ব্যাকরণ : সাধু ও চলিত ভাষারীতির পার্থক্য

সাধু ও চলিত ভাষা কাকে বলে?

চলিত ভাষা কাকে বলে?
ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, “দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গে ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী স্থানের ভদ্র ও শিক্ষিত সমাজের ব্যবহৃত মৌখিক ভাষা, সমগ্র বাঙ্গালাদেশের শিক্ষিত সমাজ কর্তৃক শ্রেষ্ঠ মৌখিক ভাষা বলিয়া গৃহীত হইয়াছে। এই মৌখিক ভাষাকে বিশেষভাবে ‘চলিত ভাষা’ বলা হয়।”

সাধু ভাষা কাকে বলে?
ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, “সাধারণ গদ্য-সাহিত্যে ব্যবহৃত বাঙ্গালা ভাষাকে সাধু ভাষা বলে।”
সাধু ও চলিত ভাষার বৈশিষ্ট্য
সাধু ও চলিত ভাষার পার্থক্য

সাধু ও চলিত ভাষারীতির পার্থক্য
ক্রমিক নং সাধু ভাষা চলিত ভাষা
উনিশ শতকের শুরুতে সংস্কৃতানুসারী পণ্ডিতদের উদ্‌যোগ-আয়োজনে যে সাহিত্যিক গদ্য ভাষার উন্মেষ, তাই সাধু ভাষা। বিশ শতকের শুরুতে প্রমথ চৌধুরীর ‘সবুজপত্রে’র আহ্বানে ভাগীরথী নদীর দুতীরবর্তী অঞ্চলের ভাষাকে ভিত্তি করে যে মৌখিক ভাষা সাহিত্যিক গদ্য ভাষার মর্যাদা লাভ করে, তা-ই চলিত ভাষা।
সাধু ভাষায় সর্বনাম পদের পূর্ণরূপ গৃহীত হয়। যেমন : তাহার, ইহার, কাহাকে, ইহাকে ইত্যাদি। চলিত ভাষায় সর্বনাম পদের সংক্ষিপ্ত রূপ গৃহীত হয়। যেমন : তার, এর, কাকে, একে ইত্যাদি।
সাধু ভাষায় ক্রিয়াপদগুলো পূর্ণরূপ ব্যবহৃত হয়। যেমন : খাইতে, খাইতেছিলাম, করিতেছিল ইত্যাদি। চলিত ভাষায় ক্রিয়াপদগুলো সংক্ষিপ্ত রূপে ব্যবহৃত হয়। যেমন : খেতে, খাচ্ছিলাম, করছিল ইত্যাদি।
সাধু ভাষায় তৎসম শব্দের সমধিক প্রয়োগ (যদিও তদ্ভব ও দেশি-বিদেশি শব্দের ব্যবহার নিষিদ্ধ নয়)। যেমন : চন্দ্র, অভ্যন্তর, অঙ্গ, সৌষ্ঠব, বৃন্ত, চর্ম, কাষ্ঠ, দর্পণ ইত্যাদি। চলিত ভাষায় তদ্ভব, দেশি-বিদেশি ইত্যাদি শব্দের প্রাধান্য (যদিও তৎসম শব্দের ব্যবহার নিষিদ্ধ নয়)। যেমন : চাঁদ, ভিতর, শরীর, গঠন, বোঁটা, চামড়া, কাঠ, আয়না ইত্যাদি।
সাধু ভাষায় সন্ধি-সমাসের আধিক্য লক্ষ করা যায়। যেমন : কাষ্ঠাহরণে, রাজাজ্ঞা, রাজপুত্রহস্তে ইত্যাদি। চলিত ভাষায় সন্ধি-সমাসের বর্জন বা সেগুলোকে ভেঙে সহজ করে লেখার বা তদ্ভব রূপ দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। যেমন : কাঠ আনতে, রাজার হুকুম, রাজপুত্তুরের হাতে ইত্যাদি।
সাধু ভাষায় বাক্যে পদবিন্যাস সুনিয়ন্ত্রিত ও সুনির্দিষ্ট, অর্থাৎ বাক্যে প্রথমে উদ্দেশ্য ও পরে বিধেয় থাকে এবং ক্রিয়াপদ সাধারণত বাক্যের শেষে থাকে। যেমন : সম্মুখে এক ক্ষুদ্র প্রান্তর দেখিতে পাইলাম। সর্বশেষে আসিল রাত্রির কৃষ্ণকায় পক্ষী তাহার পক্ষ মেলিয়া। চলিত ভাষায় পদস্থাপনের রীতি অনেক সময় পরিবর্তিত হয় এবং বাক্যে ক্রিয়াপদের ব্যবহারে অনেক স্বাধীনতা রয়েছে। যেমন : দেখতে পেলাম সামনে এক ছোট্ট মাঠ; সবশেষে এল রাতের কালো পাখি তার ডানা মেলে।
