রচনা : যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই

↬ যুদ্ধ ও বিশ্বশান্তি

↬ বর্তমান বিশ্ব ও বিশ্বশান্তি

↬ শান্তির পক্ষে বিশ্বের মানুষ

↬ যুদ্ধমুক্ত বিশ্ব চাই

↬ বিশ্ব শান্তি


ভূমিকা :
‘তাই আমি চেয়ে দেখি প্রতিজ্ঞা প্রস্তুত ঘরে ঘরে, 
দানবের সাথে আজ সংগ্রামের তরে।’
                                           – সুকান্ত ভট্টাচার্য। 
মানুষ সহজাতভাবে শান্তিপ্রিয় ও শান্তিকামী। কিন্তু সভ্যতার ইতিহাস শ্রেণিদ্বন্দ্ব ও শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস। মানব সভ্যতার এই প্রত্যূষ মুহূর্ত থেকেই যুদ্ধ, সংঘর্ষ বিকাশ? প্রতিটি শস্যের শীর্ষে মানুষের রক্ত খুঁজে পাবে।’ অনেক রক্ত ঝরেছে। সভ্যতার বেদীতল যুগে যুগে শোণিত স্রোতে হয়েছে রঞ্জিত। আজও মানুষ ভুলতে পারে নি সেই রক্তাক্ত দিনের ভয়ঙ্কর স্মৃতি। আজকের যুদ্ধের নির্মম অর্থ মানুষ জেনে গেছে, যুদ্ধ নিয়ে আর দম্ভ নয়, নয় প্রভুত্ব বিস্তারের বিলাসিতা। যুদ্ধ মানে আজ সভ্যতার বিনাশ। যুদ্ধ মানে এখন মানুষের অস্তিত্ব বিলোপ। তাই বিশ্বের দিকে দিকে আজ যুদ্ধ-বিরোধী জেহাদ। আর তাই শান্তিকামী মানুষ শান্তি রক্ষার প্রত্যাশায় শান্তির বাণী উচ্চারণ করে প্রতিষ্ঠা করেছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘও আজ পক্ষপাত দুষ্টে আক্রান্ত। গোটা বিশ্ব জুড়ে স্লোগান তুলেছে : যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই। কণ্ঠে কণ্ঠে মিলিয়ে গেয়ে উঠেছে : 
আর যুদ্ধ নয়, নয়। 
আর নয় মায়েদের শিশুদের কান্না 
রক্ত কি, ধ্বংস কি, যুদ্ধ- আর না, আর না। 

অতীতে যুদ্ধ : যুদ্ধের ইতিহাস থেকে জানা যায় বিগত সাড়ে পাঁচ হাজার বছরের পৃথিবীর বুকে মোট যুদ্ধ হয়েছে সাড়ে চৌদ্দ হাজার, প্রাণ হারিয়েছে চারশ কোটি মানুষ। একদিন যুদ্ধকে মনে করা হতো শৌর্য-বীর্যের প্রতীক। রাজ্যজয়ের নেশায় মেতেছে মানুষ বীরের সম্মানে ভূষিত হয়ে জীবন ধন্য হয়েছে কত মানুষের। ইতিহাসের কলঙ্কিত নায়ক হয়ে আজও বিভীষিকার দুঃস্বপ্ন হয়ে আছে কত মানুষ। আমরা এট্টিলা, চেঙ্গিস খাঁ, তৈমুর লঙ-এর শোণিত-বিলাসের কথা আজও ভুলি নি। ভুলি নি আলেকজান্ডার পুরু, হানিবলের বীরত্ব গাথা। কত ধর্মযুদ্ধ, কত সাম্রাজ্যের উত্থান আর পাতন। পথে পথে কত রক্ত-স্রোত বয়ে গেছে। কত অশ্ব ক্ষুরধ্বনি। কত অসির ঝনঝনা, হস্তীর বৃংহন,অশ্বের হ্রেষা। 

