চোখের রোগ : প্রতিরোধ ও প্রতিকার

চোখ আমাদের শরীরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংবেদনশীল অঙ্গ। চোখ দিয়ে আমরা এ সুন্দর পৃথিবীকে দেখি। সামান্য অবহেলা, অসাবধানতা, অজ্ঞতা ও সুচিকিৎসার অভাবে আমরা এ অমূল্য সম্পদ হারিয়ে ফেলতে পারি। তাই চোখের অসুখ বিসুখ ও তার প্রতিকার সম্বন্ধে কিছু প্রাথমিক ধারণা আমাদের সবারই থাকা দরকার। দৃষ্টিহীন মানুষ জীবিত থেকেও যেন মৃত। চোখের অনেক রোগ বেড়ে উঠে আমাদের অলক্ষ্যে। তাই কোনো রোগ থাকুক বা না থাকুক শিশুদের স্কুলে যাওয়ার বয়স থেকে শুরু করে এবং বড়দের চল্লিশে পা দেয়ার পর থেকে বছরে অন্তত একবার পরীক্ষা করানো উচিত। উন্নত বিশ্বের পাশাপাশি আমাদের দেশেও চোখের ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি হয়েছে। এ সুবিধা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে আমাদের আরো গণসচেতনতা বাড়াতে হবে। তাহলেই শুধু সার্থক হবে আমাদের সব শ্রম ও প্রচেষ্টা। 

রোগের নাম : কনজাংটিভাইটিস বা চোখ ওঠা

যত ধরনের সংক্রামক চোখের রোগ আছে তার মধ্যে চোখ ওঠা সবচেয়ে বেশি। মূলত চোখের সাদা সংশ বা কনজাংটিভাইটিস প্রদাহ হওয়াকেই চোখ ওঠা বলে। ভাইরাস জীবাণু দ্বারা এ রোগ হতে পারে। এ কারণে দু’চোখই লাল ও ব্যথা হবে। চোখ দিয়ে প্রচুর পানি পড়বে। ভাইরাসের কারণে চোখ ওঠলে খুব পুঁজ হবে না তবে জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হলে ঘন পুঁজ বা পিঁচুটি থাকবে। ভাইরাসের কারণে চোখ ওঠলে কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। তবে ২০% সালফাসিটামাইড চোখের ড্রপ ব্যবহার করা যেতে পারে, যাতে ভাইরাসের সঙ্গে জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হতে না পারে। এ রোগ দু’সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। 
প্রতিরোধ : জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হলে ২০% সালফাসিটামাইড চোখের ফোঁটা অথবা টেট্রাসাইক্লিন অ্যান্টিবায়োটিক মলম দিনে ৩-৪ বার ব্যবহার করলে ২-৪ দিনের মধ্যে লক্ষণসমূহ চলে যায়। কনজাংটিভাইটিস ও স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ নিজে নিজে ব্যবহার করবেন না। 

রোগের নাম : ট্রাকোমা

পৃথিবীব্যাপী অন্ধত্বের অন্যতম কারণ এ ট্রাকোমা। প্রথমে চোখ লাল হয়, চুলকায় এবং পানি গড়াতে থাকে। মাস কয়েক পর চোখের পাতার ভেতরের দিকে এক ধরনের ফুসকুড়ি ওঠে। চোখের সাদা অংশে জ্বালাপোড়া শুরু হয়। এরও কয়েক বছর পর ফুসকুড়িগুলো চলে গিয়ে সাদা হয়ে যায়। শুরুতেই এর চিকিৎসা আরম্ভ না করলে অন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। দরিদ্র ও জনবহুল এলাকায় এর প্রকোপ দেখা যায়। ছোয়া ও মাছির মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়। 
প্রতিরোধ : ট্রাকোমা হলে নিকটবর্তী স্বাস্থ্য কেন্দ্র বা হাসপাতালে যান। চিকিৎসার মাধ্যমে ট্রাকোমা হলে তাকে আলাদা গামছা ও তোয়ালে দিন। বাড়ির শিশুকে আপনি নিজেই পরখ করুন। যদি ট্রাকোমার লক্ষণ দেখেন, তবে সঙ্গে সঙ্গে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। মনে রাখুন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ট্রাকোমা প্রতিরোধে সাহায্য করে। 