সাধু ভাষায় বহুভাষণ বা বাগাড়ম্বর প্রশংসিত। যেমন : কপালকুণ্ডলা ধীরে ধীরে গৃহাভিমুখে চলিলেন। অতি ধীরে ধীরে মৃদু মৃদু চলিলেন, তাহার কারণ তিনি অতি গভীর নিন্তামগ্ন হইয়া যাইতেছিলেন। চলিত ভাষায় মিতভাষণ আমৃত। যেমন : কপালকুণ্ডলা গভীর চিন্তায় ডুবে গিয়ে আস্তে আস্তে ঘরের দিকে চললেন। তার কারণ তিনি খুব চিন্তিত ছিলেন।
সাধু ভাষায় দুরূহ তৎসম শব্দের ব্যবহার চলে। তবে সাধুভাষায় একসময় ব্যবহৃত অনেক শব্দই বর্তমানে অপ্রচলিত। যেমন : অত্রত্য, অপার্যমানে, নিষণ্ণ। চলিত ভাষায় দুরূহ তৎসম শব্দের ব্যবহার একেবারেই অচল। যেমন : এখানের, অক্ষমতার কারণে না পারলে বা না পারায়, অবস্থিত।
সাধু ভাষায় কর্মবাচ্যের ব্যবহার অপ্রচলিত নয়। যেমন : পথিকের কোন দস্যুলক্ষণ দৃষ্ট হইল না। চলিত ভাষায় সংস্কৃতানুসারী কর্মবাচ্যের ব্যবহার একেবারেই অচল। পক্ষান্তরে ভাববাচ্যের প্রচলন বেশি। যেমন : পথিকের কোন দস্যুর লক্ষণ দেখা গেল না।
১০ সাধু ভাষায় অনুসর্গের পূর্ণাঙ্গ রূপ ব্যবহৃত হয়। যেমন : জন্য, হইতে, দ্বারা, দিয়া, অপেক্ষা। চলিত ভাষায় অনুসর্গের সংক্ষিপ্ত রূপ ব্যবহৃত হয়। যেমন : জন্যে, হতে / থেকে, দিয়ে, চেয়ে।
১১ সাধু ভাষায় সংস্কৃত অব্যয়ের ব্যবহার হয়। যেমন : অনন্তর, যদ্যপি, তথাপি, বরঞ্চ। চলিত ভাষায় সংস্কৃত অব্যয়ের তদ্ভব রূপের ব্যবহার হয়। আবার কিছু অব্যয় আছে যেগুলো শুধু চলিতেই ব্যবহৃত হয়। যেমন : তারপর, যদিও, তবু, বরং। কেবল চলিতে – নইলে, তাহলে, নয়তো, মতন, শেষটা।
১২ সাধু ভাষায় অপিনিহিতি, স্বরসঙ্গতি, অভিশ্রুতি, সমীভবন ইত্যাদির ব্যবহার নেই। যেমন : করিল, লিখা, উনান, বিলাতি, ধূলা, জালিয়া, গল্প। চলিত ভাষায় অপিনিহিতি, স্বরসঙ্গতি, অভিশ্রুতি, সমীভবন ইত্যাদির প্রভাব বেশি। যেমন : কইর‌্যা, লেখা, উনুন, বিলিতি, ধুলো, জেলে, গপ্প।
১৩ সাধু ভাষায় ধ্বন্যাত্মক শব্দের প্রাধান্য নেই। চলিত ভাষায় ধ্বন্যাত্মক শব্দের প্রাধান্য রয়েছে। যেমন : হনহন, গনগনে, ঝনঝন।
১৪ সাধু ভাষা সুনির্ধারিত ব্যাকরণের অনুসরণ করে চলে এবং এর কাঠামো অপরিবর্তনীয়। চলিত রীতির ব্যাকরণ না থাকায় এর অনুসৃতি কষ্টসাধ্য এবং এর কাঠামো পরিবর্তনশীল।
১৫ সাধু ভাষা কথোপকথনে, নাটকের সংলাপ ও বক্তৃতার অনুপযোগী। চলিত ভাষা বক্তৃতা, আলাপচারিতা ও নাট্যসংলাপে বেশি উপযোগী।
১৬ সাধু ভাষা গুরুগম্ভীর ও আভিজাত্যের অধিকারী। চলিত ভাষা সহজবোধ্য, সাবলীল, স্বচ্ছন্দ ও কৃত্রিমতাবর্জিত।
১৭ সাধু ভাষা সার্বজনীন লেখ্য ভাষা। চলিত ভাষা শিক্ষিত ভদ্রসমাজের মৌখিক ও লেখ্যভাষা।

সংগ্রহ : ভাষা-শিক্ষা, বাংলা ব্যাকরণ ও রচনারীতি; ড. হায়াৎ মামুদ
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post