বিগত বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা : জীবন চলমান। সভ্যতা থেমে থাকে না। মানুষ বিজ্ঞান বুদ্ধি নিয়ে খুঁজে পেল আরও অজ্ঞতা শক্তির উৎস। ধীরে ধীরে সে হয়ে উঠল আরও শক্তিধর। বানাল নতুন নতুন অস্ত্র। বিগত শতকে ঘটল দুই ভয়াবহ মহাযুদ্ধ। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯ ও ১৯৩৯-৪৫)। এ যুদ্ধ অতীতের সব যুদ্ধকে ছাপিয়ে গেল। কারণ এর বিস্তৃতি ঘটেছিল বিশ্বব্যাপী। পৃথিবীর বৃহৎ রাষ্ট্রগুলো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এক মারণ-যজ্ঞে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিল বোমারু বিমান ও আধুনিক সমরাস্ত্র সজ্জিত যুদ্ধ জাহাজ। নিহত হয়েছিল সামরিক ও সামরিক স্তরের চার কোটি চৌদ্দ লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার মানুষ। বিকলাঙ্গ হয়েছিল আরও দুই কোটি মানুষ। সম্পত্তি ধ্বংস হয়েছিল তিনশ কুড়ি বিলিয়ন ডলারের। (১ বিলিয়ন = ১০,০০০ লক্ষ = ১০০ কোটি)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নিহত মানুষের সংখ্যা সর্বকালের রেকর্ড অতিক্রম করেছে। এই যুদ্ধ পাঁচ কোটি চল্লিশ লক্ষ মানুষের প্রাণ সংহার করে। বিকলাঙ্গ করে ন’ কোটি মানুষকে। সম্পত্তি বিনষ্ট করে চারশ বিলিয়ন ডলারের। এই মহাযুদ্ধেই মানব-সভ্যতার ঘৃণ্যতম অস্ত্র আণবিক বোমা ব্যবহৃত হয় জাপানে হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে। চোখের পলকে দাউ দাউ আগুনে জ্বলে যায় দুটি সমৃদ্ধ জনপদ। তেজস্ক্রিয় বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ে শহরে-গ্রামে। ধ্বংসের প্রলয়ঙ্কর রূপ দেখে শিহরিত হয় বিশ্ববিবেক। আর্তনাদ করে ওঠে পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষ। 

বিশ্বযুদ্ধের কারণ ও বিশ্বপরিস্থিতির লক্ষণীয় পরিবর্তন : উপনিবেশ বিস্তারের লোলুপতা, বিশ্বের বাজার দখলের প্রতিযোগিতা এসবই ডেকে আনে বিশ্বযুদ্ধ। সমরাস্ত্র উৎপাদনের নেশায় তখন মেতে ওঠে যুদ্ধবাজের দল। সমরোপকরণের বাজার অব্যাহত রাখার প্রয়োজনেই যুদ্ধের সর্বগ্রাসী আগুন কখনও নেভে না। 

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির ফলে অনেক ছোট হয়ে গেছে আজকের পৃথিবী। আজ যদি পেছন ফিরে তাকাই তাহলে দেখব বিংশ শতাব্দীতে কত অকল্পনীয় পরিবর্তন ঘটে গেছে বিশ্বে। সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার ভারসাম্য কতবারই না এদিক-সেদিক পরিবর্তিত হয়েছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্যস্ত না হবার যে সদম্ভ ঘোষণা লর্ড কার্জন করেছিলেন তা আজ শতাব্দী না পেরোতেই হাস্যকর প্রমাণিত হয়েছে। বলশেভিক বিপ্লবের দুনিয়া কাঁপানো আওয়াজ একদিন সারা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষকে জাগিয়ে তুলেছিল মুক্তির আকাঙ্ক্ষায়, দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল মুক্তির সংগ্রাম। অমিত ক্ষমতার অধিকারী সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনে সে সংগ্রামকে হীনবল করে দিয়েছে। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের একক ক্ষমতাধর শক্তিতে পরিণত হয়েছে, ছাপিয়ে বেড়াচ্ছে সারা বিশ্বে। এই মুহূর্তে বিশ্বের সামরিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা এক বিশ্বকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। অন্যদিকে বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার, অত্যাধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা, অতি উন্নত ইন্টারনেট ও দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যম পৃথিবীকে পরিণত করেছে এক বৈশ্বিক গ্রামে। অথচ এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার কোটি কোটি মানুষ প্রাযুক্তিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির সুবিধা থেকে বঞ্চিত। দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও ব্যাধি এদের নিত্যসঙ্গী। একদিকে সম্পদের পাহাড়, অঢেল ঐশ্বর্য, অকল্পনীয় বিলাস বৈভব, অন্যদিকে এক ‘জলহীন ফলহীন আতঙ্ক পাণ্ডুর মরুক্ষেত্রে পরাকীর্ণ পশু কঙ্কালের মাঝে মরীচিকার প্রেতনৃত্য’ চলছে- এই বিপরীতধর্মী অসুন্দর অসভ্যতা বর্তমান বিশ্বের এক নিয়ামক চিত্র। 

