল্পনাতীত, তেমনি হৃদয় বিদারক। একটি রাতের প্রচণ্ড ঝড়ের প্রলয়-নর্তনে সারা পল্লীকে বিপর্যস্ত ও তছনছ করে দিয়ে গিয়েছে। তার সর্বাঙ্গে রেখে গেছে দগদগে ক্ষতিচিহ্ন। কোন বাড়িরই ঘরদোর অক্ষত নেই। রাস্তাঘাট গাছপালা পড়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এক হাঁটু কাদা জমেছে। ফলবান গাছগুলো ফলশূণ্য। 

উপসংহার : কাল বৈশাখী যেন প্রকৃতির এক অশান্ত রূপ। এ রূপের বর্ণনা দেয়ার ভাষা নিতান্তই অপ্রতুল এর স্মৃতি উত্তেজনায় ভরপুর ও বিষাঙ্গে পরিপূর্ণ।

1 Comments

Post a Comment
Previous Post Next Post