চোগের নাম : সদ্যোজাত শিশুর চোখের সংক্রমণ (গনোরিয়া)

জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই চিকিৎসকরা সদ্যজাত শিশুর চোখে এক ফোটা করে ১% সিলভার নাইট্রেট লবণ দিন। এতে শিশুর চোখ সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পায়। যদি কোনো শিশুর জন্মের দু’দিনের মধ্যে তার চোখ ফুলে যায় বা পুঁজ সৃষ্টি হয়, তবে বুঝতে হবে সে গনোরিয়া সংক্রমণে আক্রান্ত হয়েছে।
প্রতিরোধ : এ রোগ বাচ্চার হলে অবশ্যই বাবা মা’র গনোরিয়া আছে। এক্ষেত্রে শিশুর সঙ্গে সঙ্গে বাবা মায়েরও অতিদ্রত চিকিৎসা করাতে হবে। 

রোগের নাম : রাতকানা বা জেরোপথালমিয়া

ভিটামিন ‘এ’-এর অভাবে এ রোগ হয়। রাতকানা রোগ হলে রোগী প্রথমে রাতে চোখে দেখতে পায় না। সুস্থ লোক যেমন অন্ধকারে কিছু হলেও দেখতে পায় রাতকানা রোগীর সে প্রশ্নই উঠে না। এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর তার চোখ শুকিয়ে যায়। চোখের সাদা অংশের মসৃণতা নষ্ট হয়ে যায়। এভাবে কর্ণিয়া নরম হয়ে ফুলে যায়। এমনকি ফেটেও যায়। আর এভাবেই রোগীর চোখ নষ্ট হয়ে সে অন্ধ হয়ে পড়ে। 
প্রতিরোধ : এ রোগ প্রতিরোধের জন্য ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। সবুজ ও হলুদ শাকসব্জি, ফলমূল, ডিম, দুধ, মাছ, মাংস, কলিজা ইত্যাদিতে ভিটামিন ‘এ’ আছে। 

রোগের নাম : টেরিজিয়াম

চোখের ভিতরে নাকের দিক থেকে ত্রিকোণ মাংসের দলার মতে উঠে কর্ণিয়া বা চোখের কালো অংশ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। মাঝে মাঝে চোখের দৃষ্টিতে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। প্রখর আলো, বাতাস ও ধূলা ময়লা থেকে এ রোগের সৃষ্টি হয়। 
প্রতিরোধ : কালো চশমা ব্যবহার করলে অস্বস্তি কমতে পারে। তবে অস্ত্রোপচারই একমাত্র চিকিৎসা। 


রোগের নাম : কর্ণিয়াল আলসার

চোখের কালো অংশ বা কর্ণিয়ার উপরে কোনো কারণে ক্ষত হলে সেটাকে কর্ণিয়াল আলসার বলে। কর্ণিয়াতে আলসার হলে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসার প্রয়োজন। এ আলসারের অযত্ন করলে দৃষ্টিশক্তি হারাবার আশঙ্কা থাকে। আঘাতজনিত কারণ ছাড়াও জীবাণু ভাইরাস ও ফাংগাস দ্বারা এ আলসার হতে পারে। 
প্রতিরোধ : এক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক মলম ব্যবহার করতে হবে এবং ক্ষত চোখ ঢেকে রাখতে হবে।

রোগের নাম : চোখের ছানি বা ক্যাটারাকট

চোখের মণি বা তারা এক্ষেত্রে ঘোলাটে হয়ে যায়। এর ফলে আলোর প্রবেশ পথে আংশিকভাবে বাধার সৃষ্টি করে অথবা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেয়। তখন চোখের মণি সাদা হয়ে যায় অথবা ঘোলাটে দেখায়। রোগী আলো ও আঁধারের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। রোগী ধীরে ধীরে দৃষ্টিশক্তি হারায়। দীর্ঘদিন হয়ে গেলে ওষুধ কাজ করে না। 
প্রতিরোধ : অস্ত্রোপচার করে এবং শক্তিশালী চশমার ব্যবহার করলে দৃষ্টি ফেরত পাওয়া যেতে পারে।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post