আধুনিক সমরাস্ত্রের ভয়াবহতা : পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা আজ এক উদ্বেগজনক অবস্থায় এসে পৌঁছেছে, সামরিক খাতে ব্যয়বরাদ্দ বাড়ছে। অস্ত্রনির্মাণে ঢালাওভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি। মানব সমাজ আজ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কায় থর থর কম্পমান। পৃথিবীর শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর হাতে এই মুহূর্তে ভয়ঙ্কর সব মারণাস্ত্র মজুত আছে। সংরক্ষিত আছে সমগ্র দ্বিতীয় যুদ্ধে ব্যবহৃত বিষ্ফোরকের দশ হাজার গুণ এবং প্রতি মানুষ পিছু পনের টনেরও বেশি বিষ্ফোরক। আণবিক বোমার চেয়ে চার হাজার গুণ শক্তিশালী বোমার সংখ্যা এখন পঞ্চাশ থেকে ষাট হাজার। যুদ্ধ এখন শুধু জলে-স্থলে নয়, মহাকাশে গ্রহে-উপগ্রহে বিস্তৃত হবার সম্ভাবনা। এখন দূরপাল্লার রকেট, আণবিক যুদ্ধ জাহাজ, সাবমেরিন ইত্যাদি সর্বাধুনিক সমরাস্ত্র মানুষের করায়ত্ব। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্য বিশ্বের দিকে দিকে জন্ম দিচ্ছে উদ্বেগের। নক্ষত্র যুদ্ধের ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে মার্কিন মুলুকে। লেসার রশ্মির সাহায্যে প্রতিপক্ষের ক্ষেপণাস্ত্র মহাশূন্যে ধ্বংস করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে মার্কিন সমর বিশেষজ্ঞরা। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের ফলে বিশ্ব শক্তির ভারসাম্যের যে ক্ষতি হয়ে গেছে তাতে অনুন্নত জাতিসমূহকে আজ অসহায়ভাবে মার্কিন অবরোধ ও সামরিক হুমকি মোকাবেলা করতে হচ্ছে। লিবিয়া, ইরাক, কিউবা, উত্তর কোরিয়াসহ গোটা তৃতীয় বিশ্ব ও ইসলামিক বিশ্ব আজ সে হুমকির শিকার। সদ্য ২০০৩ সালে আমেরিকা অযাচিত ও অন্যায়ভাবে ইরাকের তেলসম্পদ লুণ্ঠনের জন্যে আক্রমণ করল ইরাক, তাদের বর্বর আক্রমণে লক্ষ লক্ষ ইরাকি নারী-পুরুষ মৃত্যুবরণ করেছে, হয়েছে বিকলাঙ্গ। যেখানে গোটা বিশ্বে নানারকম আঞ্চলিক পর্যায়ে সংঘাত, যুদ্ধ, দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ, অনাহার, রোগভোগ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত মানুষ, সেখানে সভ্যতা আজ নীরব প্রত্যক্ষ করছে মার্কিনীদের তাণ্ডব। 

যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ্বখ্যাত কবি সাহিত্যিক শিল্পী বিজ্ঞানী ও বিভিন্ন সংস্থার জেহাদ : তাই পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ আজ আর যুদ্ধ চায় না। তাই পিকাসোর শ্বেত শুভ্র পারাবর আজ দেশে দেশে হাজারে হাজারে নীল গগনে ডানা মেলে উড়ছে। দেশে দেশে যুদ্ধ-বিরোধী শান্তি-মিছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আমলেই এই শান্তির দাবি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। গঠিত হয়েছিল ‘যুদ্ধ ও ফ্যাসিবিরোধী সংঘ’। অনুষ্ঠিত হয়েছে জেনেভা সম্মেলন। আইনস্টাইন, রমা, রলাঁ, আঁরি বারবুস, ম্যাক্সিম গোর্কি, রবীন্দ্রনাথ সোচ্চার হয়েছিলেন নারীঘাতী, শিশুঘাতী কুৎসিত যুদ্ধের বিরুদ্ধে। বলিষ্ঠ কণ্ঠে প্রতিবাদ করেছিলেন ফ্যাসিস্ট বর্বরতার। সমগ্র পৃথিবী জুড়ে আজ শান্তি আন্দোলন শান্তিশালী হয়ে উঠছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গড়ে উঠছে নানা সংঘ, নানা কমিটি। 

জাতিসংঘ ও বিশ্ব শান্তি আন্দোলন : ১৯৪৫ সালের আগস্টে হিরোশিমা-নাগাসাকিতে পারমাণবিক ধ্বংসযজ্ঞ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অবসান ঘটলেও এই নতুন অস্ত্রের ভয়াবহ ক্ষমতা দেখে সারা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। শান্তিকামী মানুষের উদ্যোগে গঠিত হয় সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ বা জাতিসংঘ। কিন্তু আজ দুঃখ ও লজ্জাজনক যে জাতিসংঘ পরিণত হয়েছে ‘পুতুলসংঘে’ – অকার্যকর এক সংঘে। আমেরিকা জাতিসংঘকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে আক্রমণ করেছে ইরাক। হত্যা করছে ইরাকের লক্ষ-কোটি শান্তিকামী মানুষকে। আজ দিকে দিকে পুনরায় স্লোগান ওঠেছে- ‘যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই’ – কিন্তু এই শান্তি কীভাবে আসবে বিশ্ববাসীর আজ তা জানা আছে বলে মনে হয় না। আজ মানুষ ভয়াবহ এক সঙ্কটের মধ্যে বসবাস করছে। 

উপসংহার : যুদ্ধ মানেই ধ্বংস। যুদ্ধ মানেই দুর্ভিক্ষ, উপবাস, মৃত্যু, তিলে তিলে গড়ে তোলা সভ্যতার সম্পূর্ণ ধ্বংস। তাই যুদ্ধের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ আজ প্রতিরোধী সৈনিক, শান্তির জাগ্রত প্রহরী। অতীতের মতোই আজ বিশ্বব্যাপী শান্তির আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে হবে। বিশ্বের শান্তিকামী মানুষকে এক কাতারে দাঁড়াতে হবে। সারা বিশ্বে যদি কোটি কোটি মানুষ আজ অস্তিত্বের তাগিদে শান্তির সপক্ষে রাস্তায় নেমে আসে তাহলেই শুধু যুদ্ধবাজ বর্বরজাতির দংশন থেকে এই বিশ্বকে রক্ষা করা সম্ভব। আজ সারা বিশ্বের অস্ত্রবাজদের এই শপথ নিতে হবে যে- 
‘মাটি থেকে করব উৎপাট এক সঙ্গে সব চেয়ে লম্বা দেবদারু 
যেখানে তার শিকড় ছিল আগে সেই গর্তে ফেলব ছুঁড়ে আমাদের সব অস্ত্র। 
ধরিত্রী গর্ভে, ধরণী তলে পুঁতব মোরা আমাদের সব অস্ত্র, 
মোরা চিরতরে দেব কবর তাকে সেই গভীরে 
আর পুঁতব আবার সেই জায়গায় দেবদারু 
হ্যাঁ, আসবে সময় মহা শান্তির।’


[ একই রচনা আরেকটি বই থেকে সংগ্রহ করে দেয়া হলো ]


ভূমিকা :
“আর যুদ্ধ নয়, নয়।
আর নয় মায়েদের শিশুদের কান্না
রক্ত কি, ধ্বংস কি, যুদ্ধ– আর না, আর না।”

না, বিশ্বের শান্তি প্রিয় মানুষ আর যুদ্ধ চায় না। তবু মানুষকে যুদ্ধের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়। বিগত সাড়ে পাঁচ হাজার বছরে মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে সাড়ে চৌদ্দ হাজার যুদ্ধ। বিংশ শতাব্দীর দুটি ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধ বিশ্বের মানুষকে বুঝিয়ে দিয়েছে যুদ্ধ কী? যুদ্ধের ভয়াবহতা কত নির্মম। তাইতো শান্তিকামী মানুষরা প্রতিষ্ঠা করল জাতিসংঘ নামক আন্তজার্তিক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু একাবিংশ শতাব্দীর মানুষ ইরাকের যুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করতেছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পৈশাচিক উল্লাস। শিশুর কান্নায়, নারীর আর্তনাদে, লাশের গন্ধে ইরাকের আকাশ ভারী হয়ে উঠলেও লোভী শৃগালের মতো মার্কিন প্রশাসনের দৃষ্টি এখন তেল সম্পদের দিকে।

প্রাচীন যুদ্ধ : প্রাচীনকালেও পৃথিবীতে যুদ্ধ ছিল। সে সময়কার মহাকাব্যেগুলোও যুদ্ধভিত্তিক। যুদ্ধের মাধ্যমেই এক একটি সভ্যতার জন্ম হয়েছে। আমরা হোমারের মহাকাব্য ‘ইলিয়াড’‘ওডিসির’ মধ্যে প্রাচীনকালের যুদ্ধের ভয়াবহ বর্ণনা পাই। বর্তমানেও এরই ধারা অব্যাহত রেখে চলছে যুদ্ধ। সভ্যতার ইতিহাস শ্রেণিদ্বন্দ্ব ও শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস। মানবসভয়তার সেই প্রত্যুষ মুহূর্ত থেকেই যুদ্ধ, সংঘর্ষ আর রক্তপাত। তারই মধ্য দিয়ে শক্তিশালীর ঘটেছে উত্তরণ। একের বিনাশে অপরের অস্তিত্ব হয়েছে সুরক্ষিত। আজও মানুষ ভুলতে পারে নি সেই রক্তাক্ত দিনের ভয়ংকর স্মৃতি। প্রাচীন বর্বর যুগের অসভ্য মানুষ আজকের সভ্য মানুষ হয়ে যুদ্ধের নির্মম অর্থ জেনে গেছে, যুদ্ধ নিয়ে আর দম্ভ নয়, নয় প্রভুত্বের বিস্তারের বিলাসিতা। যুদ্ধ মানে আজ সভ্যতার বিনাশ, যুদ্ধ মানে এখন মানুষের অস্তিত্বের বিলোপ। তবে আজকের মতো পারমাণবিক যুদ্ধ কিংবা আধুনিক সব সমরাস্ত্র নিয়ে প্রাচীনকালে যুদ্ধ হতো না। যুগের ভেল পাল্টানোর সাথে সাথে পাল্টে গেছে মানুষের যুদ্ধ করার উপকরন সমূহের।

যুদ্ধ কেন হয়? : এক সময় মানুষ যুদ্ধ করতো নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য। হিংস্র জন্তু - জানোয়ারের হাত থেকে বাঁচার জন্য মানুষ যুদ্ধ করত। আর এখন মানুষ যুদ্ধ করে নিজের ক্ষমতা আর অস্তিত্বের অস্তিত্ব এবং নিজের স্বার্থরক্ষার জন্য। পাশাপাশি অন্যকে ধ্বংস করার জন্য, অন্যের সম্পদ দখল করার জন্য ও অন্যের উপর আধিপত্য বিস্তারের জন্যে মানুষ যুদ্ধ করছে। তাছাড়া সম্প্রসারণশীলতার জন্য ভয়ানক যুদ্ধের উদাহরণ বিশ শতকের দুটি বিশ্বযুদ্ধ। মানুষ হিংসা – দ্বেষ, লোভ – লালসার বশবর্তী হয়েও এখন যুদ্ধ করছে।

যুদ্ধের ফলাফল : যুদ্ধের ফলাফল কখনো ভালো হয় না। যুদ্ধের ফলে অগণিত মানুষ জনপদ ধ্বংসের পাশাপাশি দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। বিজ্ঞানের অগ্রগতি আজ যুদ্ধের ভয়াবহতা ও ধ্বংসলীলা বাড়িয়ে দিয়েছে আধুনিক সমরাস্ত্র নির্মাণ করে। এজন্য বর্তমানে যুদ্ধবিগ্রহের ক্ষয়ক্ষতি মারাত্মক ও সুদূরপ্রসারী। আর আমেরিকা ও রাশিয়া অনবরত মেতে আছে শক্তির মদমত্তায়। নিজের শক্তির প্রকাশ ও আধিপত্য বিস্তারের জন্য আমেরিকা প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করছে বিভিন্ন দেশের সাথে। নতুন নতুন মারণাস্ত্র আবিষ্কার ও এর বিস্তারেও নিয়োজিত আছে আমেরিকা। আফগানিস্তানে ও ইরাকে অসংখ্য লোককে মেরে ফেলেছে। জনপদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি স্থাপত্যশিল্প ধ্বংস করেছে আমেরিকা। এখানে মানবতার চরম অবমূল্যায়ন করেছে আমেরিকা। তেমনি ১৯৭১ সালেও পাকিস্তানীরা ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছিল। যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞে আজ পুরো সভ্যতা বিপর্যস্ত। যুদ্ধের ধ্বংসলীলায় মানুষের যে ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে তা বর্ণনাতীত।

বিশ্ব পরিস্থিতির পরিবর্তন :
“তাই আমি চেয়ে দেখি প্রতিজ্ঞা প্রস্তুত ঘরে ঘরে,
দানবের সাথে আজ সংগ্রামের তরে।”
— সুকান্ত ভট্টাচার্য

কিন্তু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী দানবকে রুখবে কে? বর্তমান এককেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষে পৃথিবী এখন মানুষের হাতের নাগালে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে একসময় সূর্য অস্ত যেত না। কিন্তু আজ সেসবই ইতিহাসমাত্র। বলশেভিক বিপ্লবের দুনিয়া কাঁপানো আওয়াজ একদিন সারা বিশ্বের শোষিত ও নিপীড়িত মানুষকে জাগিয়ে তুলেছিল মুক্তির আকাঙ্ক্ষায়। কিন্তু অমিত ক্ষমতার অধিকারী সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন সে স্বপ্নকে নির্বাসিত করেছে। Time you old Gypsyman —এর মতে, সময় এখন আমেরিকার, বিশ্বের একক ক্ষমতাধর শক্তি, দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, শাসিয়ে বেড়াচ্ছে সারা বিশ্বকে। এ মুহূর্তে বিশ্বের সামরিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা এক বিশ্বকেন্দ্রিক। প্রযুক্তির উৎকর্ষে সামরিক ক্ষেত্রেই এসেছে বিরাট পরিবর্তন। তাই আমেরিকার মোড়লিতে সারাবিশ্ব ভয়ে চুপ, প্রতিবাদ করলেই সাদ্দামের মতো টুটি চেপে ধরবে। কিন্তু সভ্যতার রঙ্গমঞ্চে এ প্রেতনৃত্য কবে বন্ধ হবে তা কী কেউ জানে?

বিগত যুদ্ধের অভিজ্ঞতা : সভ্যতার চলমানতায় মানুষ আপন ধীশক্তি দিয়ে খুঁজে নিল অজ্ঞাত শক্তির উৎস। ক্রমে সে হয়ে উঠল দানবীয় শক্তির অধিকারী। বিশ শতকে পরপর দুটি বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে কোটি কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ করল সেই দানবীয় শক্তির তান্ডব। জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকির মানুষ আজো ভুলতে পারে না সেই দুঃস্বপ্নের দিনগুলোকে। চোখের পলকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় জনপদ, ঝলসে যায় মানবতা, শিহরিত হয় গোটা বিশ্ববিবেক। বেদনায় আর্তনাদ করে ওঠে পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষ।

বিগত যুদ্ধের বিভীষিকা : বিশ শতকেই ঘটেছে দুই ভয়াবহ মহাযুদ্ধ— প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪–১৯১৯ এবং ১৯৩৯–১৯৪৫)। এ যুদ্ধ অতীতের সব যুদ্ধকে ছাপিয়ে গেছে। কারণ এর বিস্তৃতি ঘটে গোটা বিশ্বময়। পৃথিবীর বৃহৎ রাষ্ট্রগুলো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এক মরণ–যজ্ঞে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিল বোমারু বিমান ও আধুনিক সমরাস্ত্র সজ্জিত যুদ্ধ জাহাজ। নিহত হয়েছিল সামরিক ও অসামরিক স্তরের চার কোটি চৌদ্দো লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার মানুষ। বিকলাঙ্গ হয়েছিল আরো দু কোটি মানুষ। সম্পদ ধ্বংস হয়েছিল তিরিশ বিলিয়ন ডলারের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত মানুষের সংখ্যা সর্বকালের রেকর্ড অতিক্রম করেছে৷ এ যুদ্ধে পাঁচ কোটি চল্লিশ লক্ষ মানুষের প্রাণ সংহার করে৷ বিকলাঙ্গ করে নয় কোটি মানুষকে। সম্পদ নষ্ট হয় চারশ বিলিয়ন ডলারের।

এ যুদ্ধে মানবসভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণ্যতম আণবিক বোমা ব্যবহৃত হয় ১৯৪৫ সালের ৬ই এবং ৯ই আগস্ট জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে। চোখের পলকে দাউ দাউ আগুনে জ্বলে যায় দুটি সম্পদ সমৃদ্ধ জনপদ। তেজস্ক্রিয় বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ে শহরে গ্রামে। ধ্বংসের প্রলয়ঙ্কর রূপ দেখে শিহরিত হয় বিশ্ববিবেক। আর্তনাদ করে ওঠে পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষ।

অশান্ত বিশ্ব পরিস্থিতি : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী ভিয়েতনাম যুদ্ধের দুঃসহ স্মৃতি এখনো মার্কিনীদের মনে কাঁটার মতো বিদ্ধ হয়। পাক–ভারত যুদ্ধ (১৯৬৫), ইরান–ইরাক (১০ বছর ব্যাপী), আফগানিস্তানের ভয়াবহতা আমাদের শান্তিকামী করে তোলে। সোমালিয়ার ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় প্রচন্ডভাবে বিশ্ববিবেককে নাড়া দেয়। ফিলিস্তিনের প্রতিটি শিশুর অসহায় আর্তনাদ বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিলেও শ্যারনের পাষাণ হৃদয় এজিদের মতো রক্তের হোলিখেলায় নেচে ওঠে। সারাবিশ্বে চলছে ভয়াবহ এক অশান্ত পরিস্থিতি, মার্কিনি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি গোটা পৃথিবীকে গিলে খাবার মতলবে আছে। সম্প্রতি শেষ হলো ইরাক যুদ্ধ। আফগানিস্তানের মাটি ক্লাষ্টার বোমার আঘাতে অঙ্গার হয়েছে। লাশের গন্ধে শকুনের উল্লাস বেড়েছে। তেমনি ইরাকের জনগনের তথাকথিত মুক্তির স্লোগানে লুটপাট হয়েছে সাড়ে পাঁচ হাজার বছরের সভ্যতা ও সংস্কৃতির নিদর্শন, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে আধুনিক সভ্যতা। আধুনিক প্রযুক্তি মিসাইলের আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন হয়েছে অসহায় শিশুর হাত, বুক ও দেহ। লাশের স্তূপে দাঁড়িয়ে মার্কিনি ট্যাংক মুক্তির পতাকা উড়িয়েছে। সে পতাকা ইরাকের নয়, মার্কিনের। ইরাক আর ইরাক নেই, নব্য আমেরিকা যেন। ইরাক এখন আমেরিকার নতুন উপনিবেশ।

আধুনিক সমরাস্ত্রের ভয়াবহতা : মানবসভ্যতা আজ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশংকায় কম্পমান। সারাবিশ্বে যুদ্ধবাজদের যুদ্ধ প্রস্তুতি সাধারন নিরীহ মানুষদের আতংকের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। পৃথিবীর শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর হাতে ভয়ানক সব মারণাস্ত্র সারা বিশ্বে মজুদ আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত বিস্ফোরণের চেয়ে দশ হাজার গুণ বেশি বিস্ফোরক। আণবিক বোমার চেয়ে চার হাজারগুণ শক্তিশালী বোমার সংখ্যা এখন পঞ্চাশ থেকে ষাট হাজার। যুদ্ধ এখন জল ও স্থলের সীমানা ছাড়িয়ে আকাশে, গ্রহে ও উপগ্রহে। রাডারকে ফাঁকি দিয়ে মানুষ এখন উপগ্রহ, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে গোয়েন্দাগিরি চালায়। দূরপাল্লার মিসাইল, আণবিক যুদ্ধজাহাজ, ভয়ংকর সব যুদ্ধ বিমান প্রস্তুত সভ্যতাকে ধ্বংসের জন্য। একটি মাত্র সুইচ টিপ দিলে কয়েক হাজার মাইল দূরের একটি সভ্যতা নিমিষেই ধূলিসাৎ হয়ে যেতে পারে।

পারমাণবিক বোমা : আধুনিক বিজ্ঞানের অন্যতম ভয়ংকর আবিষ্কার পারমাণবিক অস্ত্র। আর যুদ্ধক্ষেত্রে এই পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার যে কতটা ভয়াবহ, তার প্রমাণ পাওয়া যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিশ বছর পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্ট জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে পারমাণবিক বোমা বীভৎস আকার ধারণ করে। অগনিত মানুষের লাশ ও মানুষের অঙ্গহানি থেকে এটা বোঝা যায়, আজও মানুষ এর প্রভাব বহন করে চলেছে। এরপর থেকে শুরু হয় পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির এক মহা প্রতিযোগীতা।

যুদ্ধ নয় শান্তি : যুদ্ধ কোনো সাধারণ মানুষ কামনা করে না। সাধারন মানুষ চায় যুদ্ধমুক্ত একটি সুন্দর ও শান্তির স্থান। শান্তি স্থাপনের জন্য তাই আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগীতা ও অস্ত্রের ব্যবসা প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে। বিজ্ঞানকে যুদ্ধাস্ত্র তৈরিতে ব্যবহার না করে মানুষের কল্যানে নিয়োজিত করতে হবে। বর্ণবিদ্বেষ ও জাতিগত বিদ্বেষ দূর করে আমাদেরকে উদার মনের অধিকারী হতে হবে। পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এখন জাতিসংঘ কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথা চিন্তা করে যুদ্ধ পরিহার করা উচিত।

যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান : জাতিসংঘের সহযোগিতায় শান্তিকামী মানুষেরা ' যুদ্ধ নয় শান্তি চাই ' স্লোগানে একই পতাকাতলে সমবেত হয়েছে। তাদের সাথে যোগ দিয়ে যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে বিশ্বখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীরা, বিজ্ঞানী ও দার্শনিক। বিশ্ব শান্তির জন্য প্রতিবছর বিশেষ ব্যক্তিকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হচ্ছে। দেশে দেশে ইরাকের বিরুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ জনতার যুদ্ধবিরোধী স্লোগান শান্তির কথা বলে। বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ আবার একই ছায়াতলে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন, রোঁমারোঁলা আঁরি করবুস, ম্যাক্সিম গোর্কী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ সোচ্চার নারীঘাতী ও শিশুঘাতী কুৎসিত যুদ্ধের বিরুদ্ধে। শিল্পীর তুলিতে, কবির কবিতায়, গানের সুরে, জীবনের উদ্দামতায় আজ ধ্বনিত হচ্ছে শান্তির বীজমন্ত্র।

বিশ্বশান্তি ও বাংলাদেশ : বাংলাদেশ সবসময়ই মধ্যপন্থী একটি শান্তকামী দেশ। জাতিসংঘের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ সবসময়ই চেষ্টা করে ঐক্য ও শান্তি ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করার। যুদ্ধ নয় শান্তির এ আন্দোলনে বাংলাদেশের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ নিজেকে জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। বেড়েছে তার কন্ঠস্বরের মর্যাদা। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বিবদমান বিশ্বে শান্তি স্থাপনে ছিলেন উৎসাহী। রাষ্ট্রে রাষ্ট্র সহযোগিতা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, শান্তি, মৈত্রী ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা, অন্য রাষ্ট্রের বৈদেশিক বা অভ্যন্তরীণ নীতিতে হস্তক্ষেপ না করা ইত্যাদি হচ্ছে বর্তমানে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি। তাই বিশ্বের কোথাও যুদ্ধের ক্ষীণতম সম্ভাবনা সৃষ্টি হলে বাংলাদেশ প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে।

১৯৮৬ সালকে বিশ্ব–শান্তিবর্ষ হিসেবে ঘোষণা : পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা আজ এক উদ্বেগজনক অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। বিশ্ব সামরিক খাতে ব্যয়বরাদ্দ বাড়ছে। অস্ত্র নির্মাণে ঢালাওভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি। এ ছাড়া গোটা বিশ্বে নানারকম সংঘাত, যুদ্ধ, দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ, অনাহার, রোগভোগ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত মানুষ। তাই জাতিসংঘের মহাসচিব ১৯৮৬ সালকে ঘোষণা করেছিলেন ' আন্তজার্তিক শান্তিবর্ষ'রূপে। এর ফলে রাষ্ট্রসংঘের সব সদস্যরাষ্ট্র ও বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনগুলো শান্তির সমস্যা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় পথ নির্দেশ করার সুযোগ পেয়েছে বিশ্ববাসীও জাতিসংঘের এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। সম্প্রতি আমেরিকার দ্বিতীয় বারের মতো ইরাক আক্রমণে বিশ্ব শান্তি আবারও সংকটের মুখে। আফগানিস্তান আক্রমণের মধ্যে দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী এ দেশটির ফ্যাসিবাদী কার্যক্রম শুরু হয়েছে। অন্যান্য দেশগুলো প্রতিবাদ করছেই না বরং নানাভাবে ইন্ধন জোগাচ্ছে। সবচেয়ে শঙ্কার বিষয় খোদ মার্কিনরা এ অন্যায় আক্রমণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও খোদ জাতিসংঘ এবারও কাঠের পুতুলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এসব প্রেক্ষাপটে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় বিশ্ববাসী এর বিরুদ্ধে জোর জনমত গড়ে তুলেছে। কেবল ' শান্তি বর্ষ ' ঘোষণা দিয়ে প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। এজন্য জাতিসংঘকে নিতে হবে সাহসী ভূমিকা। বিশ্বশান্তি রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত এ প্রতিষ্ঠানটির নিকট সবাই এমনটিই প্রত্যাশা করে।

উপসংহার : যুদ্ধ মানেই ধ্বংস। যুদ্ধ মানেই দুর্ভিক্ষ, উপবাস, মৃত্যু। যুদ্ধ মানেই রক্তের হোলিখেলা, লাশের স্তূপ ও সভ্যতার বিনাশ। পৃথিবীবাসী দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ফলে ধ্বংস, মৃত্যু, মহামন্বন্তরের রক্তাক্ত আস্বাদ পেয়েছে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হলে তা হবে আরও ভয়াবহ। মানুষ আজ প্রতিবাদমুখর যুদ্ধবাজ অস্ত্র – ব্যবসায়ীদের ঘৃণ্য চক্রান্ত রুখতে। যুদ্ধের বিরুদ্ধে গোটা বিশ্ববাসী আজ প্রতিরোধী সৈনিক, শান্তির জাগ্রত প্রহরী। তাই যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ্ব আজ সোচ্চার, শান্তির পক্ষে পালন করছে অগ্রণী ভূমিকা। বিশ্বজুড়ে মানুষের সম্মিলিত শুভবুদ্ধির প্রতিরোধমূলক তৎপরতায় যুদ্ধবাজ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আজ প্রতিহত, নিস্ক্রিয় হতে চলেছে। শেষ বেলায় তাই কবি আহসান হাবিবের কন্ঠে বলতে চাই—

“আমাকে সেই অস্ত্র ফিরিয়ে দাও
সভ্যতার সেই প্রতিশ্রুতি
সেই অমোঘ অনন্য অস্ত্র
আমাকে ফিরিয়ে দাও।”

1 Comments

  1. Brotha/Sista your compositions always save my life thank you so much for your hard work 😭😭

    ReplyDelete
Post a Comment
Previous Post Next Post